তোমার নামে হৃদয় পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭+৩৮

0
353

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩৫)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
মধ্যাহৃের সময় গড়িয়েছে অনেকক্ষণ। এরই মাঝে কলিং বেলের শব্দে বুঝতে পারি তন্ময়রা চলে এসেছে। তনিমা তখনো আন্দাজ করতে পারেনি। মেয়েটা আমাকে রুম থেকে বেরুতে দেখে তখনকার পর থেকে মামনির ভয়ে দরজা লাগিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাহির থেকে মামনির বকাঝকা শুনে আর বেরুবার সাহস হয়নি। তন্ময়রা আসতে তনিমাকে পুনরায় দরজার বাহির থেকে ডাকা হল। এবারো আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া গেল না। এদিকে তন্ময় তন্ময়ের মা এবং নিকটাত্মীয়দের কয়েকজনকে নিয়ে তনিমাকে দেখতে এসেছে। পাত্রপক্ষের সামনে পাত্রীর এলাহি কান্ডে বাসার সবাই পড়ল বেশ বিপাকে। উপায়ান্তর না দেখে তন্ময়কে দূর থেকে ইশারায় ডাকতে সে ড্রয়িং রুম ছেড়ে উঠে এসেছে। বুঝতে পেরে তন্ময় তনিমাকে ফোন করতে ফোনের ওপাশ থেকে তনিমার ভয়ার্ত গলার স্বর ভেসে আসে।

” তনিমা কোথায় তুমি? বাসা থেকে বেরুতে পারবে? ”

তনিমা মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল, ” নাহ্। আমার পক্ষে সম্ভব না। বাসায় আপনার ব্যাপারে সব জেনে গেছে। ”

তন্ময় কথার ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে তাকালে তাকে হাত নাড়িয়ে কথা চালিয়ে যাওয়ার ইশারা করতে তনিমাকে অভয় দিয়ে বলল, ” জানি সব। তামান্না ফোন করেছে বলল তুমি নাকি দরজা খুলছ না? ব্যাপার কি! দরজা খুলে বেরিয়ে আসো। কেউ কিচ্ছুটি বলবে না তোমায়। ”

তনিমা ভয়ে ঢোক গিলল। ছোট করে জবাব দিল, ” বলছেন! ”

” হ্যাঁ বলছি৷ বের হও! ”

তনিমা সন্তপর্ণে উঠে দরজা খুলে দিতে তার চোখ দু’টো চড়কগাছে! এ কাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছে সে! আদৌ কি তন্ময় নাকি এটা তার কল্পনা! কয়েক সেকেন্ড সময় পর্যন্ত সে হা করে তাকিয়ে আছে। তন্ময় তনিমার এহেন আচরণে মিটিমিটি হাসছে।

তামান্না পাশ থেকে টিপ্পনী কেঁটে বলে উঠল, ” বইন আমার এবার তো মুখটা বন্ধ কর! মশা ঢুইকা গেলে পরে নমরুদের মাথায় যেমন জুতা পেটা করা লাগছিল পরে তোর নাকে মুখেও তাই করা লাগবে। ”

তন্ময় বলে উঠল, ” সমস্যা কি তোর মত মহান বোন যার কপালে আছে তার এসব নিয়ে এত চিন্তা ভাবনা কিসের! তারওপর বোনের জামাই ডাক্তার। ডাক্তার আর ডাক্তারের বউ মিলে মশা বের করার উপায় বের করে ফেলবি। ”

তন্ময় আর তনিমার বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। লজ্জাবতী গাছকে ছুয়ে দিলে সেটি নিমিষেই যেমন নুইয়ে পড়ে তনিমা তেমনি লজ্জায় মাথা নুইয়ে বসে আছে। আলাদা করে কথা বলতে বলা হলে সে তাতেও রাজি হয়নি। বড়রা সবাই তাদের কথায় ব্যস্ত, এদিকে আমি তন্ময় আর তনিমাকে নিয়ে ছাদের দিকে চলে এলাম। সবার সামনে দু’জন কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিল কিনা! প্রথমত তন্ময় আমার বেস্ট ফ্রেন্ড দ্বিতীয়ত তাদের এতোদিনের জমিয়ে রাখা বিচার আজ করেই ক্ষ্যান্ত হব।

তন্ময়কে বললাম, ” কী ব্যাপার বাছাধন! আমার বোনকে পাওয়ার জন্য তোমার মন এতো উতলা হওয়ার কারণ? যে একবারে চাকরি পাওয়ার পর পরই বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসলা? ”

” তো কি করবো? একটাকে তো এই চাকরি আর ক্যারিয়ারের জন্যই হারাইছি। আরেকটাকেও হারাবো নাকি? ”

তনিমা আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে সব শুনছে কিন্তু কোনো মন্তব্য করল না। তন্ময়ের লাগামবিহীন কথা শুনে হাত দিয়ে ইশারা করতে সে বুঝতে পেরে কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলল। বলল,
” তা তোমার ডাক্তার জামাই কই শ্যালিকা? ”

সাদিবের কথা জিজ্ঞেস করতে মনে পড়ল তাকে দুপুরের পর আসতে বলেছিলাম। সে জানিয়েছিল তার হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। তারওপর কাজ সেরে বাসায় যেতে হবে। আজ আর এদিকে আসবে না একেবারে কাল এসে নিয়ে যাবে। শুনে মনটা না চাইতেও বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। জোর গলায় কিছু বলতে পারলাম না। তাই তো সম্মতি দিতে বাধ্য হলাম।

সাদিবের প্রসঙ্গ তুলতে মনটা খারাপ হয়ে গেল।কি এমন হতো এ সময়টায় এখানে থাকলে? বাসায় তো প্রতিদিনই থাকে, একদিন না গেলে কি খুব বেশি খারাপ হয়ে যেত?

আমার মনের অবস্থা তন্ময়কে বুঝতে না দিয়ে কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করলাম। ” কোথায় আবার হসপিটালে হবে হয়তো। নয়তো বাসায়! ”

” এক্কান জামাই পাইছিস তুই! বলতে যদিও খারাপ লাগতেছে….”

তন্ময়ের এহেন বাক্যপ্রলাপে চমকে গেলাম। তার বলা বাক্যের ইঙ্গিত বোঝার চেষ্টা থেকে তার দিকে তাকালাম। আমার চাহনির অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে সে আত্নসমর্পণ করার মতো করে দু-হাত উপরে তুলল। ” রাগিস না বইন। আগে পুরো কথাটা শেষ করতে দে! ”

লম্বা করে শ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। অতঃপর শান্ত গলায় বললাম, ” বল! ”

” বলতে চাইছিলাম এতো সুন্দর বউ রেখে বেটায় ঘরে বসে কি করে। ডিম পেড়ে রেখে আসছিস নাকি, যে বসে বসে তাতে তা দেবে? এমন বউ রেখে কোথাও যাওয়াটাই তো মুশকিল। ”
শেষের কথাটা বলার সময় তন্ময় তনিমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তনিমা তন্ময়ের হাসির মর্মার্থ ধরতে পেরে লাজুক হাসল।

মনে মনে বললাম, ‘তা আমার ডিমে দিতে হবে না। ওর মা-ই তো এখনো ওকে তা দেয়!’

