তোমার নামে হৃদয় পর্ব-৫১+৫২+৫৩+৫৪

0
298

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৫১)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। গরমের উত্তাপে অতিষ্ঠ লোকজন। দেশ জুড়ে বিদ্যুতের সংকট। এতো প্রতিবন্ধকতার মাঝে দেশের অফিস আদালতের কার্যক্রম কোনোভাবেই ব্যহত হচ্ছে না। মানুষজন সবাই নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে রোজ রোজ ছুটে চলছে নিজ নিজ কর্মস্থলে। তার ওপর দেশের প্রতিটি কোণায় বিরক্তিকর ট্রাফিক জ্যাম তো নিত্যদিনকার ঘটনা। আজকের জ্যামটাও ছিল লম্বা সময় জুড়ে। এ জ্যাম লেগেছে তো লেগেছে মনে হয় ইহজনমেও শেষ হওয়ার নাম নেবে না। বিরক্তির সাথে ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলল তন্ময়। পরক্ষণে মনে হলো সে কার মতো করে কথাটা বলল? এভাবে তো তামান্না কথা বলে। বুঝতে পেরে ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত হলো। সম্পর্কে সে বর্তমানে তার শালিকা। এক জীবনে জীবনের প্রথম প্রেম হয়ে এসেছিল। ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুত ঠেকল তার কাছে। আজকাল কেন জানি তনিমার অনুপস্থিতিতে তাকেই বেশি মনে পড়ে তার। জানে কথাগুলো যে কেউ শুনলে তাকে নির্বিঘ্নে চরিত্রহীনের ট্যাগ দিয়ে দেবে। তন্ময়ের ভাবনার মাঝে ততক্ষণে জ্যাম ছেড়ে গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে।

বাসার কলিং বেল বাজাতে তন্ময়ের মা দরজা খুলে দিলেন। ছেলেকে দেখে তার গম্ভীর মুখে হাসি ফুটল। এই ছেলেই তো তার একমাত্র বাঁচার অবলম্বন। স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ছোট্ট ছেলেটি তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়েছিল। সেদিন কান্নার কারণ পুরোপুরি না বুঝলেও শুধু বলেছিল, ” তুমি কেঁদো না মা! আমি তোমার সব কথা শুনবো, তোমাকে আর কষ্ট দেবো না! ”

ফ্যামিলি অ্যালবাম ঘেঁটে এতোক্ষণ পুরোনো দিনলিপির স্মৃতিচারণ করছিলেন তন্ময়ের মা। তন্ময়ের ছোটবেলার ছবি দেখে সেদিনের সেই কথা মনে পড়ে গেছিল। তন্ময় মাকে দেখে মৃদু হাসল। ” আসসালামু আলাইকুম মা! ”

তন্ময়ের মা হাসি মুখে ছেলেকে বললেন, ” ওয়ালাইকুম আসসালাম! এসেছিস বাবা? রাস্তায় কোনো অসুবিধে হয়নি তো? ”

” না মা। কোনো অসুবিধা হয়নি। তোমার দোয়া সাথে থাকলে আমার কিছু হতে পারে বলো? ”

তন্ময়ের মা কিছুসময় মৌনতা বজায় রাখলেন। ছেলের কথায় সন্তুষ্ট হলেন বলে কিনা!
” বিপদের তো হাত পা নেই। তুই যতক্ষণ বাহিরে থাকিস ততক্ষণ আমার অনেক চিন্তা হয় রে। ”

” তুমি শুধু শুধু চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করো না তো। ” কথার মাঝে আশেপাশে চোখ বোলাল। নাহ্ যাকে সে খুঁজছে সে তার ধারেকাছেও নেই। আজ হলোটা কি তার? এমন তো কখনো করেনি।

“মা তনিমাকে দেখছি না। কোথায় ও? ”

” ঘরেই কোথাও আছে গিয়ে দেখ। ”
.

