তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-৩০

0
96

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_৩০

বাবা, ভাইয়ের কাছে কেটেছে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অথচ অবহেলিত উনিশ বসন্ত। এইচএসসি পরীক্ষার কিছুদিন পরেই জনাব মুয়ীয হাসানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো উক্তি। বিয়ের পর নতুন পরিবেশ, সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহাওয়ায় মানিয়ে গুছিয়ে নিতে বেশ সময় লেগেছিল। বিবাহ পরবর্তী জীবনে মেয়েটা তার পড়ালেখার স্বপ্ন ছেড়েই দিয়েছিল বলতে গেলে। স্বাভাবিক বটে। আজকের যামানায় অনেক মেয়েই বিয়ের পর পড়ালেখার স্বপ্ন বুনন ত্যাগ করে। বাধ্য হয় তারা। বিবাহিতা মেয়েদের আবার কিসের পড়ালেখা? এদিকে উক্তির বিয়ে হয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। যেখানে তিনবেলা ভালো খাওয়াপরা সম্ভব নয়। পড়ালেখা হবে কি করে? উক্তি তাই আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। তবে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে ওর জীবনে এক আলোকজ্জ্বল শুকতারা হয়ে আগমন হলো মুয়ীয সাহেবের। ওর ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন বড় যত্ন করে মেরামত করলেন উনি। সে অভাবনীয় আচরণে উক্তি কেঁদেছিলো বেশ। স্বামী মানুষটি সযত্নে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল ওকে। কাঁদতে দিয়েছিল। খুশির সে কান্না। অতঃপর বাড়ি বসে স্ত্রীকে অনলাইন অ্যাডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন মুয়ীয। সাজেশন, বই এগুলো যা যা আবশ্যক সবটা কিনে দিলেন। উক্তি’র আশা ছিল ঢাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্ত্রীর স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন মুয়ীয। দু’জনে একত্রে বিভোর ছিলেন ঢাবির কল্প জগতে। মাত্র অনার্স তৃতীয় বর্ষ অবধি পড়া মুয়ীয হয়ে উঠলেন উক্তির গাইড। ওর একান্ত টিউটর। ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে যথাসম্ভব ওর পড়ায় খেয়াল রাখতেন উনি। এভাবেই ভর্তি যু’দ্ধের দিনগুলো এগিয়ে গেল। ঢাবি গ ইউনিটের পরীক্ষার ঠিক দু’দিন আগে থেকে অত্যধিক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী উক্তি। গা, হাত-পা ঝ’লসে যাওয়ার মতো তাপমাত্রা। প্রচুর গরম শরীর। মেয়েটা যেন প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছিল। মুয়ীয খুব ঘাবড়ে গেল। স্ত্রীকে সুস্থ করার জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করলো। আল্লাহ্’র দরবারে দুই হাত তুলে স্ত্রীর সুস্থতা কামনা করলো। অবশেষে আলহামদুলিল্লাহ্ সুস্থ হয়ে উঠলো উক্তি। তবে মিস্ করে ফেললো ভর্তি পরীক্ষা। স্বপ্নের ঢাবি এভাবে হাত ফসকে গেল! মনে বড় কষ্ট পেল উক্তি। কাঁদলো নীরবে নিভৃতে। ভগ্ন হৃদয়ে স্বামীর পরামর্শে খ ইউনিটের পরীক্ষাও দিলো। তবে ঢাবির স্বপ্ন ততদিনে ভেঙে চুরমার। অবশেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ এক সরকারি কলেজে চান্স পেল।‌ ভর্তি হলো সেথায়। সাদরে মেনে নিলো তাকদীর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ যা করেন বান্দার কল্যাণের জন্য করেন। এ-ই মেনেই উক্তি এগিয়ে চললো সংগ্রামী জীবনে।

