তোমার জন্য এক পৃথিবী পর্ব-৩৩+৩৪

0
196

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩৩।
আমিরা চোখ মেলল বেশ খানিকটা সময় পর। যেন আবার ঘুম ভাঙ্গল। আদতেই জ্ঞান হারিয়েছিল কি না, সে বলতে পারবে না। হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছিল, এটুকু নিশ্চিত। শরীর আর নিতেই পারছিল না এত চাপ। মাথাও স্ট্রেস ঝেড়ে ফেলতে উদগ্রীব ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। তার উপর রিফায়াতকে দেখে ভয়টা বাড়ল।
চোখ পিটপিট করে আশপাশ দেখে নিল সে। এই মুহূর্তে বিছানায় শুয়ে আছে। যতদূর মনে পড়ে, মেঝেয় পড়ে গিয়েছিল সে। তারপর সবকিছু অন্ধকার। কিন্তু টানাহেচড়া অনুভূব করতে পারছিল। কানের কাছে রিফায়াতের কন্ঠ শুনেছে। কিন্তু কী বলল, তা বুঝতে পারেনি। রিফায়াত বোধহয় ওকে ডাকাডাকি করছিল। সে সাড়া দিতে চাচ্ছিল, পারেনি। শরীর পুরোপুরি অবশ হয়ে গেছিল তখন। এরপর কি রিফায়াতই ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে?
রিফায়াত এখনো টের পায়নি, জ্ঞান ফিরেছে। ঘরে সেই হালকা আলোর ল্যাম্প জ্বলছে। তবে এবার শুধু বিছানার পাশেরটা না, আরও কয়েকটা। এই ঘরে কি সিলিং লাইট জ্বলে না? আগেই লক্ষ করেছিল আমিরা, প্রতিটা দেয়ালের দুই কোণে ছোট ছোট ঝাড়বাতি। একপাশের সিলিংয়ে টিউব লাইটও আছে। আর মাথার ঠিক উপরে ফ্যান। এই ফ্যানটাও অদ্ভুত ধরনের। চারপাশে চারটা পাখা। আর মধ্যিখানে ফুলের আকৃতির ছোট লাইট। টিউব লাইট বাদে আর বাকি সবগুলো লাইট এখন জ্বলছে।
আমিরার এক হাত চেপে ধরে বসে আছে রিফায়াত, খুব কাছেই। তার দিকে না তাকিয়েও বুঝা যাচ্ছে, যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছে। ঘরে মামিও আছেন। নিচু সুরে কথা বলছেন। আমিরা কান খাঁড়া করল শুনতে,
– এই মেয়ে যদি মরে যায়, তুই কিন্তু ফাঁসবি। ওর ফ্যামিলি আছে কী নাই, কিন্তু তোর নামে কেস করার মানুষের অভাব হবে না। তুই এখনো ওকে চিনতে পারিস নাই।
রিফায়াত বলল,
– মামি প্লিজ, তুমি চুপ করো।
– চুপ করব কেন? তুই একটার পর একটা প্যারা দিতে থাকবি আমাকে আর আমি চুপ করে থাকব কেন? দুইদিন পর পর এরে-তারে নিয়ে আসতেছিস বাসায়। আর আমি বিদায় করতেছি। আর আজকে তো বিয়েই করে নিয়ে আসছিস, জানি বিদায় করতে না পারি।
– হ্যাঁ, এইজন্যই বিয়ে করছি। কারণ তুমি ওকে দেখার পর যেই সিন ক্রিয়েট করবা, সেগুলো আমার মুখস্ত। তোমার এই নাটক দেখতে দেখতে আমি ফেডাপ।
– আমি নাটক করি? আর তুই যে খুঁজে খুঁজে এইসব মেয়ে ধরে আনিস! সেইটা কিছু না।
– মেয়ে ধরে আনি বলতে কী বুঝাইতেছ? আমিরা আমার ওয়াইফ।
– কীসের ওয়াইফ, দুইদিন পর বুঝবি। এই মেয়ে যখন আসল রূপ দেখাবে, তখন টের পাবি কেমন বউ। রিমার তাও কোয়ালিটি ছিল। এইটার…
– প্লিজ, আমার ঝামেলা আমাকেই বুঝতে দাও।
– আমার মাথায় ঢুকল না, তুই কেমনে অ্যাড্রেস ভুল করলি। নামেও তো মিলে না। কোথায় আমিরা আর কোথায় সামিরা। তুই কি মুর্খ? লেখাপড়া শিখাই নাই তোরে আমি? আমিরা আর সামিরা গুলাইয়া ফেলিস।
– মামি প্লিজ! চুপ করো।
– তুই এই মেয়েকে আজকেই বাসা থেকে বের করবি, দ্যাটস ফাইনাল। আর কোনো কথা আমি শুনব না। আর এই মেয়ে যদি এইখানে থাকে, আমি থাকব না। আমার বোনের বাসায় চলে যাব।
রিফায়াত এই পর্যায়ে চুপ রইল। মামি বলল,
– এই ছেমড়ির এখনো জ্ঞান ফিরে না কেন? মরছে নাকি?
বুয়াও আছে আশপাশে। সে মিনমিন করে বলল,
– ডাক্তার ডাইকা আনলে ভালো হইতো না, ভাই?
রিফায়াত উত্তর দিল,
– ডাক্তার ডাকতে হবে না। ও একটু পরই উঠবে। ওর আসলে সারাদিনে কিছু খাওয়া হয় নাই। কালকে সারারাতও সে ঘুমায় নাই। আজকে গাড়ির মধ্যে বসে ঝিমাইছে।
– বিকালেও তো আপনের ঘরে আইসা ঘুম দিল।
– তুমি ওকে ডিনার দিয়ে কী বলছিলা? বলো নাই খেয়ে নিতে?
– হ বলছি তো! গরম-গরম খাইয়া নিতে বলছি।
– তাহলে খায় নাই কেন?
– হেইডা আমি কেমনে কমু? আমি তো খাওন দিয়াই চইলা গেছি এইহান থেকে।
– যাওয়া উচিত ছিল না। ওর সামনে বসে থাকতা।
– আপনে তো বইসা থাকবার কথা কিছু বলেন নাই।
রিফায়াত আর কোনো কথা বলল না। আলতো করে আমিরাকে ধাক্কা দিল। নিচু সুরে ডাকল,
– আমিরা! অ্যাই আমিরা।
পরক্ষণেই চোখমুখে পানির ঝাপটা পড়ল। আমিরা আর বেহুঁশ হবার ভান করে থাকতে পারল না। নড়ে উঠল আপনাতেই! চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। ঘরভর্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস বয়ে গেল মুহূর্তেই। মামি বলল,
– যাক, আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। মরে নাই! অবশ্য এত সহজে মরার কথাও না। এইসব লাইনে আসলে তো কই মাছের প্রাণ হওয়া লাগে।
– মামি! কী শুরু করলা তুমি?
– আমি কিছু শুরু করি নাই। এই মেয়ে আসলেই জ্ঞান হারাইছে নাকি নাটক করতেছে, তাই দেখ।
বলেই আমিরাকে হেঁচকা টান মেরে বসিয়ে দিলেন বিছানায়। আমিরার এবার চোখ খুলতেই হলো। মুখটা ভেজা। পানির কণাগুলো নাকের উপর সুড়সুড়ি দিচ্ছে। দুই হাতে মুখ ঢাকল সে। মামি এবার গলা চড়ালেন,
– এইসব ঢঙ্গ করার আর জায়গা পাও না! থানায় গেলে এরপর ঢঙ্গ কইরো, ঠিক আছে? দেখব নে, কতদূর কী নাটক করতে পারো।
আমিরা থরথর করে কেঁপে উঠল। এরা কি সত্যিই ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিবে? রিফায়াত বিরক্তির সুরে বুয়াকে বলল,
– মামিকে নিয়ে যাও এখান থেকে।
অবশ্য নিয়ে যেতে হলো না। মামি তার আগেই হনহন করে চলে গেলেন। বুয়াও তার পিছু নিল। রিফায়াত এই সুযোগে ঘরের দরজা বন্ধ করল। তারপর ফিরে এলো আমিরার কাছে। আমিরা তখন মুখের উপর থেকে হাত সরিয়েছে। কিন্তু চোখ তুলে তাকায়নি। মাথা নিচু করে রেখেছে। রিফায়াত ওর সামনেই বসল, মুখোমুখি। কিছুক্ষণ চুপ রইল সে। তারপর বলল,
– আমিরা, আমার দিকে তাকাও।
একবার বলায় কাজ হলো না। আমিরা ঘাড় গোঁজ করে রাখল। পরেরবার রিফায়াত বলল,
– আমি একটা কথা একবারের জায়গায় দুইবার বলতে চাই না। আই ওয়ান্ট অ্যা কুইক রেস্পন্স।
আমিরা ভয়ে-ভয়ে মাথা তুলল। একবার রিফায়াতের দিকে তাকিয়েই আবার চোখ সরিয়ে ফেলল। রিফায়াত বলল,
– এই কাজটা তুমি কেন করলা?
আমিরা উত্তর দিল না। কয়েক মুহূর্ত পর রিফায়াত আবার বলল,
– আমিরা, স্পিক আপ। চুপ করে থাকলেই তুমি পার পেয়ে যাবা না।
– আমি কিছু করি নাই।
– তাহলে কে করছে? তোমার ফ্যামিলি? তারা সবকিছু জেনেশুনেই…
– না। আমার ফ্যামিলি কিছু জানত না।
– তাহলে? ঘটনাটা কী, বলো। কাল আমি তোমাদের বাসায় যাবার পর তোমরা এমনভাব করলা সবাই মিলে যেন আমার জন্য ওয়েট করতেছিলা। কেন? যতদূর বুঝছি, তোমরা জানতা আমি আসব। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যাড্রেস ভুল ছিল। আমি নিজেই ভুল করে তোমাদের বাসায় গেছিলাম। কিন্তু তোমরা জানলা কীভাবে, আমি আসতেছি?