.
তন্ময় ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। সারা রুম চোখ বুলিয়েও তনিমাকে কোথাও দেখা গেল না। দরজা ঠেলে বিছানার বসতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন তারওপর হামলে পড়ে। আচমকা হামলায় টাল সামলাতে না পেরে তাৎক্ষণিক দু’জনে মেঝেতে পড়ে যায়। তন্ময় পেছনে তাকিয়ে দেখে হামলা করা ব্যতিটি আর কেউ। এতোক্ষণ সে যাকে খুঁজে বেরিয়েছে এই সে।

তনিমা সেভাবে মেঝেতে বসে নাটকীয় আর্তনাদ করে বলে উঠে , ” ও বাবা গো মরে গেলাম গো! কে কোথায় আছো বাঁচাও আমায়। ”

তন্ময় রাগী গলায় বলল, ” কেউ আসবে না তোমাকে৷ বাঁচাতে। আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন। ”

তনিমা কান্না থামিয়ে তন্ময়ের দিকে তাকাল। বলল, ” দুইদিনের দুনিয়ায় যদি আপনারই একদিন হয় তাহলে হবে কি করে? কয়েক ঘন্টা নিন না! ”

তন্ময় তনিমার কথায় অবাক হলো। এ কোন মেয়ে তার সামনে বসে আছে? এই মেয়ে তো কখনো এতো কথা বলে না। বলছে তো বলছে যতসব আজগুবি কথা বলছে। কোথাও তামান্নার ভুতেরা তনিমার মাথায় এসে ছাপেনি তো! উদ্ভট ভাবনা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তন্ময়। তনিমা তখনো নিচে বসে আছে। তন্ময়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে তন্ময় সেদিকে তোয়াক্কা করে না। তনিমা করুণ কণ্ঠে বলল, ” এমন করছেন কেন? আমি কি করেছি? ”

” এসব উদ্ভট কথা কই শিখেছ? ”

তনিমা না জানার মতো করে বলল,
” কই কখন উদ্ভট কথা বললাম? ”

” উদ্ভট কথা নয় বলছ? ”

” হ্যাঁ! আচ্ছা এতোকিছু করে কি হবে বলেন তো একদিন তো মরেই যাবো। তাই বলছি আপনি আমার থেকে কয়েক ঘন্টাই চেয়ে নিন৷ ”

তনিমাকে অবাক করে দিয়ে তন্ময় ফিক করে হেসে দিল। তনিমা বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোমরে হাত রেখে বলল, ” কি এমন বলেছি আমি যার জন্য আপনাকে এভাবে হাসতে হবে? ”

” তামান্না ঠিকই বলেছিল। তুমি কথা বল না বল না, যেগুলো বলো তার মধ্যে বেশিরভাগই উদ্ভট এই লাইনটা বল-ই! ”

” সব তো ওর থেকেই শেখা। ”

” হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাও আমার বোঝা হয়ে গেছে। ”
.

.
পানি নাকের আগায় উঠতে তামান্না কাশতে কাশতে মেঝেতে বসে পড়ল। কাশির চোটে মনে হলো পেট থেকে সব বেরিয়ে আসার উপক্রম। কোন দুঃখে যে জগ উঁচু করে পানি খেতে গিয়েছিল কে জানে! সাদিব ল্যাপটপে কাজ করছিল। তামান্নাকে কাশতে দেখে বিছানার ওপর কোনো রকম ল্যাপটপটা রেখে দৌড়ে এলো। মাথায় আলতো বাড়ি মেরে বলল,
” এভাবে পানি খেতে গেলে কেন? গ্লাসের কি অভাব পড়েছে? ”

কাশি থামতে তামান্না বলল, ” না অভাব পড়েনি। কে যেন আমার নাম নিয়েছে! ”

সাদিব কিৎকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেছে। এমন ধাঁচের কথা আগে সাদিব মাকে আর গ্রামে গেলে আত্মীয়দের বলতে শুনতো। এখন দেখছে ঘরের রমনীও তার একই রকমের কথাবার্তা বলছে।
” এসব কে বলেছে তোমায়? ”

” সবাই তো তাই বলে। ”

” এটা একটা প্রচলিত কথামাত্র তামান্না। এর সাইন্টিফিক কোনো ব্যাখ্যা হয় না। যে কথার কোনো মানে নেই সেসব বলতে হয় না। ”

” ইশ ডাক্তার সাহেব তুমিও না! সব কথায় তোমার মেডিকেল সাইন্সকে কেন টেনে আনো বল তো? সব কথার যে সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা থাকবে এমন হতে হবে কেন? কিছু প্রচলিত কথাও মানা লাগে। ”

” না লাগে না। যেসব কথার কোনো মানে নেই সেসব বলবে না তুমি। ”

” হয়েছে হয়েছে। তোমার বলতে হবে না। ” তামান্না উঠে চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে সাদিব ডেকে বলল, ” কোথায় যাচ্ছো! ”

” ছাঁদে যাবো একটু। যাবে? ”

