#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( অষ্টম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১০>
তবে এইসবের ভিড়ে ধীরে ধীরে পুজো এগিয়ে এসেছে শহরে। আজ চতুর্থী। পাড়ায় প্যান্ডেল বাঁধা প্রায় কমপ্লিট। নাটকের স্টেজও রেডি। শুধু আলো ঝারবাতিগুলো লাগানো হচ্ছে এদিক ওদিক। আর দিনটা রবিবার বলে সবার ছুটি, তাই পাড়ার ছেলে মেয়ে, কমিটির সব লোকেরা এসে ভিড় করেছে মণ্ডপে। একটা স্টেজ রিহার্সাল ও হচ্ছে অস্মিতাদের নাটকের। অস্মিতা সেই রিহার্সালের মাঝেই কিছুটা আনমনে দাঁড়িয়েছিল প্যান্ডেলে। এই সিনগুলোর রিহার্সাল শেষ হলে ওদের গানের রিহার্সাল শুরু হবে। এইসবই ভাবছিল আনমনে। তবে ও খেয়াল করেনি যে কিছুক্ষণ আগে লাগানো ঝাড়বাতি গুলোর মধ্যে ওর মাথার ওপরে যেটা ঝুলছে তার বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। এদিকে পাড়ার সবাইও নিজের নিজের কাজে ব্যাস্ত ছিল বলে কেউ আর এটা খেয়াল করেনি। অস্মিতা তো নিজের মনে দাঁড়িয়েছিল স্থিরভাবে। শুধু অর্ণব স্টেজ থেকে অস্মিতাকে দেখতে দেখতে খেয়াল করেছিল ওর মাথার ওপরের ঝাড়বাতিটা। আর এই দৃশ্য দেখে অর্ণব প্রায় পাগলের মতন দৌড়ে এসে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল অস্মিতাকে ওই জায়গাটা থেকে। কিন্তু ওকে বাঁচাতে পারলেও ছেলেটা নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। ঝাড়বাতিটা সোজা এসে পড়েছিল অর্ণবের ডান হাতে আর কাঁধে। টুকরো টুকরো কাঁচ এসে সঙ্গে সঙ্গে গেঁথে গেছিল অর্ণবের গায়ে। ছেলেটা যন্ত্রণায় রক্তাক্ত হয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। তবে অস্মিতার চোখের পলকেই যেন সবটা ঘটে গেল। অর্ণব ওকে আচমকা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়ার পরই ওই অতো বড় ঝাড়বাতিটা এসে পড়লো ছেলেটার ওপর। দৃশ্যটা দেখে কয়েক সেকেন্ড থমকে গেছিল অস্মিতা। তারপরই অর্ণব বলে চিৎকার করে দৌড়ে গেছিল ওর কাছে। ততক্ষণে প্যান্ডেলে থাকা প্রত্যেকটা লোক ছুটে এসেছে অর্ণবের জন্য। তারপর ধরাধরি করে কোনভাবে ঝাড়বাতিটা সরিয়ে অর্ণবকে বার করেছিল সবাই। ততক্ষণে ওর সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে গেছে। টুকরো টুকরো কাঁচ ওর কাঁধে হাতে বিঁধে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। আর ছেলেটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে সেই যন্ত্রণার মধ্যে। অস্মি তার চোখ দুটো ভিজে এলো হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে। ওকে বাঁচাতে গিয়ে অর্ণব শেষে নিজের এত বড় একটা ক্ষতি করলো! এইভাবে হার্ট করলো নিজেকে! কেমন যেন মেলাতে পারছিল না কিছু অস্মিতা এরপর। তবে আজ অনেকদিন বাদে এই ছেলেটার জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, মন থেকে।
সেদিন এরপর অস্মিতা পাড়ার সবার সাথে হসপিটাল গেছিল অর্ণবকে নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ ইমার্জেন্সির বাইরে অপেক্ষা করার পর ডাক্তার এসে বলেছিল,
