তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-২১+২২

0
92

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২১

” তোমার স্পর্ধা দেখে আমি রীতিমতো অবাক হচ্ছি নিশাত! তুমি এটা কি করে করতে পারছো? ”

জাওয়াদ বলে উঠলো মাত্রাহীন অসন্তোষের স্বরে। নিশাত সমতল আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে হাত বুলিয়ে নিলো মাথা আবৃত করে রাখা ম্যাচিং হিজাবে। না, সব ঠিকঠাক। পবিত্র ঈদুল ফিতরের সাজ সম্পন্ন হয়েছে। সে একদম মনের মতো করে রেডি হতে পেরেছে। আজকের জন্য এই সাধারণের মাঝে অসাধারণ সাজটুকুই মানানসই। স্ত্রীর কাছ থেকে কোনোরূপ রা না পেয়ে ক্ষি’প্ত হলো জাওয়াদ। তেঁড়ে গেল সিংহল গতিতে। স্ত্রীর হাতের বাজু আঁকড়ে ধরলো নি`ষ্ঠুরতার সঙ্গে। অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড় করালো নিজের দিকে। নিশাত চমকিত নেত্রে তাকিয়ে! দাঁতে দাঁত পিষে বললো জাওয়াদ,

” আমি কি ইনভিজিবল হয়ে গেছি? নাকি বোবা যে আমার কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছাচ্ছে না? ”

নিশাত এ প্রশ্নের পৃষ্ঠে শান্ত স্বরে বললো। অথচ দৃষ্টি নিচুতে নামিয়ে রাখা।

” বলো। শুনতে পাচ্ছি। ”

” কি শুনতে পাচ্ছো হ্যাঁ? কি শুনতে পাচ্ছো? ”

” এটাই শুনতে পাচ্ছি যে ঈদের মতো পবিত্র একটা দিনেও সকাল সকাল স্বামী আমার অশান্তি সৃষ্টি করছে। ”

চরম সত্য বাক্যটা গিলতে কষ্ট হলো বেশ। জাওয়াদ বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললো,

” আচ্ছা? সকাল সকাল আমি অশান্তি করছি? এখন স্বামীর কথা অশান্তি মনে হয়? ”

নিশাত এ কথার জবাব না দিয়ে স্বামীর দিকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকালো। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো এক,

” কি করেছি আমি? এমন অ্যা`টাকের হেতু কি? ”

” অ্যা`টাক! বাহ্! খুব ভালো। ” জোরপূর্বক কৃত্রিম হাসলো জাওয়াদ।

” কিছু বলার থাকলে দ্রুত বলে ফেলো। নাহলে ছাড়ো আমায়। কাজ আছে। ”

” নিশাত! কাজ দেখাবে না আমায়। তুমি একাই শুধু কাজ করো আর দুনিয়া বসে বসে খায়। এমনটা নয় কিন্তু। অর্ডিনারি একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের টিচার হয়ে বেশি কর্মজীবী হয়ে যাওনি কিন্তু। সামান্য এক স্কুলের টিচার ই তো। তা-ও আবার প্রতিবন্ধী স্কুল। হাহ্! ”

জাওয়াদের কণ্ঠে যথেষ্ট ব্যঙ্গ প্রকাশ পাচ্ছে। ওকে নিয়ে বলছে ভালো কথা। কিন্তু ওর অবুঝ, অভাগা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করবে তা শুনতে নারাজ নিশাত। সে আস্তে করে হালকা অনুভব করে বাজু হতে স্বামীর হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। বললো,

” আমাকে নিয়ে বলছো, বলো। বাঁধা দিইনি। কিন্তু ওই নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবে না।”

” বলবো। একশো বার বলবো। প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধী বলবো না তো কি বলবো? ”

” জাওয়াদ! ” আশ্চর্যজনক কণ্ঠে ডেকে উঠলো নিশাত,

” এমনটা কেন করছো? ঈদের দিন সকাল সকাল এমন আচরণ আমি ডিজার্ভ করি না। আমার অপরাধটা কোথায় বলবে? আমি। আমি মুয়ীয ভাইয়ের দেয়া এই সাধারণ, কম দামী শাড়িটা পড়েছি বলে এত তেজ? ক্ষোভ? তোমার ব্যক্তিত্ত্বে আঘাত করেছে নাকি বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে এই শাড়ি? হু? ”

নিশাতের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ ছিল অকথ্য সত্য। একদম বাস্তব। চরম সত্য। জাওয়াদ তা স্বীকার করতে নারাজ। পাল্টা রোষপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো,

” এই শাড়িটা এক্ষুনি খুলে ফেলো। খুলে, আমার দেয়া রয়্যাল ব্লু কালার শাড়ি পড়ো। কোনো ছোটলোকের দেয়া শাড়ি তোমার গায়ে দেখতে চাই না আমি। শাড়িটা আগুনে পু`ড়িয়ে দেবো। আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমার সাহস দেখে! আমার নিষেধ করা সত্ত্বেও এই শাড়িটা পড়লে কি করে? হা? ”

” কারণ শাড়িটা আমার ননদ জামাইয়ের দেয়া। সে-ও একজন মানুষ। কোনো অমানুষ কিংবা এলিয়েন নয়। ”

” তার সবচেয়ে বড় পরিচয় সে একটা ছোটলোক। বস্তির ছোটলোক। আর ওই উক্তির হাসবেন্ড। ”

” জ্বি হ্যাঁ। উক্তি’র স্বামী সে। তোমার বোন জামাই। ”