প্রথম বর্ষের রেজাল্ট দিবে সেইবার। রাত্রি তখন। ঠিক এবারের মতোই দুরুদুরু বুকে রেজাল্টের অপেক্ষায় বসে উক্তি। পাশে বসে স্বামী মুয়ীয। হাতে তার স্মার্টফোন। উক্তি খামচে ধরে রয়েছে স্বামীর একটি হাত। দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। ঘামের অস্তিত্ব চোখেমুখে। মুয়ীয দ্বিতীয়বারের মতো ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করেই সফলতা পেল। রেজাল্ট প্রদর্শিত হলো চোখের সামনে। যান্ত্রিক পর্দায়। উক্তি দ্রুততার সহিত রেজাল্টে একপলক চক্ষু বুলিয়ে নিলো। অতঃপর… আবেগাপ্লুত উক্তির কান্নায় ঘাবড়ে গেল না আজ মুয়ীয। বরং বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে আদর ছুঁয়ে দিলো কপাল কার্নিশে। আলহামদুলিল্লাহ্। সিজিপিএ ৩.৫৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে উক্তি। ফার্স্ট ক্লাস।

এবার উক্তির দ্বিতীয় বর্ষের রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। সিজিপিএ ৩.২৭ এসেছে। প্রথমবারের তুলনায় কম। একটু খারাপ হয়েছিল পরীক্ষা। মানসিক প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল অনেকটা। তাই এই অনাকাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট। সময়ের পরিক্রমায় উক্তি আজ বছর বাইশের এক তরুণী। উনিশের সে-ই ছোট মেয়েটা আজ সংসারী হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে মুয়ীয হাসানের যোগ্য সহধর্মিণী। পরিবারের সদস্যদের কাঙ্ক্ষিত স্নেহ, ভালোবাসায় সিক্ত সে। তবে কেউ কেউ আজো শুধরায়নি। আগের মতোই আছে। প্রচলিত এক বাক্য আছে না ‘ কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না। ‘ ঠিক তেমন স্বভাবের এরা।‌ কখনো শুধরাবে বলে মনে হয় না। হয়তো এমনই রয়ে যাবে চিরকাল। কিংবা আকাঙ্ক্ষিত বদল আসবে মানসিকতায়।

তমসাচ্ছন্ন তিমির। বিছানায় বসে উক্তি। সম্মুখে বালিশে ঠেস দিয়ে রাখা স্মার্টফোন। পাশে বসে জীবন। একাকী খেলছে খেলনা পি•স্তল নিয়ে। উক্তি ভিডিও কলে সংযুক্ত ভাবী নিশাতের সঙ্গে। নিশাত তৃপ্তির চোখে তাকিয়ে ওর দিকে।

” উক্তি বোন আমার। কনগ্রাচুলেশন। তোমার এই সাকসেস সত্যিই আনন্দের। ”

উক্তি মুচকি হাসি উপহার দিলো। নিশাত বলে চলেছে,

” সবে দুই ইয়ার গেছে। আরো দু’টো ইয়ার বাকি। সেগুলোতে নিজের সেরা পারফর্মেন্স দিতে হবে কিন্তু। তবেই না কাঙ্ক্ষিত সিজিপিএ মিলবে। ”

উক্তি হাতের ইশারায় বললো,

” জ্বি ভাবী। এবার রেজাল্ট কিছুটা খারাপ হয়েছে। ইনশাআল্লাহ্ পরেরবার সেটা পুষিয়ে নেবো। দোয়া করো। ”

” দোয়া তো সবসময়ই করি বোন। জীবনে অনেক বড় হও। সুখী হও। সফলকাম হও এই তো চাওয়া। ”

ভাবীর কথাগুলো শুনে উক্তি বেশ তৃপ্তি পেল। অন্তরে বয়ে গেল স্বস্তি।

” এই যে ম্যাডাম। থার্ড ইয়ারে কিন্তু অ্যাবোভ পয়েন্ট ফাইভ জিরো চাই। সংসারী হয়ে গেছেন বেশ। সংসার ধর্মের ফাঁকে ফাঁকে স্টাডিতে মন দিতে ভুলবেন না যেন। ”

নিশাতের নাটুকেপনায় শব্দহীন হেসে উঠলো উক্তি। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে সে-ও নাটুকে ভঙ্গিতে বললো,

” জ্বি জ্বি। আপনার হুকুম শিরোধার্য জনাবা। ”