আমিরা ধীর সুরে বলল,
– গতকাল একজনের আসার কথা ছিল। মানে আমার খালার পছন্দের ওই ছেলের। নাম শফিক। খালুর অফিসে জব করে। খুব অনেস্ট আর…
– আমি শফিকের বায়োডাটা শুনতে চাইনি।
– মানে উনার আসার কথা ছিল তখন।
– কিন্তু সে আসে নাই।
– উনি কোনো একটা কাজে আটকে গেছিলেন। খালুকে মেসেজ পাঠাইছিলেন। কিন্তু খালু ব্যস্ত মানুষ। সেই মেসেজ রিসিভ করছে অনেক পরে। আপনি চলে যাবার পর আমার বড় খালা আসছিলেন। উনি আমাদের বাসায় থাকার সময়ই খালুর কল আসছে। খালু তখন বলল, যার আসার কথা ছিল, সে আসতে পারে নাই। এজন্য স্যরি চেয়ে মেসেজ পাঠাইছে।
– আর তার বদলে আমি গেছিলাম!
– হ্যাঁ, মানে আমরা ভাবছিলাম আপনিই শফিক।
– সিরিয়াসলি? আর শফিকের বায়োডাটা আর লাইফ স্টোরি আমার সাথে হুবহু মিলে গেছে! ইজ ইট অ্যা জোক?
– আমি জানি না। বড় খালার কাছে যতটুকু শুনছি, শফিকের বাবা-মা নাই। মামার কাছে বড় হইছে। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর আলাদা বাসায় থাকে। ব্যাচেলরদের সাথে। খালুই তাকে প্রস্তাব দিয়েছে বিয়ের।
– স্ট্রেঞ্জ! গুড স্টোরি।
আমিরা চুপ করে রইল। রিফায়াত আবার বলল,
– রাতেই তুমি জানতে পারছ, আমি শফিক না। ঠিক?
– হু।
– তাহলে আজ কেন কল করলা আমাকে? কেন গল্প শুনাইলা তোমার খালা আমাকে বাদ দিয়ে তার পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে।
আমিরা আবার চুপ করে রইল। রিফায়াতকে সে ভালোবেসে ফেলছে। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়েছে, এই কথা বলা যাবে না। বললেও রিফায়াত বিশ্বাস করবে না। রিফায়াত বলল,
– কথা বলো। চুপ থাকবা না।
আমিরা হড়বড় করে বলল,
– আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দেন প্লিজ। প্রমিজ করতেছি, আর কোনোদিন আপনার সামনে আসব না। আপনার আশপাশেও থাকব না।
– এটা আমার প্রশ্নের উত্তর না।
– আমি কিচ্ছু চাই না আপনার কাছে। কিচ্ছু না। আপনি প্লিজ আমাকে পুলিশে দিয়েন না। আমি কিছু করি নাই। আপনার মামি যেরকম ভাবতেছে, আমি সেরকম কেউ না। কালকে আমি আমার অরিজিনাল বাসায়ই গিয়েছিলেন। আমার বাবা-মা-বোন সবাই…
– আমি যা জিজ্ঞেস করেছি, উত্তর দাও। তুমি আগেই জানতা, আমি শফিক না। এরপরেও আজ কেন মিথ্যা গল্প শুনাইছ?
– আমি ভুল করছি।
– ভুল? বিয়েটা কি তোমার কাছে ভুল মনে হচ্ছে?
– ওইটা কোনো বিয়ে হয় নাই। ওইভাবে অভিভাবক ছাড়া বিয়ে হয় না।
– তাই?
– আপনি কাজিকে ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ দিলে বিয়ে হয় না।
– বিয়ে হোক বা না হোক, ওটা একটা অফিশিয়াল ডকুমেন্ট। তুমি ওই কাবিননামার ভ্যালু বুঝো?
– কোনো ভ্যালু নাই। সব ফেক।
– আর এই ফেক ডকুমেন্ট দিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা যাবে।
– আমি কেন আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করব? আমি আপনাকে চিনিই না! আপনি কে, আপনার ফ্যামিলি কী, কে কে আছে, আমি কিচ্ছু জানি না।
– আগে জানতা না। কিন্তু এখন জানো। তুমি জানো, আমার বাবা-মা বিশাল প্রপার্টি আর ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে মারা গেছে। এগুলোর আমিই একমাত্র মালিক।
– আপনার প্রপার্টি দিয়ে আমি কী করব?
– তুমিই বলো, কী করবা? তুমি তো আমার কাছ থেকে প্রমিজ আদায় করে নিছ, যদি কোনো কারণে আমাদের বিয়ে না টিকে, আমরা একসাথে থাকতে না পারি, তাহলে আমার সমস্ত বিষয়সম্পত্তির অর্ধেকটা তুমি পাবা।
– ওইটা আমি ফান করে বলছিলাম। সিরিয়াসলি বলি নাই।
– ফান করে কি বিয়েটাও করছ?
– বিয়ে হয় নাই।
– ওহ, বিয়ে হয় নাই। কিন্তু তুমি আমার বাসা পর্যন্ত চলে আসছ!
– আমি আসতে চাই নাই। আপনি জোর করে নিয়ে আসছেন।
– তার চেয়ে বলো, তুমি কুটচাল করে আমাকে বাধ্য করছ তোমাকে নিয়ে আসতে।
– অ্যা? আমি কী কুটচাল করলাম?
রিফায়াত তাকিয়ে রইল চুপচাপ। আমিরাও হতবুদ্ধি ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। খানিক আগেও পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময়ে ভালোলাগা মিশ্রিত ছিল। ভালোবাসা তৈরি হচ্ছিল একটু-একটু। এখন সেই দৃষ্টিতে তার ছিটেফোঁটা নেই। আমিরা ফিসফিস করে বলল,
– আমি ভাবছিলাম, প্রপার্টির কথা বললে আপনি…
– হুম। কথা শেষ করো।
– আপনি কখনো ডিভোর্সের নাম মুখে আনবেন না। এটা তো সম্ভব না, পুরোপুরি অর্ধেকটা দিয়ে দেয়া। কেউ দিবেও না। আর আমি যতটুকু জানি, আইন অনুসারেও দেয়ার কথা নাই। তাই আমার মনে হলো আপনি যদি প্রমিজ করেন, তাহলে সম্পত্তি দিয়ে দিতে হবে এই ভয়ে কখনো ডিভোর্সের কথা বলবেন না। সারাজীবন একসাথেই থাকা হবে। আমিও বাবার বাসায় ফেরত যাব না বড়াপার মতো।
রিফায়াত কোনো কথা বলল না। আমিরা কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। প্রবল আতঙ্কে সে টেরই পাচ্ছে না, তার চোখ উপচে নোনাপানির ঢল নেমেছে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। রিফায়াত কী ভেবে ওর চোখের পানি মুছে দিল। আমিরার কান্নার বেগ বাড়ল সেই স্পর্শে। কলেজের ব্যাগটা পাশেই রাখা। সে ব্যাগ থেকে ওয়ালেট বের করল। আঠারোশ বাষট্টি টাকা বের করে রিফায়াতের হাতে দিল। বলল,
– আমার দেনমোহর লাগবে না। প্রপার্টিও না। আমি কিচ্ছু চাই না আপনার কাছে। প্লিজ আমাকে যাইতে দেন।
রিফায়াত কিছুটা সময় টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
– তুমি কি চলে যাওয়ার জন্য আসছ?
কান্নার তোড়ে আমিরা কথা বলতে পারছে না ঠিকমতো। সে ডানেবায়ে না-সূচক মাথা নাড়ল। রিফায়াত আবার বলল,
– তাহলে তোমার উদ্দেশ্যটা কী ছিল আমাকে বিয়ে করার পেছনে?
– আমি জানি না।
– তুমি সবই জানো কিন্তু সব কথার আগে ‘জানি না’ বলো। এটা তোমার বদভ্যাস। এইটা কি জানো?
আমিরা না-সূচক মাথা নাড়ল। রিফায়াত বলল,
– আচ্ছা, তুমি তো মাথা নাড়াতে পারো ভালো। তোমার জন্য প্রশ্নটা সহজ করে দিই। হ্যাঁ বা না – যে কোনো একটা উত্তর দিলেই হবে। মাথা নাড়ালেও চলবে। তোমার উদ্দেশ্য, সারাজীবন আমার সাথে থাকা। ঠিক?
আমিরা হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ল। রিফায়াত বলল,
– আরেকটু ক্লিয়ার করি। ফ্যামিলি থেকে তোমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। তুমি বিয়ে করতে চাও না। কিন্তু তোমার হাতে আর কোনো অপশনও নেই। সো, তোমার মাইন্ড অলরেডি সেটআপ করে ফেলেছে, বিয়ে করতে হবেই। ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক। ঠিক?
