তোমাতেই রহিব বিলীন পর্ব-১১

0
923

#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_১১
#নিশাত_জাহান_নিশি

মুহূর্তের মধ্যে আহনাফকে ছেড়ে আমি এক দৌঁড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আহনাফের গাড়িতে উঠে বসলাম। ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে। শুধু ভালো লাগা থেকেই কি উনার জন্য এতোটা অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে আমার? নাকি এই কয়েকদিনে উনার প্রতি সত্যিই কোনো ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিলো আমার?

সেই অজানা প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দীর্ঘ দেড় বছর কেটে গেলো মাঝখানে! অনার্স ৪র্থ বর্ষে পা দিয়েছি সবেমাএ৷ বিয়েটা ঐ দিন ভেঙ্গে গেলে ও বিয়ে ভাঙ্গার সম্পূর্ণ দায়ভারটা এখনো আমার উপরেই বর্তাচ্ছে! ঐদিন আহনাফ সব বিচ্ছিন্ন করে, প্রতিটা সম্পর্ককে ছেড়ে ছুড়ে চলে গিয়েছিলেন ঠিকই তবে উনার এই ছেড়ে যাওয়ার পিছনে সব’চে কঠিন আঘাতটা পেয়েছিলাম আমি! দুনিয়ার সমস্ত রকমারী আয়োজন ফিকে লাগছিলো তখন। মনে হচ্ছিলো যেনো হাজার হাজার বছরের জন্য পৃথিবীটা থমকে গিয়েছিলো শুধুমাএ আমার জন্য। মনের কোণে জমে উঠা সুপ্ত অনুভূতিরা ও তখন নিজেদের প্রকাশ করতে না পারার তীব্র যন্ত্রণায় নির্বিকার, নির্লিপ্ত, নির্জীব হয়ে পড়েছিলো। নিজেকে হারিয়ে বসতে বসতে এখন একাকিত্বে নিজেকে বড্ড প্রিয় লাগছে। নিকষ কালো অন্ধকারটা এখন শ্বাস নেওয়ার উপযুক্ত মাধ্যম বলে মনে হচ্ছে। আলো, রোশনাই এসব আমার এখন একদমই সয় না! কেমন যেনো দম বন্ধ লাগে! শ্বাস নিতে দারুন কষ্টে ভুগতে হয়। তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম সবকিছু থেকে। ভালো থাকার জন্য অন্ধকার জগতটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। পরিবার, পরিজন, সমাজ, আত্নীয়-স্বজন সবার থেকে অনেকটা দূরেই এখন আমার বসবাস!

ঐদিন আহনাফকে এক তরফা দোষারোপ করতে পারি নি আমি! কেনো জানি না হয়ে উঠে নি আমার দ্বারা৷ বিবেকে বাঁধছিলো, দম ফাঁটা আতর্নাদ আসছিলো, অনুভূতিরা আত্নাহুতি দিচ্ছিলো, ভিতরটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আসার পূর্বেই আমি দুই পরিবারের সবার সামনে দাঁড়িয়ে বুকে অজস্র দম নিয়ে বলেছিলাম,,

“বিয়েটাতে আমি প্রথম থেকেই রাজি ছিলাম না, আহনাফকে আমার কোনো দিক থেকেই পছন্দ নয়। উনার স্বভাব, চরিএ, ব্যবহার, আচরন ও আমার অতোটা পছন্দ নয়। গোটা একটা জীবন উনার মতো একজন বদরাগী ছেলের সঙ্গে কাটানো আমার পক্ষে আদৌ সম্ভবপর নয়। আর যখন আহনাফ কোনো ভাবে এই বিষয় গুলো জানতে পারেন তখনই উনি ডিসিশান নেন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার। মূলত আমার সুখের জন্যই উনি বাধ্য হয়েছিলেন দেশ ছাড়তে। আসলে উনি আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় বিয়েটা করতে চান নি। বিয়েটা তো সারা জীবনের প্রশ্ন তাই! এই প্রথম উনি ভালো মন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। আমার ফ্রিডমনেস আমায় ষোল আনায় বুঝিয়ে দিয়ে ভালো একজন মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছেন! আমাকে মুক্ত করে গেছেন। সারাজীবনের জন্য মুক্ত হয়ে গেছি আমি। উনার এই চলে যাওয়াতে আমি ভীষণ খুশি। ভীষন ভীষন ভীষন খুশি।”

