তোমার নামে হৃদয় পর্ব-৩১+৩২+৩৩+৩৪

0
358

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩১)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
” একা একা বসে কি ভাবছ? ”
সাদিবের কণ্ঠস্বর কর্ণকুহর অব্দি পৌছুতে তামান্না নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরুল। সাদিবের আগমন এতক্ষণ সে টের পায়নি। একপলক তাকিয়ে থেকে পরক্ষণে চোখ সরিয়ে নিল।
” না কিছু না। ”

সাদিব ঘড়িটা হাত থেকে খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, ” সাদিয়ার সাথে কথা হয়েছে? ”

তামান্না মৌন থেকে মাথা দোলাল।
” কি বলে? ”

” যা তোমাকে বলেছে তাই তো বলবে! ”

সাদিবের হাত থেমে গেল। দু’হাত দূরে বসে থাকা তামান্নার পানে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকাল।
” আমাকে কি বলেছে? ”

” বলল রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, সাথে মায়ের ভয় তো আছেই৷ তাই তখন নিজের দোষ ডাকতে আমাকে ব্যবহার করেছে! ”

সেকেন্ড দুয়েক নিশ্চুপ থেকে তামান্না সাদিবকে জিজ্ঞেস করল, ” একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

সাদিব মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মুখে বলল,
” একটা কেন? আপাতত ফ্রী আছি সো হাজারটা করতে পার! ”

” তুমিও কি তোমার মাকে ভয় পাও! ”

তামান্নার করা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে সাদিব ভড়কালো। বিস্মিত চাহনিতে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তামান্না জিজ্ঞানু চাহনি তখনও সাদিবের দিকে চেয়ে নিজের করা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ব্যস্ত। তামান্নাকে গুরুত্বের সাথে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদিব হেসে ফেলল। যেন মনে হল তাকে সে ভারী হাসির কথা বলে ফেলেছে। তামান্না সেই হাসিতে পুনরায় মুগ্ধ হল। ভাবল কোনো পুরুষ মানুষকে হাসলেও এত সুন্দর লাগে? সবসময় গল্প উপন্যাসেই কেবল সুদর্শন পুরুষের বর্ণনা পড়ে এসেছে। তাদের কারোর সাথে সাদিবের মিল খুঁজে পায় না তামান্না। উপন্যাস পড়ে পড়ে মাথা খারাপ করে ফেলেছিল।উপন্যাসের নায়কদের মতো একজন সুদর্শনের পাশাপাশি একজন যত্নশীল জীবনসঙ্গী আশায় ছিল। সাদিব তামান্নার চোখে তাদের চেয়ে সুদর্শন। তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ এই পুরুষটা সচরাচর খুব কম হাসে। যতটুকু হাসে মুচকি হাসিতেই সীমাবদ্ধ। তার দন্ত প্রদর্শনের হাসির দর্শন পাওয়া মুশকিল। সেই হাসির দর্শন তামান্না হাতে গুণে দুই তিনবার পেয়েছে। তামান্না নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, ‘ আচ্ছা ডাক্তার সাহেব সুদর্শনের পাশাপাশি কতখানি যত্নশীল? তাকে কতখানি বোঝে? একটু নাকি একটুও না! ”
প্রশ্নের জবাব পায় না। পায় সাদিবের খুব খারাপ একটা অভ্যাস, যা সাদিবের প্রতি বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অযথা রেগে গিয়ে চেঁচামেচি করা, একদমই অপছন্দ তামান্নার।

তামান্না সাদিবকে হাসতে দেখে বলল, ” তুমি হাসছো? ”

” কেন আমার হাসি সুন্দর না? ”

” একদমই না। খুব পচা দেখতে, এতো পচা হাসি পৃথিবীর আর কারোর হয় বলে আমার জানা ছিল না! ”

” আচ্ছা! তাই বুঝি? তাহলে তুমি সেদিন প্রাচীর থেকে পড়ে গেছিলে কেন? এখন ওভাবে তাকিয়েই বা দেখছিলে কেন? ”

তামান্না সাদিবের সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশের মতো বোকামি করার চিন্তা করল না। কণ্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল, ” সেটা তো আচমকা হাত ফসকে পড়ে গেছি। আর এখন বিরক্ত হচ্ছি। ”

” আচমকা হাত ফসকানোর জন্যে কোনো কারণ থাকে। নয়তো দক্ষ মানুষ এভাবে পড়ে কিভাবে? তাই আমার সাথে মিথ্যে কথা একদম বলবে না বুঝলে। তুমি আমার চোখে ধরা পড়ে গেছ। ”

” হ্যাঁ এখন কি তোমার হাসি বেটে খাবো আমি? ”

সাদিবের অধর জুড়ে দুষ্ট হাসি ফুটে উঠে,
” খাওয়ারও চিন্তা কর তাহলে আচ্ছা! কোনো সমস্যা নেই। তুমি প্রথমবার কিছু চাইছো আমি তোমাকে ফিরাই কি করে বল? ” কথা শেষে চোখ মারে।

” বদমাশ লোক একটা! ” বলে তামান্না সাদিবের সামনে থেকে প্রস্থান করল।

পেছন থেকে সাদিব চেচাল, ” আজ গ্রীন টি-র সাথে অন্য কিছুও চাই কিন্তু! শুধু গ্রীন টি-তে পেট ভরবে না আমার বলে দিলাম। ”
.

.
সন্ধ্যার সময় মা একাই রান্নাঘরে থাকেন। আজও সেরকম উনার পাশে কাউকে দেখা গেল না। উনি একা একা সব করছেন নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে! ভেবে উনার কাছে গিয়ে বললাম, ” মা আপনি সব তো একা একাই করছেন। আজ আমি করি? আপনি নাহয় একদিন জিরলেন! ”

তিনি স্বভাব সূলভ গম্ভীর গলায় বললেন, ” তার দরকার পড়বে না। সারাজীবন যেমন পেরেছি এখনো তেমন পারবো। ”

” মা আপনার বয়স হচ্ছে। সাথে কষ্টও পাচ্ছেন। এখন নাহয় কষ্ট করছেন এভাবে কতদিন! ”

” যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন। কপালটাই তো এমন কি করব! ”

উনার কথা যতটা সম্ভব গায়ে লাগানো থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলাম। জানি উনি আমাকে অপছন্দ করেন, কিন্তু এভাবে কতদিন! একদিন না একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। না হলেও আমাকে মানিয়ে নিতে হবে। তার জন্য সামনের দিকে আমাকেই অগ্রসর হতে হবে। সারাদিন আর কত হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়! উনি গুরুজন তারওপর এ বাসায় তার আধিপত্য বিস্তার করে। তাই উনার মাথা ঝুঁকানোর দরকার পড়বে না। সেদিক থেকে আমার অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত।

” এভাবে কেন বলছেন। সারাদিন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে আমার তো ভালো লাগে না বলুন। তাই বলছিলাম আমি আপনাকে এখন থেকে বেশি না টুকটাক সাহায্য তো করতেই পারি। ”

আমার কথার সারমর্ম শাশুড়ি মা হয়তো বুঝলেন। চুপচাপ সরে গেলেন। বলে গেলেন, ” আমি ডাইনিং এ আছি। কিছু না পারলে ডাক দিও। ”
.