” ঠিক আছে তোরা কথা বল, আমি আসছি। ”
.

.
পরদিন বিকেলে সাদিবের সাথে ফিরে চললাম নিজের আসল গন্তব্যে। আসার সময় বাবা মলিন মুখে একবার বলেছিলেন, ” আরেকটা দিন থেকে গেলে হয় না? ”

সাদিব জানাল, ” না আঙ্কেল! আসলে….

সাদিবের মুখের কথা টেনে নিয়ে আমি নিজে থেকে বললাম, ” সমস্যা নেই তো! সামনের মাসে তো আবারো আসা লাগবে। এখন যাই তখন নাহয় আরো দুটো দিন বেশি থাকব! ”

পাশ থেকে মামনি চোখ রাঙালেন। সাথে সাথে আমি বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলাম। পরক্ষণে বুঝলাম কি রেখে কি বলে ফেলেছি! সব জায়গায় এত লাগাম ছাড়া কথা যে কেন বলি মাঝে মাঝে! বুঝে আসে না আমার। আমার কথা শুনে সাদিব একবার এদিকে তাকাল।

বাসার সবার থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা দিলাম।
বাসা থেকে বেরিয়ে সাদিব গতকালকের সেই মাঠটির সামনে নিয়ে গেল। হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ” যাও উনাকে গিয়ে দিয়ে এসো। আমি দিলে হয়তো নেবেন না। ”

ব্যাগটি হাত পেয়ে আমি খানিকটা অবাক হলাম। এতো কিছুর মাঝে আমার গত কালকের করা পরিকল্পনার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। মনে পড়লে কিছু বলতে গিয়েও সাদিবকে আর বলা হলো না। তার আগেই সে হাত নাড়িয়ে সেদিকে যেতে নির্দেশ দিল। রহমান দাদার হাতে ব্যাগটা দিতে দাদা শুরুতে আপত্তি জানালেন। পরমুহূর্তে আমার জোরাজোরিতে নিতে বাধ্য হলেন। ব্যাগটা হাতে নিতে উনার চোখের কোণ জুড়ে অশ্রুর ফোঁটা চিকচিক করতে দেখলাম। ধরা গলায় তিনি আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। ” আল্লাহ তোমার ভালো করুক বুবু। সবসময় স্বামী সংসার নিয়া সুখে থাইকো, এই দোয়া করি! ”

এমন দোয়া পাওয়ার পর কার না ভালো লাগে বলুন! তারপরেও মনের ভেতর একটা খচখচানি রয়ে গেল।

বাসায় যাওয়ার পর সাদিবকে পার্স থেকে কিছু টাকা বের করে দেই। এগুলো ছিল আমার জমানো টাকা। যেগুলোর কথা কাল সাদিবকে দেবো বলেছি। সাদিব ভ্রু কুঁচকালো। প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকাতে দেখে বললাম, ” এগুলো আমার সেই জমানো টাকা। কাল না তুমি চাইছিলে? ”

সাদিব কয়েক সেকেন্ড নির্বিকার থেকে হাত থেকে টাকাটা নিল। “কত আছে এতে? ”

” পনেরো হাজার! ”

” মাত্র! এ দিয়ে তুমি এতো কিছু করে ফেলবে বলছিলে? ”

” কই, কত কিছু করে ফেলেছি? কিছু করি নি তো! ”

সাদিব উঠে গিয়ে কার্বাডের ড্রয়ারে টাকাটা রেখে দিল। ” ঠিক আছে। টাকাটা এখানেই থাক। তুমি ধরবে না একদম। ”

” ধরার জন্য কি দিয়েছি নাকি হুহ্! ভাবোটা কি আমাকে? ”

” একটা বাচাল আর উড়নচণ্ডী মেয়ে মানুষ। ”

” এই কি বললে আমি বাচাল, উড়নচণ্ডী? ” তেড়ে যেতে অনুভব করলাম মাথাটা ঘুরে উঠল। সামলে নিতে পাশে থাকা টেবিলটা চেপে ধরলাম। সাদিব এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ” কি হয়েছে? এনি প্রবলেম! ”

মাথা নাড়িয়ে বললাম, ” না। জানিনা মাথাটা হঠাৎ কেমন ঘুরে উঠল। ”

” আমি কি স্বাদে উড়নচণ্ডী বলেছি? সারাদিন টই টই করলে এমনই হবে। ”

সাদিবের কথা সেরকম পাত্তা দিলাম না। সেদিন রাতে সাদিব হসপিটালে চলে যায়। হসপিটাল থেকে তাকে ইমারজেন্সি পেসেন্ট দেখতে ডাকা হয়েছে। রোগীর অবস্থা গুরুতর! না গেলেই নয়। তাই না চাইতেই বাধ্য হয়ে তাকে হসপিটালের দিকে রওয়ানা দিতে হল।

সাদিব চলে যাওয়ার পর পুনরায় মাথা ঘুরে উঠল। এবার আর তাতে সীমাবদ্ধ রইল না। সাথে গা গুলিয়ে বমি আসা শুরু করল৷ তখন স্বাভাবিক লাগলেও এবার আর স্বাভাবিক লাগছে না। তবে কি আমি যা ভাবছি তাই হবে? ভাবতে গিয়ে অসুস্থতার মাঝেও কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভুতি অনুভব হল।
.

.
সাদিবের অনুপস্থিততে বেশিরভাগ সময় আমি বেলকনিতে বসে কাটাই। বেলকনির শেষ মাথায় পেতে রাখা চেয়ারটায় বসে উপন্যাসের পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে অপেক্ষার প্রহর গুনি। যা কিনা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দরতম অপেক্ষা বলে মনে হয়। আজ আকাশে চাঁদ নেই, নেই কোনো নক্ষত্র অথচ আমার মন জুড়ে রয়েছে এক অপার সুখ বিরাজমান। সাদিবকে খুশির খবরটা জানিয়ে সারপ্রাইজ দেবো বলে ভেবে রেখেছি। নিশ্চয়ই তার কাছে এটা নিদারুণ খুশির সংবাদ হবে।

ভাবতে ভাবতে চোখ গেল পাশের ফ্ল্যাটের দিকে। দেখলাম সেখান থেকে মৃদু আলোর জ্বলকানি। সেই আলোর মাঝে এক অবয়ব বেলকনির এপাশ থেকে ওপাশে হেঁটে যাচ্ছে অনবরত। এভাবে কিয়ৎক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অক্ষিপটে অবয়বের মুখটি স্পষ্ট হওয়া মাত্র আতংক আমাকে ঘিরে ধরল। পিছিয়ে যেতে নিলে পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেলাম। আমার ঘাড়ে পড়া তার গরম নিঃশ্বাসে ককিয়ে উঠলাম। সেই সাথে আতঙ্কিত চোখে পেছন ফিরতে সাদিবকে আবিষ্কার করলাম। অস্ফুট স্বরে বলতে চাইলাম, ” ডাক্তার সাহেব ওখানে…. ”

অধর জোড়ায় আঙ্গুলের সাহায্যে চুপ করিয়ে দিল সাদিব। অন্ধকারে তার চাহনি দেখতে না পেলেও সাদিবের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম। কোনো কিছু বলা বা ভাবনার সুযোগ না দিয়ে সাদিব পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বেলকনি থেকে প্রস্থান করল। পুনরায় মত্ত হলো আমাতে….