বুকে পাথর চাঁপা দিয়ে যদি ও অর্ণগল কথা গুলো বলেছিলাম, তবে ভেতরের প্রতিটা অঙ্গ প্রতঙ্গ জানে ঠিক কতোটা ক্ষতি হয়েছিলো ভেতরে। নিংড়ে আসছিলো সম্পূর্ণ ভেতরটা। ব্যাথায় ছটফট করছিলাম, তবে কেউ ভেতরটা দেখে নি আমার। না কেউ বুঝতে পেরেছিলো কতোটা বেদনায় আমি কাতরাচ্ছিলাম। আমার প্রতিটা কথার বিপরীতে আপুর হাতে পাঁচ পাঁচটে চড় খেয়েছিলাম ঐদিন। নেহাল ভাই অনেক বার চেষ্টা করেছিলেন সত্যিটা বলতে। তবে প্রতিবারই আমি উনাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। যদি ও নেহাল ভাই আপুকে একবার বলেছিলেন, “আহনাফ নিজ থেকেই কানাডায় ব্যাক করার ডিসিশান নিয়েছিলেন, ওখানে আহনাফের গার্লফ্রেন্ড আছে।” তাও আপু নেহাল ভাইয়ের কথা কানে তুলতে চান নি। কারণ, আপু জানতেন প্রথম থেকেই আমার এই বিয়েতে মত ছিলো না। নানাভাবে আমি আহনাফের বিরুদ্ধে আপুর কান ভাঙ্গিয়েছিলাম। সেই জের ধরেই আপু ধরে নিয়েছিলেন সম্পূর্ণটা আমার কারসাজি। আমার কারণেই আহনাফ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন!

দু পরিবারের সবাই খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন ঐদিন। ইয়ানাত আঙ্কেল আমার আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। প্রেশার ফল করেছিলো ঐ দিন উনার। আব্বু লজ্জায় মাথা নিচু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সবটা আমার চোখের সামনেই ঘটছিলো। আহত দৃষ্টিতে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আপুর শ্বশুড় বাড়ির প্রতিটা লোক আমাকে ছিঃ চিৎকার করেছিলেন। হৃদি আপু, শ্যামা আপু, শশী আপু, নেহাল ভাইয়ের আম্মু, আপুর ফুফু শ্বাশুড়ী যতো রিলেটিভস আছে সবাই আমাকে হেয় করছিলেন! গোটা সমাজের কাছে আমার পরিবার এবং আহনাফের পরিবার হাসির পাত্র হয়েছিলেন। দু মহল্লাতেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো আমাদের বিয়ের খবরটা। যখন বিয়েটা ভেঙ্গে যায়, তখন তো পাড়া, মহল্লায় নানা ধরনের কুৎসা রটবেই। দুটো পরিবারকে হেনস্তা হতে হবেই। আব্বু হঠাৎই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। আম্মু কথায় কথায় রাগ দেখাতেন, মাঝে মাঝে গাঁয়ে ও হাত তুলতেন। বাড়ি থেকে বেরুলেই পাড়ার লোকজনদের কড়া সমালোচনা সম্মুখীন হতে হতো। এর মধ্যেই আবার নেহাল ভাইয়ের হুটহাট কল করা। রাত বিরাতে দেখা করতে চাওয়া, কথা বলতে চাওয়া ভীষণ বিরক্তিকর ঠেঁকছিলো আমার। নিতে পারছিলাম না এতোসব যন্ত্রণা একসাথে। মানসিক চাঁপে অত্যধিকভাবে জর্জরিত হয়ে পড়ছিলাম। অবস্থা মৃত্যুসম ছিলো! নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে বাধ্য হয়ে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে আমি কলেজ হোস্টেলে উঠি। পরিবার, আত্নীয়-স্বজন, সমাজ সবার দৃষ্টির অগোচড়ে চলে আসি। তিস্তার সাথে হোস্টেলে পার্মানেন্ট হয়ে যাই!