.
পরিস্থিতি সব স্বাভাবিক হওয়ার পর্যায়ে। শ্বাশুড়ি মা এখন আর আগের মতো খুব একটা বাঁধা দেন না। শুরুর মতো করেই সব চলছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার নতুন নতুন আবিষ্কারের রান্না খেয়ে বাবা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। বিয়ের আগে এমনটা প্রায়ই আমার বাবার সাথে করতাম আমি। বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবাকে নিত্য নতুন রেসিপি রান্না করে খাওয়াতাম। তখন ছিলেন নিজের বাবা এখন হচ্ছেন আরেকটা বাবা। সাদিয়া নিজেকে অনেকটা শুধরে নিয়েছে। আগের মতো মিশতে অবশ্য বিব্রতবোধ করে ঠিকই। আমিও তাকে সেভাবে ঘাঁটি না। কি দরকার! যে বিশ্বাস একবার উঠে যায় তা কি পুনরায় ফেরত পাওয়া যায়? কখনো না! বিশ্বাস এমন একটা জিনিস যা একটি সম্পর্ককে মজবুত করতে যেমন সহায়ক তেমনি নিমিষেই ভেঙে ফেলতে সহায়তা করে।

এরই মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। পরীক্ষাগুলো ভালোভাবে শেষ হয়েছে। সেদিন শেষ পরীক্ষার দিন শেষবারের মতো সব বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছিলাম। একটানা চার বছরের বেশি সময় ধরে এদের সাথে কাটিয়েছি। স্মৃতির পাতার অনেকখানি জায়গা জুড়ে তাদের অবস্থান। এখান থেকে গিয়ে কেউ বিয়েসাদী করে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, কেউবা নতুন চাকরির সন্ধানে নেমে পড়বে। সবাই যে যার নিজেদের জীবন গোছাতে সময় দেবে। কারোর জন্য কারোর বিন্দু পরিমাণ সময় বরাদ্দ থাকবে না। এদিনের পর থেকে আর কারোর সাথে কারোর সেভাবে দেখা সাক্ষাৎ হবে না, যোগাযোগ করা হবে না, হবে না রোজকার আড্ডার আসর জমানো!

বাসা থেকে গত কয়দিনের ব্যস্ততায় কারোর সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। শেষবার বাবার সাথে কথা বলেছিলাম। ও বাসায় যাওয়ার কথা প্রায় ভুলে বসেছি। সন্ধ্যায় ড্রয়িং রুমে বাবা বসে টিভিতে খবর দেখছিলেন৷ সাদিব হসপিটাল থেকে ফিরেছে অনেকক্ষণ। নিজের ঘরে ফ্রেশ হতে গেছে। সন্ধ্যার নাস্তা হিসেবে আজ পাকোড়া বানাচ্ছিলাম। এক চুলায় পাকোড়া ভাজছি, আরেক চুলায় বাবার আদা দেওয়া রং চা বসিয়েছি। এ বাসায় সবাই বেশ স্বাস্থ্য সচেতন হলেও ভাজাপোড়া খেতে কার না ভালো লাগে! তাই মাঝে মাঝে ভাজাপোড়ায় হালকা কিছু বানানো লাগে। শ্বাশুড়ি মা তা নিয়ে প্রায়ই শ্বশুরের সাথে চেচামেচি করেন।

খবর দেখার এক ফাঁকে বাবা সামান্য হাঁক ছেড়ে ডাকলেন, ” কই হলো? এত সময় ধরে অপেক্ষা করতে পারছি না মা, তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো! ”

আমি রান্নাঘর থেকে জবাব দিলাম, ” এইতো বাবা হয়ে গেছে। এক্ষুনি নিয়ে আসছি। ”

পাকোড়ার প্লেট এবং রং চা নিয়ে ড্রয়িং রুমে যাওয়ার সময় বাবার ফোনে কল আসে। কল ধরতে তিনি উঠে বারান্দার দিকে চলে যান। অনেকক্ষণ কথা বলার পর ফিরে এসে আমাকে বললেন, ” তোমার বাবা ফোন করেছিল। বলল তোমাকে নাকি ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না? কোনো কারণে কি তোমার বাবার ওপর রেগে আছো তুমি? ”

বাবার কথা বলতে মনে পড়ে গেল সেদিন বাবা বাসায় যাওয়ার কথা বলেছিল। সাদিবকে বলব বলব করে বলা হয়নি, তার আগে ভুলেই গিয়েছিলাম। ” না বাবা এমন কোনো ব্যাপার নয়! আসলে এতোদিন পরীক্ষার চাপ ছিল তো তাই বাসায় কারোর সাথে সেভাবে কথা বলা হয়নি। ফোনও হাতের কাছে কম রেখেছি। ”

” তাই বলে বাসায়ও কথা বলবে না? আচ্ছা বাদ দেও। সাদিবকে গিয়ে একটু ডেকে দেবে? ওর সাথে দরকারি কথা ছিল।”

আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সাদিবকে ডাকতে ভেতরে চলে গেলাম।

চলবে….

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩২)
#ফাহমিদ_মুশাররাত
.
খোয়াসাগর দীঘি! লক্ষ্মীপুর জেলার নামকরা জায়গা খোয়াসাগর দীঘির পাড়। তৎকালীন সময়ের আনুমানিক ১৭৫৫ সালের দিকে জমিদার ব্রজবল্লভ রায় জনসাধারণের বিশুদ্ধ পানির সংকট দূরীকরণের জন্য প্রায় ২৫ একর জায়গা জুড়ে বিশাল দীঘিটি খনন করেন। এ দীঘি নিয়ে জড়িয়ে আছে অনেক কল্পকাহিনী। কথিত আছে, একবার এক নবদম্পতি এ দীঘির পাড় হয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে পানির পিপাসা লাগলে তারা পানি পান করতে দীঘির পাড়ে নামে। সেসময় পানির ভেতর থেকে অদৃশ্য কিছু একটা নববধূকে টেনে নিয়ে যায় গভীর পানির নিচে। তারপর আর সেই বধূকে কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। দীঘির পাড়ের পুনঃস্থাপনের সময় স্থাপনার দেয়ালে খোদাই করে নববধূর উক্ত ঘটনাটির উল্লেখ করা আছে।