———-” পেশেন্টের ডান হাত আর কাঁধ খুব এফেক্টড হয়েছিল। যাইহোক আমরা কাঁচের টুকরো সব বার করে ড্রেসিং করে দিয়েছি। আর ইন্টারনাল কোন ইনজুরি নেই। তাই ভয়ের কারণ নেই। তবে আজকের রাতটা অবজারভেশন এ রাখলে ভালো হতো, কিন্তু এদিকে বাস এক্সিডেন্ট হয়েছে দুটো। তাই এখন পেশেন্টের খুব চাপ। সেই জন্য সেরকম ক্রিটিকাল পেশেন্ট ছাড়া এডমিট করা হচ্ছে না। আপনারা ওনাকে এখন বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। তবে রাতে কিন্তু খুব জ্বর আসতে পারে। এতটা ব্লিডিং হয়েছে তো! একটু খেয়াল রাখবেন। আর কাল বিকেলের মধ্যেও যদি টেম্পারেচার না কমে তাহলে এডমিট করতে হতে পারে। ”
কথাগুলো বলেই উনি চলে গেছিলেন। এরপর আরোও কিছুটা সময় পার করে একজন নার্স হুইল চেয়ারে করে নিয়ে এসেছিল অর্ণবকে। ব্যান্ডেজের ওপর দিয়ে কোনভাবে শার্টটা গলিয়ে দেয়া হয়েছিল ছেলেটাকে। সারা শরীর, মুখ চোখে ক্লান্তি আর নিস্তেজ ভাব ছিল অর্ণবের। দেখে মনে হচ্ছিল ভীষণ ধকল গেছে শরীরে। আর তার ওপরে কিছু ওষুধ ইঞ্জেকশন পড়ায় আরোও যেন ঝিমিয়ে ছিল ছেলেটা। অস্মিতার এটা দেখে কেমন কষ্ট হচ্ছিল মনে। আজ এই হুইল চেয়ারে তো ওর থাকার কথা ছিল! সেই জায়গায় অর্ণব নিজের ওপর সমস্ত যন্ত্রণাগুলো নিয়ে নিল! কথাটা ভেবেই কেমন এলোমেলো লাগছিল সব কিছু।
যাইহোক, এরপর অর্ণবকে পাড়ার সবাই মিলে ওর বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু অস্মিতার যেন মনটা অস্থির ছিল সারাক্ষণ। নিজের ঘরে এসেও চিন্তাটা ঠিক যাচ্ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল অর্ণব একা। ওর বাড়িতে যদি মা বাবা বা দেখার কেউ একজন থাকতো তাহলে এতটা চিন্তা হতো না! কিন্তু একটা কেউ তো নিজের লোক নেই। পাড়ার লোক আর কতক্ষণ থাকবে! এরপর রাতে যদি খুব জ্বর আসে, কে দেখবে ছেলেটাকে! প্রশ্নগুলো যেন ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে। তবে না, এরপর আর ও চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকতে পারলো না! আজ ওকে বাঁচাতে গিয়েই ছেলেটার এই পরিস্থিতি। অস্মিতা এই সময় কিছুতেই নিজের রাগ নিয়ে দূরে সরে থাকতে পারবে না।
কথাগুলো ভেবেই সেদিন ও নিচে ড্রইং রুমে এসে মা বাবাকে বলেছিল,
———–” আমি অর্ণবের বাড়ি যাচ্ছি। আজ রাতে ওখানেই থাকবো। ”
কথাটা শুনে অস্মিতার মা অবাক হয়ে বলেছিল,
———–” কি! সারা রাত! ”
তবে ওনার কথাটাকে শেষ হতে না দিয়ে অয়নবাবু নিজে বলে উঠেছিল,
———–” তুই যা। কোন অসুবিধা নেই। ”
কথাগুলো শুনে অস্মিতা আর এক মিনিটও অপেক্ষা করেনি। ও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে অস্মিতার মা বলে উঠেছিল,
———–” তুমি হ্যাঁ কি করে বললে? একটা সমর্থ্য মেয়ে সারা রাত একটা ছেলের বাড়ি থাকবে! মানছি অর্ণবকে দেখার কেউ নেই। কিন্তু! ”
ওনার কথাগুলো শেষ হতেই অয়নবাবু এবার শান্ত গলায় বলে উঠেছিল,
———–” পুরনো ভুল আর আমি করবো না শ্রীমা। তোমার মেয়ে ভালোবাসে ওই ছেলেটাকে। আর অর্ণব ও ভীষণ ভালোবাসে অস্মি তাকে। ওদের দুজনের মধ্যে যে অভিমানের পাহাড় তৈরি হয়েছে আমার জন্য, সেটা যদি এইভাবে বিপদের দিনে পাশে থেকে কেটে যায়, তাহলে আমি কেন আটকাবো মেয়েকে! আর অর্ণবের শরীরের এই অবস্থা অস্মিতাকে বাঁচাতে গিয়েই হয়েছে। তাই এখন ওর পাশে থাকা উচিত। ”
কথাগুলো বেশ জোর গলায় বলেছিলেন উনি। অস্মিতার মা ও এরপর আর কিছু বলতে পারেনি।
চলবে।