তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো পর্ব-০৯

0
4

#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( নবম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১১>
তবে সেদিন অস্মিতা যখন অর্ণবের বাড়িতে গেছিল, ভিতর থেকে পাশের বাড়ির মল্লিক কাকু বেরিয়ে আসছিলেন। ওনাকে দেখে অস্মিতা সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করে উঠলো,
———” মল্লিক কাকু, অর্ণব কেমন আছে এখন? ”
এই প্রশ্নে উনি বেশ ম্লান স্বরে বলেছিলেন,
———-” ভীষণ জ্বর ছেলেটার। এমনকি জ্বরের ঘোরে সমানে ভুল বকছে। সত্যি, যদি এই সময় বাড়িতে কেউ একজন থাকতো! এদিকে তোমার কাকিমার খুব শরীর খারাপ। তাই আমিও সারা রাত থাকতে পারবো না! ”
কথাগুলো নিজের মনেই বলেছিলেন উনি। কিন্তু অস্মিতা এবার আস্তে গলায় বলে উঠলো,
———” আমি থাকবো কাকু অর্ণবের সাথে সারা রাত। তুমি চিন্তা কোরো না। বাড়ি যাও। ”
কথাটা শুনে উনি যেন বেশ নিশ্চিন্ত হলেন।
সেদিন এরপর অস্মিতা যখন অর্ণবের ঘরে এসেছিল, ছেলেটার ধুম জ্বর। জ্বরের ঘোরে রীতিমত কাঁপছে আর ভুল বকছে অর্ণব একেবারে নিস্তেজ হয়ে। অস্মিতা আজ সেটা দেখে অনেকদিন বাদে খুব কাছে গেছিল অর্ণবের। কপালে হাত ছুঁইয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিল অর্ণবের শরীরের উষ্ণতা। সত্যিই জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার। অস্মিতা এটা দেখে আর দেরি না করে একটা জল ভর্তি বাটি আর রুমাল জোগাড় করে নিয়ে এসেছিল জলপট্টি দেবে বলে। তারপর প্রায় সারা রাত ধরে সেই ভিজে রুমাল দিয়ে জলপট্টি দিয়ে গেছিল অর্ণবের কপালে। তবে অর্ণব আজ জ্বরের ঘোরে অনেক কিছু বলছিল অবচেতনে। আসলে অস্মিতাকেই খুঁজছিল যেন ও সারাক্ষণ। এতদিনের দূরত্ব, খারাপ লাগা, যন্ত্রণা, সব মিলিয়ে ছেলেটা ভীষণ ক্লান্ত মনে বার বার অস্মিতার নাম ধরে ডেকে যাচ্ছিল। অস্মিতাএই সময় অর্ণবকে শান্ত করার জন্য ওর হাতটা ধরে বলছিল,
———–” অর্ণব আমি এখানেই আছি। কোথাও যাইনি। প্লিজ তুমি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। ,”

তবে এর মধ্যে এক দুবার অর্ণব জ্বরের মধ্যে চোখ খুলে যখন অস্মিতাকে দেখেছিল, ও নিজের মনেই প্রশ্ন করে উঠেছিল খুব ক্লান্ত স্বরে,
———-” তোমার লাগেনি তো? ওই ঝাড়বাতিটা পড়ে যাচ্ছিল। তোমার , তোমার কিছু হয়নি তো? ”

