তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-০২

0
120

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২

” এই ছে’মড়ি! তোর ভাই কি সত্যিই চাকরিবাকরি করে? নাকি পাড়ার লেলাই দেওয়া গু^ণ্ডা মা;স্তান? এমন হা•রামি ক্যা? ”

অপ্রত্যাশিত এমন প্রশ্নে স্তব্ধ হয়ে গেল নববধূ উক্তি! ঘোমটার আড়ালে লুকায়িত তার স্তব্ধ মুখখানি। ভাই সম্পর্কে এমনতর সম্বোধন এ প্রথমবারের মতো শুনলো যে। কোনোরূপ জবাব না পেয়ে অসন্তুষ্ট হলো মুয়ীয। বললো,

” মুখে কুলুপ আইট্টা আছোছ ক্যা? কথা কানে যায় না? ”

এবারো নিরুত্তর উক্তি। মেজাজ বিগড়ে গেল বেশ। মধ্যকার দূরত্ব মিটিয়ে এক লহমায় সন্নিকটে এলো মুয়ীয। অকস্মাৎ হাত বাড়িয়ে হটিয়ে দিলো ঘোমটা নামক কৃত্রিম আবরণ। অভাবনীয় এমন কাণ্ডে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো উক্তি। খিঁচে বন্ধ করে নিলো মায়া মায়া দু’টো চোখ। ডান হাত খামচে ধরলো বিছানা চাদর। অর্ধাঙ্গিনীর ঘন, বদ্ধ অক্ষিপল্লবের পানে নজর যেতেই কেমন নির্বাক হয়ে গেল মুয়ীয। ধীরলয়ে সোজা হলো তার কুঞ্চিত ভ্রু’দ্বয়। অভিব্যক্তিতে মুগ্ধতার রেশ! বিয়ের পর এ প্রথম স্ত্রীর মায়াবী মুখশ্রী দেখার সুযোগ হলো। ওই ছোট্ট আদর আদর মুখখানি, ভয়ে খিঁচে বদ্ধ করে রাখা চোখ, ব্লাশন মাখা গালের নরম ত্বক, নাকে পড়া নথ, শিশিরে ভেজা পাতার ন্যায় কম্পিত ওষ্ঠাধর… সবটাই নজর কাড়লো মুয়ীয নামধারী মানুষটার। ধক করে উঠলো কঠিন হৃদয়ের আস্তরণে। আস্তে করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মুয়ীয। পাছে হৃদয়ে কোনো সর্বনা’শা জলোচ্ছ্বাস আছড়ে না পড়ে! খুশকো কাশি দিয়ে মুয়ীয লহু স্বরে বললো,

” অমনে চোখ গাইত্তা থোওনের কি আছে? মুই ভূত না.. প্রেত? ”

প্রশ্নটা কর্ণ পথে প্রবেশ করলো। আস্তে ধীরে চক্ষু মেলে তাকালো মেয়েটা। নজরবন্দি করলো স্বামী মানুষটির লম্বা চওড়া দীর্ঘকায় দেহটি। বুকের ভেতরে কেমন এক আপন আপন বাতাস বয়ে গেল। আজ এ মুহুর্ত হতে চিরকালের জন্য এ মানুষটি তার! শুধুই তার! হ্যাঁ, মুয়ীয হাসান আজ থেকে কাগজে কলমে শুধুই তার। উক্তি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। আস্তে করে দৃষ্টি নত করে নিলো। এবার আর সহ্য হলো না। উচ্চ স্বরে মুয়ীয দিলো এক রাম ধমক!

