তোমাতে সূচনা তোমাতেই সমাপ্তি পর্ব-০৪

0
20

#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৪

রোজা কিছুটা অবাক হলো, কারণ আদনান হঠাৎই “আপনি” বলে সম্বোধন করলো ওকে। লোকটা যেনো ফর্মালিটির সহিত আদেশ করছে যে তার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। রোজা ভাবলো রোজ রোজ এই লোকের মুখোমুখি হওয়ার থেকে যা বলবে সেটা শুনে বরাবরের মতো বিদায় করাই উত্তম।

‘ যা বলার দ্রুত বলে বেরিয়ে যান ‘

‘ আপনি আমার দেওয়া ব্ল্যাঙ্ক চেক সুন্দরভাবে ফেরত পাঠিয়েছেন, কেনো জানতে পারি?’

‘ কারণ আপনার টাকা আমি চাইনা ‘

‘ আপনি তিনদিন সবকিছু বাদ দিয়ে আমার সেবা করেছেন, তার পারিশ্রমিক আপনার প্রাপ্য। সেটা গ্রহণ করতে সমস্যা কোথায়?’

‘ আপনার সেবা করতে আমাকে বাধ্য করা হয়েছিলো ‘

‘ সে যেভাবেই হোক, সেবা তো করেছেন ‘

‘ ধরে নিন আমি ফ্রিতে জনসেবা করেছি ‘

‘ আজকাল ফ্রিতে কেউ এতো ভালোভাবে সেবা করে? জানা ছিলো না। আপনার স্টিচিং কোয়ালিটি বেশ ভালো, সাতদিন পরেই আমার আর কোনো সমস্যা অনুভূত হয়নি ‘

আদনানের কথা যেনো কানেই নিচ্ছে না রোজা, ও কোনো একটা ফাইল দেখতে ব্যস্ত ছিলো। আদনান পাত্তা পাচ্ছে না বুঝে ফাইলটা রোজার সামনে থেকে সরিয়ে নিলো…

‘ সমস্যা কি আপনার!’

‘ আমি যখন কথা বলবো, শুধু আমার কথাই শুনবেন ‘

আদনানের চোখেমুখে ভীষণ সিরিয়াস একটা ভাব, যেনো রোজা ওর কথা না শুনলে এখনি গুরুতর কিছু একটা করে বসবে! কিন্তু রোজার যে আবারো মাথা গরম হয়ে আসছে…

‘ কথা কান দিয়ে শুনতে হবে, চোখ দিয়ে নয়। আমার কান খোলাই আছে ‘

‘ আমি সেদিন নক না করে ভেতরে এসেছিলাম বলে সেটা আপনার পছন্দ হয়নি, কেউ কথা বলার সময় তাকে ইগনোর করাটাও যে একটা বেয়াদবি সেটা জানেন না?’

রোজা এবার তাকালো আদনানের দিকে…

‘ শুনছি, বলুন!’

রোজার টানাটানা কাজল কালো নেত্রজোড়ায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেনো চোখ আটকে গেলো আদনানের…

‘ আপনার কি আদৌ কিছু বলার আছে নাকি সবটাই আমার সময় নষ্ট করার বাহানা?’

আদনান পকেট থেকে একটা চেক বের করে রোজার সামনে রেখে বললো…

‘ এই চেক রাখুন, আপনার পারিশ্রমিক ‘

রোজা ভেবে পাচ্ছেনা এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ? রাগ দেখাবে বা অন্যকিছু করবে? লোকটার ওপর বিরক্তি আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। জীবনে বহু ঘাড়ত্যাড়া ব্যক্তি দেখেছে কিন্তু আদনানের মতো দুটো দেখেনি।

‘ আপনি কি একটা সহজ বিষয় বুঝতে পারছেন না? আমি একটা পয়সাও চাইনা আপনার থেকে তারপরও আবার কেনো…’

‘ আমি ফ্রিতে কাউকে দিয়ে কাজ করানো পছন্দ করিনা, আর কাজ ভালো হলে কিছু বোনাস পাওয়া যে কারো প্রাপ্য সেখানে আপনি আমার এতো বড় উপকার করে এক টাকাও পারিশ্রমিক নেবেন না সেটা আমি মানতে পারবো না ‘

‘ আপনি নিজেকে ঠিক কি ভাবেন আমি জানিনা কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি মানুষকে নিজের মর্জিমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করেন। আমি আপনার সম্পত্তি নই যে একই প্রক্রিয়া আপনি আমার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করবেন!’