কথাগুলো শুনে অস্মিতা কেমন থমকে যাচ্ছিল যেন। অর্ণব এত যন্ত্রণার মধ্যে এই একশতিন জ্বর গায়েও শুধু ওর কথাই ভেবে যাচ্ছে! ছেলেটা কি তাহলে আজও সত্যি ওকে ভালোবাসে! প্রশ্নগুলো মনে আসতেই খেয়াল হচ্ছিল অর্ণবের কাঁধ আর হাতের ব্যান্ডেজটায় কতটা রক্তের দাগ লাগা! সব কিছু ছেলেটা সহ্য করছে শুধুমাত্র অস্মিতার জন্য। কথাগুলো ভেবেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিল জলে। মনে হচ্ছিল যেভাবেই হোক অর্ণবের জ্বরটা কমাতেই হবে।
এর মধ্যে অর্ণব একটা সময় নিস্তেজ শরীরে যেন নিজের মা কে দেখতে পেয়েছিল। মনে হচ্ছিল মা দূরে চলে যাচ্ছে খুব। অর্ণব তাই আঁতকে উঠে বসেছিল মায়ের জন্য। অস্মিতা এই মুহূর্তে সাথে সাথেই ওর কাছে এসে অর্ণবকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল। এতটা জ্বরের জন্যই অর্ণব এরকম করছে। বুঝতে পারছিল ছেলেটার খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই অর্ণবের হাত ধরে এই সময় বলে উঠেছিল,
———” কেউ কোথাও যায়নি অর্ণব। কারোর কিছু হয়নি। তুমি একটু শান্ত হও। ”
কথাগুলো বলতে বলতেই অর্ণব অস্মিতার বুকের মধ্যে মাথা রেখেই সেন্সলেস হয়ে গেছিল। অস্মিতা এই সময় ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল হঠাৎ। অর্ণবকে হারিয়ে ফেলার ভয়। তাই ওকে জড়িয়ে ধরেছিল অস্মিতা সব কিছু ভুলে। এরপর সারা রাত জেগে অর্ণবের মাথার কাছে বসেছিল, যতক্ষণ না জ্বর নেমেছে। অস্মিতা দু চোখের পাতা এক করেনি।

