তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-১৪

0
158

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_১৪

অন্ধকার রাত। আকাশের বুকে জ্বলজ্বলে শশাঙ্কের উপস্থিতি। গভীর নিদ্রায় শায়িত মুয়ীয। রাতের শেষ প্রহর তখন। শয্যাসঙ্গিনী পাশে অনুপস্থিত। ঘুমে মগ্ন মানুষটি জানেও না এত রাতে তার অগোচরে কি হচ্ছে। কোথায়, কোন অবস্থায়, কি করে বেড়াচ্ছে তার স্ত্রী। সে কি অকল্পনীয়, অভাবনীয় কিছু করে চলেছে! সে-ই সত্যি কি জনাব হাসানের জানা উচিত নয়? এই ভিন্ন রূপটি, অবাক দৃশ্যটি আর কত রইবে অজানা?

শুভ্র রঙা হিজাবে আবৃত সতর। গভীর রাতে রবের দরবারে হাজির সে রমণী। জায়নামাজে নিয়েছে ঠাঁই। সিজদায় লুটিয়ে মহান আল্লাহ্’র এক ও অদ্বিতীয় সত্তার আনুগত্য স্বীকার করে। পড়ছে তাহাজ্জুদের নামায। রাতের শেষ প্রহরে, মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে, তখন তাহাজ্জুদ আদায়কারীরা মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ্ তা’য়ালার ভালোবাসায় নিদ্রা ত্যাগ করে জেগে ওঠে। উত্তম রূপে অযু করে পবিত্র দেহে হাজিরা দেয় শ্রেষ্ঠ মালিকের নৈকট্যে। [ আল্লাহ্ তা’য়ালা প্রতিদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব! কে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে দান করব! আর কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব!’ (বুখারি ও মুসলিম)। ]

আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। ’ (সূরা: সাজদা, আয়াত: ১৬)।

শুধু নামাজ আদায় নয়, রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ্’র দরবারে কান্নাকাটি করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা খাঁটি ঈমানদারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঈমানদারদের গুণাবলি সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত ব্যয়কারী ও রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থী। ’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১৭)।

তাহাজ্জুদ নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর শ্রেষ্ঠ এক নামাজ। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা হলো আল্লাহ্’র মাস মুহাররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের তাহাজ্জুদের নামাজ। ’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর : ১১৬৩)।

তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ্ তা’য়ালা প্রতিদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব! কে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে দান করব! আর কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব!’ (বুখারি ও মুসলিম)।

প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িসহ সব যুগের ওলি ও বিদ্বানরা তাহাজ্জুদ নামাজে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন।

হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ইসলামের প্রাথমিক যুগে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেন। প্রিয় নবীর (সা.) প্রতি কিছু সময় নামাজ পড়ার নির্দেশ ছিল না বরং রাতের কিছু অংশ ছাড়া সারারাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়ের নির্দেশ ছিল।

তাহাজ্জুদের নামাযে মগ্ন উক্তি। বিবাহিত পরবর্তী এই এক মাস, প্রায়শ তার রাতের শেষ তৃতীয়াংশ কেটেছে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করে। স্বামী মানুষটি এসময় গভীর ঘুমে থাকে আচ্ছন্ন। সে কি আদতেই ঘুমে মগ্ন, স্ত্রীর এই চক্ষু জুড়ানো রূপের সাক্ষী হয়নি! নাকি সাক্ষী হয়েও অদেখা করে রইছে! মনে মনে অদ্ভুত প্রশান্তির পরশ বয়ে যাচ্ছে কি?

রৌদ্র তপ্ত সে দুপুর। উন্মুক্ত ঘরের সকল জানলা। আয়েশি ভঙ্গিতে আলো প্রবেশ করছে ঘরে। আলোকিত করছে গৃহভ্যন্তর। মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে উক্তি। শান্ত নীরব সে পরিবেশে আকস্মিক ঘরের মূল দরজায় কড়া নাড়ার প্রবল শব্দ। একের পর এক কড়াঘাত হচ্ছে দরজায়। উক্তি সচকিত হয়ে উঠলো। নিজ ঘর হতে অসন্তোষের রোষানল সহকারে বেরিয়ে এলো জান্নাত।

” ম র ণ! কেডা ম•রছে? অ্যামনে দরজা বাইড়াইতাছে ক্যা?”