পড়ালেখার খরচ যদি ও আব্বু বহন করছেন, তবে আমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা, যোগাযোগ করা উনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আম্মুর সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। যদি ও কলটা আমার তরফ থেকেই যায়! বিনা প্রয়োজনে আম্মু কল করেন না। মেয়ে যে তাদের সম্মান রাখতে পারেন নি, কোন খাতিরে উনারা আমার সাথে কথা বলবেন? আমার খোঁজ খবর রাখবেন? জিজু মাঝে মধ্যে হোস্টেলে আসেন। আমার সাথে দেখা করে যান। যাওয়ার সময় বিভিন্ন গিফটস, নাশতা, চকলেট, আইসক্রীম দিয়ে যান। জিজুর আসা যাওয়ার ব্যাপারে অবশ্য আপু কিছু জানেন না। যদি জানেন, তাহলে হয়তো জিজুর সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিবেন!

নেহাল ভাই ৬ মাস পূর্বে কানাডা ব্যাক করেছেন! প্রায় দুবার উনি আমাকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছিলেন। প্রতিবারই আমি উনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কোনো কারণ জানাই নি। শুধু বলেছিলাম, “এখনি বিয়ে করতে চাইছি না।” প্রতিবার ব্যর্থ হয়ে উনি বিষন্ন মনে পিছু ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে আক্রমনাত্নক কোনো মনোভাব উনার মধ্যে দেখি নি। কানাডা ব্যাক করার পূর্বে একদিন দেখা করেছিলাম নেহাল ভাইয়ের সাথে। জানতে চেয়েছিলাম, “আহনাফ কেমন আছে? বিয়ে করে স্যাটেল্ড হয়ে গিয়েছেন তো?” নেহাল ভাই কেবল রহস্যময় হাসি হেসেছিলেন৷ প্রতিত্তুরে কিছু বলেন নি! আমি ও জানার আগ্রহ প্রকাশ করি নি। হয়তো উনার প্রতিত্তুরে ভীষণ আঘাত পেতে হবে! জেঁচে কে আঘাত চায় বলুন?

,
,

আজ বিকেলটা একটু অন্যরকম। অন্যদিনের মতো অতোটা স্বাভাবিক নয়। কারণ আমার সামনেই আপু এবং আব্বু বসে আছেন। দুজনই গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। চোখ তুলে উনাদের দিকে তাকানোর সাহসটা পর্যন্ত কুলোতে পারছিলাম না আমি। তাই মাথা নিচু করে থাকাটাই আপাতত শ্রেয় মনে করছি। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আব্বু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,,

“বাড়ি ফিরবে না তুমি? এই ভাঙ্গা চূড়া ছোট্ট খোঁপড়ীর মতো রুমটাকেই নিজের বাসস্থান হিসেবে ধরে নিয়েছ?”

মাথা তুলে আব্বুর তুলে তাকালাম। স্থির দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে চেয়ে বললাম,,

“কোথায় যাবো? আমার কি আদৌ কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা আছে?”

“বাড়ি ফিরে চলো। দেড় বছর অনেক হয়েছে। আমি এবং পল্লবী তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে এসেছি!”

পল্লবী আপু ও এবার আব্বুর সঙ্গে সুর মিলেয়ে তটস্থ কন্ঠে বললেন,,

“বাড়ি ফিরে চল। অনেক হয়েছে মান অভিমান। সবাইকে ছেড়ে নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।”

“একা থাকতেই স্বস্তি বোধ হচ্ছিলো। তবে তোমরা এসেছ, হয়তো ফিরিয়ে দিতে পারব না!”

“সামনের সপ্তাহে হৃদির বিয়ে। শ্বশুড় আব্বু তোকে হৃদির বিয়েতে দেখতে চাইছেন।”

কেনো জানি না মনটা আনচান করে উঠল। অজানা কোনো সম্ভাবনায় অন্তঃকরনের আশপাশটা দ্রুত গতিতে কাঁপতে আরম্ভ করল। কৌতুহল বশত জানতে ইচ্ছে হলো,

“আহনাফ কি আসবেন বিয়েতে?”