চলবে…?

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩৬)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
অনবরত ফোনের রিংটোন বেজে যাচ্ছে। সাদিবের তোলার বালাই নেই। রোগী দেখার সময় সাদিব ফোন সবসময় সাইলেন্স করে রাখে। যাতে ব্যস্ততার মাঝে কেউ তাকে বিরক্ত করতে না পারে।
আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। রোগী দেখা শেষ করে সরাসরি বাসার পথে রওয়ানা দিয়েছে। ফোনটা আর সেভাবে চেক করে দেখা হয়নি।

ফোনের স্ক্রিনে পরিচিত নাম্বার নজরে ঠেকতে খানিকটা বিস্মিত হল সাদিব। এতদিন পর অনাকাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে সাড়া পেতে দেখে সাদিব চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। না চাইতেও ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকাল।

ফোনের বিপরীত পাশ থেকে শোনা গেল। ” কেমন আছো? ”

সাদিব শান্ত মেজাজে বলল, ” ভালো। তুমি? ”

” আমিও ভালো। শুনলাম নাকি বিয়ে করেছ? ”

” হ্যাঁ করেছি। ”

” যাক ভালোই হল। জীবন তো একটাই। তাই এভাবে অতীত নিয়ে পড়ে থাকার চেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ভালো। ”

ফোনের এপাশ থেকে সাদিব তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল। ” তা হঠাৎ এতোদিন পরে! কি মনে করে? ”

” সাদিব আমি চলে এসেছি। ইভেন এ মুহুর্তে বাসাতেই আছি। তোমার বারান্দার মুখোমুখি। একটু এদিকে আসবে প্লিজ! ”

অপর পাশের ব্যক্তির অন্যায় আবদারে সাদিবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। একে তো সেদিন সবার সামনে অপমান করে আরেকজনের হাত ধরে পালিয়েছে, এখন ফিরে এসে নতুন করে তামাশা শুরু করেছে।

রাগ ছেপে না রেখে সরাসরি কাঠকাঠ গলায় বলল, ” সেদিন না নিজের স্বার্থের জন্য কারোর পরওয়া না করে চলে গেছিলে? একবারো কারণটা জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না। তাহলে এখন কেন ফিরে এসেছ? ”

প্রিয়ন্তির ঠান্ডা মাথার জবাব, ” তোমার কথা মনে পড়ল যে! ”

” লিসেন তুমি আমার অতীত। তোমাকে নিয়ে এখন আমার ভাবার মতো কোনো সময় বরাদ্দ নেই। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে তুমি জানতে পেরেছো আমি ম্যারিড। সুতরাং অযথা আমার জীবনে আসার চেষ্টাও করবে না। ” সাদিব দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করল।

” আরে আরে রাগছ কেন? মাথা ঠান্ডা করে একটু এদিকে আসো। বেশি না অন্তত একবার! সবটা একবার এক্সপ্লেনের সুযোগ দেও। ”

” একবারের জন্যেও না। না মানে একদমই না। ” রেগে ফোন রেখে দেয় সাদিব।
.

.
তামান্না কাল রাত থেকে উদাসীন। সে যা দেখেছে সেটা আদৌ কতটুকু সত্যি! নাকি পুরোটাই তার মনের ভুল! প্রিয়ন্তিদের বাসা সাদিবদের পাশে। তারওপর প্রিয়ন্তির বারান্দায় সাদিবের বারান্দার ঠিক বিপরীত পাশে, যেখান থেকে দু’জন অনায়াসে দু’জনকে দেখতে পারবে। প্রথম জীবনের প্রেম মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। জীবনটা তখন অনেক রঙিন মনে হয়। চোখে জাগে কতশত রঙিন স্বপ্ন। জীবনের শেষ মুহূর্ত অব্ধি একসাথে কাটানোর সাধ মনে জাগে।

তামান্নার মনে অজানা ভীতি সৃষ্টি করেছে যদি প্রিয়ন্তি সাদিবের কাছে পুনরায় ফিরে আসতে চায় সাদিব কি তাকে মেনে নিয়ে তামান্নাকে ছেড়ে দেবে? তাহলে তার সে মুহূর্তে কি করা উচিত হবে? সাদিবের দিকে তাকিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যাবে নাকি নিজের অধিকারের জোর খাটিয়ে থেকে যাবে? পরক্ষণে ভাবছে, দূর বাস্তব জীবন কোনো নাটকের অংশ নয় যে নাটকের মতো ঘোরপ্যাঁচ থাকবে। আবার একই প্রশ্ন উকি দিচ্ছে, কিন্তু নাটক তো জীবন থেকেই নেওয়া! একবার কি সাদিবের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবে? যদি সে রেগে যায়?

সাদিব বাসায় ফিরেছে প্রায় ঘন্টাখানেক। এরমাঝে তামান্নাকে আশেপাশে কোথাও নজরে পড়ছে না৷ ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে প্রিয়ন্তির কথাগুলো কানে বাজতে থাকে। প্রিয়ন্তির হঠাৎ ফিরে আসার কারণ ভাবতে থাকে। ঘুরে আসে অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার দিকে। ভাবতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। একজন বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ কখনো অতীতের ছলনার সাথে বাঁচতে চাইবে না। তামান্না সত্যি বলে, ডাক্তার সাহেব তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি দিন দিন লোপ পেয়ে যাচ্ছে!
.