” উক্তি আমার বোন না। একদমই না। ” উচ্চ স্বরে অসম্মতি পোষণ করলো জাওয়াদ।

” উঁচু গলায় বললেই সত্যি মিথ্যা হয়ে যাবে না। উক্তি তোমার বোন হয় জাওয়াদ। একমাত্র ছোটবোন। ”

” না না না। ও.. ও খু•নি। আমার মায়ের খু•নি। ”

এলোমেলো কণ্ঠস্বরে তীব্র প্রতিবাদ জানালো জাওয়াদ। নিশাত প্রত্যুত্তরে উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলো,

” উক্তি খু নি নয়। নবজাতক একটা বাচ্চা কখনোই খু নি হতে পারে না। ও কি দিয়ে খু ন করেছিল তোমার মা’কে? হা? ছোট ছোট নরম ওই হাত-পা দিয়ে? যার কিনা হাড়গোড় একদম তুলতুলে নরম? নাকি ওই দাঁতহীন মাড়ি দিয়ে মে`রেছিল? বলো? চুপ করে আছো কেন? বলো? ”

” নি..শা..ত! ”

চিৎকার করে হাতের নাগালে থাকা মাঝারি আকৃতির শোপিসটা জাওয়াদ ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। তীব্র ঝংকার তুলে মেঝেতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে ভেঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো শোপিসটা। অত্যন্ত নির্দয়, নির্মম ভাবে শোপিসটার মৃ ত্যু হলো। তবুও থামলো না নিশাত। ভয় পেল না। বরং উঁচু জোর গলায় বলে গেল,

” উক্তি খু*নি না। না না না। ছোট বাচ্চা ছিল ও। সেদিন সবটাই ছিল নির্মম নিয়তি। তোমাদের তাকদীর। স্বীকার করে নাও জাওয়াদ। স্বীকার করে নাও। উক্তি খু`নি নয়। ও খু*ন করেনি। ”

” নাহ্! উক্তি… উক্তিই খু নি। ও.. ও মে°রেছে আমার মা’কে। কেড়ে নিয়েছে। ও খু*নি। ”

ছন্নছাড়া কিছু শব্দগুচ্ছ মুখে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল জাওয়াদ। নিশাত তখনো পিছু বলে চলেছে উক্তি খু নি নয়। শেষোক্ত এই ঘটনার সাক্ষী স্বরূপ দরজার বাহিরে তখন উপস্থিত একজন। সকলের অগোচরে দাঁড়িয়ে সে। কে এই অজ্ঞাত ব্যক্তি? কি হয়েছিল অতীতের সে-ই নির্মম, অপ্রত্যাশিত দিনে? নবজাতক উক্তি কি সত্যিই খু নি? কোন পন্থায় খু ন করেছিল নিজ জন্মদাত্রী মা’কে..? উত্তর আজও জ্ঞাত হয়েও যেন অজ্ঞাত। অজানা।

” উঃ উঃ! ”

মূক শব্দে নিষেধ করে চলেছে উক্তি। কিন্তু বিপরীতে বসে থাকা বান্দা রীতিমতো নাছোড়বান্দা। সে এই শব্দহীন আপত্তি শুনলে তো?!

” না না। তোমারে খাইতে হইবো। হা করো হা। ”

নিজে ইয়া বড় এক হা করে উক্তি’কে হা করতে ইশারা করলো সে। উক্তি হেসে ফেললো এতে। পেট ভরা। তবুও অবুঝ প্রাণটির অনুরোধ রক্ষার্থে হা করলো। মুচকি হেসে কাকির মুখে এক চামচ সেমাই পুরে দিলো জীবন। উক্তি মৃদু হেসে সেমাই মুখে নিলো। ইশারায় ওকেও বললো হা করতে। জীবন দ্রুত মাথা নেড়ে বললো,

” না না কাকি। আর খাইতে পারুম না তো। পেট ভরা‌। ”

উক্তি মিথ্যামিথ্যি চোখ রাঙিয়ে দিতেই জীবন ফট করে হা করলো। উক্তি তা দেখে নিঃশব্দে হেসে উঠলো। স্নেহের সহিত ভাতিজার মুখে সেমাই পুরে দিলো। ওরা একে অপরকে এভাবেই সেমাই খাইয়ে যাচ্ছিল। সময়ের পরিক্রমায় কখন যে শিশু জীবন এবং শিশুসুলভ মনের অধিকারীনি উক্তির মধ্যে অবর্ণনীয় বন্ধন গড়ে উঠেছে তা বোধহয় ওদের নিজেদেরও অজানা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ দুটির মধ্যে কল্পনাতীত ভাব হয়েছে। জীবন ও উক্তির অবসর এখন কাটে একে অপরের সান্নিধ্যে। বিকেলে ওরা জমায়েত হয় উক্তির ঘরে। সেথায় বসে দু’জনে। জীবন হাজির হয় তার গল্পের ঝুলি নিয়ে। সারাদিন কি করলো সে, স্কুলে কেমন সময় কাটলো, কোন ছেলেটা কেমন দুষ্টুমি করলো, কোন মেয়েটা কার সঙ্গে অহেতুক ঝগড়া করলো, কে টিচারের বকা খেল, সে টিফিনে পুরোটা খেয়েছে কিনা, কাকির বানিয়ে দেয়া টিফিন ঠিক কতটা সুস্বাদু ছিল, তার বন্ধুরা কিভাবে টিফিনের ভাগ চেয়ে কাড়াকাড়ি করছিল ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত কি বলে বেড়ায় জীবন। বোবা উক্তি সবটা বেশ কৌতূহল নিয়ে শোনে। সময়টা উপভোগ করে। দৈনন্দিন ঘটনা বলতে বলতে কখন যে জীবন তার আহ্লাদে কাকির কোলে স্নেহের একটুখানি পরশের লো’ভে শুয়ে পড়ে টেরও পায় না বোধহয়। উক্তিও আদর করে জীবনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে চুমু এঁকে দেয়। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় এটা ওটা বলে। যার বেশিরভাগ বোঝে না বালক জীবন। তবুও সে আসে। কাকীর কাছে আসে। কাকির সঙ্গে নৈঃশব্দ্য সময় কাটাতে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা অকৃত্রিম। নির্ভেজাল। নির্মল। একদম স্বচ্ছ। কোনোরূপ মিথ্যা, অস্বচ্ছতা নেই সেথায়।