উক্তি এবং নিশাত দু’জনে দুই প্রান্তে বসে ভিডিও কলে সংযুক্ত। উৎফুল্ল আজ তাদের মন। অকস্মাৎ ঘটে গেল এমন এক কাণ্ড যা চমকে দিলো উভয়কেই! নিশাতের ঠিক পাশে এসে বসলো মানুষটি। হাতে নিলো মোবাইল। এখন সরাসরি যান্ত্রিক পর্দায় তার মুখ দর্শন হচ্ছে। উক্তি বিহ্বল চোখে তাকিয়ে! মানুষটি মুচকি হেসে উঠলো। বললো ওকে,

” মেনি মেনি কনগ্রাচুলেশন লিটল সিস। উইশিং ইয়্যু অ্যা ভেরি গ্লোরিয়াস ফিউচার। ”

জাওয়াদের হাসিমাখা মুখে আশ্চর্যান্বিত চোখে তাকিয়ে নিশাত! জাওয়াদ! মাত্র জাওয়াদ তার নিজের ছোট বোনকে অভিনন্দন জানালো! উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করলো! এ-ও দেখার ছিল একদিন! নিশাত তড়িৎ তাকালো উক্তি’র দিকে। উক্তির বিস্ময়কর মুখখানি বড় মায়ার সৃষ্টি করছে। দেখে মনোবেদনা হচ্ছে অন্তঃস্থলে। উক্তি কিছুপল নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের দিকে। কখন যে দু’চোখ গড়িয়ে কষ্টধারা নামতে লাগলো টেরও পেল না সে। জাওয়াদ এতক্ষণ গর্বিত নয়নে বোনকে দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু যেই না বোনের চোখে অশ্রু ঝড়তে দেখলো লহমায় যেন বাস্তবতা জ্ঞান ফিরে এলো তার। আপন ছোট বোনকে ভাইয়ের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়তো স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু তাদের বেলায় যে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক এক চিত্র। সে কবেই বা হতে পেরেছিল উক্তি কায়সারের ভাই? আজ একবেলা হাসিমুখে কথা বলে, অভিনন্দন জানিয়েই বড় ভাই হয়ে গেল সে? নাহ্। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে র”ক্তলাল মরিচ গুঁড়ার প্রলেপ লাগিয়ে দিলো যেন। চট করে ভিডিও কলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ওপাশ থেকে। নিশাত অপ্রসন্ন চোখে তাকালো স্বামীর দিকে। শীতল কণ্ঠে বললো,

” কাজটা ভালো করলে না তুমি। একবেলা ঢঙ করে কখনোই উক্তির ভাই হয়ে উঠতে পারবে না। ওর মতো সুন্দরমনা মেয়ের ভাই হতেও যোগ্যতা লাগে। আনফরচুনেটলি সে যোগ্যতা তোমার নেই। ইয়্যু আর অ্যা বিগ জিরো অ্যাজ অ্যা ব্রাদার অফ উক্তি। ”

মুখের ওপর জোরসে চপেটাঘাত করলো যেন কেউ। ঝ’লসে গেল আশায় বেঁচে থাকা হৃৎপিণ্ড। করুণ চোখে তাকিয়ে জাওয়াদ। নিশাত আঙ্গুল তাক করে শাসিয়ে উঠলো ওকে,

” আমার বোন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে থাকবে। ওর চোখে আর এক ফোঁটা অশ্রু চাই না আমি। মাইন্ড ইট। ”

নিশাত তো চলে গেল সেথা হতে। জাওয়াদ রয়ে গেল একাকী ভগ্ন হৃদয়ে। ওদিকে উক্তির আহত মনটার খবর জানলো না কেউই। চার দেয়ালের মাঝে তলিয়ে গেল সে-ই যন্ত্রনাপ্রদ অশ্রুর চিৎকার।

চলমান সময়ের স্রোতে পেরিয়েছে অনেকগুলো দিন। বদল এসেছে অনেকের জীবনযাত্রায়। কোনো এক রৌদ্রস্নান দুপুর তখন। দোকানে ভীড় জমিয়েছে দু’জন ক্রেতা। তন্মধ্যে একজন আবার নারী। বোরকা আবৃত নারী। নারী হাত বাড়িয়ে কাগজের ছোট টুকরোটি দিলো দোকানদারের সহকারী কিশোর ছেলেটিকে। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে কাগজটি নিলো। তাতে লেখা,