দীঘির পাড়ের বেঞ্চির ওপর অনেকক্ষণ যাবত একা বসে আছে তনিমা। আগে দাদা বাড়িতে আসলে প্রায়ই তাদের এদিকটায় আসা হত। দাদার মুখে ছোট বেলায় তানিমারা অনেকবার এ দীঘির সম্পর্কে শুনেছে। কৌতুহলী দীপ্ত তামান্না দীঘির নামের বিশেষত্ব শুনতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, দীঘিটির এক প্রান্ত থেকে অন্যপান্তে তাকালে মনে হবে এটি কুয়াশায় ঢেকে আছে। এ কারণে স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছে খোয়া সাগর দীঘি বা কুয়াশাময় দীঘি। এছাড়া শীতের সময় আসলে অল্প কুয়াশার মাঝেও দীঘির এ প্রান্তে থেকে ওপ্রান্তের অংশ স্পষ্ট দেখা যায় না।

বিকেলের দিকে দীঘির পাড়ে লোকজনের বেশ সমাগম থাকে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু আসে বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা জমাতে তো আবার কিছু লোকজন আসে প্রেমিক যুগল হয়ে সময় কাটাতে। মোটকথায় বিকেলবেলা হলেই এখানে সবার ভীড় জমে। এক ঘন্টার মতো সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা না পেয়ে তনিমা বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ধরা পড়ার ভয়ে সে দেখা করতে এতদূর এসেছে। অথচ লোকটার এখনো আসার সময় হয়নি। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্তি এসে ভর করল তার মাঝে। পৃথিবীর সবচেয়ে অসহ্যকর জিনিসটা হল কারো জন্য অপেক্ষা কারাটা। একবার খালি লোকটাকে ভাগে পেয়ে নেই মজা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াবো তাকে। কথাগুলো আওড়ানোর মাঝে তনিমার দৃষ্টিতে কাঙ্ক্ষিত লোকটির দেখা মিলল।

” এই স্যরি স্যরি। একটু লেট করে ফেলেছি। ”

তনিমা কিঞ্চিৎ রাগের সাথে বলল, ” একটু লেট? ক’টা বাজে দেখুন তো! ”

লোকটা হাত ঘড়িতে চোখ বুলাল। তনিমার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখল তনিমা কোমরে দু’হাত রেখে শাসানোর ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিপরীত প্রান্তের মানুষটির রাগ কমাতে হেসে আমতা আমতা করল, ” আসলে কি বল তো….

” আসলে নকলে কিছু শুনতে চাইনি। আপনি এক ঘন্টা লেট করেছেন তার জন্য আপনার পানিশমেন্ট আছে। ”

” পানিশমেন্ট? তোমাকে অনেক শান্ত ভেবেছিলাম তনিমা। একদিকে তোমার বড় বোন সে তো ধানী মরিচ তাকে মানানো তো এর থেকেও সহজ কাজ।”

তনিমা চোখ বড় করে লোকটির দিকে তাকাল।
” শুনুন ওকে একদম এদিকে টানবেন না। ও-র ভয়েই আপনার সাথে এখানে দেখা করতে আসা। সেই আপনিই তো বুঝলেন না। যার জন্য করলাম চুরি সে-ই বলে চোর! ” শেষের কথাটা বলে তনিমা ভেঙচি কাটল।

” আচ্ছা তাকে জানিয়ে দেই সবটা কি বল? ”

” আপনি কি পাগল? জানলে আমাকে আস্ত রাখবে ও? তারওপর আপনার সাথে আমার রিলেশন তাও যাকে সে… আচ্ছা থাক বাদ দিন। ”

” বাদ কেন দেব? একদিন না একদিন তো ও ঠিক জানবে, আর যখন জানবে তখন কি করবে? ”

” জানবে তো ঠিকই। যখন আপনি আপনার বাসায় ম্যানেজ করে আমার বাসায় আসবেন ঠিক তখনই। ”

” তা ঠিক। তোমার মনে হয় না আমাদের সম্পর্কে জানলে ও কষ্ট পেতে পারে? ”

শুনে তনিমা নির্বিকার রইল। বলার মতো সেরকম কোনো কথাই খুঁজে পেল না। পর মুহূর্তে মনে হল তার একটা ব্যাপারে জানাটা ভীষণ জরুরি।
” আচ্ছা আপনার মা যখন জানতে পারবে আমার ব্যাপারে তখন তিনি কেমন রিয়েক্ট করবে? না মানে একে তো আপুকে উনার অপছন্দ তারওপর এখন যদি শুনে আমি তখন? ”

” সেটা আমার ওপর ছেড়ে দেও। মা আমার সুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক সম্মতি দিয়ে দেবে। শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ”
.

.
বাবা গতকাল সন্ধ্যায় ফোন করে শ্বশুরকে ও-বাড়িটাতে যাওয়ার কথা জানাতে তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। আমার মাধ্যমে সাদিবকে ডেকে বলেছিলেন সে যেন আজ আমাকে বাবার বাসা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। শুনে ডাক্তার সাহেব কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় নি। আমিও ভেবেছিলাম হয়তো তার মত নেই। এমনিতেই সে ব্যস্ত মানুষ, যাওয়া নিশ্চয়ই হবে না। তাই এক প্রকার আশা ছেড়ে দিয়েছলাম। কিন্তু আজ বিকেলে হুট করে এসে জানাল, ” তামান্না রেডি হয়ে নেও। আমরা একটু পর বের হব। ”

সাদিবের কাছে বের হওয়ার কথা শুনে মনে হল ঈদের চাঁদ দেখেছি৷ ছোটবেলা ঈদের আগের দিন চাঁদ দেখা নিয়ে যেমন হৈ হুল্লোড় করতাম সেরকম লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। কতদিন বাসার কাউকে দেখি না। সেই চিরপরিচিত বাসায় থাকা হয় না। তকি তনিমার সাথে মারামারি করা হয়না। দুষ্টুমির জন্য মায়ের কাছে বকা খাওয়া হয় না। এতোদিন পর আবার সব পাওয়া হবে। এক মুহূর্ত সময় অপচয় না করে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম।

” ডাক্তার সাহেব চল আমি রেডি! ”

সাদিব ভেবেছিল আমার তৈরি হয়ে ঘন্টা খানেকের মতো সময় লেগে যাবে। অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে আমি দশ মিনিটে ঝটপট রেডি হয়ে নিলাম।
“এতো তাড়াতাড়ি? ”

” হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি হবে না? নিজের বাড়িই তো যাচ্ছি। কোথাও বিয়ের দাওয়াতে তো আর না। ”

” না মানে মেয়ে মানুষ এতো তাড়াতাড়ি রেডি হতে পারে জানা ছিল না৷ তাই আরকি! ”

” আমি সব পারি ঠিক আছে। এখন চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”

” চলেন! ”
.