দুমদাম পা ফেলে এগিয়ে গেল জান্নাত। উন্মুক্ত করলো দরজা। সহসা হতবাক ছাপ উপস্থিত হলো তার চোখেমুখে। বড় হয়ে গেল দুই চোখ। উক্তি ঈষৎ ভীতু নজরে তাকিয়ে। এ লোকগুলো! এরা কেন এসেছে?! সেবার এরা আসার পর যা হয়েছিল, আজও ভোলেনি উক্তি। স্পষ্ট রূপে পাই টু পাই স্মরণে।

” আমনেরা? ” দুর্বল-ভীত কণ্ঠ জান্নাতের।

” হ আমরা। তোমার হারামজা* জামাই কই? ”

শুধিয়ে উঠলো এক মাঝবয়সী আগন্তুক। পড়নে তার লুঙ্গি। কালচে শার্ট। চোখের সাদা অংশে হলদে ভাব। চুলগুলো কেমন এলোমেলো। দেখতেই কেমন ভয় হয়। গা গুলিয়ে ওঠে। উক্তি ঝাড়ু হাতে সরে গেল। দাঁড়ালো কিছুটা দেয়ালের আড়ালে। স্বামী সম্পর্কে এমন নিম্ন সম্বোধন শুনে চেঁতে উঠলো জান্নাত। উঁচু কণ্ঠে বললো,

” হ্যায় কই মুই ক্যামনে জানমু? দিন রাইত তো আমনেগো লগেই থাহে, খায়। ঘুমায়। ” শেষের শব্দটা নিচু স্বরে বললো।

” হোনো মাইয়া ফাও কথা কইবা না। হাছা কইরা কও। মারুইফ্ফা কই?”

” মুই জানি না। ” জবাবে বললো জান্নাত।

ঠিক সে মুহূর্তে,

” কেডা আইছে বড় বউ? ”

প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে সেথায় উপস্থিত হলেন মোমেনা বেগম। ওনাকে দেখে এক অল্প বয়সী আগন্তুক বলে উঠলো,

” এই যে কাকি। এদিক আও। তোমার পোলা এইসব কি শুরু করছে, হা? আমগো কি মানুষ বইল্লা মনে হয় না? তোমার মতো ভালো মাইনষের পোলা এমন অজাতের ঘরে কুজাত হইলো ক্যামনে? ”

উক্তি সরল চোখে তাকিয়ে। লোকটি কি শাশুড়ি মায়ের প্রশংসা করলো! নাকি মুখের ওপর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঝামা ঘষে দিলো! মোমেনা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,

” তুই মোর ভালা কইলি না মন্দ, আগে হেইয়া ক। হ্যারপর কইতাছি বাকিডা। ”

ছেলেটা ইয়া লম্বা হাসি দিয়ে বললো,

” কি যে কও না কাকি! তোমার মন্দ কমু কোন মুখে? আমার কি অতবড় স্পর্ধা আছে? কও? তোমার ভালাই তো কইলাম। ”

” থাক থাক। আর চাপা মারন লাগতো না। ”

হাতের তালু দেখিয়ে থামতে ইশারা করলেন মোমেনা বেগম।

” আইচ্ছা। ” সুবোধ বালকের ন্যায় মাথা নাড়লো আগন্তুক ছেলেটি।

পাশ থেকে আরেকজন তপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

” তুই থামবি ছ্যাড়া! এত পিরিতের আলাপ কিয়ের? ”

ছেলেটা ত্বরিত মুখ লটকে ফেললো। সে-ই লোকটা এবার মোমেনা বেগমকে বললো,

” এই যে ভাবী। পোলা কই আমনের? ”

” জানি না। ”