‘ আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছে আমার নেই ‘

‘ কিন্তু আপনি সেটাই করছেন। আমি মানা করা সত্ত্বেও আমার ওপর জোর করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপাচ্ছেন। আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন ছিলো, আর আমি যতো দ্রুত সম্ভব সেসব ভুলে যেতে চাই ‘

রোজার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলো আদনান, মেয়েটার ভেতরে ওর প্রতি কতোটা ক্ষোভ তা কথায়ই প্রকাশ পাচ্ছে…

‘ এতো অপছন্দ করেন আমায়?’

‘ আপনাকে পছন্দ করার কোনো কারণ দেখিনা! যাই হোক, দশ মিনিট পার হয়ে গেছে। এবার আসতে পারেন আপনি ‘

আদনান আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো, চেকটা এখনও টেবিলের ওপর রয়ে গেছে দেখে রোজা বললো…

‘ আপনার চেক নিয়ে যান, নাহলে আমি আবারো ফেলে দিতে বাধ্য হবো ‘

‘ এটা আপনার জন্যে, আর ফেলবেন না রাখবেন সেটা সম্পূর্ন আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। তবে ফেরত পাঠাবেন না, ফেরত পাঠালে আমি আবারো আসবো ‘

বেরিয়ে গেলো আদনান, রোজা চেকটা হাতে তুলে দেখলো। পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যামাউন্ট। ভেবে পাচ্ছেনা এই চেকটা কি করবে, পরে সাত পাঁচ না ভেবে চেকটা ড্রয়ারে ফেলে রাখলো

‘ নির্ঘাত এই লোকের ঘাড়ের রগ বাঁকা, নাহলে একটা মানুষকে এতোবার মানা করার পরও এভাবে বারবার দেখা করতে চলে আসে? অসহ্য!’

নিজের রাগ নিজের মধ্যেই চাপা রেখে পুনরায় কর্মে মনোনিবেশ করলো রোজা, ওদিকে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরতেই আদনান দেখলো ওর বন্ধু তানভীর এসেছে…

‘ হেই, তানভীর কখন এসেছিস?’

‘ কোথায় ছিলি তুই? জানিস আমি কতক্ষণ ধরে এসে বসে আছি এখানে? তোর সেক্রেটারি বললো সে নাকি জানেনা তুই কোথায় গেছিস ‘

আদনান চেয়ার টেনে বসলো…

‘ জরুরি দরকার ছিলো ‘

‘ কি এমন দরকারি কাজে গেছিলি যেটা তোর সেক্রেটারি জানেনা?’

‘ ও জানে, কিন্তু আমি ওকে বলতে মানা করেছি তাই বলেনি ‘

‘ হোয়াট! গোপন মিশনে নেমেছিস নাকি যে কাউকে জানতে দেওয়া যাবেনা?’

‘ এইসব কথা বাদ দিয়ে কাজের কথা বল, কি দরকারে এসেছিস?’

‘ আদনান, আমাদের মধ্যে কি শুধু কাজের সম্পর্ক? আমরা বন্ধু! আর তোর বন্ধু তোর খোঁজ খবর নিতে এসেছে। ঐরকম একটা অবস্থা দেখে গেছিলাম তোকে, খোঁজ নিতে আসবো না?’

‘আই অ্যাম ফিট এন্ড ফাইন!’