” অ্যাই ছেমড়ি! মুখ বন্ধ কইরা তামাশা নিতাছোছ? কথা কছ না ক্যা? বোবা নাকি? ”

আকস্মিক কেমন এক দুর্বোধ্য চাহনি ফেলে চোখ তুলে তাকালো উক্তি। নয়নে নয়নে নিঃশব্দ কথোপকথন হলো দু’জনের। হলো দুরূহ শব্দের লেনদেন। আস্তে ধীরে কুঞ্চিত হলো মানুষটির ভ্রু। মস্তিস্কে আঘাত করতে লাগলো একের পর এক দৃশ্যপট। চট করে এক ভাবনা খেলে গেল। তৎক্ষণাৎ উঁচু গলায় ডেকে উঠলো মুয়ীয,

” মা! মা! ”

মাত্র দু’টো ডাক। হুট করেই কোথা হতে দরজা ঠেলে উদয় হলেন মোমেনা বেগম। যেন দরজার ওপাশেই ছিলেন দাঁড়িয়ে। উনি একা নন। সঙ্গে রয়েছে কনিষ্ঠ কন্যা মুন্নি এবং জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ জান্নাত। একজনকে ডাকতেই তিনজন হাজির। উত্তপ্ত মেজাজের আরো দফারফা হলো। বাঁ ভ্রু চুলকাতে চুলকাতে ঘরময় পায়চারি করে চলেছে মুয়ীয। অত্যন্ত শান্ত স্বরে শুধালো মা’কে,

” বউ কথা কয় না ক্যা? ”

রসগোল্লার ন্যায় চোখ করে তাকিয়ে মোমেনা বেগম। জান্নাত ও মুন্নি নিভৃতে চোখ চাওয়াচাওয়ি করে নিলো। সকলের মুখে যেন অদৃশ্য স্কচটেপ বাঁধা। অবরুদ্ধ কণ্ঠনালী। মুয়ীয পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

” ছেমড়ি কথা কয় না ক্যা, মা? ”

পায়চারি থামিয়ে দাঁড়ালো মুয়ীয। দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে মায়ের অবয়বে। মা মোমেনা বেগম আমতা আমতা করে চলেছেন। তার জানা উত্তর। তবুও বলতে অপারগ কণ্ঠনালী। কি থেকে কি বলবেন উনি! এখুনি কি একদফা অশান্তি হবে না! অবশ্যই হবে।

” মা! ”

ভারিক্কি যে শাসক স্বরে আঁতকে উঠলেন মোমেনা বেগম।

” মু.. মুয়ীয মোর বাপ! কথাডা একবার হোন। ”

” ছেমড়ি কথা কয় না ক্যা? ”

থেমে থেমে হৃদয় ছু’রিবিদ্ধ করা স্বরে শুধালো মুয়ীয। মোমেনা বেগম পড়লেন মহা বিপাকে। এবার বলবেন টা কি উনি? বাকি দু’টো মুখে কুলুপ এঁটে আছে কেন? কিছু একটা বলে তো ওনায় বাঁচাক? না ওরা কেউ বললো না। তবে মুখ খুললো আরেকজন। যাতে ঘরময় হলো তুমুল বি°স্ফোরণ!

” কাকি তো কথা কইতে পারে না কাকু। ”

এক নতুন দিনের সূচনা। রবির মিঠে রোদ জানালা গলিয়ে প্রবেশ করছে ঘরে। ছুঁয়ে যাচ্ছে কোমল দেহের অধিকারিণী কন্যাকে। জানালার গ্রিল আঁকড়ে, তাতে মাথা ঠেকিয়ে উদাস বদনে দাঁড়িয়ে উক্তি। দু চোখে অবর্ণনীয় উদাসীনতার ঘূর্ণিপাক। লহমায় তার জীবনটা কেমন করে বদলে গেল। আপন হলো পর। পর হলো নিকটতম আপন। এ বাড়ি, এ বাড়ির মানুষগুলো আজ তার আপনজন। সবচেয়ে কাছের। সে কি পারবে এই মানুষগুলোকে আপন করে নিতে? কিংবা তারা পারবে এই জঘন্য মেয়েটিকে আপন করে নিতে! হয়তো না। তাই তো গতরাতে এক প্রস্থ ঘূর্ণিঝড় উঠলো এ ঘরে। তার জীবনের অন্যতম বড় সত্য এভাবে প্রকাশিত হবে, জানা ছিল না। স্বামী মানুষটি কি তবে কিছুই জানতো না? প্রতারণার শিকার হলো সে! এবার কি হবে? গতরাতে তো একদফা চেঁচামেচি করে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করলো মানুষটি। এরপর? তার এই নগণ্য জীবনে কি সুখ পাখিটা কখনোই ধরা দেবে না? অধরা রয়ে যাবে আম”রণ!