– হু।
– বিয়েটা তুমি শফিক মানে তোমার খালার পছন্দ করা পাত্রকেও করতে পারতা। আমার ধারণা, সেটাই বেশি ভালো হতো। ফ্যামিলি থেকে বিয়ে দিত। তাতে তোমার লাইফের একটা সিকিউরিটি থাকত। শফিক চাইলেই হুট করে তোমাকে ডিভোর্স দিত না। তোমাকেও বাবার বাসায় ফিরতে হতো না। কিন্তু এখন তুমি যা করলা, তাতে ইনসিকিউরিটির পরিমাণ আরও বাড়ল। তুমি মিথ্যে কথা বলে আমাকে বিয়ে করলা। এখন আমি সত্যিটা জানলাম। আবার তুমি বিশ্বাস করো, কাজি অফিসে বিয়ে করলে নাকি তা টিকে না। তোমার বিশ্বাসটাই সত্যি প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। এরপর কি তোমার বাসায় ঢুকতে দিবে তোমাকে? তোমার বড় খালা কি শফিকের সাথে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হবেন?
আমিরা না-সূচক মাথা নাড়ল। রিফায়াত বলল,
– তার মানে তোমার এই কুল-ওই কুল সব গেল। তুমি আমাকে দিয়ে প্রমিজ করাইলা, ডিভোর্সের সময় অর্ধেক প্রপার্টি লিখে দেয়ার। কিন্তু এটার ডকুমেন্ট তৈরি করায় ইন্টারেস্ট দেখাও নাই। সো, আমি এখন প্রমিজ রাখবই বা রাখতে বাধ্য, এমন কোনো গ্যারান্টি নাই। আমি এই মুহূর্তে তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিলেও তোমার কিছু করার নাই। তুমি তো দেনমোহরের অঙ্কটাও ঠিকঠাক লিখতে বলো নাই কাজিকে। আঠারোশ বাষট্টি টাকা না হয়ে আঠারো লক্ষ বাষট্টি হাজার হলেও নাহয় মানা যেত মোটামুটি।
আমিরা চোখ বড় বড় করে বলল,
– আঠারো লক্ষ বাষট্টি হাজার!
রিফায়াত হেসে ফেলল শব্দ করে। বলল,
– অনেক টাকা, তাই না? বিশাল ধরা খেয়ে গেছ।
– আমি জীবনেও এতগুলো টাকা দেখি নাই।
– দেখতে চাও?
– উহু।
– কেন? নিজের চোখে না দেখলে তো বুঝতে পারবা না, কী বিশাল মিস করছ!
– দেনমোহরের টাকা বেশি হলে সমস্যা আছে। বিয়ে টিকে না।
এবার রিফায়াতের অবাক হবার পালা।
– অ্যা?
– হু। দাদির কাছে শুনছি, দেনমোহর হতে হয় খুব কম। আমার দাদা দেনমোহর দিয়েছিল পাঁচ টাকা। তখন নাকি চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহরে বিয়ে হতো। কিন্তু দাদা বলছে, পাঁচ টাকা দিয়েই বিয়ে করবে। ওটুকুই তার সামর্থ্যের মধ্যে। আমার দাদারও আপনার মতো বাবা-মা ছিল না। অনেক ছোটবেলায় মারা গেছে। কোনো টাকাপয়সা আর সম্পত্তিও রেখে যায় নাই। দাদা বড় হইছে তার চাচার কাছে। চাচা বলছিল, বিয়ে উপলক্ষ্যে বাড়ির মধ্যে একটা ঘর তুলে দিবে। আর কিছু না। চাচার দোকানে কাজ করত দাদা। ওই টাকা দিয়ে বউ চালানোর সামর্থ্য ছিল না।
– তারপর?
– তারপর আর কী? দাদিকে বিয়ে করল পাঁচ টাকা দেনমোহরে। আমার দাদি সেই টাকা কোনোদিন খরচ করে নাই। যত অভাব আর কষ্ট আসছে, সব সহ্য করছে। কিন্তু ওই পাঁচ টাকা খরচ করে নাই। ওই টাকা দাদি খুব যত্ম করে রেখে দিয়েছিল। এজন্যই বিয়ে সারাজীবন টিকে গেছে।
– তাই?
– হ্যাঁ। বড়াপার বিয়ে হইছিল দশ লক্ষ টাকা দেনমোহরে। আঠারো লক্ষ থেকে কম কিন্তু অনেক টাকা তো। তাতে লাভ কী হয়েছে? বিয়ে তো টিকল না। দুলাভাই আপাকে সেই টাকা কোনোদিন দেয়ও নাই। বলে, ঘরে থাকতে দিছি এটাই বেশি। পছন্দ হইলে থাকবা, না থাকলে যাও গা। টাকাপয়সা আবার দিতে হবে কেন? এতকাল যে বসাইয়া বসাইয়া খাওয়াইলাম, পরাইলাম। সেগুলোর হিসাব দাও! ওইগুলা কাটাকাটি হইলে উলটা তুমিই আমারে টাকা দিতে বাধ্য। বড়াপা আর কথাই বাড়ায় নাই। লাগবে না টাকা তার। যেইখানে সম্মান নাই, সেইখানে থাকবেও না সে।
– হুম। তো এইজন্য তোমার মনে হলো, বেশি টাকা দেনমোহর হলে বিয়ে টিকে না!
– বিয়ে টিকুক বা না টিকুক, বেশি দেনমোহর হলে লাভটা কী? ডিভোর্সের সময় তো টাকাটা বউ পাবে না।
– আমি যতদূর জানি, বিয়ের দিনই দেনমোহর পরিশোধ করার নিয়ম।
– এটা আমিও জানি। কিন্তু টাকার অঙ্ক বেশি হলে বিয়ের দিনই পরিশোধ করা যায় না। মানে এত টাকা কেউ সাথে নিয়ে ঘুরে না। তাই মনে করে, পরে দিলেই হবে। পরে আর দেয় না। ডিভোর্সের সময় বউ টাকা চাইলে বলে কীসের টাকা? এতকাল খাওয়াইছি-পরাইছি। ওইগুলোর হিসাব দাও।
– ভরণপোষণের সাথে দেনমোহরের কোনো সম্পর্ক নাই, আমিরা। ভরণপোষণ হচ্ছে স্ত্রীর হক। বিয়ের পর স্বামী এই ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। আর দেনমোহর হচ্ছে এককালীন টাকা বা সম্পত্তি, যেটা বিয়ের দিনই দিতে হয়। আর এর উপর স্বামীর কোনো অধিকার বা হক থাকে না। এটা স্ত্রীর ব্যক্তিগত হক।
– এইটা তো বেশিরভাগই মানে না। আসল কথা হচ্ছে, এতগুলো টাকা বউকে দিয়ে দিতে আত্মায় চড়চড় করে। এইজন্য বিয়ের দিন গড়িমসি করে। বলে, এতগুলো টাকা এখনই দিব কেমনে? টাকা তো অ্যারেঞ্জ করার ব্যাপারও আছে। সময় লাগবে। এখন বিয়ে হয়ে যাক। পরে দিব নে। কিন্তু পরে আর দেয় না। এরপর ডিভোর্সের দিন বউ টাকা চাইলে তখন ভরণপোষণের কথা তুলে খোঁটা দেয়। এজন্য আমি বিয়ের সময়ই দেনমোহরের টাকা নিয়ে নিছি। আপনার কাছে ইন্সট্যান্ট যা ছিল, সবটুকু নিছি। ‘পরে দিব’র হিসাবনিকাশে আমি নাই। পরে যে আপনি দিবেন, তার গ্যারান্টি কী?
– এখন তো আবার দিয়েও দিলা।
আমিরা সবকিছু ভুলে আগের মতোই সাবলীল হয়ে গেছে। কলকল করে কথা বলছে। তার কন্ঠে বোধহয় যাদু আছে। আমিরা একবার কথা বলতে শুরু করলে রিফায়াতের মনে ভালো লাগা জন্মায়। সেও আমিরার সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলতে থাকে। ইচ্ছে করে, আমৃত্যু এভাবেই চলতে থাকুক কথোপকথন। এই সময়টা কখনো শেষ না হোক। এই মোহটাই গতকাল এলোমেলো করে দিয়েছিল সবকিছু। রিফায়াত আবার মোহের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। খানিক আগের কাঠিন্য উবে গিয়ে তার চেহারায় ভর করেছে উচ্ছ্বলতা। নিজের অজান্তেই সহজ ভঙ্গিতে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে সে। আচানক আমিরা থমকে গেল। এই থমকে যাওয়াটা রিফায়াতকেও মোহ থেকে বের করে আনল। আমিরা শান্ত সুরে বলল,
– আপনার সাথে তো সারাজীবন থাকতেই পারব না। সারাজীবন দূরে থাক। একদিনও পার হলো না। কয়েক ঘন্টা মাত্র। এই দেনমোহর দিয়ে কী করব আমি? সারাজীবন থাকতে পারলে আমি এই টাকা রেখে দিতাম। বরং টাকাটা আমার কাছে থাকলে বারবার আপনার কথা মনে পড়বে। তার চেয়ে আপনার টাকা আপনার কাছেই থাকুক।
রিফায়াত ধীর সুরে বলল,
– ঠিক। তোমার কথায় লজিক আছে। তাছাড়া এই টাকা দিয়ে তুমি কিছুই করতে পারবা না। না আলাদা বাসা ভাড়া করতে পারবা, না পড়াশুনা, না তোমার প্রতিদিনকার খরচ মিটবে। আঠারো লক্ষ টাকা হলে নাহয় একটা কথা ছিল।
– আঠারো লক্ষ টাকা দিয়ে কি সব কিছু হবে? বাসা ভাড়া, পড়াশুনা আর ডেইলি খরচ? বাকিটা জীবন কি পার হবে?