‘ তাই তো দেখছি, সুস্থ হয়ে গেছিস এটাই হাজার শুকরিয়া। আচ্ছা, বাবার কাছে শুনলাম নতুন একটা সফট ড্রিংকস নাকি বাজারে আনার আলোচনা চলছে? নতুন প্রোডাক্ট এখনই না এনে আগেরটাই আরো কিছুদিন রেখে দেখতে পারিস, ওটাও তো বেশিদিন হয়নি বাজারে এসেছে ‘

‘ প্রোডাক্ট যতোই নতুন হোক, প্রফিট না হলে বসিয়ে রেখে তো লাভ নেই। ওটার সেল খুবই কম হচ্ছে, লাস্ট দুই বছরে আমাদের কোনো প্রোডাক্ট এতো কম সেল হয়নি ‘

‘ দেখ, তুই যা ভালো বুঝিস। তোর প্রতি আমার ফুল সাপোর্ট আছে ‘

‘ থ্যাংক ইউ! বাই দ্যা ওয়ে, জানতে পেরেছিস কে তোর ওপর হা’ম’লা করেছিলো? আমার মনে হচ্ছে তোদের রাইভাল কোনো কোম্পানি হবে’

‘ এটা অন্য কারো কাজ না, আমি যাকে সন্দেহ করছি তারই কাজ। কিন্তু এখনও প্রমাণ পাইনি। লোক লাগিয়েছি, শীঘ্রই সব জানা যাবে ‘

তানভীর ও আদনানের বাবা বিজনেস পার্টনার, সেই সুবাদে ওরাও বহুদিনের পুরোনো বন্ধু। আদনান ও তানভীর নিজেদের মধ্যে প্রায় সব বিষয়ই শেয়ার করে, কিন্তু আজ রোজার সঙ্গে দেখা করার বিষয়টা তানভীরের থেকে লুকিয়ে গেলো আদনান!
______________________________________

রিসিপশনের সামনে দাঁড়িয়ে অন্য ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছিলো রোজা, কাজের ফাঁকে সময় পেলে সবার সঙ্গেই মোটামুটি কথা বলার চেষ্টা করে ও। কথা শেষে রোজা বাইরে যাচ্ছিলো, সুজানা আজ ব্যস্ত তাই লাঞ্চ একাই করতে হবে। হসপিটালের গেটের সামনে আসতেই পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠে নিজের নাম শুনে ঘুরে তাকায় রোজা। পুরুষটিকে দেখে কিছুক্ষণের জন্যে স্তব্ধ হলো মেয়েটা, কারণ এই পুরুষটির সঙ্গেই বিয়ে ঠিক হয়েছিলো ওর। পুরুষটি এগিয়ে এসে দাঁড়ালো রোজার সামনে, হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলো..

‘ কেমন আছো?’

‘ জ্বি ভালো ‘

এরপর দুজনের মাঝেই কিছু সময়ের নীরবতা, দুজনের কেউই বুঝতে পারছে না কিভাবে কথা এগোনো উচিত বা আদৌ কিছু বলা উচিত কিনা। নীরবতা ভেঙে সেই পুরুষটিই বললো…

‘ ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমরা কি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?’

রোজা তাতে আপত্তি করলো না, পাশের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওরা বসলো। লোকটার নাম নিষাদ, একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে ম্যানেজার হিসেব কর্মরত। রোজার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর দুবার তাদের দেখা হয়েছিলো কিন্তু তারপর রোজার ওই ঘটনায় বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ হয়নি। নিষাদ ভেবে পাচ্ছিলো না কিভাবে কথা শুরু করবে তার আগেই রোজা বললো…

‘ আপনার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে ভাবিনি, বাবার মুখে শুনেছি আপনার বাড়ি থেকে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে তাই আমারও আর আপনাকে ফোন করার সাহস হয়ে ওঠেনি ‘

‘ হুমম, আসলে আমার মা আপনাদের বাড়ি গেছিলো বিয়ের কোনো এক বিষয়ে কথা বলতে। তার দুইদিন আগে থেকেই আপনি নিখোঁজ ছিলেন, যদিও আপনার বাড়ির লোক কিছু বলেনি তবে আশেপাশের লোকেদের কাছে শুনে আমার মা…’

‘ ওনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এটাই করতো, যেখানে আমার বাড়ির লোকেরাই বিশ্বাস করেনি সেখানে উনি তো…’

‘ দেখুন রোজা, আমি জানিনা কি হয়েছে। যা হয়েছে সেটা তোমার ইচ্ছাকৃত ছিলো নাকি…’

‘ কিছুই আমার ইচ্ছাকৃত ছিলো না, আমি পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। যদিও আমি জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না, আর পরিস্থিতিটাই এমন যে আমি নিজের সাফাই দিলেও লাভ হবেনা তবুও বলা উচিত। আমার সঙ্গে তেমন খারাপ কিছুই হয়নি ‘