মনের সব কথাকে প্রশ্রয় দিতে হবে কেনো? মন যা বলবে তাতেই কেনো সায় দিতে হবে? চুপচাপ আমি আপুর কথা মেনে নিয়ে আপুকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“বাড়ি ফিরে গেলে তোমাদের আবার মান সম্মান খোঁয়া যাবে না তো?”

মুহূর্তের মধ্যে আপু নাক, মুখ কুঁচকে আমার মাথায় গাড্ডা মেরে বললেন,,

“খুব বড় বড় কথা শিখে গেছিস তাই না? ভুল তো করবি করবিই আবার গলা উঁচিয়ে কথা ও বলবি? ঐ দিনের পর থেকে আহনাফের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই আমাদের। আহনাফ কথাই বলতে চাইছে না আমাদের সাথে। ভেবে দেখ, ছেলেটা কতো কষ্ট পেয়েছে!”

নিশ্চুপ থেকে আমি ব্যাগপএ গুছিয়ে আব্বু এবং আপুর সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। হোস্টেল ম্যানেজারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আব্বু আমায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তিস্তার জন্য মনটা খুব খারাপ করছিলো। আর একসাথে থাকা হবে না হয়তো! সুখ, দুঃখের বন্টনটা ও স্থগিত হয়ে যাবে বোধ হয়।

,
,

হৃদি আপুর বিয়ের ঠিক তিন দিন পূর্বেই আমরা নেহাল ভাইদের বাড়িতে এসে শিফট হলাম। আপুর শ্বশুড় বাড়ির সব আত্নীয়, স্বজন নেহাল ভাইদের বাড়িতে বিয়ের চারদিন আগেই উঠে গেছেন। বিয়ে বাড়ি খুব জমজমাট৷ আত্নীয়-স্বজনদের রোল পড়ে গেছে। সবাই আমাকে হেয় চোখে দেখলে ও নেহাল ভাইয়ের আম্মু এবং হৃদি আপু আমায় ভীষণ আগলে রেখেছেন। ইয়ানাত আঙ্কেল সব ভুলে আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আগে যেমনটা ভালোবাসতেন এখনো ঠিক তেমনটাই ভালোবাসছেন।

নেহাল ভাইদের বাড়িতে আসার পর থেকে ভীষণ চুপচাপ থাকার চেষ্টা করছি। কোনো কিছুতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না আমি। খুব নিরাগ নিরাগ লাগছে। সারাক্ষণ রুমে বন্ধী হয়ে থাকছি। কেনো জানি না, লোকজনদের সাথে মিশতে এখন একদমই ভালো লাগে না। কথাবার্তা, হাসাহাসি সবকিছুই এখন বড্ড বিরক্তির ঠেঁকে। শব্দ দূষণ মনে হয়! রুমে নিসঙ্গ বসে থাকতে ও আজ কেনো জানি না ভীষণ অস্বস্তিকর ঠেঁকছে। অতঃপর দম বন্ধকর পরিস্থিতি এড়াতেই আমি বিকেলের দিকে ছাঁদে উঠে এলাম। ছাঁদের প্রতিটা আনাচে কানাচে বিভিন্ন বাগান বিলাসের সমারোহ। গাঁদা, গোলাপ, ডালিয়া, শিউলি, ফুলের ঘ্রাণের পুরো ছাঁদটা ম ম করছিলো৷ কমলা রঙ্গের সূর্যটা ও পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। একটু পরেই বুঝি সন্ধ্যা নেমে আসবে। বিস্তীর্ণ লালচে আকাশটা আজ নীলে নীলে ছেঁয়ে আছে। চোখ ফেরানোই দায় হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে করতে ছাঁদের ডান পাশে থাকা দোলনাটায় চড়ে বসলাম। সাথে সাথেই দমকা হাওয়া এসে দেহ, মনকে বেসামাল ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো৷ দুপাশে ঝুলে থাকা খোলা চুল গুলো ও বাতাসে দোল খেতে আরম্ভ করল।