তপ্ত শ্বাস ফেললো মেয়েটা। আস্তে ধীরে কেটে গেল অন্যমনস্ক ভাব। চকিতে চমকালো উক্তি! দৃষ্টি নিবদ্ধ জানালা গলিয়ে বাহিরে। এতগুলো কৌতূহলী মুখ কেন তাকিয়ে এদিকে! জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা মিলছে অসংখ্য টিনশেডের বাড়ি। সেসকল বাড়ির দরজা, জানালায় উপস্থিত বেশকিছু উৎসুক মুখ। তাদের দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে এ বাড়ির ঠিক এ-ই ঘরের জানালায়। সকলে যেন একই সঙ্গে এদিকে তাকিয়ে। এতক্ষণ নববধূ উক্তি’কে দেখছিল বুঝি! উক্তি তো উদাসীনতার জন্য টেরই পায়নি। প্রতিবেশী মহিলা, কিশোরী, তরুণী একাধারে অনেকেই দেখে যাচ্ছিল ওকে। ফিসফিসিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাও বলছিল। মানুষগুলোর পোশাক, বেশভূষায় পরিচয় মিলছিল তাদের জীবনযাত্রার মানের। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য তারা। হালচাল এবং আচরণেই বোঝা যাচ্ছিল। উক্তি মেয়েটা এসবে অভ্যস্ত নয়। এই পরিবেশ, এমনতর জীবনযাপন, নতুন মানুষগুলো। ওর কেমন কষ্ট হচ্ছিল। বুকের খাঁচায় ছটফটিয়ে যাচ্ছিল প্রাণ বায়ুটা। অসহনীয় এক যন্ত্রণা বুকের অলিগলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফট করে জানালা হতে সরে গেল উক্তি। এই মানুষগুলোর অদ্ভুদ, উৎসুক চাহনি ওকে যে বড় পীড়া দিচ্ছে!

উক্তি ঘরের এদিক ওদিক তাকালো। এ ঘরটা ওর নিজের বেডরুমের থেকে বেশ ক্ষুদ্রাকৃতির। আসবাবপত্র তা-ও বেশ কম। বহু বছরের পুরনো একটা খাট, যার ডিজাইনও বেশ আগেকার। বর্তমানে এমন ডিজাইনের খাটের দেখা মেলে না। একটা স্টিলের রঙ ওঠা সবুজাভ আলমারি, একটা পুরনো কাঠের টেবিল, একটা কাঠের আলনা। আসবাবপত্র বলতে এ-ই আছে। অন্য কিছু নয়। উক্তি আস্তে ধীরে হেঁটে বিছানায় এলো। বিছানা তখনো ফুলেল সজ্জায় সজ্জিত। এসব পরিষ্কার করা উচিত। উক্তি পড়নে থাকা অল্প দামী শাড়িটার আঁচল কোমরের একপাশে গুঁজে নিলো। এরপর দক্ষ হাতে পরিষ্কার করতে লাগলো বিছানা। এ মুহূর্তে এই ঘরে একা সে। স্বামী মানুষটার দেখা মেলেনি ঘুম থেকে উঠে। গতরাতে কোন ফাঁকে এসে যেন পাশে ঘুমিয়েছিল। টের পায়নি উক্তি। একদফা অশান্তি, ক্লান্তির দরুণ সাড়ে বারোটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তখন তেজ দেখিয়ে রুমের বাইরে স্বামী মুয়ীয হাসান। এরপর মানুষটা কত রাতে এসেছে, ঘুমিয়েছে টের পায়নি উক্তি। শুধু ঘুমের ঘোরে অনুভব করেছে আজ এ বিশাল অন্ধকার রাতে সে একা নয়। একটুখানি ভরসা, নিরাপত্তা দেয়ার জন্য পাশে, অতি সন্নিকটে রয়েছে কেউ একজন!