.
প্রিয়ন্তি বারান্দায় মেঝেতে মনমরা হয়ে বসে আছে। দৃষ্টি তার সামনের বারান্দায়। প্রায় ছয় মাসের অধিক সময় পেরুবার পর গতকাল সন্ধ্যার পর এ বাসায় পা রাখতে পেরেছে। মায়ের মন গলিয়ে ফেলাটা প্রিয়ন্তির জন্য কোনো ব্যাপার না হলেও বাবা এখনো তার প্রতি নারাজ। বাবার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। বিয়ের আগে সবটা জানিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে বললে একমাত্র মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি খুশিমনে মেনে নিতে পারতেন। এভাবে তাদের সবাইকে সে না ঠকালেও পারতো। এ নিয়ে রেগে প্রিয়ন্তিকে নিজের মেয়ে মানতে অস্বীকার করেছেন। মা বোঝানোর পর একটু গলতে শুরু করেছে। তাও সম্পূর্ণ রূপে নয়।

প্রিয়ন্তির জন্য আজ থেকে ছয় মাস আগের গল্পটা ছিল ভিন্ন। এই বারান্দায় বসে সাদিবের সাথে রাতে গল্প করে কাটিয়ে দিত। সাদিব অনেক রুটিনমাফিক জীবনযাপন করে যেটা কিনা প্রিয়ন্তির জন্য বিরক্তির কারণ ছিল। এ নিয়ে প্রায়ই মনমালিন্য চলত দু’জনের মাঝে। সাদিব যথাসাধ্য তাকে বোঝানোর চেষ্টায় অব্যহত থাকত। সাদিবকে সেসময় মনে হতো সে একজন শিক্ষক আর প্রিয়ন্তি তার শিক্ষার্থী। হলুদের আগের রাতে সাদিব হুট করে উধাও হয়ে গেছিল দেখে প্রিয়ন্তি রেগে গাল ফুলিয়ে বারান্দায় বসে ছিল। সাদিব এসে সেদিনও তার রাগ ভাঙিয়েছিল। বলেছিল, ” হসপিটালে ইমারজেন্সি যেতে হয়েছিল।” অথচ কে জানত পরেরদিন হবে সম্পর্কের পূর্ণতার পরিবর্তে শেষ দিন!

বিয়ের দিন খুশি মনে প্রিয়ন্তি পার্লারে গিয়েছিল বউ সাজবার উদ্দেশ্যে। এতদিনের প্রণয়ের পূর্ণতা পেতে চলেছে বিধায় প্রিয়ন্তির পাশাপাশি প্রিয়ন্তির পরিবারের লোকজনও বেজায় খুশি। মেয়ে আধুনিক হলেও বিগড়ে যায়নি। কিংবা বিগড়ানো ছেলেদের মধ্যে কাউকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়ায়নি। ঠিকই নিজের জন্য ভালো পাত্রই বেছে নিলো কিনা! আত্নীয় স্বজনদের মাঝে প্রিয়ন্তির খালা মামি চাচীরা সহ তাদের মেয়েকে দেখিয়ে দু- একবার বলতেও শোনা গেছে, ” ঐ দেখ মেয়েটা প্রেম করলেও বাপ মায়ের মনের মতো জামাই ঠিকই জোগাড় করে ফেলেছে। ”

প্রিয়ন্তির গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। বর্তমান ছেলেদের বেশিরভাগ মেয়েদের রঙটা দেখেই প্রেমে পড়ে যায়। ভালো খারাপের বালাই নেই। প্রিয়ন্তির প্রতি পাড়া মহল্লায় ভালো খারাপ সব ছেলেদের লাইন পড়ে থাকত। কিন্তু প্রিয়ন্তি সব-কয়টা ছেড়ে সাদিবকে বেছে নিয়েছে। সাদিবের কাছে একইভাবে প্রিয়ন্তিকে ভালো লাগত।

বিয়ের দিন সকালের দিকে খুশি মনে পার্লারে রওয়ানা দেয় প্রিয়ন্তি। দুপুর গড়াতে বাসা থেকে ফোনে সমানে তাড়া দিতে থাকে প্রিয়ন্তির মা।

” প্রিয়! কই তুই? আর কতক্ষণ লাগবে আসতে?”

প্রিয়ন্তি হাসি মুখে জবাব দেয়, ” এইতো আরেকটু হয়ে গেছে, এক্ষুনি আসছি। ”

” আরেকটু আরেকটু করে অনেকটা সময় কেটে গেছে অথচ তোর আরেকটু ফুরচ্ছে না কেন! সোজাসাপ্টা বল বিয়েটা কি করবি? নাকি ইচ্ছে নেই? ”

” এই তো মা। হাইলাইটার-টা একটু কম হয়ে গেছে এটা ভালো মতো ঠিক করে আসছি। ”

প্রিয়ন্তির মা ধমকে মেয়েকে উঠলেন, ” রাখ্ তোর হাইলাইটার! ওদিকে পাত্রপক্ষের লোকজন সব চলে এসেছে। ”

প্রিয়ন্তি উল্টো বিরস কন্ঠে জানাল, ” বিয়ে তো একবারই করবো। কোনো কমতি থাকলে হবে নাকি। আসুক তারা। ” বলে ফোন রেখে দেয়।

প্রিয়ন্তুির রাগের আগুনে ঘি ঢালতে পুনরায় ফোনটা বেজে ওঠে। বাসা থেকে ফোন এসেছে ভেবে ফোনটা তুলতে চাইল না। পরপর তিন চারবার রিং হতে আর এড়িয়ে যেতে পারল না। বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করে, “হ্যালো! ” বলতে ভেসে এলো এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর।

” প্রিয়ন্তি আপু কোথায় আপনি। প্লিজ আপনি এই বিয়েটা করবেন না প্লিজ! ”

প্রিয়ন্তি ধমকে উঠল, ” এই তোমাকে না কতবার বলেছি আমাকে ফোন দেবে না? তারপরেও বিরক্ত করছ? ”

” আপু দেখেন আপনি যদি বিয়েটা করেন তাহলে আমার ভাই একদম শেষ হয়ে যাবে। প্রণয় ভাই সুইসাইড করেছে আপু। ” বলে ফুপিয়ে কেঁদে দিল মেয়েটা।

কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র প্রিয়ন্তি থমকে গেছে। চারপাশে মনে হচ্ছে অন্ধকার দেখছে। প্রণয় তার জীবনে প্রথম প্রেমিক পুরুষ। ছোট একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব বেড়ে যায়। প্রণয় ভেবেছিল প্রিয়ন্তি নিজের ভুল বুঝে ঠিক তার কাছে ফিরে যাবে। মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দু’জনের অভিমান কমার পরিবর্তে প্রণয়কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে প্রিয়ন্তি বিয়ের পিঁড়িতে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এদিকে সাদিব ছিল প্রিয়ন্তির কেবলই ভালোলাগা। রাগের বসে প্রণয়কে দেখাতে চেয়েছিল প্রণয়কে ছাড়াও সে বাঁচতে পারে। অন্যকারোর সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারে।

সাদিবের ক্যারিয়ার, বংশ গরিমার কাছে প্রণয়কে কিছুই মনে হয়নি প্রিয়ন্তির। প্রণয়ের কাছে ফিরে যাওয়ার চেয়ে সাদিবকে বেছে নেওয়াকে নিজের জন্য ভালো মনে হয় তার। কিন্তু ভাগ্য তাকে পুনরায় প্রণয়ের কাছেই যেতে বাধ্য করে। প্রণয়ের আত্ম হুতির কথা শোনামাত্র নিজেকে সামলে রাখতে পারল না প্রিয়ন্তি। কঠোর মন নিমিষেই গলে বরফ থেকে পানিতে রূপান্তর হতে শুরু করল। চোখ ভিজে উঠল। শেষ মুহুর্তে এসে হলেও বুঝতে পারল সাদিব তারজন্য কিছুই না। বরং প্রণয়কে ছাড়া অসম্ভব।

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রিয়ন্তি জিজ্ঞেস করল, ” প্রণয় এখন কোথায়? ”

” ভাইয়াকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। ” হসপিটালের নাম বলে মেয়েটি ফোন রেখে দিল।

বিপদের সময় এসে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রিয়ন্তির বেলায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। চলে যাওয়ার আগে ফোনে কাঁপা হাতে সাদিবের উদ্দেশ্যে মেসেজ টাইপ করল। অতঃপর গন্তব্য হিসেবে প্রণয়ের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
.
.