” তো জানেন ডা কি? দুইদিন পরপর পোলায় টাহা মা’রবো, এরপর গা ঢাকা দিবো। এইডা কি সার্কাসের খেলা পাইছে? ”

লোকটার কণ্ঠে ঝড়ে পড়ছে উত্তাপ। মোমেনা বেগম পাল্টা উত্তপ্ত কণ্ঠে বললেন,

” মুই ক্যামনে কমু পোলায় কি হরে না হরে? ছোডো ছিল। চোহে চোহে রাখছি। এহন বিয়া কইরা ছ্যাড়ার বাপ হইছে। মুই আর কিছু জানি না। যা জানোনের বউ জানে। ”

জান্নাত হকচকিত কণ্ঠে বললো,

” এইয়া কি কইতাছেন মা? এরমধ্যে মুই কোন থে আইলাম? আকাম কুকাম করে আমনের পোলা, আর দোষী মুই? ”

” তুমি ছাড়া আর কেডা হইবো? কেমন বউ হইছো তুমি? জামাইরে বুঝাই হুনাই সঠিক পথে রাখতে জানো না! ”

জান্নাত বিদ্রুপাত্মক হেসে করতালি দিতে লাগলো। থমকানো স্বরে বলতে লাগলো,

” বাহ্ মা বাহ্! পোলা জন্ম দিলেন আমনে। পাইল্লা পুইষা বড় করলেন আমনে। পড়ালেহা করাইলেন। বিয়া দিলেন। হেই পোলা যেই বিপথে গেল অমনি দোষ হইলো বউয়ের? বউ করছে ডা কি? জু য়া খেলন শিখাইছে না খেলতে পাডাইছে?”

মোমেনা বেগম এবার নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। উক্তি আড়ালে সবটাই শুনলো। সে বুঝে উঠতে পারলো না আমাদের সমাজে বসবাসরত মানুষগুলোর চিন্তাধারা এমন কেন? আসলেই তো। সন্তানকে জন্ম দেয় এক মা। পৃথিবীর আলো দেখায়, এতগুলো মাস গর্ভে ধারণ করে। অসংখ্য ত্যাগ স্বীকার করে সন্তানকে লালনপালন করে। শিক্ষাদীক্ষা দেয়। বড় করে তোলে। সে-ই সন্তান যদি বিপথে ধাবিত হয় তবে মা’কে কেন দোষারোপ করা হয়? কখনো আবার দোষারোপ করা হয় স্ত্রীকে। কিন্তু কেন? পরিবারের আপন মানুষগুলো কি কখনো নিজের লোকের ক্ষতি চায়? স্বইচ্ছায় বিপদে চালিত করে? না। করে না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, কখনোবা শিক্ষার নেতিবাচক দিক, কখনো আবার সঙ্গ দোষেই লোহা ভাসে। এক্ষেত্রে মা-স্ত্রী ই এক ও অদ্বিতীয় মূল দায়ী নয়। দোষী নয়। সব মা-বাবা ই সন্তানের কল্যাণ কামনা করে। ভালো চায়। হাতেগোনা কিছু তার ব্যতিক্রম। ধরার বাইরে। উক্তি আফশোসের দৃষ্টি ফেলে তাকালো শাশুড়ি মায়ের পানে। উনি বিবর্ণ বদনে দাঁড়িয়ে। দরজায় দাঁড়ানো নেতা গোছের লোকটি অত্যন্ত বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো,

” ওই ওই। তোমগো এই প্যাচাল থোও তো। হাছা কইরা কও মারুফ কই। ”

থমথমে কণ্ঠে বললেন মোমেনা বেগম,

” জানি না। ”

লোকটি ক্ষি’প্র গলায় বললেন,

” বা•লডা জানো তুমি। গেলাম আইজ। তোমার ওই পোলার দর্শন পাইলে না, ঠ্যাং ভাইঙ্গা হাতে ধরাই দিমু। এই আইজ কইয়া রাখলাম। ”

অতঃপর সঙ্গী সাথীদের উদ্দেশ্যে বললেন,

” অ্যাই। চল তোরা। চল চল। ”