” না। এখন তোমার কোথাও যাওয়া হবে না। এদিকে আসো। ”

” কেন? গেলে কি হবে? ”

” কারণ তোমার কাজ আছে। তাছাড়া অসময়ে ছাঁদে যাওয়া ঠিক না। ”

” আচ্ছা! গেলে কি হবে? ”

” রাতের বেলায় এ অবস্থায় ছাঁদে যেতে হয় না। বলা হয় ছাঁদে এবনরনাল জিনিসের চলাফেরা থাকে। ”

তামান্না সাদিবের কথায় ভ্রু কুঁচকালো। বার কয়েক পরখ করে দেখল তাকে। তামান্নাকে এভাবে তাকাতে দেখে সাদিব প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল, ” কি দেখছ? ” তামান্না বলল, ” তোমাকে দেখছি! ”

সাদিব ভাবল অন্যকিছু। চুলে হাত বুলিয়ে সামান্য ভাব নিতে চাইলে তামান্না বলল, ” তুমি এবনরমাল জিনিসে বিশ্বাস কর? ”

সাদিব নিজেকে সামলে নিল। বুঝতে দিতে চাইল না তামান্নাকে সে যে ভুল বুঝেছে! ” না করার কি আছে? ”

” এর বুঝি কোনো সাইন্টিস্ট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে ডাক্তার সাহেব? ”

” সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা না থাকলেও কোরআনে তো উল্লেখ আছে তাই না? কোথায় কি মিলাতে আসে মেয়েটা! ”

সাদিবের কথার সত্যতা বুঝতে পেরে তামান্না নিশ্চুপ রইল। তামান্নাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদিব ডাকল। ” কি, দাঁড়িয়ে আছো কেন? এদিকে আসো। ”

” কি হয়েছে? ”

” মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের কাজ পারো নিশ্চয়ই? ”

” অবশ্যই। কই সাক হে? ”

” বোহাত সাক হে! চুপচাপ এই ডকুমেন্টটা তৈরি করে দেখাও। আজাইরা বসে থেকে মাথায় সারাদিন তোমার আজেবাজে চিন্তা ঘুরঘুর করে। তারচে জং ধরা মাথা থেকে জং চাটাই কর। ”

” আমি আজাইরা চিন্তা করি? ঠিক আছে যাও করবো না তোমার কাজ। যাও নিজের কাজ নিজে করো গিয়ে। ” ল্যাপটপ ঠেলে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে তামান্না।

” আমার কাজ নয় ম্যাম! এটা আপনার কাজ। কোনো বাহানা নয়। চুপচাপ কাজ চালাও। নাহলে ভাববো কিছুই পারো না। প্রাইভেটে পড়ে শুধু শুধু শ্বশুরের টাকাগুলো ধ্বংস করেছ.। ”

তামান্নাকে রাগাতে পেরে সাদিবের বেশ লাগছে। রাগটাকে এ মুহুর্তে তার কাছে উপভোগ্যের মনে হচ্ছে। তামান্না রেগে বলল, ” কি বললে তুমি? আমি তোমার শ্বশুরের টাকা ধ্বংস করেছি? ঠিক আছে দেও। আমিও তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি। ”

সাদিব ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে বলল, ” হ্যাঁ দেও। ”

তামান্না নিজের মতো কাজে মনোযোগ দিয়েছে। সাদিব এটাই চেয়েছিল। তামান্নার অলস সময়কে কাজে লাগাতে পেরে সাদিবের ভালো লাগছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি নিজের অর্ধাঙ্গীনিকে। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানের বাতাসে তামান্নার খোলা চুলগুলো বারবার সামনে এসে তাকে বিরক্ত করে চলছে। বারবার হাতের সাহায্যে চুলগুলো ঠেলে পেছনে পাঠাচ্ছে সে। সাদিব ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে কাকড়া ক্লিপ এনে সযত্নে তামান্নার চুলগুলো বেধে দিল। তার মাঝে তামান্না নিজের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করে ফেলল। সাদিব সবটা পরখ করে দেখল। কিছুটা ভুল থাকায় সেগুলো শুধরে দিল। তবে বকল না। তামান্নাকে ভুল শুধরে দেওয়ার মাঝে শিখিয়ে দিল। সব শেষে সাদিব বলল, ” আমি এগুলো কার থেকে শিখেছি জানো? ”

” কার থেকে? ”

” তোমার বাবার থেকে। ”

” কিহ্? আমার বাবার থেকে আবার কিভাবে? ”

” তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়তাম। উনি আমাদের বাসায় তখন প্রায়ই আসতেন। বাবার সাথে অনেক সময় বসে গল্প গুজব করতেন। কথায় কথায় বাবা আমার কম্পিউটারের প্রতি কৌতুহলের কথা জানান। সেবার জন্মদিনে আমাকে উনি একটা কম্পিউটার গিপ্ট করেছিলেন। বাবা আমাকে টুকরো শিখাতে চাইলে আমি আংকেলের জন্য শিখিনি জানো? বাবাকে বলেছিলাম আমি কম্পিউটারের সকল বেসিক উনার থেকেই শিখবো। বাবাও আপত্তি করেননি। ”

তামান্না সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনল। কোনো প্রতিউত্তর করল না। সাদিব পাশ থেকে উঠে যাওয়ার সময় হঠাৎ তামান্না পেটে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করল। না চাইতেও তার মুখে দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। বহু কষ্টে, ” ডাক্তার সাহেব! ” বলে সাদিবকে ডাকল।

#চলবে….

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৫২)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সাদিব সবে রুমের চৌকাঠ পেরিয়েছে। পেছন থেকে তামান্নার আর্তনাদ শুনে সেখানেই থেমে গেছে। তাকিয়ে দেখল তামান্না পেটে হাত দিয়ে অর্ধশোয়া অবস্থায় কাতরাচ্ছে। চোখ মুখ তীব্র কষ্টের জানান দিচ্ছে। সাদিবের সেখানটায় দাঁড়িয়ে থাকার জো রইল না। দৌড়ে তামান্নার দিকে এগিয়ে আসে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জানতে চায়, ” কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? ”

ব্যথা যেন ক্রমশ বাড়ছে বৈ কমছে না। তামান্নার মুখ থেকে কোনো কথাই যেন বের হতে চাইছে না। সহ্য করতে না পেরে সাদিবের কাঁধে খামচে ধরে। সাদিব কিছু চিন্তা করে সাথে সাথেই কোলে তুলে নেয় তামান্নাকে। রওয়ানা দেয় হসপিটালের দিকে।

” বেশি ব্যথা করছে? দেখ একটু অপেক্ষা কর কিছু হবে না তোমার। ” একহাতে সাদিব গাড়ি ড্রাইভ করছে অন্যহাতে ফোনে ডাক্তার মনিরা সুলতানার নাম্বার ডায়াল করছে। কিন্তু প্রতিবারই তিনি কেটে দিচ্ছেন। এদিকে তামান্নার আর্তনাদে মনে হচ্ছে সাদিবের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিছুক্ষণ আগেও তো সব ঠিকঠাক ছিল। তাহলে হুট করে এমন কি ঘটল যার জন্য তামান্নার পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হলো? রাতের বেলায় আধ ঘন্টার রাস্তায় যেখানে দশ মিনিটে যাওয়া সম্ভব সেখানে মনে হচ্ছে এ রাস্তার কোনো কুল কিনারা নেই। বিপদ আসলে বুঝি এভাবেই এসে হানা দেয়!

হসপিটালের সামনে গাড়ি থামাতে ডাক্তার মনিরা সুলতানাকে দেখা গেল। তিনি সেসময় বাসায় ফিরছিলেন। সাদিব তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে মনিরার দিকে ছুটে যায়। মনিরা সাদিবকে দেখে খানিকটা অবাক হলেন। গত মাস তিনেক সময় ধরে সাদিবকে রাতে হসপিটালে থাকতে খুব একটা দেখা যায় না। যা কাজ সেই সকাল থেকে বিকেলের আগ অব্দিই।

সাদিবকে নজরে আসতে মনিরা হাসি মুখে বললেন, ” আরে ডাক্তার ইরফান সাদিব যে! হঠাৎ এসময় কি মনে করে? ”

” মিসেস মনিরা আমার আপনার সাথে কথা বলার জন্য হাতে একদম সময় নেই। ”

” কি হয়েছে আপনার? উত্তেজিত হয়ে আছেন কেন? ”

সাদিব গাড়ির দিকে দেখিয়ে বলল, ” আমার ওয়াইফ… ” এতটুকু বলে সাদিবের কথা আটকে গেল যেন। বলার মতো মুখ থেকে বাকি কথাটুকু বের হতে চাইল না। মনিরা পুরোটা না বুঝলেও সাদিবের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পেরেছেন তামান্নার কিছু তো একটা হয়েছে! সাদিবকে প্রশ্ন না করে নিজেই এগিয়ে গেলেন সেদিকে। তামান্নাকে কাতরাতে দেখে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” আমার হাত ধরে সাবধানে নেমে এসো। ”

মনিরার কণ্ঠ শুনতে তামান্নার ততক্ষণে খানিকটা হুঁশ আসে। হাত বাড়িয়ে দিতে চাইলে পাশ থেকে সাদিব বলল, ” আপনি চলুন আপনার চেম্বারের দিকে, ওকে নিয়ে আমি আসছি। ”

” হ্যাঁ তাই ভালো। ”
.