গোধূলি নেমেছে ধরনীর কোলে। মাগরিবের ওয়াক্ত তখনো চলমান। লালচে রঙা আকাশ ধীরে ধীরে ঘন আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে। মাঝের ঘরটিতে মাদুর বিছিয়ে রাখা মেঝেতে বসে মোমেনা বেগম। ওনার ডান পাশে বসে উক্তি। একটুখানি দূরত্বে মুখোমুখি বসে জান্নাত। জীবন উক্তির বাহু ঘেঁষে বসে। তাদের মধ্যখানে রাখা স্টিলের এক গামলা। সেথায় মুড়ি মাখা। অল্প চানাচুর, পেঁয়াজ কুচি, মরিচ কুচি ও সরিষা তেলের সংমিশ্রণে মুড়ি মাখানো হয়েছে। মেখেছেন মোমেনা বেগম। ওরা বসে সেই মুড়ি মাখা খাচ্ছে। খেতে খেতে মোমেনা বেগম বলছেন,

” আইজকাল স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক অ্যাক্কারে নষ্ট হইয়া গেছে গা। ওই বাড়ির জরিনা! রোজ গেলে স্বামীর লগে কাইজ্জা করে। অশান্তি করে। ”

জান্নাত মুড়ি চিবুতে চিবুতে বললো,

” জামাইডাও কম খচ্চর না মা। জরিনারে খালি মা:রে। ”

” মারুক। ব্যাডা মাইনষে মা`রবো না তো কেডা মা`রবো? হেইলেইগ্গা ও-ও পাল্টা মাইর দিবো? অ্যামন অসভ্য মাইয়া!”

জান্নাত একাকী বিড়বিড় করে উঠলো,

‘ জামাই বইয়া বইয়া খালি মা*রতো আর ও চুম্মা দিতো? এক্কারে ঠিক করছে মাইরা। আরো দু’গা দেয়া উচিত আছিল। ‘

উক্তি ঠোঁট নাড়ানো লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো জান্নাত ঠিক কি বিড়বিড় করে চলেছে। উক্তি সত্যিই অবাক এখানকার কর্মকাণ্ড, মানুষজনের হালচাল দেখে! স্বামী স্ত্রীকে মা`রছে। স্ত্রী-ও পাল্টা গালিগালাজ করে স্বামীকে আঘাত করছে। এ-ও সম্ভব? শেষ যামানা চলে এসেছে। আসলেই। তাই তো আশ্চর্যজনক দৃশ্য এখন স্বাভাবিক রূপেই সংগঠিত হচ্ছে। উক্তি ভাবনায় হারিয়ে ছিল। অকস্মাৎ ভাবনা ভঙ্গ হলো। কর্ণপাত হলো ভারী পুরুষালী কণ্ঠস্বর,

” রাইতের মধ্যে মোর ব্যাগপত্র গুছাই হালাইছ, ছেমড়ি। ”

বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই ব্যাগপত্র গুছানোর কথা শুনে উক্তিসহ সেথায় উপস্থিত প্রতিটি সদস্য বেশ চমকালো! মোমেনা বেগম কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” আচনকা ব্যাগ গুছাইবো ক্যা? কই যাবি বাপ? ”

” রাজশাহী। ”

জান্নাত ফট করে শুধিয়ে উঠলো,

” রাজশাহী ক্যা ভাইয়া? ঘুরতে যাইবেন? ”

” কামে যাইতাছি। ফূর্তি করতে না। ”

গমগমে সে স্বরে জান্নাত ও উক্তি উভয়েই কেমন শঙ্কিত হলো। মুয়ীয একপলক স্ত্রীর পানে তাকিয়ে সেথা হতে চলে গেল। মোমেনা বেগম পিছু ডেকে উঠলেন,

” মুয়ীয! মুড়ি খাইয়া যা বাপ। ”

থামলো না মুয়ীয। শুনলো না। দ্রুততম পায়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো। উক্তি নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে। হঠাৎ ঝড়ের বেগে হলোটা কি? কিছুই তো বোধগম্য হলো না।