ধরনীর বুকে তমসা ঘনিয়েছে তখন। ঘনিয়েছে এ ঘরের অভ্যন্তরেও। থমথমে মুখে উপস্থিত সকলে। মুয়ীযের বড় আপা ময়না সে-ও আজ উপস্থিত। সে-ই যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আগমন হলো তার। পরের দিন বিকেল নাগাদ ই ছোট ভাইয়ের আদেশ অমান্য করে নিজ বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। আজ এলো আবার। বড় ভাইয়ের জন্য। বয়সে সে মারুফ হতে তিন বছরের ছোট। ৩২ বছর বয়সী এ নারী ব্যক্তিজীবনে দুই কন্যার জননী। পেশায় গার্মেন্টস্ কর্মী। ময়না বিরূপ চোখে তাকিয়ে বড় ভাইয়ের দিকে। সকলের মধ্যমণি হয়ে কাঠের চেয়ারে বসে মারুফ। ঘোরাচ্ছন্ন মুখশ্রী। এলোমেলো চুল, বেশভূষা। চোখের সাদা অংশ হলদে। ঘোলাটে। পাশেই দাঁড়িয়ে স্ত্রী জান্নাত। লজ্জায় রক্তিম মুখ। এ সেই লজ্জা নয় কিন্তু। অপমানজনক লজ্জা। উক্তি ভয়ালু দৃষ্টি মেলে তাকালো স্বামীর পানে। আজ দিনভর যা হলো! স্বামী মানুষটির অভিব্যক্তি বোঝা দুষ্কর। কেমন দুর্বোধ্য, জটিলতায় ভরপুর অবয়বে মাঝের ঘরটির একাংশে দাঁড়িয়ে। পিঠে বাঁধা দু হাত। ডান হাত আঁকড়ে ধরে বাঁ হাতের কব্জি। ময়না বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্যে নাখুশ কণ্ঠে বললো,

” ভাইয়া তুমি কি কোনোদিন বড় হইতা না? আর কত জালাইবা আমগো? দিন নাই। রাত নাই। দুইদিন পরপর শুরু হইয়া যায় নাটক। এইয়া কি, হাঁ? ”

জান্নাত ওড়নায় নাক মুখ গুঁজে। ফ্যাচ ফ্যাচ কেঁদে বলে উঠলো,

” আপা, দয়া কইরা আমনের ভাইরে একগুয়া বুঝান। মোর আর সহ্য হইতাছে না। আর কত সহ্য করুম, কন তো। ”

ময়না বলে উঠলো,

” আহ্ ভাবী! তুমি আবার কানতে লাগছো ক্যা? থামো। মোরা হগলে আছি তো। ”

মা মোমেনা বেগম বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে বললেন,

” ও যা শুরু করছে না! এইবার সহ্যের বাইরে গেছে গা। মুই ভাবতে পারতেছি না এক জু•য়াখোর, ম•দখোর মোর পেটে আছিল! এইয়া জন্ম দিছিলাম মুই? এইদিন দেহার লেইগ্গা?”

মারুফ নির্বাক বসে। দৃষ্টি অবনত। মেঝেতে স্থির। জান্নাত অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে। বলে গেল একদমে,

” কতদিন কইলাম এইয়া বন্ধ করতে। ভালা না এগুলা। ম দ, জু^য়া ভালো মাইনষে করে না। জীবন নষ্ট হইয়া যায়। কিন্তু না। হোনেই না মোর কথা। হুনবো ক্যা? মুই কেডা? মোর কথার কোনো দাম আছে? ”

ঝরঝরে কাঁদছে জান্নাত। উক্তি দুঃখী নজরে তাকিয়ে। মুয়ীয ধীর স্থির ঘুরে দাঁড়ালো সকলের উদ্দেশ্যে। গম্ভীর-শাণিত স্বরে বললো,