ছাঁদের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ড্রইং রুম থেকে শুনছিলাম, নেহাল ভাই আসবেন। এয়ারপোর্টে আছেন। একটু পরেই হয়তো বাড়ি এসে পৌঁছাবেন। তবে কারো মুখে আহনাফের কথাটা একবার ও শুনি নি! কেউ উনার নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করছেন না। তবে কি উনি আসবেন না? আমি যে চোখে এক সাগর তৃষ্ণা নিয়ে উনাকে এক পলক দেখার জন্যই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম তা কি উনি কখনো বুঝবেন না? উনাকে একটু ছোঁয়ার আশায় যে চাঁতক পাখির মতো তাড়পাচ্ছি তা কি উনি আদৌ বুঝবেন না? উনাকে ঘিরে আমার মনে যে তীব্র প্রখর অনুভূতি গুলো বাসা বেঁধেছে সে বাসার পাকাপোক্ত একটা নীড় হয়ে কি উনি ফিরে আসবেন না? নাকি তনিমাকে বিয়ে করে উনি কানাডাতেই স্যাটেল্ড হয়ে গেছেন? সত্যিই কি উনি তনিমাকে ভালোবাসতেন? নেহাল ভাই ঐ দিন কেনো কিছু বললেন না? কেনো মৌণ থেকেই কানাডা ফিরে গেলেন? ইদানিং তো দেখছি নেহাল ভাই ও আমায় কল করছেন না। কেউ আহনাফ সম্পর্কে আমায় কোনো খবর ই দিচ্ছেন না। কি চলছে তবে আমার অগোচড়ে?

এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই ছাঁদে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেলাম। কারো ধপাধপ পায়ের শব্দ আমার কর্ণকুহরে খুব কঠিন ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে পিছু ফিরে তাকাতেই হাসোজ্জল মুখে নেহাল ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কোঁমড়ে দুহাত গুজে নেহাল ভাই কুঁজো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অনবরত দম নিচ্ছেন আর হাঁফিয়ে উঠা কন্ঠে বলছেন,,

“হেই? তুমি এখানে কি করছ?”

বিস্মিত ভঙ্গিতে দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। এক ছুটে নেহাল ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি অস্থির কন্ঠে উনাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,

“আহনাফ আসেন নি?”

“আহনাফের জন্য ওয়েট করছিলে?”

“বলুন না? আহনাফ আসেন নি?”

“আহনাফ তো আসে নি!”

তব্ধ শ্বাস ছেড়ে আমি মাথা নিচু করে পুনরায় দোলনায় গিয়ে বসলাম। এই মুহূর্তে আমি অনুভূতি শূন্য। বেহায়া মনকে বুঝাচ্ছিলাম, “এতো আশা করিস কেনো?” আশা ছাড়তে পারিস না? যে তোর না, তাকে নিয়ে এতো ভাবিস কেনো? আত্নসম্মানবোধ নেই তোর? তোর ও কি অবস্থান ঐ অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মতো? ক্লান্ত হতে পারিস না তুই? একটু তো ক্ষান্ত হতে পারিস। বিশ্রাম তো তোর ও প্রয়োজন তাই না? আশা ছেড়ে দে প্লিজ। তবেই ভালো থাকতে পারবি!

চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়াতেই মনে হলো সেই চির কাঙ্ক্ষিত চেনাকন্ঠি স্বরটা আমার কর্ণকুহরে খুব মধুরভাবে প্রতিধ্বনিত হলো। দম ফাঁটা শ্বাস ছেড়ে আমি পিছু ফিরে তাকাতেই তব্দিত ভঙ্গিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আহনাফ স্বয়ং আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে উনি আমার দিকে নয় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ব্ল্যাক টপস পরিহিতা সুন্দুরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে খুব হেসে হেসে কথা বলছেন। মেয়েটা মৃদ্যু হেসে আহনাফের হাতে হাত রেখে বলছেন,,

“রিয়েলি ইয়ার৷ নেহালদের বাড়ির ছাঁদটা সত্যিই নজর কাড়ার মতোন।”

“ইয়েস। তাই তো ফার্স্টেই তোকে ছাঁদে নিয়ে এলাম।”

নেহাল ভাই আমার পাশ থেকে সরে এসে অট্ট হেসে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“হেই আহনাফ? একটু এদিকে ও তাকা। ছাঁদে কিন্তু একটা ফুটন্ত গোলাপ ও দাঁড়িয়ে আছে। তোর অপেক্ষায় মুর্ছে যাচ্ছে যে। কেয়া ইয়ার? কৃপা করে একটু নজর তো দে!”