‘ ৫০০ গ্রাম হলুদের গুঁড়া ও মরিচের গুঁড়া দেন। ‘

কিশোর ছেলেটি আকর্ষণীয় হাসি উপহার দিয়ে বললো,

” ঠিক আছে ভাবী। অক্ষুনি দিতাছি। ”

ছেলেটি দ্রুত হাতে হলুদের গুঁড়া ও মরিচের গুঁড়া পলিথিনের পাতলা ব্যাগে পুরে ফেললো। সে ফাঁকে বললো ওকে,

” ভাবী আর কিছু লাগবো? ধনিয়া? জিরা? ”

উক্তি জবাব দিতে ভুলে গেল। সে যে বেঘোরে তাকিয়ে দুই হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা তার একান্ত দোকানদারের পানে। জনাব মুয়ীয হাসান। স্বল্প দূরত্বে কানে ফোন ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সে। কারো সঙ্গে খ্যাক খ্যাক করে চলেছে। ওর ওই রাগত, বিরক্তিকর চেহারাই উক্তির মনে মাদল বাজিয়ে চলেছে। বোরকা আবৃত মুখখানিতে সরু হাসির উদয় হয়েছে। যা অজানা কারোর। মুয়ীয কথা বলতে বলতে এদিকে তাকালো। স্ত্রীর অবয়বে চোখ পড়তেই ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,

‘ কি? ‘

মোহাচ্ছন্ন উক্তি হালকা মাথা নাড়িয়ে বোঝালো কিছু নয়। মুয়ীয মাথা ঝাঁকিয়ে পুনরায় ফোনে কথা বলতে লাগলো। চট করে এক ধমকি দিলো ফোনের ওপাশের মানুষটিকে। এতেই ঘোর কেটে গেল উক্তি’র। উক্তি পেঁচা মুখ করে স্বামী হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। পঁচা লোক একটা। খালি হাউকাউ করে। একটুখানি সুন্দর করে কথা বলতে পারে না। চেঁচামেচি ই পারে শুধু।

” ঠিকই ভাবতাছেন ভাবী। ”

কিশোর ছেলেটির কণ্ঠে ঘোর কেটে গেল উক্তির। সে অবুঝ চোখে তাকালো ছেলেটির দিকে। ছেলেটি ওর দিকে স্বল্প ঝুঁকে রয়েছে। ফিসফিসিয়ে একদম গোপনতম কথা বলার ভঙ্গিমায় বলছে,

” ভাই মনে হয় ঝাল খায় বেশি। এই লেইগাই কথায় এত ঝাঁঝ। ঠিক না ভাবী? ”

বোরকার আড়ালে ফিক করে হেসে উঠলো উক্তি। হাত বাড়িয়ে পলিথিনের ব্যাগটি নিলো। মূল্য পরিশোধ করতে পাঁচশ টাকার একটি নোট দিলো। ছেলেটি চট করে ফিরতি মূল্য এগিয়ে দিলো। পরক্ষণে দ্বিতীয় ক্রেতার প্রয়োজন মাফিক হলুদ, মরিচের গুঁড়া দিতে লাগলো। উক্তি স্বামীর পানে একপলক তাকিয়ে চলে গেল সেথা হতে।‌ পেছনে রয়ে গেল চার মাস বয়সী এই গুঁড়োর দোকান। নিজস্ব পন্থায় এখানে হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া এবং অন্যান্য মশলা গুঁড়া করে বিক্রি করা হয়। দোকান মালিক মুয়ীয হাসান। এছাড়াও আরেক কর্মে বর্তমানে ব্যস্ত থাকে মুয়ীয। কি সে-ই কর্ম…? চলুন একঝলক জেনে নেয়া যাক।

.