নরম কোমল হাত দু’টো ব্যস্ত ব্যাগে দুখানা শার্ট, একটি লুঙ্গি, একটি থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, একটি স্যান্ডো গেঞ্জি, একটি ফুল প্যান্ট রাখার তালে। তবে সে মানবীর আজ মন ভালো নেই। চোখে লবণাক্ত বারিধারা। মুখখানি আবেগে লাল টুকটুকে রঙ ধারণ করেছে। ঠোঁট কাঁপছে থরথরিয়ে। মুয়ীয সে মুহূর্তে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করলো। এসেই এগিয়ে গেল কাঠের টেবিলের ধারে। টেবিলের ড্রয়ার উন্মুক্ত করে একটি নীলাভ কভারে আবৃত ফাইল বের করলো। উঁচু কণ্ঠে কারো সঙ্গে কথা বলে চলেছে মানুষটি। ফাইল দেখে ফোনালাপে কিছু এক বলছে। কখনো মন্দ গালিও দিচ্ছে। ভারী মন্দ সে গালি। উক্তি ভয়ে-আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে দাঁড়িয়ে। কর্মব্যস্ত হাত দু’টো সেই কখন থেমে গিয়েছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে স্বামীর পানে। মানুষটি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন? কি হয়েছে তার? এমন অদ্ভুতুড়ে পীড়া কেন অনুভূত হচ্ছে? মানুষটি কি ভালো নেই? কোনো সমস্যায় রয়েছে? আকস্মিক এমন রাজশাহী সফরে যাচ্ছে কেন? তা-ও চারদিনের জন্য! কোনোকিছুই খোলাসা করে বলছে না। এর ওপর মেজাজ চড়ে রয়েছে। খালি উচ্চ স্বরে চেঁচামেচি করছে। ফোনের অপর প্রান্তে কাউকে ঝাড়ছে। হয়েছেটা কি? সব স্বাভাবিক তো? নাকি ঘনিয়ে আসছে কোনো অস্বাভাবিক ঝড়…?

” ভাই, এইডাই ফকফকা এক সুযোগ। ময়লা সাফ কইরা দিই? ”

যুবকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। তা অবলোকন করে কুটিল হাস্য আভা ফুটে উঠলো মানুষটির ঠোঁটের কোণে। সিগারেটে লম্বা সুখটান দিয়ে হালকা মাথা নাড়লো সে। অর্থাৎ ইতিবাচক সাড়া। যুবকটি আশানুরূপ ইতিবাচক সাড়া পেয়ে দা`নবীয় হেসে উঠলো। নিঃশব্দ সে হাসিতে যুক্ত হলো ওই মানুষটিও।

টিক টিক টিক..! কাউন্টডাউন স্টার্টস্………!

চলবে।

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২২

‘ দিল-এ-নাদান তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়,
আখির ইস দার্দ কি দাওয়া কেয়া হ্যায়!
– মির্জা গালিব ‘

তমসাবৃত রাত্রি প্রহর তখন। মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলা করছে চন্দ্র। বাহিরের ন্যায় এ ঘরেও নেমেছে ঘোর আঁধার। কৃত্রিম বাতি জ্বালানো হয়নি এখনো। খোলা জানালা গলিয়ে অবলীলায় ঘরে প্রবেশ করছে বহিরাগত আঁধার। বিছানায় এলোমেলো রূপে সোজা হয়ে শুয়ে উক্তি নামক রমণী। দীঘল কালো কেশে আবৃত মুখের অর্ধ ভাগ। পরিহিত শাড়িটি অপরিপাটি। দৃশ্যমান দেহের কিছু সাধারণ গুপ্ত অংশ। রমণীর চুলের ফাঁক গলিয়ে দৃশ্যমান বাম গাল, ভিজে নোনাজলে। চোখেমুখে বিমর্ষতা। কালো রঙা বিরহ আভা। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তার এই বিমর্ষ অবস্থায় একটুকরো সান্ত্বনা দেয়ার জন্য পাশে নেই কেউ। একাকী শুয়ে সে। সম্পূর্ণ একা। স্বামী মানুষটি? সে-ই গতকাল সকাল সকাল রওনা দিয়েছে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে মিনিটের জন্য কল দিয়েছিল ওকে। মৃদু কণ্ঠে জানিয়েছিল সহি সালামতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে সে। ব্যাস অতটুকুই ছিল শেষ কথা। এরপর আর কথা হয়নি। শুধু ও ওপর আল্লাহ্ জানেন বিবাহ পরবর্তী স্বামী বিহীন এই প্রথম রাতটি কতটা যন্ত্রণাদায়ক ছিল উক্তি’র জন্য। রাতভর ঘুমাতে পারেনি অসহায় মেয়েটি। অসহনীয় বেদনায় ছটফট করেছে। আঁধার মাঝে নিজের ঠিক ডান পাশেই হাতড়ে বেড়িয়েছে সে ভরসার শক্তপোক্ত পুরুষালী হাতটি। না পায়নি সে। সে-ই শক্ত হাতের ভরসা খুঁজে পায়নি। চক্ষু সয়ে যাওয়া অন্ধকারে উক্তি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল ডান পাশের শূন্য বিছানায়। দু’চোখ ছাপিয়ে নামছিল জলকণা। ঝাপসা হয়ে আসছিল দৃষ্টি। ব্যথা হচ্ছিল মাথায়। একটুখানি শান্তির ঘুমের জন্য কাতরেছে সে‌। তবে দেখা মেলেনি ঘুমের। বছরের দীর্ঘতম রাত যেন সেটিই ছিল। উক্তি’র কাছে তো তা-ই মনে হলো। দুঃখ প্রবণ সে লম্বা রাতটি অবশেষে শেষ হলো। সকাল নাগাদ আধঘন্টার জন্য বুঁজে এলো অশ্রুভেজা চোখ দু’টো। অতঃপর..? ছটফটে রাতের শেষে এলো সকাল। দুপুর পেরিয়ে বিকেল। ঠিক বিকেল নাগাদ ঘটলো আরেক অপ্রত্যাশিত অঘটন।