” ঐ দিকে কি দেখছিস? ”

মায়ের কণ্ঠে ধ্যান ভাঙল প্রিয়ন্তির। অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনটা আচমকা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। ছোট করে জবাব দিল, ” ভাবছি! ”

” কি ভাবছিস? ঐখানে তোর থাকার কথা ছিল তাই তো? ”

” হুম! ”

প্রিয়ন্তির মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ” এখন আর ভেবে কি করবি। ঐ পথের দরজা তুই নিজেই নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়েছিস। ”

” আচ্ছা মা সাদিব কি খুশি ওর বউকে নিয়ে? ”

প্রিয়ন্তির মা কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠে,
” জানি না। ”

প্রিয়ন্তি শুনে অবাক হয়। বিস্মিত নয়নে মায়ের দিকে ফিরে তাকায়। ” জানো না মানে? তোমার কথা হয় না সামিরা আন্টির সাথে? ”

” সেই মুখ রেখেছিস তুই? ” বলে গটগট করে হেঁটে ভেতরের দিকে চলে গেলেন।
.

.
সাদিব তৈরি হচ্ছিল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। তামান্না বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দু’জনের টুকটাক কথার মাঝে সাদিবের ফোনটা আচমকা বেজে উঠে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চুল আছড়ানোর ফাঁকে তামান্নাকে ফোনটা এগিয়ে দিতে বলল। সাদিবের কথা মতো ফোনটা হাতে নিতে স্ক্রিনে ভেসে আসা নামটা দেখে তামান্না নিমিষে চুপসে গেল। সে যে ভয়ের আশঙ্কা করেছে তাহলে কি সেটাই সত্যি হতে চলল…..!

চলবে….

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩৭)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সাদিব তৈরি হচ্ছিল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। তামান্না বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দু’জনের টুকটাক কথার মাঝে সাদিবের ফোনটা আচমকা বেজে উঠে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চুল আছড়ানোর ফাঁকে তামান্নাকে ফোনটা এগিয়ে দিতে বলল। সাদিবের কথা মতো ফোনটা হাতে নিতে স্ক্রিনে ভেসে আসা নামটা দেখে তামান্না নিমিষে চুপসে গেল। সে যে ভয়ের আশঙ্কা করেছে তাহলে কি সেটাই সত্যি হতে চলল।

” কি হলো! ফোনটা দিতে এতো সময় লাগে কেন?

তামান্না চুপচাপ সাদিবের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে দ্রুত হেঁটে রুম ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। দু’জনকে কথা বলতে দেখলে সহ্য করা এ মুহুর্তে তার পক্ষে অসম্ভব।

তামান্নার চলে যাওয়া লক্ষ্য করে সাদিব ভেবেছিল ফরমাশ দেওয়ায় রেগে গেছে। সাদিব কিছু বলতে চেয়েও পারল না। তার আগেই তামান্না সেখান থেকে প্রস্থান করল। পরক্ষণে ফোনের
স্ক্রিনে প্রিয়ন্তির নাম্বার দেখে বোঝার অবকাশ রইল না। সাদিব বিরক্ত হয়ে ফোন বিছানার দিকে ছুড়ে মেরে পা বাড়ালো বারান্দার দিকে।
.

.
বেলা সাড়ে এগারোটা! সাদিব বারান্দা থেকে ফিরে এসে তামান্নাকে রুমে পায়। গোমড়ামুখে তামান্না বসে আছে। সাদিবের আর বুঝতে বাকি রইল না যা ঘটার তা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। সাদিব বিষয়টা হালকা করার স্বার্থে তামান্নাকে জিজ্ঞেস করে,
” তখন কোথায় গিয়েছিলে? ”

সাদিবের কথার প্রতিত্তোরে কোনো জবাব মেলে না। বরঞ্চ তামান্না বসা থেকে শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে। সাদিব সবটা দেখে লম্বা শ্বাস ফেলল। এগিয়ে গিয়ে তামান্নার মাথার পাশে বসল। কপালে হাত ছুয়ে দিয়ে বলল, ” অসময়ে শুয়ে পড়লে যে? শরীর খারাপ করল নাকি দেখি? ”

তামান্না চোখ মেলে চাইল। সেকি তামান্নার চোখের কার্ণিশে অশ্রু! সাদিব নড়েচড়ে বসল। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে গেলে তামান্না বলে উঠে,
” আজ হসপিটালে গেলে না? ”

” না! তোমার কি হয়েছে সেটা বল? ”

” কিছু হয়নি তো! কিছু কি হওয়ার কথা ছিল? ”
.

.
তামান্না সারাদিন রুমের চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ ছিল। সকালের পর কিচ্ছুটি মুখে রুচে নি। রুচবার কথাও না। অথচ এমতাবস্থায় তার উল্টো নিয়মমাফিক খাওয়া এবং নিজের খেয়াল রাখা উচিত। নিজের স্বামীর সাথে পর নারীর মেলামেশা পৃথিবীর কোনো মেয়েই মেনে নেবে না। হোক না সে তার প্রেমিকা! সাদিবকে এখনো জানানোর সুযোগ হয়নি তামান্নার। অস্বস্তির পর যেমন স্বস্তি মেলে তেমনি বুঝি খুশির ঝিলিক দেখা দেওয়ার পর মুহূর্তে বেদনার্ত জীবনের আভাস মিলে।

ড্রয়িংরুমে পা বাড়াতে কলিং বেলের শব্দ ভেসে আসে কানে। দরজা খুলতে অবাক হয় তামান্না। দরজার ওপাশে প্রিয়ন্তির মা মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়ন্তি তামান্নাকে দেখে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তামান্নার উপস্থিতি যেন সে আশা করে নি। বিস্ময়ে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। তামান্নাকে উপর নিচ সবটা পরখ করে দেখে পরক্ষণে নিজের মায়ের দিকে তাকালে তিনি মাথা উপর নিচ দোলালেন। সামলে নিয়ে প্রিয়ন্তি মুখে হাসি ফোটাল। এগিয়ে এসে তামান্নাকে জড়িয়ে ধরল।

” তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। ”

জবাবে তামান্না সৌজন্যতা বজায় রাখতে মুখে কৃত্রিম হাসি টানল। সরু চোখে প্রিয়ন্তির দিকে তাকাল। বলতে চাইল, ” সত্যি কি ভালো লাগছে? নাকি বলার জন্য বলছো? ”

তামান্না এবং প্রিয়ন্তির সম্পর্ক শুধুমাত্র দেখা দেখির মাঝে হাই হ্যালোতে সীমাবদ্ধ ছিল। তুইতোকারি সম্পর্কে যায়নি কখনো। তবুও দু’জনের জানাশোনা ভালো। এ মুহুর্তে তামান্নার কাছে প্রিয়ন্তিকে ভীষণ বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ চলে গিয়ে আবার হঠাৎই ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে। সাথে এও জানতে ইচ্ছে করছে এ মুহুর্তে সে ঠিক কি চাইছে?

” তোমার শ্বাশুড়িকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় উনি? ” তামান্না এবং প্রিয়ন্তির কথার মাঝে প্রিয়ন্তির মা তামান্নাকে জিজ্ঞেস করল।

” উনি দুপুরের পর তো ভাতঘুম দেন। হয়তো রুমেই আছেন। ”

” একটু ডেকে দেবে প্লিজ? ভাবী হয়তো আমার ওপর রেগে আছেন। ”

” জ্বি আণ্টি! আপনারা বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি।

” আর শোন, উনাকে গিয়ে আমার নাম বলবে না।”

তামান্না কৌতুহলী দীপ্ত হয়ে জানতে চাইল, ” তাহলে কি বলবো? ”

” বলবে পাশের বাসার আন্টি এসেছে দেখা করতে। ”
.

.
সামিরার দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য ভাতঘুম দেন। আছরের ওয়াক্তের সময় উঠে একেবারে নামায সেরে নেন। প্রতিদিনের মতো নামায শেষ করার পরমুহূর্তে তামান্নাকে রুমের বাহিরে দেখা যায়। নামাযের মাঝখানে থাকায় মেয়েটা দাঁড়িয়ে সালাম ফেরানোর অপেক্ষা করছিল। খেয়াল করলেও তিনি সালাম ফিরিয়ে রা শব্দটিও করলেন না। তবে তামান্না চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল না। বলল, ” আপনার সাথে পাশের বাসার আন্টি দেখা করতে এসেছেন! ”

সামিরা গম্ভীর গলায় বলল, ” কে এসেছে এমন অসময়ে? ”

তামান্না পড়ল বিপাকে। কি বলবে? প্রিয়ন্তির মা বললেন তো উনার নাম না নিতে নয়তো তিনি যাবেন না। নিজেকে সামলে নেওয়ার মাঝে শোনা গেল, ” তা তো ঠিকভাবে বলতে পারব না। না মানে উনাকে তো এখানে আসতে দেখেনি আগে তাই আরকি! ”

সামিরা সেকেন্ড দুয়েক চুপ থেকে ভাবলেন। ভেবে বললেন, ” আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসছি। ”
.

.
” আসবো? ” প্রিয়ন্তির কণ্ঠ শুনতে পেয়ে তামান্না দরজার দিকে ফিরে তাকাল। না চাইতেও রাজ্যের বিরক্তি সব এসে তার চোখে মুখে হানা দিল। একটা সময় ছিল যখন তামান্না সবার সাথে মন থেকে মিশত। সেরকম প্রিয়ন্তির মত মুডি মেয়ের সাথেও একইভাবে মিশতে সক্ষম হয়েছিল। এ মুহুর্তে সে-সময়ের কথা মনে করে নিজের ওপর ভীষণ রাগান্বিত হচ্ছে তার।

প্রিয়ন্তি ঘুরে ঘুরে সারা রুম দেখছে। আর তামান্না দাঁড়িয়ে থেকে প্রিয়ন্তিকে খুঁটে খুঁটে দেখছে। দুধে আলতা গায়ের রঙের সাথে হালকা গোলাপি রঙের জামায় দারুণ লাগছে মেয়েটাকে দেখতে। মনে হচ্ছে জামাটা একান্তই তার জন্য বানানো হয়েছে।

” এ রুমটায় আমি যখন শেষবার এসেছিলাম তখন একরকম ছিল এখন অন্যরকম। ”

” কেন খুব খারাপ দেখতে লাগছে? ”

” না সেটা বলতে চাইনি। বই খাতার স্তুপ ছিল তখন। মনে হয়েছিল ভুল করে কোনো লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েছিলাম। বরং সুন্দর দেখাচ্ছে! ” ঠাট্টার সাথে বলল, ” এখন জাতের লাগছে। ”

” কেন লাইব্রেরি অজাতের হয় নাকি? ”

” না সেটা বলি নি। আচ্ছা বাদ দেও! ” কথার প্রসঙ্গ পাল্টে প্রিয়ন্তি জানতে চাইল, ” তো দু’জনের মধ্যে বোঝাপোড়া কেমন যাচ্ছে? ”

প্রিয়ন্তির সাহস দেখে তামান্না বরাবরের মতো অবাক হচ্ছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে প্রিয়ন্তিকে দু’চারটে বুলি শুনিয়ে দিতে। কিন্তু আপসোস! বাসার অতিথি হিসেবে সেটা করারও উপায় নেই। মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলল, ” ভালো। তোমার কেমন যাচ্ছে? ”

প্রিয়ন্তি খানিকটা মিইয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা হাসিটা নিমিষে মিলিয়ে গেছে। তামান্না আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার জবাবের অপেক্ষায়। প্রিয়ন্তির এখনকার জবাবই বলে দেবে তার ফিরে আসার উদ্দেশ্য। কিন্তু তামান্নাকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়ন্তি জানাল, ” হ্যাঁ ভালোই। ”

ইতিবাচক জবাব পেলেও তামান্না সন্তুষ্ট হয়নি। মনের খটকা তখনো পুরোপুরি দূর হয়ে যায়নি।
” তো তোমার বর আসেনি? ”

প্রিয়ন্তি মলিন মুখে বলল, ” ও আসেনি। আমি একাই এসেছি। ”

তামান্না কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ” কেন? ”

” আসলে তুমি তো জানোই আমাদের বিয়েটা পরিবারিকভাবে হয়নি। তখনকার পরিস্থিতির বশে চলে যেতে হয়েছিল। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। তাদের ছেড়ে এভাবে কতদিন দূরে থাকা যায় বল? তাই তারা বলল আমিও সব ছেড়ে ছুড়ে ছুটে চলে এলাম। ”

” তাই বলে স্বামী শ্বশুর বাড়ি পেলে রেখে? ” তামান্নার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো।

” বাবা মাকে ছেড়ে যেতে পারলে তাদের কেন নয়?”