টিনশেডের এই বাড়িতে ছোট-বড় মিলিয়ে রুম মোটে তিনটি। বাড়ির দশা জীর্ণশীর্ণ। শেষ কবে এর সংস্কার করানো হয়েছিল ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। উক্তি আস্তে ধীরে হেঁটে চলেছে। ঘুরে দেখছে বাড়িটা। সে-ই সকাল থেকেই ঘরে বন্দি সে। কেউ এলো না খোঁজ নিতে। সকালের খাবার খাওয়া তো বহু দূরের কথা। এতক্ষণ ভদ্রতা, সৌজন্যতা প্রদর্শনের খাতিরে ঘরেই বসে ছিল সে। ভেবেছিল কেউ ডাকতে আসবে না। না, এলো না কেউ। এভাবে আর কতক্ষণ? বেলা বারোটা বাজতে চললো। খিদেয় পেটে ইঁদুর বিড়াল দৌড়ঝাঁপ করছে। জ্বলছে পেট গহ্বর। তাই তো অপারগ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। উক্তি হেঁটে বেড়াচ্ছিল একাকী। হঠাৎই থমকে গেল পদযুগল। কানে প্রবেশ করলো এক নারীর অসন্তোষের বাক্যবাণ!

” বৌমা! তোমার পোলাডা কিন্তু দিনকে দিন বহুত ফাজিল হইয়া যাইতাছে। জায়গায় বেজায়গায় মুখ চালায়। কাইল ওরে কেডা কইছিল মুয়ীযরে হেইসব কইতে? পোলাডা মোর হুদাই চেইত্তা গ্যালো। এত্তগুলা কথা হুনাই দিলো। ”

উক্তি ধীরপায়ে বাড়ির বাইরে এলো। বেড়োতেই নজর কাড়লো রান্নাঘর। রান্নার জন্য এক নির্দিষ্ট ঘর রয়েছে। সেখানেই রন্ধন কর্মে ব্যস্ত বেশকিছু নারী। মোমেনা বেগম এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ জান্নাত তন্মধ্যে অন্যতম। জান্নাত পিঁড়িতে বসে সবজি কেটে চলেছে। দু’হাত দূরে আরেক পিঁড়িতে বসে গ্যাসের চুলায় তরকারি সামলাচ্ছেন মোমেনা বেগম। মুখ ঝামটা মে°রে ওনাকে বললো জান্নাত,

” হোনেন মা, মোর জীবন ছোডো মানুষ। হ্যায় কি এই হগল জটিল বিষয় বোঝে? সরল মন। যা মনে আইছে, কইয়া দিছে। হ্যাতে হইছেডা কি? মুয়ীয ভাই বুঝি সত্যিডা কোনদিন টের পাইতো না? হ্যায় কি চোখে পট্টি বাইন্ধা ঘোরে? ”

মোমেনা বেগম খুন্তি নাড়ানো বন্ধ করে তাকালেন পুত্রবধূর পানে। কটমট করে বললেন,

” মুখে লাগাম দিতে হ্যাখো বউ। একডা মাত্র পোলারে তোমার লাহান অজাত বানাইয়ো না। ”

জান্নাত দাঁতে দাঁত পিষে তাকিয়ে। পাল্টা উত্তর দিতে যাচ্ছিল তখনই পাশ থেকে আরেক মহিলা ফোঁড়ন কেটে বললেন,

” সত্যিই আফা! তোমার কেমন পোড়া কপাল গো! বড় বৌডার মুখে এট্টুখানি মধু নাই। মুখ খুললেই খালি তিতা বাইর হয়। আর ছোডো বউ? হ্যায় তো… ”