আহনাফ হাসি থামিয়ে নেহাল ভাইয়ের দিকে নজর দিতেই সেই নজরটা দুর্ভাগ্যবশত তিন ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার উপর পড়ল। আহনাফের স্থির দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমার চোখ দুটো বেসামাল হয়ে পড়ল। দৃষ্টি জোড়া সংকুচিত করে আমি তড়িৎ গতিতে মাথা নিচু করে নিলাম। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো সবেমাএ শান্তির দেখা পেলো। বিষাদের সুর গুলো অনুরাগে মধুর রাগিনী তুলছিলো। মনে হলো থমকে থাকা পৃথিবীটা যেনো মুহূর্তের মধ্যে নতুন উদ্দমে আবারো পুর্নজীবিত হলো। এই বুঝি খুশিতে হতবিহ্বল হয়ে আমি দম আটকে মরেই যাবো! বাঁচার আশা সত্যিই দুরাশা হয়ে পড়েছে!

অচেনা মেয়েটাকে আহনাফের সাথে দেখে বিন্দু পরিমান খারাপ লাগা কাজ করছে না আমার। শুধু এই ভেবেই শান্তি লাগছে যে, উনাকে তো একটা পলকের জন্য দেখত পেলাম! এই বা আমার জন্য কম কিসের?

ইতোমধ্যেই চারদিকে মাগরিবের আযান পড়তে আরম্ভ করল। নেহাল ভাই এবং ঐ মেয়েটার ফিসফিসানির আওয়াজ আমার কানে মিহি ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। ফিসফিসিয়ে উনারা কিছু বলছিলেন। এর মধ্যে হুট করেই মেয়েটা অনর্গল কন্ঠে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,,

“হেই প্রভা। তোমাকেই তো এতোক্ষণ খুঁজছিলাম!”

উদ্বেলিত দৃষ্টিতে আমি সামনে ফিরে তাকাতেই খেয়াল করলাম আহনাফ হাত দিয়ে দুজনকে ইশারা করে বলছেন ছাঁদ থেকে নামতে। নেহাল ভাই মেয়েটার মুখ চেঁপে ধরে জোর করে মেয়েটাকে টানতে টানতে ছাঁদ থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন। মেয়েটা ও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই যেনো ছাদ থেকে নামতে চাইছেন না! নেহাল ভাইয়ের সাথে অবিরত ফাইটিং করে চলছেন। মুখ ফুটে কিছু বলার জন্য ছটফট করছেন।

নেহাল ভাই এবং মেয়েটা ছাঁদ থেকে নিশ্চিহ্ন হতেই আহনাফ প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে ভীষন গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে এক পা দু পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করলেন। ঠোঁটের আলিজে উনার এক প্রকার দুষ্টু হাসি লেগে আছে। প্রকান্ড চোখে আমি শুকনো ঢোক গিলে কুন্ঠা, উদ্বিগ্নতা এবং জড়তা নিয়ে পেছনে হটতে লাগলাম। দোলনার সাথে এডজাস্ট হয়ে দাঁড়াতেই আমার অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠল। এবার কোন দিকে যাবো আমি? ওয়ে খুঁজে পাচ্ছিলাম না পালানোর! ঐদিকে আহনাফ আমার থেকে মাএ এক ফুট দূরত্বে অবস্থান করছেন। চোখের পলকেই হয়তো এক ফুট দূরত্বটা ও এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কপালে কয়েক দফা ভাঁজ ফুটিয়ে আমি আহনাফের ঐ নেশাক্ত দু চোখে তাকিয়ে কম্পিত কন্ঠে বললাম,,

“সামনে থেকে সরুন। এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো?”

মুহূর্তের মধ্যেই আহনাফ সমস্ত দূরত্ব নিশ্চিহ্ন করে আমার গাঁয়ের সাথে একদম চিপকে দাঁড়িয়ে আমার মুখে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে ফিসফিসে কন্ঠে বললেন,,

“আহনাফ শেখকে কতোটা ভয় পাও দেখছিলাম! আশ্চর্যের বিষয় কি জানো? ভয় পাওয়া চেইক করতে গিয়ে অজান্তেই তোমার বুকের হার্টবিটের আওয়াজ শুনতে পেলাম! আচ্ছা? আওয়াজটা কি আদৌ ভয় থেকে? নাকি অন্য কোনো রিজন আছে?”