‘ সত্যি তো! বড্ড স্বার্থপর তুমি। কারোর জানমালের পরওয়া নেই তোমার। যেখানে আপন মানুষের প্রতি যার মায়া দয়া নেই সেখানে আমি কে? ‘ তামান্না ভাবল। মনে মনে সিন্ধান্ত নিল, ‘ ডাক্তার সাহেব চাইলে বাধ্য হয়ে হলেও আমাকে আমার জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। জোরপূর্বক কারোর সাথে কাটানো আমার স্বভাব বিরোধী। তোমার মতো স্বার্থপরতার সহিত উৎপীড়ন করার স্বভাব তো একদমই নয়….

চলবে…..

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩৮)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
‘সত্যি তো! বড্ড স্বার্থপর তুমি। কারোর জানমালের পরওয়া নেই তোমার। আপন মানুষের প্রতি যার মায়া দয়া নেই সেখানে আমি কে? ‘ তামান্না ভাবল। মনে মনে সিন্ধান্ত নিল, ‘ ডাক্তার সাহেব চাইলে বাধ্য হয়ে হলেও আমাকে আমার জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। জোরপূর্বক কারোর সাথে কাটানো আমার স্বভাব বিরোধী। তোমার মতো স্বার্থপরতার সহিত উৎপীড়ন করা আমার স্বভাব বিরোধী।

প্রিয়ন্তি ঠিক চলে যাওয়ার সময়ই সাদিব বাসায় ফিরল। প্রিয়ন্তি সাদিবকে দেখে থমকে গেল। আর সাদিব সেটা দেখেও না দেখার ভান করে অন্যপাশে চোখ ফিরিয়ে নিল। প্রিয়ন্তি কিছু বলতে চাইলে সাদিব বলে উঠল, ” তামান্না রুমে আসো একটু দরকার ছিল। তাড়াতাড়ি এসো! ”

সাদিবের এড়িয়ে চলা দেখে তামান্না চমৎকৃত হল। অন্যদিকে প্রিয়ন্তি হতাশ, ব্যথিত নয়নে সাদিবের দিকে চেয়ে রইল। ভেবেছিল সাদিব এখনো তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। তামান্না সুযোগ পেয়ে প্রিয়ন্তিকে নিজের অবস্থান বোঝাতে সাদিবকে ইতিবাচক জবাব দিল। প্রিয়ন্তি নিজেকে সামলে মৃদু হেসে বিদায় জানিয়ে নিজের বাসার দিকে পা বাড়ালো।
.

.
সাদিব তামান্নাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে তামান্না এক ঝটকায় সাদিবকে নিজের থেকে সরিয়ে দিল। আচমকা ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে পেছনে সরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল সাদিবের। তামান্নার এহেন আচরণে সাদিব অবাক হওয়া যেন ভুলে গেছে। বিম্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে দেখছে। তামান্নার কাঠিন্যতা এর আগে কখনো চোখে পড়েনি, মেয়েটার হুট করে কি হলো? হয়তো বাসায় আসতে দেরি করে ফেলেছে ভেবে তামান্নার দিকে পুনরায় এগিয়ে গেল।

তামান্না তেতে উঠল। উঁচু গলায় বলল, ” লজ্জা লাগে না তোমার? ঘরে বউ রেখে প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে যেতে? ”

সাদিব চমকে উঠে তামান্নার প্রশ্নে। চোখে মুখে জিজ্ঞাসানু দৃষ্টি ফুটে উঠে। ” মানে? কি বলছো এসব? তোমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না! ”

” মানে বুঝতে পারছো না? বুঝবে কি করে? তোমরা তো সবাই ভালো। আসল সমস্যা তো আমার। কারণ আমার ভাগ্যটাই যে খারাপ। ” কথাটা শেষ করে তামান্না কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে।

সাদিব থামাতে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে তামান্নার পাশে মেঝেতে বসে। কাঁধে হাত রাখে। তামান্না নিরবে কাঁদে। কান্নার বেগ বেড়ে গেলে হেঁচকি উঠে যায়। সাদিব দু’কাঁধে আলতোভাবে হাত রেখে নিজের দিকে ঘোরাল। মিহি গলায় বলল, ” কি হয়েছে ক্লিয়ার করে না বললে কি করে বুঝবো বল? কেউ কিছু বলেছে.? ”

” কিছু হয়নি! ” অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে তামান্না।

” তাহলে এভাবে কাঁদছো কেন? ”

তামান্নার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকে হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা মুছে শান্ত গলায় বলল, ” সাদিব আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমাকে একটু একা ছেড়ে দেও। ”

সাদিবের নাম ধরে সম্বোধন শুনে সাদিব হতভম্ব হয়। তামান্নার হঠাৎ রাগের কারণ বুঝতে এতটুকুও অসুবিধে হয়নি। নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ” উহু সেটা বললে তো মানছি না। সারাদিন বহুত একা থেকেছো। এখন কোথাও যাওয়া চলবে না। এখানেই আমার সামনে বসে থাকতে হবে। ”

কান্নার কারণে ইতিমধ্যে তামান্নার চোখ জোড়া লাল রঙ ধারণ করেছে। সাদিবের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতে সাদিব হকচকিয়ে গেল।

” বেলকনিতে গিয়ে বসে থাকো। তোমার জন্য তোমার প্রিয়ন্তি প্রতিদিন অপেক্ষা করে। অযথা আমাকে বিরক্ত করবে না। ”

সাদিব যা বোঝার বুঝে গেছে। প্রিয়ন্তির কারণে তাদের স্বামী স্ত্রী দু’জনের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হোক এটা সে হতে দেবে না। প্রিয়ন্তি নিশ্চয়ই কিছু বলেছে তামান্নাকে, নাহলে হুট করে রাগবে কেন মেয়েটা! প্রিয়ন্তির সাথে সরাসরি কথা বলা দরকার। মেয়েটা আসলে কি চায়, যখন চাইল পালিয়ে গেল। যখন চাইল ফিরে এসে অশান্তি শুরু করে দেবে এটা তো হতে পারে না। রেগে সাদিব বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়ন্তির একটা বিহিত করা দরকার মনে করল। ভেবেছিল এড়িয়ে গিয়ে বিহিত করবে। কিন্তু না! সে এতো সহজে শোধরানো তো দূরের বরং তামান্নাকে তার থেকে দূরে সরানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

সাদিব ফোন হাতে নেয়। প্রিয়ন্তির নাম্বারে ডায়াল করতে যাবে এর মাঝে তামান্নার কণ্ঠ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছায়। ” প্রিয়ন্তির সাথে কথা বলবে তা বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেই পার। ফোন দিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছো? ”

” ওর সাথে আমার সরাসরি কথা বলা দরকার। তার জন্য হলেও ফোন করাটা জরুরি! ”