বিদ্রুপাত্মক হাসলেন সে প্রতিবেশী মহিলা। যাতেই মোমেনা বেগমের উজ্জ্বল মুখে কালো আঁধার ঘনিয়ে নামলো। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন উনি। আস্তে ধীরে নড়ছে খুন্তি। উক্তি সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো। শুনলো। চমকপ্রদ ভাবে তার এখন আর খিদে পাচ্ছে না। সবটুকু ক্ষুধা উধাও হয়ে গিয়েছে। ভরপুর ভরেছে পেট। তাই তো ঘরের দিকে উল্টো পথ চললো উক্তি মেয়েটা।

ধরনীর বুকে তমসা নেমেছে। সময় তখন রাত আটটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরলো মুয়ীয। চোখেমুখে অবসন্নতা। দেহে লেপ্টে থাকা পোশাকের ঘর্মাক্ত অবস্থা। চুলগুলো উস্কো খুস্কো। শার্টের উপর দিকের বোতাম খুলতে খুলতে ঘরে প্রবেশ করলো ছেলেটা। সহসা নজরে এলো স্ত্রীর মুখশ্রী। মুয়ীয দেখেও অদেখা করে ভেতরে প্রবেশ করলো। এগিয়ে গেল আলনার ধারে। চমকালো বেশ! আলনায় সুনিপুণ ভঙ্গিতে গুছগাছ করে রাখা সমস্ত পোশাক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েলি স্পর্শে আজ সেজেছে এই সামান্য দেখতে পুরনো আলনা। বহু দিন, মাস, বছর বাদে কোনো মেয়েলি স্পর্শ পেল! মনটা সীমাহীন ভালোলাগায় ভরে গেল! বাঁকা চোখে বামে তাকালো মুয়ীয। উক্তি কিছুটা দূরে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে। কচলে চলেছে নরম দু’টো হাত। পড়নে সাদামাটা এক শাড়ি। মাথা আবৃত সে শাড়ির আঁচলে। দু গালের ত্বক ছুঁয়ে নেমে এসেছে এক গাছি ছোট চুল। চোখেমুখে প্রসাধনীর ছোঁয়া দৃশ্যমান নয়। মেয়েটা সাজেনি কেন! ও কি সাজতে পছন্দ করে না? চট করেই প্রশ্নটা মস্তিষ্কে হানা দিলো। ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মুয়ীয। আলনা থেকে একটা শুভ্র রঙের স্যাণ্ডো গেঞ্জি, গামছা ও রঙিন লুঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর হতে। উদ্দেশ্যে বাড়ির বাইরে অবস্থিত গণ টয়লেট!

দিবাকরের আলোয় আলোকিত বসূধা। মাটিতে বিছানো বড় এক মাদুর। তাতে রাখা খাবারদাবার। একত্রে সকালের খাবার খেতে বসেছে পরিবারের সদস্যরা। উক্তি এবং জান্নাত দুই জা সকলের খাবার পরিবেশনে দায়িত্বরত। মুয়ীয আজ উপস্থিত রয়েছে। মোবাইলে কারো সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলে চলেছে মানুষটা। কখনোবা কাজ বুঝতে না পারার অপরাধে ওদিকের মানুষটাকে গালমন্দ করে চলেছে। যে গালি উক্তি’র কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। কখনো এমন অদ্ভুত, বি’শ্রী গালি শোনেনি সে। তাই কেমন এক অনুভূতি হচ্ছে। ভালো নয় এ অনুভূতি। বিরূপ অনুভূতি। উক্তি মাথায় আঁচল ঠিক করে মুয়ীযের কাছে এলো। সাবধানী ভঙ্গিতে মোটা চালের ভাত পরিবেশন করছিল। তখনই মুয়ীয ফোনে দিলো এক রাম ধমক। দুর্বল, নিরীহ আত্মা কেঁপে উঠলো মেয়েটার। হাত ফসকে আরেকটু হলেই ভাতের পাতিল পড়ে যাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে কোনোমতে নিজেকে সামলাতে সক্ষম হয়েছে সে। মুয়ীয কিন্তু আড়চোখে সবটা ঠিকই লক্ষ্য করলো। তবে বললো না কিছুই। বরং নিজ ফোনালাপে ব্যস্ত রইলো। উক্তি তপ্ত শ্বাস ফেলে দ্রুততার সঙ্গে খাবার পরিবেশন করে সরে গেল স্বামী হতে।