শাশুড়ি মায়ের কথা মোতাবেক নিকটস্থ মুদির দোকানের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিল কালো রঙা বোরকা পরিহিতা উক্তি। তার কোমল হাতের মুঠোয় বন্দী ভাতিজা জীবনের ছোট হাতটি। ধীরে সুস্থে, সাবধানে পথের একপাশ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল তারা। জীবন একাকী বকবক করে যাচ্ছিল। উক্তি আজ নিশ্চুপ। কোনো রা নেই। জীবনের কথাগুলো আদৌ শুনছে কিনা জানা নেই। শুধু হেঁটে চলেছে। এলোমেলো, অর্থহীন সে হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে আকস্মিক উক্তি থমকে গেল। দু পা যেন আঁঠার ন্যায় আঁটকে গেল জমিনে। চোখে বিস্ময়ের পাশাপাশি অশ্রুধারা! বাবা! হ্যাঁ, তার জন্মদাতা বাবা। ওই তো স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে। পথের একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাদা রঙের গাড়িটি। ড্রাইভার গাড়ির কি যেন চেক করছে। কোনো অসুবিধা হয়েছে বোধহয়। আর বাবা মানুষটি? বিকেলের মিঠে রোদেও ঘেমে যাচ্ছিল। একটু পরপর হাতে থাকা রুমালের স্পর্শে মুখে লেপ্টে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে নিচ্ছিল। আর আশপাশে এমনিই তাকাচ্ছিলো। হঠাৎই বাবা মেয়ের দৃষ্টি একে অপরেতে আটকালো। বিস্মিত নয়নে একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারা! বালক জীবন কিছু বুঝতে ব্যর্থ। সে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে কাকির দিকে তাকিয়ে। তখনো ধরে কাকির নরম কোমল হাতটি। বাবা ও মেয়ে ঠিক কতদিন পর একে অপরকে দেখলো? প্রায় সাত মাস। হ্যাঁ। ওদের বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর কায়সার সাহেবের সঙ্গে না ওর সরাসরি দেখা হয়েছে। না হয়েছে স্নেহমাখা দু’টো আদুরে কথা। আজ এতগুলো মাস বাদে দেখা। মেয়ের অভিমানী মন যে শান্ত, বাধ্য থাকতে নারাজ। মন চাইছে ছুটে গিয়ে বাবাকে শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে। তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে অজস্র অভিযোগ জাহির করতে। এত এত সুখদুঃখের কথা বলতে। পঁচা বরটার নামে শব্দহীন ভাষায় বিচার দিতে। আফসোস! সেসবের কিছুই আজ আর সম্ভব নয়। তাদের সম্পর্কের সমীকরণ যে আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো স্বাভাবিক নয়। মা সে-ই যে চলে গেল। সঙ্গে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওদের মধ্যকার সখ্যতা, ভালোবাসা। অবশ্য বাবা মেয়ের মধ্যে বিন্দুমাত্র সখ্যতা হওয়ার সুযোগ মিললোই বা কোথায়? জন্মলগ্ন হতেই তো সে দু’চোখের বি`ষ। বাবার চোখের বি`ষ। ভাইয়ের চোখের বি`ষ। অপয়া, অলক্ষ্মী এক বি`ষ সে! পুরনো কথাগুলো স্মরণে আসতেই কেমন গুমড়ে মিইয়ে গেল মেয়েটি। ত্বরান্বিত বাবা হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো জীবনের হাতটি। বড় বড় পা ফেলে এগোতে লাগলো গন্তব্য মুদির দোকানের উদ্দেশ্যে। এমনভাবে বাবাকে এড়িয়ে, অগ্রাহ্য করে চলে গেল যেন এখানে অন্য কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিলই না কোনোদিন। চলে তো গেল উক্তি। তবে থামলো কি চক্ষুদ্বয়ের বারিধারা…?!
.

পরপর দু দুটো অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ও দুঃখে কাতর উক্তি। আঁধার মাঝে শুয়ে ওই অন্ধকার ঘরে। তার দুঃখবেদনা দেখার জন্য নেই কেউ‌। কেউ নেই…!

সন্ধ্যা পূর্ববর্তী মূহুর্ত তখন। আকাশে ছড়িয়ে লালচে রঙের আলপনা। পথঘাট প্রায় নীরব। লোক সংখ্যা কমে এসেছে অনেকখানি। বিরাজমান শুনশান নীরবতা। বাতাসের উপস্থিতি ক্ষীণ। ভ্যাপসা গরমে জ্বলে উঠছে দেহ। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে বিশালাকার একেকটি গাছ। তাদের লম্বাটে ছায়ায় পথঘাট কেমন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। গা ছমছমে পরিবেশ। একাকী এমনতর রাস্তার ডান পাশ ধরে হেঁটে চলেছে মুয়ীয। বিক্ষিপ্ত হয়ে মন। দ্রুতগামী পদযুগল। চোখেমুখে রাগের আভাস। হাঁটছিল সে। হঠাৎ স্থির দাঁড়িয়ে গেল মানুষটি। চঞ্চল হলো চোখের মণি। সজাগ কর্ণ গহ্বর। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পিছু টের পাচ্ছে দ্বিতীয় কারোর উপস্থিতি। মুয়ীয আস্তে ধীরে বাঁ কাঁধ বরাবর মুখখানি আনলো। অতঃপর ঘুরে তাকালো পেছনে। চমকের আধিক্যে ঈষৎ পরিবর্তিত হলো মুখভঙ্গি! তার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে হৃষ্টপুষ্ট স্বাস্থ্যের অধিকারী একজন। লোকটির পেছনে দু সারিতে দাঁড়িয়ে ছয়জন। মোটমাট সাতজন দাঁড়িয়ে। লোকগুলোর চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের অভিসন্ধি ভালো নয়। মন্দ উদ্দেশ্যে এসেছে তারা। বড় করে দম ছাড়লো মুয়ীয। বিক্ষিপ্ত মনটিকে কিছুটা সামাল দিয়ে গমগমে স্বরে শুধালো,