.
আমাদের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির ভেতর ঢোকার সময় গেটের বাহিরে তকিকে দেখতে পেলাম। আগের সবকিছুই আগের মতো আছে। তকির সেই নিত্যদিনকার মতো অনিয়ম এখনো নিয়মে রূপান্তরিত হয়নি। তাকে দেখলাম সবে বাহির থেকে ফিরেছে। সাইকেল গেটের ভেতর তুলে রাখছে। ” ভাই! ” বলে ডাকতে সে এদিকটায় ফিরে তাকাল। জানে তাকে শুধুমাত্র ভাই বলে সম্বোধন করে কে! ছেলেটার মুখে হাসি ফুটল। সাইকেলটা সেভাবে ফেলে রেখে দৌড়ে আসল। এসে আশেপাশে না তাকিয়ে সরাসরি জড়িয়ে ধরল।

তকি আবেগাপ্লুত হয়ে গেছে। ধরা গলায় বলল, ” আপু কতদিন তোরে দেখি নাই রে। কত মিস করি তোরে! তোর কি একটুও আমার কথা মনে পড়ে না? ”

” আমিও তোদের কতদিন দেখি না। কত্ত মিস করি কিন্তু চাইলেই কি চলে আসা যাওয়া যায় বল? ”

তকি ছোটবেলায় মামনির পর আমার কাছেই বেশি থেকেছে। তাই তার তনিমার চাইতে আমার প্রতি আলাদা টান কাজ করে। এই যে দেখা মাত্র নিজের শখের সাইকেল খানা ফেলে দৌড়ে এসেছে। তারওপর জড়িয়ে ধরে সরাসরি কেঁদে ফেলেছে। এতেই কম কিসে!

সাদিব এতক্ষণে পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। ভাইবোনের আবেগঘন মুহুর্তে পুরোটা সময়ে সে মৌন ছিল। তকি সাদিবকে খেয়াল করতে সালাম বিনিময় করল। সাদিব সালাম নিয়ে তকিকে বলল, ” মেহমানকে কি বাসার বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে ছোট্ট সম্বন্ধী? নাকি ভেতরেও নিয়ে যাবে? ”

তকি অবাক হল। বলল, ” মেহমান কে? ”

” কেন আমাকে চোখে লাগে না? আপুর কথা নাহয় বাদ দিলাম। ”

তকি লাজুক হেসে বলল, ” ওহ্ স্যরি ভাইয়া চলুন ভেতরে চলুন! ”

কলিংবেল চাপতে ভেতর থেকে মায়ের গলা শুনতে পেলাম। তিনি তনিমাকে বলছেন, ” তনিমা দরজাটা খুলে দে তো। তোর নবাবজাদা ভাইটা আসছে বোধহয়! ”

তনিমা দরজা খুলতে দরজার এপাশে আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেছে। অন্যসময় তার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক থাকলেও আজ রয়েছে বিস্ময়। নিজেকে দ্রুত সামলে সে হাসল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ” আপু তুই? একদম সারপ্রাইজ দিয়ে দিলি! ”

” তোর একার না আমার জন্যেও এটা একটা সারপ্রাইজ ছিল। ”

ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকতে পূর্বের ন্যায় বাবাকে সোফায় বসে ফোন চালাতে দেখলাম। মামনি রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। অসময়ে আমাদের দেখে বাবা সহ বাসার সবাই খুশি হলেন। কুশল বিনিময় শেষে নিজের রুমের দিকে চলে আসছিলাম বাবা পেছন থেকে তকিকে ডাক দিলেন। আজ যেন তিনি তকির একটা ব্যবস্থা করবেন বলেই বসে ছিলেন। আমাদের আগে পাঠিয়ে তকি পেছন পেছন আসছিল। বাসায় দেরি করে ঢুকেছে তারওপর আমাদের দেখে ভেবেছিল বাবা হয়তো তাকে খেয়াল করবে না।

” তকি তুই কোথায় যাচ্ছিস? ”

” কেন? আপু জার্নি করে এসেছে সে টায়ার্ড আমার কি টায়ার্ড লাগে না? ”

” টায়ার্ড লাগা ছুটচ্ছি হতচ্ছাড়া। সারাদিন বাহিরে টো টো করে ঘুরে বেড়াবি ভাবছিস আমি ছেড়ে দেবো? ”

” বাবা সারাদিন কই গেলাম? দেখছো না আপুকে আনতে গেছিলাম? ”

” বাহানা দেওয়ার জায়গা পাস না? আপুকে যদি তুই আনতে যাস তো ভাইয়া কি উড়াল মেরে আসছে। ”

” ভাইয়া পুরোটা পথ এনেছে তারপর বাড়ির সামনের বাকিটুকু আমি এনেছি। ”

” দাঁড়া তুই ফাজলামোর জায়গা পাস না। নীলিমা এই নীলিমা কোথায় গেলে তোমার ছেলে কি বলে শুনো? ”

অনেকদিন পর নিজের বাড়ি আসলাম। এসেই শুরুতে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। আহা পরিবেশ জুড়ে সেই পরিচিত গন্ধ। অনেকদিন পরে নিজের রুমে এসে যেন স্বস্তি ফিরে পেলাম। সাদিব ফ্রেশ হতে গেছে। আমি ততক্ষণে বিছানায় টান টান করে শুয়ে পরেছি। শান্তি লাগছে অনেকটা। মনে হচ্ছে সব থাকা সত্ত্বেও এতদিন যেন কিসের অভাবে ছিলাম। এখন নিজের পূর্বের ঠিকানায় আসার পর সব ঠিক হয়ে গেছে। আসলে যত বড় অট্টালিকায় থাকা হোক না কেন! নিজের বাসার চেয়ে শান্তির জায়গা পৃথিবীতে দু’টো হয় না। শুয়ে থাকতে গিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি। যখন ঘুম ভাঙল দেখতে পেলাম…..

চলবে…?