” বাহ্, আমি বললাম তুমি ও মেনে নিলে ডাক্তার সাহেব? ” তামান্নার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।

” তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। বিশ্বাস কর ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ” সাদিব করুণ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। ” হ্যাঁ মানছি আগে ছিল। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু যে একবার আমার সাথে প্রতারণা করেছে তাকে দ্বিতীয়বার ফেরানোর অপশন আমার কাছে নেই। ”

তামান্না সেকেন্ড কয়েক মৌন থেকে বলল,
” তোমাকে একটা সংবাদ দেওয়ার ছিল। জানিনা সেটা জানার পর তুমি কেমন রিয়েক্ট করবে। খুশি হবে নাকি নারাজ।”

” বল না। কি বলবে? ”

” ডাক্তার সাহেব তুমি বা…

তামান্নার অর্ধেক বলা কথার মাঝে সাদিবের মুঠোফোনটা সশব্দে বেজে উঠে। স্ক্রিনে ভেসে আসে প্রিয়ন্তির নাম্বার। দেখতে পেয়ে আস্তে আস্তে তামান্নার শান্ত হতে থাকা মেজাজ পুনরায় তেতে উঠল।
.

.
রেস্টুরেন্টে সামনা-সামনি বসে আছে সাদিব প্রিয়ন্তি। সাদিব গুম মেরে বসে আছে। হয়তো ভাবছে প্রিয়ন্তিকে কিভাবে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দেওয়া যায়! কিয়ৎক্ষণ মৌনতা বজায় রাখার পর প্রিয়ন্তি আগে মুখ খুলে,

” স্যরি! আ’ম রিয়েলি স্যরি সাদিব! ”
সাদিব গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ” কেন? ”
” জানো না? ”
” না! ”

প্রিয়ন্তি শ্বাস ছাড়ল। বলল, ” সাদিব আমি সত্যি অনুতপ্ত। ”

সাদিব নির্বিকার হয়ে বলল, ” তো? তুমি দোষ করেছ। অনুতপ্ত তো তোমারই হওয়া উচিত! ”

প্রিয়ন্তি মাথা নিচু করে আছে। দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ। ” আমি বুঝতে পারছি সেদিন আমার এভাবে চলে যাওয়াটা উচিত হয়নি। অন্তত তোমাকে জানানোর প্রয়োজন ছিল। আসলে…

” থাক! ” সাদিব হাত তুলে প্রিয়ন্তিকে থামিয়ে দেয়।
” আসলে নকলে শোনাতে এসো না। যা হওয়ার হয়ে গেছে, বর্তমানের সাথে অতীত জড়িয়ে কোনো লাভ নেই। শুধু একটা অনুরোধ করব! ”

প্রিয়ন্তি ছোট করে জবাব দিল, ” কি? ”

” আমার আর তামান্নার থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকো। প্লিজ ওকে অন্তত ভুল বুঝিও না। এমনিতে..

এতটুকু বলে থেমে গেল সাদিব। গত রাতের কথা বলতে গিয়েও বলল না। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন বাহিরের মানুষের জানার অধিকার নেই। যেখানে মূল সমস্যাটাই প্রিয়ন্তি। সে তো একদমই নয়! সাদিবের নিরবতা লক্ষ্য করে প্রিয়ন্তি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে। ” এমনিতে? ”

” আমি চাইনা ও আমাকে ভুল বুঝুক। ”
সাদিব বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চলে আসতে নিলে প্রিয়ন্তি বলে উঠে, ” তুমি কি মন থেকেই কথাটা বলছো সাদিব? ”

” অফ কোর্স! তুমি জানো তোমার আর ওর মধ্যকার পার্থক্য কতখানি? পার্থক্য করলেও ওকে অপমান করা হবে। আর যাই হোক তোমার মতো কোনো ঠক প্রতারণা কারিনীর কথা ভেবে ওর মতো নির্দোষকে কষ্ট দিতে পারি না। শত হলেও আমার আমানত, আনার সহধর্মিণী সে। আশা করি এরপর থেকে কোনো সন্দেহ থাকবে না কারোর। ” কাঠ কাঠ গলায় বলে সাদিব অপেক্ষা করল না। হনহনিয়ে হেঁটে বাহিরে বেরিয়ে গেল।
.

.
তনিমা তন্ময়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের শুক্রবারে কাবিন। তামান্না একদিকে খুশি হলেও অন্যদিকে জমে আছে একরাশ অভিমান। ডাক্তার সাহেবের প্রতি চরম অভিমান জমে বুকটা ভার হয়ে আছে তার। ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারলে এ মুহুর্তে ভালো লাগতো।

অনেকদিন পরে ছাদে এসেছে। মেঘলা আকাশের বুকে কালো মেঘের ঘনঘটা বেশ লাগছে দেখতে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেছে। প্রকৃতিতে মিশে গেছে সব বিস্বাদ। এই জন্যই বোধহয় আল্লাহ সূরা বাকারার ১৪৪ তম আয়াতে বলেছেন, ” আকাশের দিকে তোমার বারবার তাকানোকে আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি। ”

ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরে আসতে সিঁড়ির রুমে মিসেস সামিরা শিকদারের সাথে দেখা হয়ে যায় তামান্নার। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন। তামান্নার মনে হল এই বুঝি কোনো খুঁত খুঁজে বের করবেন। হলোও তাই! স্বভাব সূলভ বলে উঠলেন, ” এই ভর দুপুরে ছাঁদে গিয়েছিলে কেন? ”

” ঘরে ভালো লাগছিল না। তাই একটু ছাদে গিয়েছিলাম। ”

সামিরা সামান্য চুপ করে থাকলেন। গতকাল প্রিয়ন্তিরা চলে যাওয়ার পরপর সাদিব বাসায় ফেরে। বাহির থেকে এসে আগে সাদিব মায়ের সাথে দেখা করেনি এমনটা খুব কমই হয়েছে। অথচ কালই তার দেখা করা সবচেয়ে জরুরি ছিল বলে মনে করেছেন তিনি। ছেলের সাথে সে বিষয়েই দরকারি কথা বলতে এসেছিলেন। রুমের সামনে আসতে ভেতর থেকে তামান্নার গলার আওয়াজ শুনে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। তামান্নার রাগী গলার আধো আধো কথা শুনে যা বোঝার বুঝলেন। প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ” কাল অনেক চেচামেচি শোনা গেছে তোমার। কিছু হয়েছে নাকি? ”

মিথ্যে কথা বলার মতো স্বভাব নেই তার। তবুও এ মুহূর্তে এড়িয়ে চলাটাকেই সবচেয়ে বড় সমাধান মনে হল। বলল, ” না! ”

” তাহলে চেচামেচি কি খুশিতে করেছিলে? এতো যদি অসহ্য লাগে আমার ছেলেকে তাহলে তাকে ছেড়ে কেন দিচ্ছ না…..

চলবে….?

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]