” কি চাই? ”

” তোর সাড়ে সর্বনাশ। ”

ব্যাস। ও-ই ছিল দুই পক্ষের মধ্যকার সর্বশেষ কথোপকথন। পরের সময়টুকু ছিল অকল্পনীয়! অভাবনীয়! মা`রকাটারি মুহূর্ত। লোকগুলো বলা নেই কওয়া নেই আক্রমণ করে বসলো। নিজেকে রক্ষা করতে পাল্টা আঘাত আরম্ভ করলো মুয়ীয হাসান। মুয়ীয সাধারণ পরিবারের এক সাধারণ সন্তান। মা`রপিটে অভিজ্ঞ নয় সে। নয় সে সিনেমার হিরো যে কিনা সর্ব অবস্থায় নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম। স্বাভাবিক ভাবেই মুয়ীয সামান্য ধস্তাধস্তি টাইপের মা`রপিটে অভ্যস্ত। নিম্নবিত্ত জীবনধারায় এমন ধস্তাধস্তি, মা`রপিট কম হয়নি। এসব ভালোই পারে সে। অভ্যস্ত। সে-ই মতো অদক্ষ হাতে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেল মুয়ীয। কাউকে কাউকে দমন করতে সক্ষম হলো। মনে মনে বারবার পড়ে যাচ্ছিল দোয়া ইউনুস।

لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ، إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِين
উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুব’হানাকা ই’ন্নি কুনতু মিনাজ জ-লিমিন। [ সূরা আম্বিয়া: আয়াত ৮৭ ]

অর্থ: তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তুমি পবিত্র সুমহান। আমি নিশ্চয়ই জা*লিমদের দলভুক্ত।

দু পক্ষের মধ্যে তখন তুমুল আঘাত, পাল্টা আঘাত চলমান। মুয়ীয তাকে আঘাত করতে আগত ব্যক্তিকে ধরে বেদম প্রহার করছিল। ঘু`ষিতে ফাটিয়ে ফেলছিল নাকমুখ। সহসা…! ঘটে গেল লোমহর্ষক এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা! স্থির হয়ে গেল পরিবেশ। গাছের ডাল হতে উড়াল দিয়ে পালালো একঝাঁক পাখি। চারদিক তলিয়ে গেল ঘন অন্ধকারে।

শান্ত-নীরব সে ঘরটিতে শুভ্র রঙা বিছানায়… যন্ত্রনাময় এক অচেতন অবস্থায় শায়িত শ্যাম পুরুষটি। সফেদ ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে রাখা মাথার একাংশ। পড়নে হাসপাতালের আকাশী রঙা পোশাক। স্যালাইনের ক্যানোলা বিঁধে হাতের উল্টো পৃষ্ঠে। দেহে প্রবেশ করছে উপকারী স্যালাইন। শ্যামবর্ণ সে পুরুষটি তো অচেতন অবস্থায় শুয়ে। কিন্তু তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা রমণী? সে রমণীর বুকে যে উঠেছে ঝড়। অসময়ের কালবৈশাখী ঝড়। যে ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে অন্তঃস্থল। তছনছ হচ্ছে সব। উক্তি অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে শুধু। নিঃশব্দে করে চলেছে কত কি অভিযোগ। কেন? কেন তাকে এমন দহনে পোড়াচ্ছে মানুষটি। কেন তার থেকে সুন্দর বিদায় নিয়ে এমন জখম রূপে ফিরে এলো? সে তো তার মানুষটি সুস্থ সবল রূপে বিদায় জানিয়েছিল। পুরোপুরি না হলেও ঠিকঠাক চলছিল সব। তবে? এমন অপ্রত্যাশিত অঘটন ঘটলো কি করে? সে যে আর সহ্য করতে পারছে না। নিজের মানুষটিকে এমন রুগ্ন, আহত, নিস্তেজ অবস্থায় সহ্য করতে পারছে না। মানুষটি উঠুক। একটুখানি চোখ মেলে তাকাক। মুখের ভাষায় না হোক। অন্তত চোখের ভাষায় বোঝাক ‘ আমি ঠিক আছি বউ। ‘ না। কেউ বোঝালো না। নিস্তেজ মুয়ীয চোখ মেলে তাকালো না। বউকে কিচ্ছুটি বললো না। কোনোরূপ সত্য হোক কিংবা মিথ্যা.. আশ্বস্ত করলো না। তাই তো বেদনাবিধুর অশ্রুতে ভেঙে পড়লো উক্তি। শব্দহীন অঝোরে কাঁদছে সে। ডান হাতের তালুতে নাক, ঠোঁট লুকিয়ে কাঁদছে। কান্নার দমকে নড়েচড়ে, কেঁপে উঠছে শরীরটা।
.