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩৩)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
ঘুম ভাঙার পর দেখতে পেলাম তনিমা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে। তাও কিনা হেসে! খটকা লাগল তার হাবভাবে। আড়াল থেকে বুঝতে চেষ্টা করলাম ঘটনাটা ঠিক কি হতে পারে! মেয়েটা এই অবেলায় কার সাথে এত ফুসুরফাসুর করছে? পরক্ষণে সাদিয়ার সেদিনকার বলা কথাটা মনে পড়ে গেল। কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এখন সত্যি ঠেকছে। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বেলকনির দিকে এগুলাম। যদি সাদিয়ার বলা কথা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এর একদিন কি আমার একদিন! কিন্তু আপসোস আমি সব জায়গায় যেতে বরাবরের মতো দেরি করে ফেলি। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমি যেতে যেতে তনিমা কথা বলা শেষ করে কান থেকে ফোন সরিয়ে ফেলে। বেলকনি ছেড়ে রুমের দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে যায়। চোখে মুখে আশঙ্কা চেপে বসে। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ” আপু তুই কখন উঠলি? ”

” কার সাথে কথা বলছিলি এতোক্ষণ? ”

ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,” কার আবার এক ফ্রেন্ডের সাথে বলছিলাম। ভার্সিটির নিউ ফ্রেন্ড। খুব ক্লোজ বুঝলি? ”

” সে নাহয় বুঝলাম। তাই বলে ক্লোজ ফ্রেন্ডের সাথে এতো হেসে হেসে কথা বলার কি আছে? কই আমারও তো কত ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে। আমি তো কখনো বলি নাই এভাবে! ”

” কি যে বলিস না হাসির কথা বললে হাসবো না? আমি কি হাসি প্রতিবন্ধী? ”

” তুই শুধু হাসি প্রতিবন্ধী না তুই তো বোবা একটা। ঠিক মতো কথাও বলতে পারিস না। এক কথা পাঁচবার জিজ্ঞেস করলে একবার জবাব দেস! ”

” তোরা জিজ্ঞেস করবি ক্যান এতোবার? বোবা মানুষরে কথা বলতে দেখছিস কোনো দিন? ”

দু’জনের ঝগড়ার মাঝখানে মামনি চলে আসে। পূর্বের ন্যায় তিনি বলতে শুরু করলেন,
” লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ! দুইজন আবার লাগা শুরু করছিস? একটারও বুঝ বুদ্ধি নাই তোদের? ”

তনিমা নেকা স্বরে বলল, ” দেখ না মা, আমি কি করলাম তোমার মেয়েই তো আমাকে বোবা বলছে। ”

” ঠিকই তো বলছি। বোবারে বোবাই তো কমু! ”

” আবার? তামান্না ড্রয়িং রুমে যা। সাদিব তখন থেকে বসে আছে। তোর জন্য সন্ধ্যা থেকে কিচ্ছুটি মুখে তোলেনি। ”

চমকে উঠলাম মামনির কথা শুনে। ডাক্তার সাহেব না খেয়ে আছে এখনো, তাও আবার আমার জন্য? শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। এ কেমন ভেলকিবাজি শুরু করলা তুমি ডাক্তার সাহেব। জীবনে তো খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস কর না৷ আর আজ এত দরদ উতলে পড়ছে। মতলব তো ভালো ঠেকছে না। শ্বশুর বাড়ি এসে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে দেখাচ্ছ আমার কত্ত কেয়ার কর তাই তো! কই বাত নেহি! আমিও দেখি কতক্ষণ থাকতে পারো এভাবে? মনে মনে আওড়িয়ে মামনিকে বললাম, ” খায়নি কেন? তকিকে তো বলল সে এ বাসার মেহমান। ”

” আহ্ এত কথা কেন বলছিস? তুই গিয়ে দেখ না একটু! তাহলেই তো হয়। আমাকে বলতে হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। ”

” যাচ্ছি যাচ্ছি। বল গিয়ে এতো লজ্জা পেতে হবে না। তুমি আর জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছো না। ”

” এই মেয়েটা একবারে বেশি বেশি করে। আমি না গেলেও তো খারাপ দেখায়। বলবে শ্বশুর বাড়ি আসলাম শ্বাশুড়ির খবর নেই। এইজন্যই তো যাওয়া লাগে। ” বলতে বলতে মামনি নিজের কাজে চলে গেলেন। আমি তনিমাকে ভেংচি কেটে মামনির পেছন পেছন বেরিয়ে পড়লাম।
.

.
” তোমার গ্রীণ টি! ” সাদিবের সামনে গ্রীণ টি-র কাপটি এগিয়ে দিয়ে বললাম।

সে আমার দিকে করুণ চাহনিতে তাকাল। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” শুধু গ্রীণ টি? ”

” কেন তুমি নাকি এতোক্ষণ কিছুই মুখে তুলছিলে না? তোমার তো খিদে পায়নি তাই না? ”

” কখন বলেছি? ”

” তাহলে কি? তোমাকে এভাবে জামাই আপ্যায়ন করতে চাইল তুমি তো প্রত্যাখান করলে। আমাকে যদি শ্বশুরবাড়িতে এভাবে আপ্যায়ন করা হত না ইসস্ হইছিল কাম! ”

” কি হতো? মেয়ে হয়ে জামাই আপ্যায়ন চাইছো? ”

” ডাক্তার সাহেব আপনি যে কিভাবে ডাক্তারি পাশ করলেন কে জানে! গটে দেখছি আপনার একটুও বুদ্ধি নেই। ”

” তোমার মতো বুদ্ধিমতি বউ কপালে জুটলে বুদ্ধি দিয়ে কি হবে বল? তাই তো বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেছে। ” কথাটা বলার সময় খেয়াল করলাম সাদিবের মুখটা কালো আঁধারে ছেয়ে গেছে। বুঝলাম বেচারার সত্যিই খিদে পেয়েছে। এভাবে আর মজা না করি। পরে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

” সেটাই বুঝতে হবে৷ বউয়ের কদর করা শিখ ঠিক আছে। নাহলে পরে বুঝবে! এখন এটা ধর আমি আসছি। ” কাপটা হাতে ধরিয়ে হাঁটা ধরলাম কিচেনের দিকে।
.