– ডিপেন্ড করে তুমি কীরকম লাইফ লিড করবা। তোমার বাসা যদি কোনো পশ এরিয়ায় হয়, যেমন এদিকেই কোথাও। তাহলে মান্থলি এক লক্ষ টাকা ভাড়া দিতে হবে। দ্যাট মিনস আঠারো লক্ষ টাকা তোমার দেড় বছরের বাসা ভাড়া। বাকি রইল…
– না না এত দামি এলাকায় থাকব না। আমাদের ওদিকে। পুরান ঢাকায় বাসা ভাড়া খুব কম। তাছাড়া আমি একা মানুষ। এক রুম ভাড়া নিলেই হয়ে যাবে। এক হাজার টাকা পার মান্থ। আর আমার কলেজের খরচ বেশি না। মান্থলি বেতন সাতশ টাকা। যাওয়া-আসা বাবদ তিনশ ধরে রাখলাম। এক বছর পর আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ব। তখন বেতন এত বেশি লাগবে না। তবু সব মিলে এক হাজার ধরলাম। জামাকাপড় জুতা, বইখাতা বাবদ দুই হাজার ধরি। আর খাওয়া বাবদ এক হাজার। আমি অত বেশি খাই না। আমার খাওয়া-দাওয়া খুবই কম। এইজন্য বড়াপা প্রায়ই বকাবকি করে। আর মা বলে, খায় না ভালো হইছে। টাকা বাঁচল। মেয়ে মানুষের অত খাওয়ার দরকার কী? দুইদিন পর বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়িতে যাবে। তখন শাশুড়ি বলবে, মা হাঁসের মতো গপগপ করে ভাত গেলানো শিখাইছে। উঠতে বসতে ভাতের খোঁটা দিবে। যাই হোক, টোটাল পাঁচ হাজার টাকায় আমার মাস চলে যাবে। আঠারো লক্ষ বাষট্টি হাজারকে যদি পাঁচ হাজার দিয়ে গুণ দেই…
আমিরা কলেজের ব্যাগ থেকে ক্যালকুলেটর বের করল। তারপর হিসেব করে দেখল, তিনশ বাহাত্তর মাস চলবে পারবে সে। অর্থাৎ একত্রিশ বছর। অনেকটা সময়! আমিরার এখন সতেরো বছর চলছে। আর কয়েক মাস পর আঠারো হবে। আঠারো আর একত্রিশ মিলে উনপঞ্চাশ বছর। বলা চলে, পুরোটা জীবনই ঠিকঠাক পার হয়ে যাবে এই টাকায়।
সে বলল,
– আপনার প্রপার্টি লাগবে না। আঠারো লক্ষ বাষট্টি হাজার টাকা দেন। আমি চলে যাব এখান থেকে। আর কোনোদিন আপনার সামনে আসব না। আই প্রমিজ।
রিফায়াত অবাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আমিরা সেটা লক্ষ করে বলল,
– আচ্ছা, আঠারো লক্ষ টাকা দিতে না চাইলে আরও কম দেন। আঠারো লক্ষ টাকা দিতে গেলে আপনার আত্মায় চড়চড় করবে। এতগুলো টাকা কম তো না। থাক…
আবার হিসেব করতে বসল সে। তার পড়াশুনা শেষ হবার আরও ছয়-সাত বছর বাকি আছে। এরপর চাকুরি খুঁজবে। আজকাল চাকরি পাওয়াটা অত সহজ না। কমসে কম দুই-তিন বছর লাগবেই। অবশ্য এই সময়টা সে একদমই বসে থাকবে না। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই থেকেই টিউশনি করাবে। অর্থাৎ নিজের ইনকাম সোর্স থাকবে। তাহলে বেকারত্বের জন্য এক বছর ধরে নেয়া যাক। মোট আট বছর, অর্থাৎ ছিয়ানব্বই মাস। প্রতি মাসে পাঁচ হাজার খরচ হলে টোটাল টাকার অঙ্ক হয়, চার লক্ষ আশি হাজার।
– আপনি আমাকে চার লক্ষ আশি হাজার টাকা দেন। আর কিছু লাগবে না।
রিফায়াত কোনো কথা বলল না। আমিরার কথোপকথন তাকে এতটাই সম্মোহিত করে ফেলেছে, সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে সামনে বসা মেয়েটাকে। তার আনমনে মাথা নাড়ানো, হাত নেড়ে কথা বলা, ক্যালকুলেটরে হিসেব করা। সবথেকে বেশি যে বিষয়টা সম্মোহন করেছে, তা হলো আমিরার সরলতা। এই মেয়ের মাথায় বাস্তব বুদ্ধি বলতে কিছু নেই। ফ্যামিলি থেকে যতটুকু শিখেছে, যতটুকু শুনেছে, তা দিয়ে জীবনকে পরিমাপ করে সে। নয়তো মাত্র আঠারোশ বাষট্টি টাকা দেনমোহরে বিয়ে করতে কোনো মেয়েই রাজি হবে না বর্তমান যুগে। আমিরা বলেই তা সম্ভব হয়েছে। আমিরা এই টাকাটা রিফায়াতকে ফেরত দিয়েছে। কারণ তার চিন্তাধারা জুড়ে সবথেকে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে রিফায়াতের সঙ্গে থাকা। যে কোনো মুল্যে সে সারাজীবন রিফায়াতের পাশে থাকতে বদ্ধপরিকর। টাকা সেখানে কোনো অপশন হতেই পারে না। তবু জীবনে পথ চলতে গেলে টাকার দরকার হয়, এই বোধটুকু তার আছে। হয়তো এজন্যই এই মুহূর্তে টাকা চাচ্ছে। তাও অঙ্কটা প্রাধান্য পায়নি। তার কাছে টাকার অঙ্কটা বড় হবার চেয়ে সবথেকে বেশি জরুরি সারাজীবন একাকি পার করা। কেন? রিফায়াত না থাকলে কি তার জীবনে আর কেউ আসবে না? নাকি সে আসতেই দিবে না?
রিফায়াতের হাতের মুঠোয় তখনও আঠারোশ বাষট্টি টাকা রয়ে গেছে। মুঠোটা আমিরার খোলা হাতের উপর রেখে সে নিজেও মুঠ ছেঁড়ে দিল। তারপর বলল,
– তোমার দাদি এত গল্প শুনিয়েছেন তোমাকে। বিয়ে টিকিয়ে রাখার কথা কিছু বলেননি?
– হ্যাঁ বলছে তো। দাদির কথা হচ্ছে, মেয়েদের বিয়ে লাইফে একবারই হয়। বারবার না। সো, একবার বিয়ে হয়ে গেলে ডিভোর্সের কথা মাথা থেকে পুরাপুরি বাদ করে দিতে হবে। এই শব্দটা মাথায়ই রাখা উচিত না। যদিও আমাদের ধর্মে লেখা আছে, মেয়ে ডিভোর্সের পর আবার বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু এটাও লেখা আছে, ডিভোর্স হচ্ছে সবথেকে নিকৃষ্টতম। আল্লাহ নিষেধ করছেন, যেন কেউ খুব সহজেই ডিভোর্সের কথা মাথায় না আনে। বিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করতে হবে। একান্তই যদি পসিবল না হয়, তখন ডিভোর্সের কথা ভাবা যায়। কিন্তু তার আগে সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে যেন বিয়ে না ভাঙ্গে। যেমন বড়াপা কিন্তু অনেক অত্যাচার সহ্য করছে। তার শাশুড়ি খুবই অসভ্য আর জাঁদরেল মহিলা। আপার লাইফটা একদম তিতা বানিয়ে ফেলছিল। আপা তাও ডিভোর্সের কথা মুখে আনে নাই। মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করছে। ইভেন দুলাভাই যখন পরকীয়া প্রেম শুরু করল, তখনও আপা অনেক চেষ্টা করছে তাকে শুধরাইতে। কিন্তু দুলাভাই তো শুধরানোর মানুষ না। তার মাথায় বাচ্চার ভুত চাপছে। তার মাও তাল দিতেছে। আপা তখনও মাটি কামড়ে পড়ে ছিল শ্বশুরবাড়িতে। এরপর যখন দুলাভাই আরেকটা বিয়ে করে বউ নিয়ে আসলো, আপাকে বলল বেডরুম ছেঁড়ে দিয়ে গেস্ট রুমে থাকতে। আপা তখন এক কাপড়েই চলে আসছে ওই বাড়ি ছেঁড়ে।
– তোমার আপা সত্যিই অনেক কষ্ট করছেন লাইফে। আর তুমি এত সহজে হাল ছেঁড়ে দিচ্ছ? খুব ইজিলি ডিভোর্সের চিন্তা তোমার মাথা চলে আসছে।
– কী করব? আপনার মামি সারাজীবন এই নিয়ে খোঁটা দিবে। আমাকে তো উঠতে-বসতে কথা শুনাবেই। অনেক অত্যাচার করবে আমার উপর। সেইটা নাহয় আমি সহ্য করলাম। কিন্তু আপনাকেও ছেঁড়ে দিবে না। কথায়-কথায় বলবে, রিফায়াত এইটা কী বিয়ে করলি তুই? ধরেন আমি একটা ভুল করলাম। বা কিছু একটা মামির মনমতো হলো না। তখন আপনাকে ডেকে বলবে, কী বিয়ে করছিস তুই, দেখ। এই মেয়ের কোনো যোগ্যতাই নাই সংসার করার। এরপর আপনার ফুপুর কানে ঢালবে। উনি কল করে বলবে, তোর বাপের পছন্দ করা মেয়ে বিয়ে করলে আজকে এই দিন দেখতে হতো না…
রিফায়াত সশব্দে করে হাসল। আমিরা বলল,
– আপনি হাসতেছেন কেন? আমি কি হাসির কথা বলছি কিছু?