কেবিনের বাইরে দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে স্থির হয়ে বসে মোমেনা বেগম। পড়নে কালো বোরকা। মাথা আবৃত সুতির ওড়নায়। পুরোপুরি অনাবৃত মুখশ্রী। নারীর অন্যতম ফরজ পর্দা পালন করেন না উনি। মেঝেতে হালকা ধূলোয় মাখামাখি হয়ে বসে মাঝবয়সী সে নারী। চোখেমুখে দুঃখের জলোচ্ছ্বাস। এখনো ভিজে দুই গাল। অর্থহীন দৃষ্টিতে কোথায় যেন তাকিয়ে উনি। ভয় হচ্ছে খুব। অতীতের ভয়ার্ত সে-ই মুহূর্ত মানসপটে হানা দিচ্ছে অনবরত। ভয়ে কাঁপছে অন্তর। চেঁচিয়ে কাঁদছে হৃদয়। অশান্তি অনুভূত হচ্ছে খালি।

একদিকে অজানা ভয়ে কাতর মোমেনা বেগম। অন্যদিকে স্বল্প দূরত্বে হাসপাতাল করিডোরে দাঁড়িয়ে মুন্নি, জান্নাত, মারুফ। মুন্নি উচ্চ গলায় চেঁচামেচি করে চলেছে। দোষারোপ করে চলেছে ছোট ভাবীকে। মুন্নির যুক্তিহীন ভাষ্যে ভাইয়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী ওই বোবা, ফা’লতু মেয়েটি। এভাবে পাবলিক প্লেসে বোন চেঁচামেচি করায় লজ্জিত মারুফ। সে বারবার বোনকে চুপ থাকতে অনুরোধ করছে। কিন্তু মুন্নি তা শুনলে তো। পুরনো সব ক্ষো’ভ যেন একত্রে সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে আসছে। মুন্নির কিসের এত ক্ষো’ভ ছোট ভাবীর ওপর? কোন অজানা সত্য লুকিয়ে এর পেছনে?

একটু পরপর থেমে থেমে চেঁচামেচি করে চলেছে মুন্নি। তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত মারুফ। জান্নাত কেমন অদ্ভুতভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ছোট ননদকে বাঁধা দেয়ার কোনোরূপ ইচ্ছে তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। আর মুয়ীযের বড় বোন ময়না? এমন দুঃখময়, সঙ্কটের মূহুর্তে সে কেন অনুপস্থিত? ভাইয়ের এই দুর্দিনে তার কি থাকার কথা ছিল না? আজ হঠাৎ এই হাসপাতাল করিডোরে এমন অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা ঘটছে কেন? এসবের মূল হেতু কি? উত্তর সকলের অজানা…।

দেখতে দেখতে হাসপাতালের দিনগুলো কিভাবে যেন পেরিয়ে গেল। মা ও স্ত্রীর অবিরাম সেবা-শুশ্রূষায় সর্বোপরি মহান রবের অশেষ রহমতে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে মুয়ীয। অবশেষে হাসপাতালের সে-ই যন্ত্রণাদায়ক, মানসিক ও শারীরিক অশান্তির দিনগুলোর অবসান হলো। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ পেয়েছে সে। বাড়ি ফিরেছে আজ প্রায় একমাস।

খোলা জানালা বরাবর উপস্থিত মুয়ীয। ডান হাতটি স্থাপিত জানালার গ্ৰিলে। দৃষ্টি নিবদ্ধ দূরাকাশে কিংবা কোনো অজানায়। গভীর ভাবনায় তলিয়ে মানুষটি। উদাস তার চাহনি। নিজের ওপর না চাইতেও দিনকে দিন অসন্তোষ কাজ করছে। বিরক্তি কাজ করছে। হাহাকার হচ্ছে চারিপাশে। নিজ ভাগ্যের ওপর কেমন হাসি পাচ্ছে। কি ছিল সে? আর আজ কোন অবস্থানে? এ-ই ছিল তার ভাগ্যে? এমনটা না হলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? এমনটা যে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। মুয়ীয কেন এত উদাস হয়ে পড়ছে? সে কি তবে ভুলতে বসেছে…. আল্লাহ্’র সে-ই নির্দেশ,

‘তিনি (আল্লাহ্) যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না, বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৩)

আল্লাহ্ তা’য়ালা পূর্ব থেকেই সকল সৃষ্টির তাকদীর নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ্ বলেন, ‘জলে ও স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত, তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে (ভূগর্ভের অন্ধকার স্তরে) এমন কোনো শস্যকণাও অংকুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোনো বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নাই।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৫৯)

ভাগ্য মানুষের জীবনকে সংযত করে। আল্লাহ্ বলেন, ‘এটা (ভাগ্য নির্ধারণ) এ জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার জন্য হর্ষোত্ফুল্ল না হও। আল্লাহ্ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদের।’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ২৩)

আল্লাহ্ মানুষের জন্য যা নির্ধারিত করে রেখেছেন তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। পবিত্র কোরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ্ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেনই; আল্লাহ্ সব কিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩)

মুয়ীয দিনকে দিন হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। তার বোধশক্তি, ইন্দ্রীয় হতাশায় কার্য ক্ষমতা হারাতে বসেছে। মাথার মধ্যে চেপে বসছে ভুলভাল চিন্তা ভাবনা। সে ওলোটপালোট ভাবছে। তাকদীরে ভরসা হারাচ্ছে। নিজেকে হেয়প্রতিপন্ন করছে। অকর্মণ্য ভাবছে। এই চরম দুঃসময়ে তার সঙ্গ ছাড়তে ভোলেনি সহধর্মিণী উক্তি। মা হয়তো পরিস্থিতির শিকার হয়ে কিংবা কখনো কখনো বোধহীনতার জন্য রাগ প্রকাশ করছে। আদরের পুত্রকে কটূ বাক্য বলে ফেলছে। এতে আরো ভেঙে পড়ছে মানুষটি। কাকে আঁকড়ে ধরে এই দুঃসময় অতিক্রম করবে সে, জেনেও যেন জানা নেই।