.
ভোর সাড়ে পাঁচটা!
বাহিরে মৃদু আলো ছড়াতে শুরু করেছে। ফজর নামাজ শেষ করে ভাবলাম একবার বাহিরে বেরোনো যাক। অনেকদিন বের হওয়া হয় না। সাদিব নামাজ পড়ে বাসায় ফিরেছে সবে। এসেই বিছানায় পুনরায় গা এলিয়ে দিয়েছে। নিজের বাসায় থাকলে এতোক্ষণে আর বিছানার ধার ধারত না। সকাল সকাল হাঁটতে বেরুনোর অভ্যাস তার। ডাক্তারদের বেশ সচেতনতা অবলম্বন করতে হয় কিনা! কিয়ৎক্ষণের ব্যবধানে তাকে নেত্রপল্লবের দ্বার বন্ধ করতে দেখলাম। ভোরের আলো চারপাশ ছড়াতে গায়ে সুতি ওড়নাটা ভালোভাবে পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পরক্ষণে পেছন থেকে সাদিবের কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে এসে ঠেকল।

” এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো? ”

” একটু বের হব। অনেকদিন বের হওয়া হয় না। ভাবলাম এখন একবার আশেপাশটা ঘুরে আসি। ”

সাদিব শায়িত অবস্থা থেকে ঝটপট উঠে পড়ল। পাশে রাখা টেবিলের ওপর থেকে চশমা তুলে চোখে বসাল। বলল, ” চল আমিও যাবো! ”

” কিন্তু তুমি না ঘুমচ্ছিলে? ”

” ঘুম আসছিল না। এমনিই চোখ বন্ধ করে ছিলাম। ”

দু’জন পিচঢালা রাস্তার পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছি। গরমের মৌসুম হলেও সকাল সকাল আবহাওয়া খানিকটা ঠান্ডা থাকে। সকালের শীতল বাতাসটা তখন দারুণ লাগে। হাঁটতে হাঁটতে দু’জন চলে এলাম এক বড় মাঠের সামনে। মাঠের ওপাশে প্রাইমারি এবং তার বিপরীত পাশে হাইস্কুল। এখানে প্রতিদিন বিকেলবেলায় এলাকার ছেলেরা ফুটবল, ক্রিকেট শীতের মৌসুমে ব্যাডমিন্টনের মতোন নানান খেলায় মেতে থাকে। তাদের হৈ চৈ-এ পুরো পাড়া গম গম করে। আসলে তাদের হৈ চৈ ছাড়াও না তেমন একটা জমে না। এভাবে দিনের বেশিরভাগ সময়ের পাশাপাশি অনেক রাত অব্ধি আড্ডা চলে। আমাদের শৈশবটাও আমরা এখানে খেলে পার করেছি। আমরা তিন ভাইবোন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক দুটোই এখান থেকে শেষ করেছি। গভীর এক টান তো রয়েছে বটে। আমার আর তনিমার জন্য এটা অতীতের স্মৃতি হলেও তকির জন্য তা এখনো বর্তমান।

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি খোলা মাঠটির দিকে। মাঠ জুড়ে সবুজ ঘাসে অনাবৃত। ঘাসের ওপর বিন্দু বিন্দু শিশির কথা জমে আছে। পা থেকে জুতো জোড়া খুলে রাখলাম। উদ্দেশ্য খালি পায়ে ঘাসের ওপর কিছুসময় হাঁটবো। আমার এহেন কান্ডে সাদিব অবাক হলেও নির্বিকার থেকে দেখতে লাগল। তাকে রেখে কদম আগে বাড়িয়েছি। আমার দেখা দেখে সেও আর দাঁড়িয়ে রইল না। হাতে হাত রেখে দু’জন কদম মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। মৌনতা বজায় রেখে দু’জন অনেকটা সময় ধরে হাঁটছি। এভাবে কিয়ৎক্ষণ সময় হাঁটার পর আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদিব জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

” আমি কথা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারি না। অগোছালোভাবে কিছু কথা বলব শুনবে? হাসবে না তো? ”

” বল! হাসবো কেন? ”
পরক্ষণে রাশভারি কণ্ঠে বলে উঠল, ” কিন্তু ফাজলামো করলে খবর আছে। ”

শুনে ফিক করে হেঁসে দিলাম। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে কথাগুলো মনে মনে একবার গোছানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালালাম। সাদিবের হাত নিজের মুঠোবন্দি করে মৃদুস্বরে ডাকলাম, ” ডাক্তার সাহেব! ”
সাদিব কৌতুহলী চোখে চেয়ে রইল।

” ডাক্তার সাহেব এই হাতটিকে আঁকড়ে ধরে তোমার সাথে বৃষ্টি ভেজা পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটতে চাই, হুটহাট গভীর রাতে দু’জনে বেরিয়ে পড়বো দু’জন মিলে ঘুমন্ত শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আর ঠিক এখনকার মতো করে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে গল্প করতে চাওয়ার ইচ্ছে আমার আজন্মকালের। রাখবে আমার আবদার টুকু? ”

ডাক্তার সাহেব মুখে কিছু বলল না। বিস্ফোরিত চাহনিতে চেয়ে আচমকা তার বাহুডোরে আবদ্ধ করে আমাকে ঠিক বুঝিয়ে দিল।

” ব্যস এতটুকুই? ”

আমি ছোট্ট শব্দের মাধ্যমে আমার অভিব্যক্তি জানালাম, ” হু!”

” তুমি আমার নিকট আমানত। একবার স্বেচ্ছায় যখন তোমার দায়িত্ব নিয়েছি সেখানে এই সামান্য আবদারটুকু রাখতেও পারবো। ”

সাদিবের বক্ষগহ্বরের মাথা রাখলে এক অদ্ভুত শান্তির সন্ধান পাই। চারিদিক থেকে মৃদু শীতল বাতাস বইছে, দূর থেকে অজানা পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে ভেসে আসছে সাথে ডাক্তার সাহেবের গায়ের সেই মাতাল করা সুঘ্রাণ নাকে ধরা দিচ্ছে। আঁখি জোড়ার দ্বার বন্ধ অবস্থায় মুহুর্তটাকে যথা সম্ভব উপভোগ করছি।

তখনো আমরা দু’জনের কেউ জানতাম না এটাই হবে আমাদের একসাথে কাটানো শেষ এবং সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতাম তাহলে কখনো মুহূর্তটাকে হারাতে দিতাম না।

চলবে….

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩৪)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
” আরে তামান্না বুবু যে! ঐ দিকে কই গেছিলা সাথে ইনি কে? ”

ফেরার পথে মাঠে প্রবেশ করার মুখে একটা দোকান পড়ে। সেই দোকানের বৃদ্ধ দোকানদার, নাম রহমান। মুখ ভর্তি পাকা দাড়ি, মাথায় সাদা রঙের পাতলা টুপি, পরণে হলদেটে ভাব সেই চিরাচরিত ভূষণ, সাদা পাঞ্জাবিটি। উনাকে আমরা দাদা বলেই সম্বোধন করে থাকি। যখন আমি মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোবো সেসময় ইনি এখানে ছোট টিন সেটের মুদি দোকানটি দিয়ে বসেছেন। সবার সাথে অমায়িক ব্যবহারের জন্য শিক্ষকরাও উনাকে বেশ সম্মান করে। সকালবেলা বাবা প্রায়ই এদিকে হাঁটতে আসেন তখন দাদার সাথে বসে বেশ কিছুসময় গল্প গুজব করে যান। উনার হাতের রঙ চা – টা আমার দারুণ লাগে। তাইতো হাঁটতে আসার বাহানা দাঁড় করিয়ে বাবার সাথে উনার এখানে চা খেতে আসতাম। যাওয়ার সময় উনার সামর্থ অনুযায়ী হাতের মুঠোয় পাঁচ দশ টাকার চকলেট ধরিয়ে দিতেন। নিতে না চাইলে অনুযোগের সাথে বলতেন, ” কম দামী তো তাই নিতাছো না বুঝছি! কি করবো কও? দামী জিনিস দেওয়ার সামর্থ তো আমার নাই, নইলে আমার বুবুরে আমি তাই দিতাম! ”