উত্তর না দিয়ে আমিরাকে জড়িয়ে ধরল রিফায়াত। কাছে টেনে এনে বলল,
– তুমি আমার বউ, আমিরা। এই সংসার তোমার। এই বাসা, এই ঘর সবকিছু তোমার। এখানে তুমি একমাত্র বস। তোমার কথায় সবাই উঠবে আর বসবে। কেউ তোমাকে কথা শোনাবে না। কারও সেই অধিকার নাই।
– আছে। আপনার মামি শুনাবে। ফুপু শুনাবে। তাছাড়া এই সংসার আমার না। আপনার মামির। হতে পারে এইটা আপনার বাবা-মায়ের বাসা। উনারা এখানে থাকতেছে। কিন্তু আপনাকে এটাও মনে রাখতে হবে, আপনার মামি কিন্তু এই সংসার নিজের মনে করেই এতকাল এই বাসায় আছেন। আপনাকে নিজের ছেলে মনে করেই কিন্তু লালন-পালন করছেন। সেখানে আমি উড়ে এসে জুড়ে বসলে তো হবে না। এইটা অন্যায়। তাছাড়া সংসার কীভাবে করে, আমি জানি না। ওইটা আমার মায়ের ডিপার্টমেন্ট। আমি তো কোনোদিন সংসার করিই নাই। আনিসা অবশ্য মায়ের এসিস্ট্যান্ট। ও একটু-একটু সংসার করতে পারে। তার চেয়ে আমি চলেই যাই। ওহ ভালো কথা, আমার বাসা তো ভাড়া করা হয় নাই। বাসার জিনিসপত্রও কিনতে হবে। আমি তাহলে বাবার বাসায় যাই। কাউকে বলব না, বিয়ে করছি। আপনিও বলবেন না। আজকে হচ্ছে মাসের একুশ তারিখ। নয় দিনের মধ্যে আমি বাসা খুঁজে পাব। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে কাপড়চোপড় গুছাতে হবে। ব্যাগ, বইপত্র সবকিছু এক দিনে নেয়া যাবে না। মা দেখে ফেললে ঝামেলা হয়ে যাবে। অল্প অল্প করে সরাতে হবে। যখন সবকিছু সরানো শেষ, আমি কলেজের নাম করে বের হয়েই দিব ফুরুত করে উড়াল। আমাকে কেউ খুঁজেই পাবে না আর। আচ্ছা, আপনি তো বললেন না, আমাকে চার লক্ষ আশি হাজার টাকা দিবেন নাকি। না দিলে কিন্তু আমি গন কেস। মা আমাকে সত্যিই বাসায় জায়গা দিবে না।
রিফায়াত আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আমিরাকে। তার চোখ বেয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে নোনাপানি। সে ফিসফিস করে বলল,
– আমি তোমাকে কোথাও যাইতে দিব না, আমিরা। কোথাও না। তুমি থাকবা আমার বুকের মধ্যে।
=================================

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩৪।
ভোর হচ্ছে। চারপাশে অল্প অল্প করে আলোকিত হচ্ছে। পাখিরা চিৎকার করছে। কাক কা কা করে ডাকছে। সুর্য পুর্ব আকাশে উদিত হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওপাশের আকাশ লাল রঙ ধারণ করেছে। দেখলে মনে হবে আকাশটাই বুঝি লাল। প্রতিদিন এভাবেই সকাল হয়। নতুন একটা দিন শুরু হয়। রিফায়াতের কখনো সকালবেলায় এই রূপ দেখা হয় না। বরাবরই ঘুমপ্রিয় মানুষ সে। তাই যতক্ষণে ঘুম ভাঙ্গে, সুর্য উদিত হয়েই যায়। আবার কখনো সুর্যের আগে তাকে বিছানা ছাড়তে হলেও বাইরের দিকে তাকানোর অবকাশ হয় না। ঘরে এসি চলে। এই অজুহাতে বাইরের পরিবেশ থেকে তার ঘরের সংযোগ একান্তই বিচ্ছিন্ন থাকে।
আজ বোধহয় অনেকগুলো বছর পর কিংবা এই প্রথম সকাল দেখা হলো। বসার ঘরে এসি চললেও জানালার পর্দা হালকা রঙের। সেই পর্দা গলে সহজেই বাইরের আলো চলে আসতে পারে ঘরের ভেতর। রিফায়াত সারারাত বসার ঘরে ছিল। সোফায় শুয়ে ঘুমের ভান করেছে। ঘুম আসেইনি। রাতভর ভুতের মতো চুপচাপ তাকিয়েছিল সিলিংয়ের দিকে। কী এক অদ্ভুত উপায়ে সিলিং জুড়ে আমিরাকেই দেখা গেছে শুধু। রিফায়াতের খুব ইচ্ছে করছিল শোবার ঘরে গিয়ে আমিরাকে এক ঝলক দেখে আসতে। যায়নি সে। অনেক কষ্টে ইচ্ছেটা লুকিয়ে রেখেছে। কারণ এই ইচ্ছে বাস্তবায়ন করতে গেলে বাসার ভেতর কিয়ামত সংঘঠিত হয়ে যেতে পারত।
আমিরা বেহুঁশের মতো ঘুমুচ্ছে। গভীর সেই ঘুম, যেন কতকাল চোখ বুজতে পারেনি। চোখমুখে এক ধরনের তেলতেলে ভাব চলে এসেছে। চুলগুলো দেখতে আগের চেয়েও দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে। মুখের চারপাশে ফুলেফেপে আছে তারা। রিফায়াত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোথায় যেন শুনেছিল, ঘুমুলে মানুষকে সবথেকে বেশি নিষ্পাপ দেখায়। সুন্দরও যে লাগে, তা কেউ বলেনি। আজ রিফায়াতের চোখে সেই সৌন্দর্য ধরা পড়েছে। এমন নয়, আমিরার গায়ের রঙটা উজ্জ্বল লাগছে। অথবা চেহারায় এক ধরনের মায়া ফুটে উঠেছে। আমিরা কোনো কারণে নাক কুঁচকে গেছে। কপালে একটু ভাঁজ। যেন ঘুমের ঘোরে প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছে সে। কেউ ওর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। অথবা ডাকাডাকি করছে।
আদতে সেরকম কিছু হয়নি। রিফায়াত একটু আগে এই ঘরে এসেছে। ঘটনার শুরু রাতের বেলায়ই। আমিরাকে কেন্দ্র করে মামির সাথে এক প্রকার বাগবিতন্ডা হয়ে যাচ্ছিল। মামি চিৎকার করে বাড়িঘর মাথা তুলে ফেলেন প্রায়। পারলে তখনই রওনা দেন বোনের বাসার উদ্দেশ্যে। কারণ আর কিছুই না। রিফায়াত বলেছিল, আজ রাতে আমিরা এই বাসায় থাকুক। শুনেই তেলেবেগুণে জ্বলে উঠেছেন মামি। আমিরাকে তিনি এখানে থাকতেই দিবেন না।
মামা বরাবরের মতো নীরব দর্শকের ভুমিকায় ছিলেন। রিফায়াতের মামা একটু গা-ঝাড়া ধরনের মানুষ। নিজের ব্যবসায় ছাড়া অন্য কোনো দিকে তাকান না। আশপাশের সমস্ত ডিপার্টমেন্ট তার স্ত্রীর কাঁধে ফেলে দিয়ে আজীবন নিশ্চিন্ত থেকেছেন। এমনিতেও স্ত্রীর বিপক্ষে কথা বলার অভ্যেস নেই। রিফায়াতের মামি খুবই জাঁদরেল ধরনের মহিলা। এই বাসায় তার হুকুম ছাড়া কেউ একবারের জায়গায় দু’বার নিঃশ্বাস ফেলে না। রিফায়াত চাচ্ছিল, মামা যেন মামির সঙ্গে কথা বলেন। এই রাতের বেলায় আমিরাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া মানে নিজেদের উপরই বিপদ চলে আসবে। মেয়েটা একাকি ফিরতে পারবে না। রাস্তাঘাটে যে কোনো অঘটন হতে পারে। বাসাও অনেক দূর। সেই পুরান ঢাকায়। ওখানকার অলিগলি মানেই একেকটা ঘুপচি। দিনের বেলায়ই ওদিকে পা বাড়ালে ঘুলঘুলির ভেতর ঢুকে পড়তে হয়। আর রাতের বেলায় তো এই ঘুলঘুলি চরম বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াবে। আমিরা হয়তো নিজের বাসা চিনতেই পারবে না। এদিকে রিফায়াত নিজে ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে, তাও সম্ভব না। সে নিজেও ওই ঘুলঘুলির ভেতর ঢুকলে আর বের হতে পারবে না। মামা বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। ভাগ্নের সঙ্গে তিনিও একমত। কিন্তু স্ত্রীকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলার সাহস তার নেই।
এরপর রিফায়াত নিজেই বুঝাল মামিকে। তবু তিনি গোঁ ধরে রইলেন। তার একটাই কথা, আমিরা বাসা থেকে বের না হলে তিনিই বের হবেন। রিফায়াত পড়ল বেকায়দায়। আচানক সে বলল,
– ও আমার ওয়াইফ। ওকে তুমি রিমা পাওনি যে, কিছু বললেই বাসা থেকে বের হয়ে যাবে। আমিও চাচ্ছি না, ও বাসা থেকে চলে যাক।
– কেন চাচ্ছিস না? ওই মেয়ে তো তোর বাবার পছন্দ করা মেয়ে না। সামিরার সাথে ওর দূর-দূরান্তের পার্থক্য। সামিরার পায়ের নখের সমান যোগ্যতাও ওর নাই। ও একটা ফ্রড।