দম নিলেন উনি। মুখ থেকে নির্গত হওয়া উনার প্রতিটা তপ্ত শ্বাস আমার শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায় অদ্ভুত এক মন মাতানো শিহরণ জাগিয়ে তুলছিলো। মন কাননে বাহারী রঙ্গের সব প্রজাপতিরা পাখা ঝাঁড়ছিলো নিঃসংকোচে। এক ঝাঁক জোনাকীর আলোয় বোধ হয় তমসা এবং বিষাদের নীল রঙ্গে ঢাকা মনের শহরটা মিটমিটে আলোর দিশা খুঁজে পাচ্ছিলো। বাতাসে বাহারী ফুলের চাঁপা ঘ্রাণ ভেসে আসছিলো। পুষ্প কাননে সদ্য ফোঁটা ফুলের কুঁড়িরা কানে কানে যেনো বলছিলো,,

“বসন্ত এসে গেছে!”

সমস্ত অনুভূতিকে মনের গুপ্ত কোটরে তালাবন্ধি করে আমি অকপট রেগে আহনাফের দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“নাটক করতে এসেছেন? দেড় বছরে ও নাটক শেষ হয় নি?”

আচমকা আহনাফ বাঁকা হেসে হেয়ালী কন্ঠে বললেন,,

“নাটকের লাস্ট মোমেন্টে দাঁড়িয়ে আছি। নাটকের মূল চরিএ, “তনিমা ও এসে গেছে!”

“মানে? ঐ মেয়েটা তনিমা ছিলো?”

“উহু। তনিমা নয়। তনিমা ভাবী হবে!”

কন্ঠ জড়িয়ে আসছিলো আমার। অজানা এক ভয়ে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসার পূর্বেই আমি টাল মাটাল কন্ঠে আহনাফকে বললাম,,

“ভাভাভাবী?”

আহনাফ চশমার ফ্রেমটা উপরের দিকে টেনে বাঁকা হেসে বললেন,,

“আলবাত ভাবী! উডবি ভাবী!”

“কাকাকার উডবি?”

আহনাফ রহস্যময়ী হাসি টেনে বললেন,,

“এখনি বলতে পারছি না কিছু। হ্যাঁ, তবে সময় হলে সবটাই চোখের সামনে দেখবে।”

আযানের মধুর ধ্বনিতে চারপাশটা মুখরিত হচ্ছিলো ঠিকই, তবে আমার মনে বাজছিলো বেদনার সুর। খুব তিতা, তিক্ত এই সুর। কোনো ব্যক্তিই চাইবে না স্ব-ইচ্ছায় সেই বেদনার সুরকে আপন করে নেওয়ার। বিশ্বাস করুন, আমি চেষ্টা করছিলাম কান্না চেঁপে রেখে যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকতে। তবে কন্ঠনালী থেকে হু হু করে শব্দে বিষাদের সুর নির্গত হচ্ছিলো খুব মর্মান্তিকভাবে। জানি না, আমার সামনের মানুষটা সেই নিরাগের সুর শুনতে পাচ্ছিলেন কিনা। আদৌ আমার দিকে উনার ধ্যান আছে কিনা। ইতোমধ্যেই মনে হলো কেউ আমার উড়নায় হাত দিয়েছেন। উড়নায় সামান্য টান অনুভব করছিলাম। অশ্রুসিক্ত চোখে আমি অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অবলোকন করতে পারলাম, আহনাফ ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ফুটিয়ে আমার মাথায় ঘোমটা টেনে দিচ্ছেন। সম্পূর্ণ ঘোমটটা আমার মাথায় টেনে দিয়ে আহনাফ মুগ্ধ নয়নে আমার দুচোখে চেয়ে বললেন,,

“কি দরকার ছিলো ঐ দিন আমাকে সেইফ করার? সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার? খুব মহান হতে চাইছিলে? আমাকে তোমার বিবেকের কাছে ছোট করে?”

#চলবে….?