” মা। তোমার পোলারে শুধরাই যাইতে কও। নইলে কও মুয়ীয নামে ওর কোনো ভাই আছে, হেইয়া ভুইল্লা যাইতে। হ্যায় যদি ভাবে রোজ রোজ এমন আকাম কুকাম করবো। আর মাইনষে টাহার লেইগ্গা ঘরে আইবো। হাঙ্গামা করবো। মোগো মানসম্মান ধুলিসাৎ করবো। তয় ভুল ভাবতাছে। মুই এইয়া আর একটুও সহ্য করুম না। এইয়া বন্ধ করতে কও। নইলে হ্যার একদিন কি মোর একদিন। বাড়িতে তুলকালাম উঠবো কিন্তু। সাবধান! ”

তর্জনী তাক করে শাষিয়ে গেল মুয়ীয হাসান। তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি বা*রুদের স্ফু’লিঙ্গে কেঁপে উঠলো মাঝের ঘরটি। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরিবারের মানুষগুলো। থরথরিয়ে কাঁপছে হৃদ গহ্বর। মারুফের মনে হচ্ছিল সে অতল ভূমধ্যসাগরে ভেসে যাচ্ছে। একটুখানি খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাইছে বাঁচার জন্য। হাতের পাঁচটি আঙ্গুল কেঁপে কেঁপে সমুদ্রের বুকে দাবড়ে যাচ্ছে। মাথা উঁচিয়ে রাখা গভীর পানির উপরিভাগে। নাক, চোখ শুধু বাহিরে। বাকি সব পানির অতলতায় ডুবে। হাঁসফাঁস অবস্থা। ভয়াবহ ভবিষ্যৎ কল্পনায় উপস্থাপিত হতেই, কেমন এক নিদারুণ যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো মারুফ। ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকালো। মুয়ীয প্রস্থান করছে সেথা হতে। পিছু পিছু উক্তি। পরিবারের সদস্যরাও একাকী ফেলে তাকে, চলে যাচ্ছে। স্ত্রী সন্তান-ও সাথ দিলো না। চলে গেল। বিমর্ষ চোখের তারায় সকলের প্রস্থান ধরা দিলো। মাঝের এই ঘরটিতে কাঠের চেয়ারে একাকী শুধু একাকী বসে মারুফ হাসান। পিনপতন নীরবতা বি’দ্ধ হচ্ছে শিরায় উপশিরায়।

রাতের আঁধারিয়া চাদরে ঢেকে শহরতলী। শীতাংশু’র মোহনীয় রূপের ছটা উপস্থিত অন্তরীক্ষে। বিছানায় কিনারে বসে মুয়ীয। মানসিক বেদনায় উৎপীড়িত অন্তর। উরুর ওপর স্থাপিত দুই কনুই। হাতের দশটে আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ হয়ে। সে মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়তার ওপর রাখা থুতনি। চোখে বোধশক্তির বাইরে অবস্থিত এক ভাষা। ঘরজুড়ে নীরবতার ভ’য়াল থাবা। উক্তি ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। স্বামী মানুষটির এমন সন্তপ্ত অবস্থা অবলোকন করে পু’ড়ছে তার অন্তঃস্থল। চোখেমুখে বিমর্ষতা। ধীরপায়ে এগিয়ে এলো উক্তি। নিঃশব্দে দাঁড়ালো স্বামীর পাশে। দ্বিধাপূর্ণ দাঁড়িয়ে সে। বুঝে উঠতে পারছে না, মন যা বলছে তা করা ঠিক হবে কিনা। এ পরিস্থিতিতে আদৌও পুরোপুরি মানানসই কিনা। মনের সঙ্গে এক নীরব লড়াই চলমান। মিনিট দুই অতিবাহিত হলো নৈঃশব্দ্য লড়াইয়ে। মুয়ীয তখনো অজ্ঞাত সঙ্গিনীর উপস্থিতি সম্পর্কে। তার মন যে ডুবে অতল উদ্বেজনে। সহসা ধ্যান ভঙ্গ হলো মানুষটির। চমকিত নেত্রে তাকালো বামে! স্ত্রীর অবয়বে। হাসান সাহেবের চোখেমুখে তখন অবাকতার রেশ বিরাজমান! কেননা…

চলবে।