গোধূলি বেলা। লালচে কমলা রঙে রঙিন আকাশ। পাখপাখালি দলবেঁধে ফিরছে নিজ নীড়ে। আটতলা এক অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে এসে থামলো রিকশাটি। রিকশা হতে নেমে এলো শ্যাম পুরুষটি। অতঃপর রিকশা ভাড়া পরিশোধ করে, দক্ষ দুই হাতের ভরে গ্রহণ করলো গ্যাস সিলিন্ডারের বারো কেজি ওজনের ভারী সে-ই বোতল। লালাভ রঙা যমুনা গ্যাস সিলিন্ডারটি উঁচু করে শক্তপোক্ত হাতে তুলে নিলো। পেছন হতে প্রস্থান করলো রিকশা। মুয়ীয সিলিন্ডারের বোতল হাতে প্রবেশ করলো অ্যাপার্টমেন্টের অন্দরে। ছয়তলায় এ সিলিন্ডার পোঁছে দিতে হবে তার। বর্তমানে ওই গুঁড়া দোকান ব্যতীত শহরের নিকটস্থ কিছু স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার সাপ্লাই করে থাকে মুয়ীয। রিকশা চালানো আপাতত বন্ধ। সে পথে আর চলছে না মানুষটি। সৎ পন্থায় সফলকাম হবার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। কোনো কাজই ছোট-বড় নয়। সততাই মূল ভিত্তি। সেই মনোভাবে এগিয়ে চলেছে মুয়ীয। বর্তমানে এই দ্বৈত কর্ম দ্বারা হালাল উপার্জন করছে সে। এছাড়াও ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। নিত্যনতুন সফলতার খোঁজে অনন্য কিছু করার মনোভাব বাস করে অন্তরেতে। ইনশাআল্লাহ্ আকাঙ্ক্ষিত সফলতা ধরা দেবেই একদিন না একদিন।

রাত্রি নেমেছে ধরনীর বুকে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মুন্নি। ওর রুমমেট কেয়া, খেয়া আপাতত অনুপস্থিত। মাঝের ঘরটিতে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে মুন্নি। উপুড় হয়ে শুয়ে সে। ভিডিও কলে সংযুক্ত রয়েছে কারো সঙ্গে। মেয়েটির পড়নে সালোয়ার কামিজ। ওড়নার অস্তিত্ব নেই দেহে। আশপাশে কোথাও পড়ে রয়েছে বুঝি। ফোনালাপে মগ্ন মেয়েটি টেরও পেল না দরজায় কড়া নেড়েছে কেউ। দ্বিতীয়বার নক করে সাড়া পেল না আগন্তুক। তাই তো ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলো সে। হাতে ছোট এক পিরিচ। তাতে সবজি পাকোড়া। কিছুক্ষণ পূর্বে ভাজা হয়েছে। এই দিয়ে নাস্তা করছে আজ পরিবারের সদস্যরা। উক্তি এসে মুন্নির পাশে দাঁড়ালো। মুন্নির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ডাকতে যাচ্ছিল। তখনই নজর কাড়লো অযাচিত কিছু দৃশ্য। ফোনের ওপাশে উদোমদেহী এক তরুণ। এদিকে মুন্নি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকায় অঙ্গভঙ্গি দৃষ্টিকটু। কিছুটা দৃশ্যমান বক্ষ বিভাজিকা। দু’জনে হাসিমুখে কেমন একটা ভাবভঙ্গি করে কথা বলছে। বিশেষ করে ছেলেটি। তার ভাবসাব ঠেকছে অশ্লীল। আর মুন্নি লাজে রাঙা হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে উক্তি অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলো,

‘ উঃ…! ‘

খুব কাছ থেকে বোবা স্বরে ডাকছে কেউ। তৎক্ষণাৎ ঘোর হতে ছিটকে পড়লো মুন্নি। ফোন হাতে ঘুরে তাকালো পাশে। ছোট ভাবী দাঁড়িয়ে যে! এই মহিলা এখানে আবার কি করছে। মুন্নি আস্তে ধীরে কেমন বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিমা করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ওপাশে থাকা বাবু সোনাকে বললো,

” বাবু অখন রাখতাছি গো। রুমে একখান আপদ আইছে। হেইডারে বিদায় কইরা কল দিমু নে। ঠিক আছে? ”

” চলে যাবে জান? আচ্ছা ঠিক আছে গো। নিজের খেয়াল রেখো। আর আচ্ছা মতো ঝাঁটাপেটা করে আপদ বিদায় করো। কেমন? উম্মাহ! ”