রিফায়াত চট করে উত্তর দিল না। সামিরার বৃত্তান্ত যেদিন শুনলেন মামি, সেদিনও একই ধরনের কথা বলেছিলেন। রিমার পায়ের নখের সমান যোগ্যতা সামিরার নেই। আসলে এই কথাটা এক ধরনের অজুহাত। কাউকে প্রত্যাখান করতে হলে অন্য একজনের সাথে তুলনা দিয়ে এই কথা বলার কোনো জুড়ি নেই। মামি ভালো করেই জানেন, রিমার সাথে রিফায়াতের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। রিমা যেরকম শক্ত ধাতের মেয়ে। মামির অপমানজনক কথাবার্তা শোনার পর রিফায়াতের সাথে সম্পর্ক রাখার কথা ছিল না তার। তবু সে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে চেয়েছিল। তার দেয়া শর্তগুলো রিফায়াতকে হলফ করে মানতে হবে। রিফায়াত এই সুযোগ লুফে নিতে পারেনি। এরপর তাদের সম্পর্ক জোড়া লাগার ক্ষীণতর আশাও উবে গেছে। তাই রিমার সাথে অনায়াসে সামিরার তুলনা দেয়া যায়। রিমাকে তুলনামুলক ভালো বললেই তো সে আর ফিরবে না। এখন আবার আমিরার সাথে সামিরার তুলনা হচ্ছে।
মামির আসল উদ্দেশ্য রিফায়াত খুব ভালো করেই জানে। তার বোনের মেয়ে আদৃতাকে তিনি খুবই আদর করেন। নিজের মেয়েকে সবসময় আদৃতার উদাহরণ দেন। পড়াশুনায় মেয়েটা খুবই ভালো। একই সাথে নানান গুণাবলীও আছে। মেয়েটা খুব ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করে। গান গায়। নাচ শিখে। আবৃত্তি করে। দেখতেও সুন্দরী। মামির খুব ইচ্ছে, আদৃতার বিয়ে হোক রিফায়াতের সঙ্গে। ভাগ্নিকে তিনি নিজের ঘরে বউ করে আনবেন। এই সংসারটা তার এত বছরকার যত্মে গড়া। এখানে আদৃতা ছাড়া আর কাউকে মানায় না। কাউকে তিনি জায়গা দেবেনও না।
রিফায়াত হঠাৎ করেই বলল,
– এরপর শুনব, আদৃতার পায়ের নখের সমান যোগ্যতা সামিরার নাই। তোমার তো আদৃতা ছাড়া আর কাউকেই যোগ্য মনে হয় না।
মামি আচানক থমকে গেলেন। তিনি জানেন, রিফায়াত তার ভাগ্নিকে বিয়ে করতে আগ্রহী না। এর পেছনে কারণ জানতে অনেক চেষ্টা করেছেন। খুঁজে পাননি। একবার সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন। রিফায়াত রহস্যময় উত্তর দিয়েছে,
– আমি যেরকম মেয়ে পছন্দ করি, আদৃতা ওরকম না।
তিনি এরপর ভাগ্নিকে রিফায়াতের পছন্দমতো চলার পরামর্শ দিয়েছেন। রিফায়াতের পছন্দ জেনে নিয়েছেন কৌশলে। এরপর ভাগ্নিকে সেভাবেই উপস্থিত করেছেন কয়েকবার। কিন্তু রিফায়াত অন্য জগতের মানুষ। আদৃতাকে সে চোখেই দেখে না। এরপর অবশ্য আসল কারণ জানা গেছিল। রিমার সাথে রিফায়াতের কয়েক বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক। তিনি বিষয়টা জানতেন না। রিমার কথা রিফায়াত কিছুই বলেনি তাকে। জানলে আরও আগেই ভাঙ্গানি দেবার ব্যবস্থা করতেন।
মামি চুপ করে আছেন। রিফায়াতের মনে হলো, এখন আদৃতার কথা না বললেই ভালো হতো। আদৃতার প্রসঙ্গ উঠতেই পরিবেশটা খুব ভারী হয়ে গেছে। মামির রাগ আরও চড়ছে। আদতে চুপ থাকলেও তার ভেতর আগ্নেয়গিরির স্ফুর্লিঙ্গ ফুটছে। রিফায়াত মনে মনে ঢোক গিলল। আদৃতার কথা সে বলতে চায়নি। আচানক মুখ ফস্কে বের হয়ে গেছে। খানিক পর প্রসঙ্গ পালটে ফেলল সে। আগের কথার রেশ ধরে বলল,
– ইট ওয়াজ অ্যা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং, মামি। আমিরা আমাকে যা যা বলেছে, সবটা শোনার পর আমার মনে হলো এখানে আমিরাকেও দোষ দেয়া যায় না। ও আসলে জানত না…
– এগুলো সব মিথ্যে কথা। বানানো গল্প। তুই বিশ্বাস করে নিলেও আমি করব না।
– বিশ্বাস করা ছাড়া আর তো কোনো উপায় নাই। ভুলটা আমার ছিল। আমিই ওদের বাসায় গিয়েছিলাম।
মামি তেঁতে উঠলেন,
– যত যাই হোক, এটা কোনোভাবেই কো-ইন্সিডেন্স হতে পারে না। নট পসিবল।
– ঠিক আছে। আমি তাহলে শফিক নামের ওই ছেলের সাথে যোগাযোগ করি। আমিরার কাছে তার ডিটেইলস থাকার কথা। তারপর খোঁজ নিলেই জানা যাবে, কতটা সত্যি আর কতটা মিথ্যা।
– আমিরাকে নিয়ে তোর এত মাথাব্যাথা কেন? ওকে বল এক্ষুনি চলে যেতে। ও ভালোয়-ভালোয় যেতে না চাইলে কীভাবে যাওয়াতে হয়, তার ব্যবস্থা…
– ও চলে যেতে চাচ্ছে। তুমি ওকে যেই ভয় দেখিয়েছ, এরপর ওর নিজেরও ইচ্ছা নাই এখানে থাকার। আমি যত যাই বলি না কেন, সে ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাচ্ছে। বারবার বলছে, চলে যাবে।
মামি গলা ফাটিয়ে বললেন,
– তো যাচ্ছে না কেন? কে আটকে ধরে রাখছে ওকে? নাটক কিন্তু সন্ধ্যা থেকে অনেক করে ফেলছে। আমি সবকিছু হজম করতেছি। তার মানে এই না…
– আমি ওকে যেতে দিচ্ছি না।
– কেন? তুই কি চাস না আমি এখানে থাকি? ঠিক আছে…
মামি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিতেই রিফায়াত আঁতকে উঠল,
– না মামি। তুমি আমার কথাটা শুনো। প্লিজ।
– কী শুনব তোর কথা? কী চাচ্ছিস তুই? তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ওই মেয়ে তোকে বশ করেছে। কী দেখে ওই কালী তোর মনে ধরল, বল তো। তাও যদি দেখতে ভালো হতো। না আছে চেহারা, না হাইট। মাথার উপরও কাকের বাসা…
– আল্লাহ ওকে এইভাবে বানাইছেন। এখানে ওর কোনো হাত নাই।
– কিন্তু ওকে পছন্দ করার পেছনে তোর হাত আছে। তুই এতই মজে গেছিস আমিরার প্রতি, একবারে বিয়ে করেই বাসায় নিয়ে আসছিস। কোন সাহসে এই কাজ করলি? তোর কি একবারও মনে হলো না, আমি কোনো অবস্থাতেই এই মেয়েকে অ্যাকসেপ্ট করব না? একবার কি আত্মা ঘামল না?
রিফায়াত চুপ রইল। আমিরাতে আসলেই মজে গেছে সে। একারণে ওকে হারানোর বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে চায়নি। বিয়ের পর মামির চিন্তা মাথায়ও আসেনি ওর। অবশ্য আসলেও কি বিয়েটা আটকে যেত? মামি প্রচন্ড একগুঁয়ে স্বভাবের। আদৃতা ছাড়া বাকি সব মেয়ে তার চোখে অসুন্দর, খুঁতওয়ালা। আদৃতার বদলে কাউকে মানায় না যেন। এই কথাটা রিফায়াত জানত। তার মনের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল রিমার সাথে ব্রেকআপ হবার পর। এই ক্ষোভ দিনকে দিন বিদ্রোহে পরিণত হয়েছে। আজ কাজি অফিসে বসে রেজিস্টার খাতায় সাইন করার সময় মন অন্তত এটুকু জানত, আদৃতাকে সে বিয়ে করবে না।
মামি চিৎকার করে বলল,
– কথা বলিস না কেন? এতকাল তোর ফুপু লাফালাফি করল তোর বাবার নাকি পছন্দ করা মেয়ে আছে। সেই মেয়ের প্রতি তোর ভালোই আগ্রহ দেখা গেল। ফুপু-ভাতিজা মিলে ফোনে গুটুর-গুটুর করলি। শুনলাম তো সবই। ফুপু আবার ছবি-বায়োডাটাও পাঠিয়েছে। আমার বোনের বাসায় যাওয়ার সময় তোর হয় না। তুই এত বিজি থাকিস। কিন্তু ফুপুর কথামতো সামিরাকে দেখতে চলে গেছিস ঢ্যাং ঢ্যাং করে। আমাকেও বলিস নাই। কারণ আমি জানলে তো মানা করতাম। যাইতে দিতাম না পুরান ঢাকায়।
– মামি, প্লিজ। এই রাতের বেলায় লম্বা প্যাচাল শুরু করো না। আমিরাকে নিয়ে কথা বলতেছিলাম। সো, আমিরাতেই স্টিক থাকি।
– স্টিক থাকার কিছু নাই। ওই মেয়ে এখানে থাকবে না, ব্যস। এটাই ফাইনাল কথা।
– আমিও ওকে রাখব না এখানে। তাই বলে রাতের অন্ধকারে বাসা থেকে বের করে দিতেও চাচ্ছি না। ও নিজে এই বাসায় আসেনি। আমি নিয়ে এসেছি। আফটার অল, ও আমার ওয়াইফ। তুমি মানো বা না মানো, দেয়ার ইজ অ্যান অফিশিয়াল ডকুমেন্ট। বুঝতে পারতেছ? ও নিজের ইচ্ছায় না গেলে আমি ওকে বের করে দিতেও পারব না। আমার সেই রাইট নাই।
– তুই তো বললি, ও নাকি চলে যাইতে চাচ্ছে। তুই আটকায় রাখছিস।
– আমি বলতেছি, ও চলে যাবে। কিন্তু তার আগে কিছু ফরমালিটিস আছে। সেগুলো অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হবে। সর্ট আউটের ব্যাপার আছে।
– কী সর্ট আউট?