উনার অনুযোগ শুনে আমি আর না নিয়ে থাকতে পারতাম না। ভাবতাম অর্থের দিকে সামর্থবান না হলে কি হয়েছে উনার একটা সামর্থবান মন রয়েছে। আমার কাছে এসব মানুষদের ভীষণ ভালো লাগে। মানুষের ভালোবাসার কাছে অর্থবিত্ত বরাবরই তুচ্ছ। বিত্তবান শ্রেণির লোকেরা উপর থেকেই বিত্তশালী অথচ মনের দিক থেকে এসব মানুষের থেকেও নিন্মবিত্ত!

সূর্য ততক্ষণে পুব আকাশে উঁকি দিচ্ছে। এখানে এসেছি সময় তখন ঘন্টাখানে পেরিয়েছে।রহমান দাদাকে সালাম বিনিময় শেষে কুশলাদি জানতে চাইলাম। সাদিবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি বললেন, ” আজ চা খাইবা না? আসো দু’জন বইসা চা খাইয়া যাও। ”

উনার চায়ের প্রস্তাব শুনে না করতে পারলাম না। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল উঠে আসার সময়। সাদিব উনাকে চায়ের বিল দিতে চাইলে তিনি নিতে রাজি হচ্ছিলেন না। এতো করে সাদিব সাধল কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা! কোনো মতেই তিনি এ বিল নেবেন না।

” না ভাই আমি এই টাকা নিমু না। তুমি আমার মেহমান, মেহমান হইল গিয়া আল্লাহর রহমত। আমি তোমার থেইকা টাকা নিলে আল্লাহ বেরাজ হইবো না কও? ”

কি আর করার! বাধ্য হয়ে দু’জন চলে আসতে লাগলাম। তবে আমার মনে ভাবনা ছিল অন্যটা। আসার পথে ডাক্তার সাহেব আমাকে জানালেন,
” উনি তো দেখছি ভীষণ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ। টাকা তো কিছুতেই নিলেন না। ”

ভেবে রাখা কথাখানি সাদিবকে বলব কি বলব না তা ভাবার মাঝে সাদিব নিজে থেকে বলল,
” আচ্ছা একটা কাজ করলে কি হয়? ”

” কি কাজ? ”

” উনার পরিধেয় কাপড়টা খেয়াল করে দেখেছ তুমি? মনে হয় না অনেকদিনের পুরনো? ”

” হুম। উনাকে আমি এই বেশে দেখতেই অভ্যস্থ। ”

” তাহলে উনাকে একটা পাঞ্জাবি গিফট করলে কেমন হয়? ”

কথাটা আমার কর্ণকুহরে চমকপ্রদ ঠেকল। এতোক্ষণ তো আমি মনে মনে সেটাই ভাবছিলাম। ডাক্তার সাহেব কিভাবে বুঝল? বললাম,
” আমি এতক্ষণ তাই ভাবছিলাম। তুমি না দিলেও আমি ঠিক একটা কিনে নিয়ে যেতাম! ”

সাদিব ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ” টাকা পেতে কই? ”

” আছে আমার কাছে। ”

” কই পাইছো? ”

” আগে থেকেই জমিয়ে রেখেছি। দেখ না আমার দরকারি জিনিসের কথাও তোমাকে বলি না। সেই টাকা থেকেই ম্যানেজ করে নেই। ”

সাদিবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। শান্ত গলায় বলল, ” তো কিছু ধার দিও তো আমায়। টাকা পয়সার অনেক সংকটে আছি৷ বিয়ে করতে গিয়ে তো কম খরচ হলো না বল? ”

আমি গুরুতর ভঙ্গিতে বললাম, ” হ্যাঁ তাই তো! কত লাগবে? ”

” বেশি না আপাতত দু’লাখ হলেই এনাফ। ”

সাদিবের টাকার অঙ্ক শুনে আমার চোখ দু’টো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল যেন।
” আর কিছু? দু’লাখ টাকা এই ইহজন্মকালেও আমি একসাথে চোখে দেখি নাই। আমারে বেছে দেও তবুও তো তুমি এত টাকা পাবা না। ”

” তাহলে কত দিতে পারবে নাহয় তাই দিও! ”
.

.
সাদিব হসপিটালে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ হয়েছে।
তনিমাও ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্য তৈরি হচ্ছে। তারপর বাসায় সম্পূর্ণ একা আমি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে তনিমা মুখে ফেস পাউডার ঘসে চলছে সেই তখন থেকে। কোনোভাবেই সেগুলো মন মতো হচ্ছে না দেখে বিরক্তিতে বার কয়েক “ছ” শব্দটি মুখ গহ্বর হতে নিঃসৃত হচ্ছে। তবুও মেয়েটা হাল না ছেড়ে বরাবরের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তনিমার গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণের, আমার তার থেকে ফর্সা। এ নিয়ে প্রায়ই সে অভিযোগ করত। ওর থেকে আমার গায়ের রঙ কেন বেশি সুন্দর? দু’জন সমান হতে পারলাম না!