যাইহোক, তবে সকালের দিকে অর্ণবের জ্বরটা নেমেছিল অবশেষে। অস্মিতার মনটা শান্ত হয়েছিল যেন এরপর। তবে অর্ণব আজ চোখ খুলে অস্মিতাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল! আরো অবাক হয়েছিল যখন অস্মিতা ভীষণ নরম স্বরে বলেছিল,
———” তোমার শরীর ঠিক লাগছে তো? দেখি। জ্বর নেই তো এখন? ”
কথাটা বলেই অর্ণবের কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখেছিল ওর উষ্ণতাটা। তবে অর্ণব এই স্পর্শে কেমন স্থির হয়ে গিয়েছিল। যার জন্য এতদিনের অপেক্ষা, সে আজ ওর এত কাছে! ভেবেই কেমন নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ও অস্মিতার দিকে। তখনই অস্মিতা বললো,
———-” তোমাকে কিছু খেতে হবে এখন। এরপর ওষুধ আছে। আমি একটু কর্নফ্লেক্স নিয়ে আসছি। তুমি রেস্ট নাও। ”
কথাগুলো বলেই অস্মিতা ব্রেকফাস্ট আনতে চলে গেছিল। কিন্তু অর্ণব এই মুহূর্তেও যেন স্বপ্নের মধ্যে আছে বলে মনে হচ্ছিল। এই মেয়েটা সত্যিই ওর এত কাছে আজ! বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন।
তবে অস্মিতা যখন খাবারটা নিয়ে এসেছিল, অর্ণব ওকে দেখে নিজে থেকে উঠে বসার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেছিল যেন। অস্মিতা এটা দেখে সাথে সাথে ওর কাছে এসে ওকে আঁকড়ে ধরেছিল। তারপর একটা বালিশ নিয়ে অর্ণবকে হেলান দিয়ে বসিয়ে বলেছিল চিন্তিত মুখে,
———” তুমি এইভাবে একা একা উঠতে গেলে কেন? একে এতটা ব্লাড লস হয়েছে, তার ওপরে কাল সারা রাত জ্বর ছিল! কতটা উইক হয়ে আছো জানো? ”
কথাটায় অর্ণব চুপ ছিল এই মুহূর্তে।
কিন্তু এরপর কিছু মুহূর্তের ভিড়ে অর্ণব কেমন নিজের মনেই বলে উঠলো,
——–” তোমার কাল কোনভাবে লাগেনি তো? কিছু হয়নি তো? ”
প্রশ্নটা শুনে অস্মিতা স্থির হয়ে গেছিল যেন কয়েক সেকেন্ড। কাল রাতেও জ্বরের ঘোরে অর্ণব ওকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করছিল। আর আজ আবার! ছেলেটা কি সত্যি ওকে নিয়ে এতটা ভাবে! তাহলে দেড় বছর ওইভাবে দূরে থাকলো কি করে! কথাগুলো ভেবেই অস্মিতা আস্তে গলায় বলে উঠলো,
———–” ঠিক আছি আমি। কোথাও লাগেনি। ডোন্ট ওরি.. তুমি খেয়ে নাও। ”
কথাটা বলে ও অর্ণবের দিকে এগিয়ে দিল কর্নফ্লেক্স এর বাটিটা। কিন্তু আজ ওর খেতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। ডান হাতে আর কাঁধেই তো চোট লেগেছে! আর এত ব্যথা যন্ত্রণার মধ্যে নাড়াতে পারছে না ঠিক হাতটা যেন! তাই কোনভাবে খাচ্ছিল ছেলেটা। এই দৃশ্য দেখে অস্মিতা আর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলো না। ও নিজে অর্ণব কে বলে উঠলো,
———” তুমি ছাড়ো। হাতে জোর করে স্ট্রেস দিতে হবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ”
কথাটা বলেই ও অর্ণবের হাত থেকে চামচটা নিয়ে ওকে খাওয়াতে শুরু করলো। অর্ণব এই মুহূর্তে নিস্পলক ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। এই মাঝের দেড় বছরে কত হার্ট করেছে হয়তো মেয়েটাকে! তাও আজ এইভাবে সঙ্গে আছে অস্মিতা। এত চিন্তা ওকে নিয়ে! কথাটা ভেবে ও বলে উঠলো খুব স্থির গলায়,
——–” তুমি কাল সারা রাত আমার সাথে ছিলে?”
এই প্রশ্নে অস্মিতা অল্প কথায় বললো,
———” হ্যাঁ। কেন? ”
কথাটায় অর্ণব কিছুটা এলোমেলো হয়েই বললো,
——–” কেন করতে গেলে এইসব! আমার সাথে সারা রাত একই বাড়িতে! পাড়াতে কিছু কিছু লোক আছে যারা এইসব শুনলে উল্টো পাল্টা কথা বলতে পারে! আর আমার জন্য তোমাকে এইসব শুনতে হবে এটা আমি চাই না। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অর্ণব। কিন্তু এবার অস্মিতা বেশ শান্ত গলায়ই বলেছিল,
———” কে কি ভাবলো তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। যদি লোকের কথা নিয়ে ভাবতাম তাহলে দেড় বছর আগে ফ্যামিলির এগেনস্ট এ গিয়ে তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতাম না! যাইহোক, সেসব পুরনো কথা। আর তোমার এই অবস্থা তো আমাকে বাঁচানোর জন্যই হয়েছে। তাই তোমাকে সুস্থ করার দায়িত্বও আমার। ”
কথাগুলো কেমন সহজ কথায় বুঝিয়ে দিল অস্মিতা অর্ণবকে। তবে অর্ণব আজ কিছুটা বেহিসাবি হয়ে বলে উঠলো,
———–” তার মানে শুধু আমি বাঁচিয়েছি বলেই এসেছো। যদি এমনি আমার কিছু হতো আসতে না এইভাবে? অস্মিতা, আমার জন্য কি মনে কোন ইমোশন কোন ফিলিংসই আর বাকি নেই? ”
প্রশ্নগুলো শুনে অস্মিতাও আজ চুপ না থেকে বলে উঠেছিল,
———-” ফিলিংস ইমোশনস! এইসব এর কোনদিন কোন দাম ছিল তোমার কাছে! একটা সময় তো এই দরজার বাইরেই আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলাম শুধু একবার তোমাকে দেখবো বলে। তুমি কি সেদিন বেরিয়েছিলে? তাই আজ এইসব প্রশ্নের কোন মানে হয় না। যাইহোক, তোমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমি আসছি। দুপুরে খাবার নিয়ে আসবো। সাবধানে থেকো। ”
কথাগুলো বলে অস্মিতা নিজের মনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেছিল সেদিন ঘরটা থেকে।
চলবে।