– ওকে টাকা দিতে হবে।
– কী?
– দেনমোহর।
– কত টাকা?
– আঠারো লক্ষ বাষট্টি হাজার।
মামির চোখ কপালে উঠল। তিনি গলা চড়িয়ে বললেন,
– ওই ফকিন্নি জীবনে চোখে দেখছে আঠারো লাখ টাকা? এই দেখ, বলছিলাম না, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসছে! দেখলি তো। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই টাকা চাইতেছে। দুইদিন পর আবার আসবে। তখন বলবে প্রপার্টি আমার নামে লিখে দাও। তুই যে কী বিপদ ডেকে আনলি, রিফায়াত!
– এটা ওর দেনমোহর।
– দেনমোহরের অঙ্ক এত বেশি হবে কেন? আঠারো হাজার দিয়ে কাজ সারতে পারিস নাই?
– দেনমোহরের কথা কাজি সাহেব আমিরাকে জিজ্ঞেস করছেন। আমাকে তো বলেন নাই।
– ওই কাজি দেখ গিয়ে ওই মেয়েরই সেটআপ করা। তোকে বুদ্ধি বানাইছে, বুঝলি! এগুলো সব টাকা হাতানোর প্ল্যান। কাজির কমিশনও আছে এর মধ্যে।
– আমার প্রবলেম আমাকেই সলভ করতে দাও। তুমি প্লিজ এটা নিয়ে কোনো টেনশন কইরো না।
– প্রবলেম কেমনে সলভ করবি তুই? এই মেয়ে টাকা ছাড়া নড়বেই না। এখন টাকা হাতে পাইলে এখনই বের হয়ে যাবে বাসা থেকে।
– এখন এত টাকা দেয়ার সিচুয়েশন নাই। সো, আমিরা আজ রাতে এই বাসায় থাকুক। কাল আমি সবকিছু সর্ট আউট করব। ঠিক আছে?
– তুই আঠারো লাখ টাকা দিয়ে দিবি ওকে? সিরিয়াসলি?
রিফায়াত হতাশ সুরে বলল,
– এছাড়া আর কোনো অপশন কি আছে?
মামি শেষমেশ ক্ষান্ত হয়েছেন। তবে রাগ কমেনি। কপালের দুপাশের রগ দপদপ করছে। ঠিকমতো কথাই বলতে পারছেন না। প্রেশার বেড়ে হাই হয়েছে। রিফায়াত এরপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। মামি বললেন,
– তুই ওই ঘরে যাবি না।
রিফায়াত পেছন ফিরল। অবাক ভঙ্গিতে বলল,
– মানে কী?
– মানে তুই অন্য ঘরে ঘুমা। ওই মেয়ের সাথে এক ঘরে ঘুমানোর মানে বুঝিস না? তুই সেধে সেধে ওকে চান্স দিচ্ছিস কেন ব্ল্যাকমেইল করার?
– বুঝলাম না, আমি কী চান্স দিব?
– আজকে এই মেয়ের সাথে এক ঘরে ঘুমাইলে দুইদিন পর দেখবি বিশাল পেট নিয়ে হাজির হয়েছে। বলবে, তোর বাচ্চা ক্যারি করতেছে সে। কার না কার সাথে শুয়ে পেট বাজাবে। এরপর তোর ঘাড়ে ফালাবে। টাকাপয়সার খনির গন্ধ পেয়েছে এই মেয়ে। সহজে কি তোর পিছু ছাড়বে মনে করছিস? তোরে পাইছে সোনার রাজহাঁস।
রিফায়াত অবাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মামির মুখে কি কিছুই আটকাচ্ছে না? সত্যি বলতে, আমিরার সাথে এক বিছানায় ঘুমুবার চিন্তা তার মাথায় আসেইনি। এও মনে নেই, আজ ওদের বাসর রাত। আমিরাকে বিয়ে করা পর্যন্তই তার সমস্ত প্রাপ্তি সীমাবদ্ধ ছিল। বারকয়েক খুব কাছাকাছি গেলেও কামনার দৃষ্টি তাকায়নি একবারও। রিফায়াতের মনেই হয়নি, আমিরা ওর শয্যাসঙ্গিনী। কেন মনে আসেনি, এটা অদ্ভুত লাগল। হতে পারে, তার মাথায় শুধু আমিরাকে নিজের করে পাওয়াটা মুখ্য ছিল। আবার হতে পারে, রিমার জায়গাটা অন্য কাউকে দেয়ার মতো মানসিক অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি।
খানিকটা সময় পর রিফায়াত মাথা নেড়ে বলল,
– তুমি টেনশন করো না। ওই ঘরে ও একাই ঘুমুবে।
এরপর অবশ্য অনেকটা সময় রিফায়াত শোবার ঘরে ছিল। আমিরার খাবার গরম করে এনেছে। সাথে তার নিজের খাবারও নিয়ে এসেছিল। দুজন একসাথে বসে রাতের খাবার খেয়েছে। আমিরা আসলেই খুব কম খায়। তাকে দেয়া হয়েছিল, এক প্লেটের অর্ধেক ভাত। বাকি অর্ধেকে তরকারি আর ভাজি। নির্ঘাত মামির নির্দেশে বুয়া এই কাজ করেছে। বাসায় কেউ আসলে এত অল্প ভাত তাকে দেয়া যায় না। আবার হতে পারে, তখন ভাতই ছিল ওইটুকু। আমিরা প্লেটের ভাত অর্ধেকেরও কম খেয়েছে। সর্বসাকুল্যে তিন-চার নলা হবে। তার হিসেবে অবশ্য আরও বেশি। কারণ প্রতি নলায় সে ভাত তোলেই চার-পাঁচটা। মুরগির তরকারিতে দুটো মাংস আর একটা আলু ছিল। সে অপেক্ষাকৃত ছোট মাংস খেয়েছে। আর একটা আলুর অর্ধেক। করোলা ভাজি খেয়েছে চার ভাগের এক ভাগ। পানি গ্লাসের অর্ধেকটা। ব্যস, তার খাওয়া শেষ। রিফায়াত হতভম্ব হয়ে বলল,
– এইটুকু খেয়েই হয়ে গেল তোমার?
– হু।
– তুমি সারাদিন না খেয়ে আছ। ক্ষুধা মিটল কীভাবে?
– সারাদিন না। ওই বারগার শপে গিয়ে আস্ত একটা বারগার খেয়েছি। বিশাল সাইজ। আপনি আসার আগেই অর্ডার করে খেয়ে ফেলেছিলাম। কারণ অর্ডার না করলে ভেতরে বসতে দিত না।
– তাও সকালের কথা। এরপর তো কিছু খাও নাই।
– দুপুরে এমনিতেও আমার খাওয়া হয় না। কলেজে থাকি তো। বাসা থেকে টিফিনের খরচ দেয় না। মা বলছে, কলেজ ছুটি হইলে এরপর বাসায় গিয়ে ভাত খাইতে। কিন্তু আমার তখন খাইতে ইচ্ছা করে না। তাছাড়া, কলেজ শেষ করে বাসায় ফিরতেও বিকাল হয়। তখন আমি দুধ চা খাই, এক পিস টোস্ট দিয়ে।
– আর রাতের খাওয়া?
– এই যে খাইলাম!
– এটুকুতেই হয়ে গেল?
– হু। আমি বেশি খাই না রাতে। ভরপেট খাইলে আমার ঘুম হয় না ভালো। বদহজম হয়। পেটের মধ্যে ঘুটঘুট করে।
আমিরার নির্ঘাত বদহজম হয়েছে। রাতে ঘুমায়নি ভালোমতো। এজন্য ঘুমের ঘোরে কপাল কুঁচকে রেখেছে। পেট ব্যাথা করছিল কি? রিফায়াত চট করে ওর পাশে শুয়ে পড়ল। মামির এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি। সকালে একদফা ঘুম ভাঙ্গার পর ফজরের নামাজ পড়ে আবার শুয়েছেন তিনি। এই ঘুম ভাঙ্গতে ঘন্টাদুয়েক লাগবে। মামা উঠবেন আরও ঘন্টাখানেক পর। বুয়ার অবশ্য উঠার সময় হয়ে গেছে। রিফায়াতকে যদি সে বসার ঘরে খুঁজে না পায়, মামির কাছে গিয়ে কি কথা লাগাবে?