মুয়ীয যখন আবোলতাবোল ভাবনার গহীনে হারিয়ে। ঠিক সে মুহূর্তে কাঁধে পেল অকৃত্রিম ভরসার হাতখানি। চট করে ঘোর কেটে গেল। ডান পাশে তাকালো সে। কেমন নিষ্প্রাণ সে চাহনি। উক্তি’র বুকে ব্যথা হচ্ছিল। জ্বলছিল চোখ। স্বামীর এমন করুণ রূপ কোনো স্ত্রীর কাম্য নয়। সহ্য করার মতো নয় এই দুর্বিষহ দৃশ্য। তার সুস্থ সবল অর্ধাঙ্গের আজ এ কি পরিণতি? নিজের পায়ে চলা, মাথা উঁচু করে বাঁচা মানুষটা আজ…। আজ হুইলচেয়ারে। সেদিনের সে-ই অকল্পনীয় আক্রমণে মাথায় আঘাত পেয়েছিল মুয়ীয। র`ক্ত ঝড়েছিল বেশ। প্রায় ভেঙে গিয়েছিল ডান পা। মাথায় আঘাত পেয়ে রাস্তার একপাশে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল সে। শত্রুরা তখন অবিরাম লাথে, আঘাতে ভেঙে দিয়েছিল পা। আরো অঘটন ঘটতো। তবে ভাগ্যক্রমে সেখানে কোনো এক পথচারীর আগমন হয়েছিল। তাই তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও পালাতে বাধ্য হলো শত্রুর দল। সে-ই পথচারী মুয়ীযের র;ক্তাক্ত অবস্থা দেখে বেশ ঘাবড়ে যায়। দ্রুত কল করে নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে। অতঃপর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় পুলিশ। আহত মুয়ীযকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুয়ীযের মোবাইল ও ওয়ালেট মারফত যোগাযোগ করা হয় ঢাকা নিবাসী পরিবারের সঙ্গে। খবর পেয়েই ছুটে আসে উক্তি ও পরিবারের সদস্যরা। সে-ই থেকে আরম্ভ তাদের দুর্দিনের। উন্মোচন হলো এক অসাধারণ নারী সত্তার। উক্তি নামক রমণী সত্যিই সীমাহীন ধৈর্য নিয়ে জন্মেছে। সে-ই জন্ম লগ্ন হতে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়ে আসছে। এখনো চলমান তা। অসুস্থ স্বামীর দিবারাত্রি সেবাশুশ্রূষা করা, তাকে মানসিকভাবে অনবরত অনুপ্রেরণা দেয়া। এসব মোটেও সহজ ছিল না। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া একটা মানুষকে পূর্বের ন্যায় গড়ে তোলা বেশ কষ্টকর বটে। দিন নেই রাত নেই এই কষ্টকর কার্য জারি রেখেছে উক্তি। সে বিশ্বাসী। মহান আল্লাহ্’র ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। স্বামী মানুষটির এই দুরবস্থা স্বল্প সময়ের জন্য। আল্লাহ্ তাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। ইনশাআল্লাহ্ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। সে-ই আগের মতো হয়ে যাবে।

উক্তি স্বামীর পানে তাকিয়ে মুচকি হাসি উপহার দিলো। সে হাসিতে আজ বিমুগ্ধ হলো না মুয়ীয। আস্তে করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তাকালো পূর্বের ন্যায় জানালা গলিয়ে বাহিরে। উক্তি স্বামীর থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পেয়ে হতাশ হলো না। গত একমাস যাবত এটাই স্বাভাবিক, সাধারণ দৃশ্য। এতে হতাশ হওয়ায় কিছু নেই। শুরু শুরু কষ্ট হতো। কান্নায় জ্বলে উঠতো দু’চোখ। বুকের ভেতরটায় ফাঁকা লাগতো। কেমন দমবন্ধ লাগতো। ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে এমন আচরণ এখন গা সয়ে এসেছে। তবুও স্বামীকে সে-ই পূর্বের ন্যায় দেখতে উদগ্রীব তনু মন। উক্তি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় হাত নাড়িয়ে বললো,

‘ খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আসুন। খাবেন। ‘

মুয়ীয সাড়া দিলো না। উক্তি পুনরায় বললো। মুয়ীয এখনো নিরুত্তর। উত্তরের আশায় উক্তি যেই না মানুষটির কাঁধে হাত রাখলো, অমনি নিঃশব্দে হাতটা সরিয়ে দিলো মুয়ীয। শীতল কণ্ঠে বললো,

” এহান থে যা। বিরক্ত করিস না। ”

‘ কিন্তু আপনার খাবার? ওষুধ খেতে হবে তো। ‘

উক্তি হাতের ইশারায় কথাটি বললো। মুয়ীয চুপ। উক্তি আস্তে করে জিভে ঠোঁট বুলিয়ে নিলো। শব্দহীন ভাষায় বললো,

‘ খাবার এখানে নিয়ে আসি? এখানে খাবেন? ‘

অধৈর্য হয়ে তেঁতে উঠলো মানুষটা। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ উঁচুতে উঠে গেল,

” কইলাম না যা ভাগ এহান থে। কেন বিরক্ত করতাছোছ? দূর হ মোর চোখের সামনে থে। ”

চলবে।