খাবার খাচ্ছে সকলে। তন্মধ্যে চেঁচামেচি আরম্ভ করলো মুয়ীযের ছোট বোন মুন্নি। নাক সিঁটকে বলে চলেছে,

” ইয়াক থু! এই বা•লের ডাইল রানছে কেডা? এইডা ডাইল না হলুদ গোলাইন্না পানি! ”

মুয়ীযের বড় ভাই মারুফ সে-ও একই সুরে তাল মেলালো,

” হ। আইজ ডাউল রানছে কেডা? ক্যামন গিদইর্রা লাগতাছে! ”

জান্নাত তৎক্ষণাৎ ক্ষে’পে উঠলো,

” হ লাগবোই তো। আইজ মুই ডাইল রানছি না? অহন তো ডাইলরে বা•ল ই লাগবো! ”

” বা°ল রানছো তো বা°ল কমু না? ”

পাল্টা জবাব দিলো মুন্নি। মোমেনা বেগম পুত্রবধূকে বলে উঠলেন,

” এতগুলা বছর সংসার কইরা কি শিখলা বউ? অহন তরি ডাইলডাও ঠিকমতো রানতে জানো না! জানো তো খালি মুখ চালাইতে। ”

জান্নাত থেমে নেই। নেকি কান্নার সুরে অভিযোগ জানাতে ব্যস্ত। উক্তি দুঃখী চাহনি ফেলে তাকিয়ে। এসব কি হচ্ছে! এ কোন পরিবেশে এসে পড়লো সে! সকালে ঘুম থেকে উঠে শুরু। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অশান্তি। ঝগড়া। এই টিনশেড এলাকায় শান্তি কোথায়? দিনরাত খালি চারদিকে অশান্তি। ঝুট ঝামেলা। তার বাপ, ভাই এ কোন শূলে চড়ালো তাকে! অন্যমনস্ক দুঃখ ভারাক্রান্ত মেয়েটার হঠাৎ করেই গলায় বিষম বেঁধে গেল। কাঁশতে কাঁশতে নাজেহাল অবস্থা। চোখমুখ হয়েছে লাল। ফর্সা মুখশ্রীর হাল করুণ। আকস্মিক এ কাণ্ডে চলমান ঝামেলা থমকে গেল। কাশির দমকে মেয়েটার প্রাণ ওষ্ঠাগত। পানি চাইবে যে তা-ও সম্ভব নয়। বাকিরা হা হয়ে তাকিয়ে। হঠাৎই আশার আলো দেখা দিলো। চোখের সামনে স্টিলের গ্লাসে পানি। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে গ্লাস হাতে নিয়ে পানি পান করতে লাগলো উক্তি। ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেয়ে নিলো। মাদুরে গ্লাস রেখে পেল শান্তি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ঠিক সে মুহূর্তে ঝাঁড়ি দিয়ে উঠলো সে পুরুষটি,

” মূর্খ নি? কাঁশতে কাঁশতে ম^রতে বইছোছ। পানি চাবি না? ”

রাগের চোটে প্রশ্ন করে তো ফেললো। পরক্ষণে হুঁশ ফিরলো মুয়ীযের। কেমনতর প্রশ্ন করলো সে! এক বোবা-মূক নারী পানি চাইবে!! এ যে অসম্ভব!

চলবে।