ওসব চিন্তাভাবনায় আপাতত গেল না রিফায়াত। গতকাল আমিরার যা অবস্থা ছিল, আজ তার নিজের অবস্থা সেরকম। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। রাতভর ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে চোখ বুজে এলেও শান্তিতে ঘুমানো যায়নি। বিছানায় শুয়ে যে আরাম, তা পাচ্ছিল না। সোফা যদি বিছানার কাজই করত, তাহলে আর বিছানার দরকার হতো না। তার উপর মশার উৎপাত আছে। অ্যারোসল দিয়ে মোটামুটি কাজ হলেও সেই গন্ধে ঘুম পালিয়েছিল। তাছাড়া এসির বাতাস গায়ে না লাগলে ওর ঘুম হয় না। বসার ঘরে এসি আছে। কিন্তু সেটা সোফা থেকে অনেক দূরে। সরাসরি বাতাসটা গায়ে লাগে না। তবু কোনোরকমে ঘুমুবার চেষ্টা করছিল। এরপর তো পর্দা গলে দিনের আলোই চলে আসতে শুরু করল বসার ঘরে। খানিকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে এরপর পা টিপে সে চলে এসেছে শোবার ঘরে। রাতে কয়েকবার ভেবেছিল, সবাই ঘুমিয়ে গেলে পা টিপে ঢুকে পড়বে শোবার ঘরে। কিন্তু দেখা গেল, মামি নিজের শোবার ঘরের দরজা আটকাননি। নিজের ঘরে যেতে হলে রিফায়াতকে তার ঘরের সামনে দিয়েই যেতে হবে বিধায় এই নজরদারির ব্যবস্থা করেছেন। এমনিতেও তিনি সারারাত সতর্ক ছিলেন। দু-একবার ঘর থেকে বের হয়ে এসে উকি মেরেছেন, রিফায়াত বসার ঘরে আছে কি না। অন্ধকারে বুঝতে পারেননি রিফায়াত জেগে আছে। তাকে দেখেছে। ফজরের নামাজ পড়ার আগেও একবার উকি দিয়েছেন। তারপর নিশ্চিন্ত মনে ঘুম দিয়েছেন। অভ্যেসবশত ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছেন। এই সুযোগে রিফায়াত চলে এসেছে নিজের ঘরে।
দুই হাত বাড়িয়ে আমিরাকে নিজের কাছে টেনে আনল রিফায়াত। আমিরা গুটিসুটি হয়ে আছে। বোধহয় ঠান্ডা লাগছে খুব। কম্বলের তলায় তার হাত-পাগুলো ভাঁজ করে রাখা। এসির বাতাস সরাসরি মুখে এসে লাগায় নাক বন্ধ হয়ে আছে। একটু পর পরই নাক টানার চেষ্টা করছে আর মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রিফায়াত রিমোটের বাটন চেপে এসি বন্ধ করে দিল। ঘরটা খুব ঠান্ডা হয়ে আছে। এই ঠান্ডাটুকুই তার ঘুমুবার জন্য যথেষ্ট। টুপ করে আমিরার কপালে আলতো চুমু দিল সে। ফিসফিস করে বলল,
– আমার লাইফে তুমি ভুল মানুষ না, আমিরা। আমার জন্যই তুমি এই দুনিয়াতে আসছ। আল্লাহ তোমার আর আমার জোড়া লিখে রেখেছিলেন বলেই বিয়েটা হয়েছে। ভুল ঠিকানায় চলে যাওয়াটা আসলে ওছিলা মাত্র।
আমিরা ঘুমের ঘোরে উত্তর দিল,
– হু।
– আমিও তোমার লাইফে ভুল কেউ না।
– জানি।
– তুমি কিন্তু বলোনাই, কেন সব জেনেশুনেও আমার কাছে মিথ্যে বললা।
– আমি শফিককে বিয়ে করতে চাই না। তাই মিথ্যা কথা বলছি।
– কেন?
– শফিককে আমার পছন্দ না।
– তুমি তো তাকে দেখোই নাই।
– দেখার দরকারও নাই। তোমাকে দেখছি না? ওটুকুই আমার জন্য এনাফ।
আমিরার কি ঘুম ভেঙ্গেছে? রিফায়াত সেটাই ভাবছিল। একটুপর বুঝল, ঘুম ভাঙ্গেনি। তবে পাতলা হয়ে এসেছে। রিফায়াতের কথাগুলো তার কানে যাচ্ছে। তাই ঘুমের ঘোরে উত্তর দিচ্ছে। নয়তো ‘তুমি’ সম্বোধন করত না। পরশু বিকেলে যখন ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, রিফায়াত দুবার ওকে অনুরোধ করেছে ‘তুমি’ বলতে। ‘আপনি’টা শুনতে খুব দূরের লাগে। আমিরা উত্তর দিয়েছিল,
– দূরের লাগলেও আমার কিছু করার নাই। আমি চট করে কাউকে তুমি বলতে পারি না।
রিফায়াত তখন বলল,
– কিন্তু আমরা দুদিন পরই বিয়ে করতেছি। সো, আমাকে তুমি বলাই যায়। তাই না?
– আপনার কী মনে হয়, বিয়ে হলেই কি খুব আপন হওয়া যায়? মনের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়?
রিফায়াত উত্তরটা দিতে পারেনি। আমিরার প্রশ্নটা শুনতে খুব হালকা লাগলেও উত্তর দিতে হয় ভারী। এরপর আমিরা নিজেই বলল,
– স্যরি বাট খুব কাছের কেউ না হলে ‘তুমি’ বলতে পারি না। আমাকে দিয়ে হয় না।
তার মানে কী দাঁড়ায়? রিফায়াত এখন আমিরার খুব কাছের মানুষ? তার মনের মধ্যে কি স্থায়ী আসন তৈরি হয়ে গেছে ওর জন্য? রিফায়াত ফিসফিস করে বলল,
– আমি কি ঠিক শুনলাম?
– কী?
– আমাকে ‘তুমি’ বলছ একটু আগে।
– ‘তুমি’ই তো বলব।
– এর মানে কি আমি তোমার খুব আপন? তোমার মনের খুব কাছাকাছি চলে যেতে পারছি?
আমিরার মুখে আবছা হাসি ফুটল। সে বিড়বিড় করে বলল,
– তুমি তো আমার মনের মধ্যেই বসে আছ।
– তাই? কখন থেকে?
– যখন তোমাকে প্রথম দেখলাম। তুমি চায়ের দোকানদারকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেছিলা। সে আমাদের বাসা দেখিয়ে দিল। ঠিক তখন তুমি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাইলা। এরপর হাসলা। তখন আমি মনে মনে বলতেছিলাম, তুমিই কি শফিক? যদি হও, তাহলে আমি বিয়ে করতে রাজি।
রিফায়াত অবাক হলো। সে জানতই না, আমিরা ওই মুহূর্তে তাকে দেখেছে। সেও তাকিয়েছিল। কিন্তু অত ভালো করে লক্ষ করেনি। রাস্তা থেকে ওই জানালাটা তেমন দেখাও যায় না।
– কিন্তু আমি শফিক না।
– আরে, নামে কী আসে যায়? তুমি শফিক বা টফিক সেইটা দিয়ে তো আমার দরকার নাই। আমার শুধু তোমাকেই লাগবে। তুমি মফিজ হলেও সমস্যা নাই!
রিফায়াত হেসে ফেলল। আমিরার মুখটা খুব কাছে চলে এসেছে। ঘুমের ঘোরে কথা বলতে-বলতে আমিরা তাকে কোলবালিশ বানিয়ে ফেলেছে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়েকে এতটা কাছ থেকে দেখা হচ্ছে রিফায়াতের। দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড় তার। জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল,
– এতই যখন আমাকে লাগবে, চলে যাওয়ার জন্য পাগল হইছ কেন? খালি টাকা-টাকা করো। চিনছ শুধু টাকা! পারো শুধু হিসাব করতে, কত টাকা পাইলে সারাজীবন চলে যাবে তোমার। ধরো টাকা দিয়ে দিলাম। তারপরও কি আমাকে ছেঁড়ে থাকতে পারবা?
জিজ্ঞেস করা হলো না। তার বদলে সে বলল,
– ঠিক আছে, আমি এখন থেকে ‘তোমার মফিজ’।
– উহু। তুমি আমার রিফায়াত। শুধু আমার!
‘আমার রিফায়াত’ কথাটা অদ্ভুত রকমের জোর আছে। প্রবল অধিকারের ছাপ পাওয়া যায়। ঠিক এমন করে রিমা কখনো বলেইনি! তার কাছে সে ছিল শুধুই ‘রিফায়াত’!
আচমকা ফোন বাজতে লাগল। বালিশের নিচে রাখায় ভাইব্রেশন টের পাওয়া যাচ্ছে। রিঙটোন অফ করা। আমিরা বোধহয় আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে তার নাক দিয়ে। উহু, হা করে শ্বাস নিচ্ছে। নাক তো বন্ধ! রিফায়াতেরও চোখ বুজে এসেছিল। ফোনের ভাইব্রেশন টের পেয়ে তন্দ্রা উবে গেছে। খুব সাবধানে আমিরাকে খানিক দূরে সরিয়ে দিল সে। ফোনটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠার জোগাড় হলো ওর। স্ক্রিণে লেখা উঠেছে, ‘রিমা কলিং’…
===========================