সাজসজ্জার প্রতি আমার যতটা সখ তারথেকে দ্বিগুণ সখ তনিমার। তাকে সাজলে বরং আমার থেকে ভালো মানায়। মামনির দুই মেয়েকে নিয়ে দুই রকম অভিযোগ। আমাকে নিয়ে অভিযোগ আমি সাজুগুজুর ধার ধারি না। উনার ভাষ্যমতে একটু সাজলে কি এমন ক্ষতিটা হয়! পরিবারে বড় ধরনের অনুষ্ঠান যেমন কারোর বিয়ে না লাগলে আমাকে সাজতে দেখা যায় না। মুখে সামান্য পাউডার মেখে দৌড় লাগাই। ভার্সিটি গেলে সাথের কয়েকজনকে দেখতাম তারা নিজেদেরকে গাল ভর্তি মেকাপে আবৃত করে রাখত। তাদের কাউকে এসবে ভালো লাগলেও বেশিরভাগকে দেখতে বেশ বিদঘুটে ঠেকত।

তনিমার ক্ষেত্রে মামনির অভিযোগ ছিল গায়ের রঙ নিয়ে। এখনো প্রায় বলতে শোনা যায়,
” আমার মেয়েটার গায়ের রঙটা চাপা না হয়ে আরেকটু পরিষ্কার হলে কি হতো? ওকে কিভাবে যে পাত্রস্থ করব? এ যুগে সুন্দর চেহারা ছাড়া কেউ তো মেয়ে নিতেই চায় না! ”

মামনির কথায় তনিমার হাসিমাখা মুখখানি বেজায় ভার হতো। জবাবে বলত, ” না পারলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দিও। ”

তনিমার এহেন মন্তব্যে মামনি বুঝতেন গায়ের রঙটা নিয়ে সে নিজেও মর্মাহত। পরক্ষণে বুঝতেন, সবটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত! কেউই নিজেকে নিজের হাতে বানায়নি। অথচ আমার আর ওর মাঝে তুলনা চললে সবাই ওকেই সুন্দরী বলে আখ্যা দেয়। আমার ওর থেকে গায়ের রঙটাই সুন্দর আসলে মুখের কাঠামো আমার থেকেও বেশি ওরটা সুন্দর।

তনিমার বিরক্তির মাঝেই ওর ব্যক্তিগত ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। ফোনের শব্দে সম্বিত ফিরতে মেয়েটা ফোনটা তাড়াহুড়ো করে হাতে নিয়ে নিল। আমাকে তোয়াক্কা না করে রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে কথা বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেছে। মিনিট দুয়েক পর মলিন মুখে এসে মাথার পাশে দাঁড়াল।

” আপু শুনছিস? ”

তনিমা এ মুহুর্তে কি বলতে পারে সে ব্যাপারে আগে থেকেই আন্দাজ আছে। তাই বুঝেও ঘুমানোর ভান করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। আমার সাড়া শব্দ না পেয়ে তনিমা গায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকানি দিল।

” এই আপু শুন না! ”

চোখ খুলে তনিমাকে চোখ রাঙিয়ে বললাম,
” কি সমস্যা? দেখছিস না ঘুমচ্ছি? ”

তনিমা তড়িঘড়ি করে বসে পড়ল। ” তোর একটা হেল্প লাগবে আমার প্লিজ না করিস না! একমাত্র তুই পারবি। ”

” আমি কোনো হেল্প টেল্প করতে পারব না। সর খুব টায়ার্ড লাগছে। ”

” আরে একবার শুন তো! ”

তনিমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম। মেয়েটা ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে। যদিও তার এটা ছোটবেলাকার কমন অভ্যাস! কোনো কিছুতে টিকতে না পারলে কেঁদে দেওয়া। এবারও ব্যতিক্রম ঘটবে না বুঝতে পেরে উঠে নড়েচড়ে বসলাম।

” বল কি হয়েছে? তার আগে তোর মোবাইলটা একটু দে তো! ”

একবার বলতেই তনিমা সাথে সাথে দিয়ে দিল। কল লিস্টে ঢুকে উঁকি দিতে গিয়ে দেখলাম মিনিট তিনেক আগের নাম্বারটা আর কারোর নয়। বরং সেটা তন্ময়ের। বুঝলাম সাদিয়া সেদিন ঠিকই বলেছে। আমার অগোচরে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে আমার নিজের ছোট বোন প্রণয়ের রেলগাড়ী চালাচ্ছে, সাদিয়া সেদিন না বললে জানতামই না। তনিমার বাছাই করা প্রেমিককে ভালো লাগলেও সেটা তাকে বুঝতে দিলাম না। রাগ দেখিয়ে বললাম, ” এসব কি তনিমা? তন্ময়ের নাম্বার তোর ফোনে কেন? ”

তনিমা মাথা নিচু করে নির্বিকার রইল। আমার ধমকে সে কেঁপে উঠেছে। অন্যসময় হলে মেয়েটার প্রতিবাদী মন ঠিক জেগে উঠত। অপরাধ বুঝতে পেরে তাই চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। আমার সামান্য ধমকে ওকে ভয় পেতে দেখে আমার কাছে ব্যাপারটা দারুণ লাগছে। হাসি থামানো পর্যন্ত দায় হয়ে যাচ্ছে।

” এক্ষুনি মাকে গিয়ে তোর ব্যাপারে সব জানাচ্ছি। তুই শুধু দেখে যা! ”

” আপু আগে শোন আমার কথা আপু…..

পেছন থেকে তনিমা ডাকলেও সাড়া দেই নি। বরঞ্চ তাকে ভয় পাইয়ে দিয়ে উঠে চলে গেলাম মামনির কাছে। তন্ময় বেশ কয়েকদিন আগে তার আর তনিমার ব্যাপারে সবটা জানিয়েছে আমাকে। শুরুতে খুব রেগে গিয়েছিলাম দু’জনের একজনও জানায়নি বিধায়। পরক্ষণে তন্ময় তনিমা যে ভয় পাচ্ছিল জানাতে, সে ব্যাপারে বুঝিয়ে বললে রাগ অনেকটা কন্ট্রোলে আসে। যা তনিমার সম্পূর্ণ অজানা ছিল।

সকালে সাদিব চলে যাওয়ার পর মুহূর্তে আমার ফোনে তন্ময়ের কল আসে। তন্ময় জানায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর মাকে নিয়ে ও আমাদের বাসায় আসতে যায়। তন্ময়ের মায়ের সাথে কথা বলার জন্য তনিমার আড়ালেই মামনিকে ফোন ধরিয়ে দিলে তারা দু’জনে এ ব্যাপারে কিছু সময় কথা বলেন৷ আমার সুবাদে তন্ময়কে বাসার সবাই আগে থেকেই চেনে। বাবাকে আমি নিজ দায়িত্বে বোঝাই তন্ময় খুব ভালো একটা ছেলে। আজকালকার যুগে ওর মতো ছেলে পাওয়া দুষ্কর। এদিকে তনিমাও তন্ময়কে চায়। তাহলে তারা একবার আসলে সমস্যা কিসের? সব বাচবিচার করে দেখতে আপত্তি কোথায়? শুনে বাবা কিছুসময় ভাবল। ভেবে উনার মত জানালেন।

সবার মতামত শেষে তন্ময়কে জানালে তন্ময় ফোনের অপর পাশে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। দু’জন মিলে তখনই প্ল্যান করি তনিমাকে বিকেলে সারপ্রাইজ দেবো।

কিন্তু তখনও জানতাম না তনিমার সারপ্রাইজ প্ল্যান করতে গিয়ে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাব……

চলবে?