ন্যাকা কণ্ঠে কতগুলো সংলাপ ঝেড়ে দূর হতে উড়ন্ত চুমু দিলো তরুণ। মেকি লাজুক হেসে সে চুমু হাতের তেলোয় গ্রহণ করলো মুন্নি। চুমু’টা লুকিয়ে রাখলো হৃদ গহীনে। চোখের সামনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ননদ আর এক অল্প বয়সী ছোকড়ার নাটক দেখে উক্তি বাকশূন্য। আমাদের যুব সমাজের আজ এ কি অধঃপতন! এভাবে প্রকাশ্যে, ভয়ভীতিহীন মনে হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে তারা? এর সমাধান কি? এভাবেই কি তাদের ইহকাল, পরকাল বিনষ্ট হয়ে যাবে?
________

“বন্ধুরা সবাই জিএফ-বিএফ নিয়ে মাখামাখি করছে, এতে আমার কি? আমি কেন ওদের নোংরামী দেখে হতাশ হব? ওদের মতো হতে চাইব? বরং আমি নিজেকে রবের সন্তুষ্টির জন্য পবিত্র রাখব। নিশ্চয়ই আমার রব্বের ওয়াদা সত্য।”
.
এটাই হোক প্রতিজ্ঞা…
.
“আর দুনিয়ার জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখেরাতের আবাসই উত্তম। অতএব, তোমরা কি অনুধাবন কর না?” (আল আন’আম : ৩২)
.
এরূপ সাহসী যুবক-যুবতীদের প্রতিদান স্বরূপ রাসূল সল্লালাহু আলাইহিস সালাম বলেন,

“যে ব্যক্তি আমাকে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী জিনিস (জিহ্বার) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী জিনিসের (যৌ•নাঙ্গের) নিশ্চয়তা দেবে (সঠিক ব্যবহার করবে) আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দিবো৷” [বুখারী: ৬৪৭৪]

লেখক: সংগৃহীত
________

মুন্নি তার প্রেমালাপে বিরতি দিয়ে ভিডিও কল কেটে দিলো। কোনোমতে অলস দেহে উঠে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে। সঠিক হুঁশেও নেই সে। ওড়না বিহীন এতটা সময় এক গায়রে মাহরাম এর সামনে ছিল, তা যেন খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। দৃষ্টিকটু, লজ্জাজনক নয়।

” কি হইছে? মোর ঘরে কি চাই? ”

উক্তি বিছানায় রাখলো পাকোড়ার পিরিচটি। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় বলতে লাগলো। মনোযোগ দিয়ে তা দেখলো মুন্নি। বুঝতে পারলো উক্তি বলছে যে,

” তুমি এখনো এই ছেলেটার সাথে যোগাযোগ রেখেছো? ”

” হ রাখছি। হ্যাতে তোমার কি? ”

নির্ভীক চিত্তে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো মুন্নি। উক্তি বোঝানোর উদ্দেশ্যে হাত নেড়েচেড়ে বললো,

” মুন্নি ছোট তুমি। এসব প্রেম ভালোবাসার বয়স নয় এটা। ধোঁকা খেয়ে জীবন শেষ করার বয়স। হারাম সম্পর্কের ফাঁদে পা দিয়ো না প্লিজ। জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। ”

” মোর জীবনে কি হইবো না হইবো হ্যাতে তোমার কি? হা? নিজের চরকায় তেল দাও গিয়া। যাও যাও। ”

মাছি তাড়ানোর মতো বিদায় করতে চাইছে উক্তিকে। উক্তি এবার সরলতা ত্যাগ করে অভিভাবকের ন্যায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে বললো,

” তোমার ভাইয়া, মা জানলে কিন্তু চরম অশান্তি হবে। ভুলে গেলে গতবার… ”

কথাটা সম্পূর্ণ করা হলো না। মুন্নি অভব্য স্বরে বলে উঠলো,

” না না। ভুলি নাই। তোমার লেইগা মা টের পাইয়া গেছিল। মোর এই… এই ডাইন গালে থা°প্পড় মা’রছিল। আস্ত একখান ডা’কিনী তুমি। মাইনষের খালি ক্ষতিই করতে পারো। অপয়া, অলক্ষ্মী! ”

চলবে।