‘ আমি সেসব কিছুই জানতে চাইনা, যা হয়েছে সেটা অতীত। সেসব নিয়ে ভেবে বর্তমান নষ্ট করার মানে হয় না। আমার মা যদিও আবার মেয়ে দেখতে শুরু করেছে আমার জন্যে ‘

‘ আমার জন্যে আপনাদের সবাইকেই সাফার করতে হয়েছে, আমি তার জন্যে ক্ষমা চাইছি। আশা করি আপনি জীবনসঙ্গী হিসেবে অনেক ভালো মেয়ে পাবেন ‘

রোজা ভেবেছিলো নিজের কথা শেষ করে উঠে যাবে, অল্পদিনের পরিচয়েই রোজা বুঝেছে লোকটা ভীষণ ভালো মনের মানুষ আর তার সামনে বসে রোজার নিজের মধ্যে কেমন অপরাধবোধ কাজ করছে! এরই মধ্যে হুট করে নিষাদ বললো…

‘ আমি আপনাকেই বিয়ে করতে চাই রোজা ‘

চমকে উঠলো রোজা, এতকিছুর পরও নিষাদ ওকেই বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে? বিষয়টার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না ও তাই ওই মুহূর্তে নিষাদকে কোনো উত্তর দিতে পারেনি রোজা। তবে ছেলেটা রোজাকে ভাবার জন্যে সময় দিয়েছে। রোজার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেককিছু, কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আজ সন্ধ্যায় আদনানের এনগেজমেন্ট, এনায়েত সাহেবের জোরাজুরিতে তার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে ও যদিও বিয়ে নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই ওর। ছেলে বিয়েতে রাজি হয়েছে তাতেই বেজায় খুশি এনায়েত সাহেব, অনেক গেস্টদের দাওয়াতও দিয়েছেন। আদনান রেডি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে নিলো, তানভীর বিছানায় বসে আছে।

‘ আই কান্ট বিলিভ দিজ! তুই বিয়েতে রাজি হয়েছিস? তোকে যে কখনো বিয়ে করতে দেখবো ভাবিইনি ‘

‘ বিয়ে কোথায়, এনগেজমেন্ট হচ্ছে ‘

‘এটাই তো বিয়ের একটা ধাপ, ধীরে ধীরে সবই হবে। কিন্তু তোর হবু বউকে আমার ঠিক পছন্দ হলো না ‘

‘ কেনো? সুন্দরী না?’

‘ সৌন্দর্য্যের ব্যাপার না, কিন্তু কিছু একটা ঘাপলা আছে মনে হয়। সেদিন তোর সঙ্গে লাঞ্চ করতে গেছিলো না? তখন খেয়াল করলাম, একটু বেশিই চালু টাইপের ‘

‘ রেস্টুরেন্টটা নতুন খুলেছে বলে তোকে ট্রিট দেওয়ার জন্যে নিয়ে গেছিলাম, আমার হবু বউকে পরখ করতে বলিনি। তাছাড়া তুই অন্য টেবিলে খাওয়ায় ব্যস্ত ছিলি, সেখান থেকে তুই কিভাবে বুঝবি মেয়েটা কেমন?’

আদনানের কথা শুনে অবাক হলো তানভীর…

‘ ব্রো! এখনি এতো পজেসিভ?’

বন্ধুর কথায় বাঁকা হাসলো আদনান, একটু পরেই ওর হবু বাগদত্তা মেয়েটি এসে হাজির হলো রুমে! সোজা হেঁটে এসে আদনানের বাহু জড়িয়ে ধরতেই আদনান বললো…

‘ ওয়াও! ইউ আর লুকিং বিউটিফুল ‘

আদনানের প্রশংসা পেয়ে মেয়েটি যেনো খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো, আদনানের স্যুটে একটু হাত ঝেড়ে মেয়েটি বললো…

‘ তোমাকেও ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে!’

আদনান আর ওর বাগদত্তার কাহিনী দেখে তানভীরের মাথার ফিউজ যেনো উড়ে গেলো! বহুদিন পর যেনো আদনানের সেই পুরোনো রূপ দেখছে!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]