.
তামান্নার ব্যথার অনেকটা উপশম ঘটেছে। এ যাত্রায় ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় তামান্না এবং তার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি। তামান্নাকে এতো রাতে মনিরা যেতে দিলেন না। হসপিটালে থাকার পরামর্শ দিলেন। সাদিবও কোনো দ্বিরুক্তি করল না। তামান্নাকে বিশ্রাম নিতে বলে বেরিয়ে গেলেন মনিরা। সাদিব মনিরার সাথে আলাদা করে কথা বলতে সেও সরে এলো তামান্নার কাছ থেকে।

” হয়েছে টা কি ডক্টর? ”

সাদিবের কথায় ডাক্তার মনিরা সুলতানাকে বেশ চিন্তিত দেখাল। বললেন, ” সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। এমনটা তো সচরাচর হয় না। ”

” সেটা তো আমিও জানতাম। কোথাও আপনি ভুল ঔষধ দিয়ে দেননি তো? ” সাদিব সন্দিহান হয়ে বলল।

সাদিবের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ডাক্তার মনিরা বললেন, ” আপনার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। দেখুন, আপনার সাথে আমার না আছে পারিবারিক ঝামেলা আর না আছে ব্যক্তিগত। আপনার আর আমার পরিচয়ই তো পেশার তাগিদে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি তাকে কোনোপ্রকার ভুল ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেইনি। অন্য সব পেসেন্টের মতো তার যথাযথ ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। ইভেন আপনার ওয়াইফকে ভুল ঔষধ দিয়ে আমি নিজের ক্ষতি নিজে করতে চাইব কেন? বিশ্বাস না হয় তো সেগুলো কাল আনিয়ে একবার চেক করে নিতে পারেন। ”

সাদিব চুপ করে রইল। এ মুহুর্তে তার বলার মতো কোনো কথা অবশিষ্ট নেই। শুধু আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাল, তিনি তার স্ত্রী এবং সন্তানকে সহিসালামতে রেখেছেন।
.

.
আশফাক শিকদার সকাল সকাল চলে এলেন হসপিটালে। হাতে করে এনেছেন তামান্নার যাবতীয় ঔষধপত্র। গতকাল রাতে বাসায় ফিরে সামিরার মুখে শুনেছেন তামান্নার অসুস্থতার কথা। এবং তাকে হসপিটালের দিকে নিয়ে আসার কথা। সাদিবকে ফোন করলে সে সেভাবে কিছুই জানাল না। আসতে বললে সাদিব নিষেধ করলেও তিনি শুনলেন না। বাধ্য হয়ে সাদিবকে সকালের কথাটাই বলতে হলো। এ সুযোগে সাদিব সাথে করে ঔষধগুলো নিয়ে আসার কথা বলে দিল। কিন্তু তিনি যে এতো সকাল সকাল চলে আসবেন ভাবেনি কেউ। তামান্না তখনো ঘুমন্ত অবস্থায়। রাতে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিলেন ডাক্তার মনিরা সুলতানা। তাও সেটা সাদিবের সামনেই। আশফাক শিকদারকে দেখে সাদিব বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সারারাত সে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। রাতের শেষ প্রহরে এসে চোখের পাতা জোড়া এক হয়েছে।

” বাবা আপনি এতো সকাল সকাল? ”

” তাছাড়া কি করব? তোরা এখানে আমি কিভাবে পড়ে পড়ে নাক ঢেকে ঘুমাই বল তো? ”

” তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি? ”

” কি হয়েছে খুলে বল তো? ”

সাদিব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অতঃপর শুরু থেকে শেষ অব্ধি সবটা জানালে তিনি বললেন, ” আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। সাদিব ঔষধগুলো ওখানে রাখা আছে ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয়। ততক্ষণে আমি তামান্নার সাথে দু’টো কথা বলি। ”

সাদিব মাথা নাড়িয়ে ডাক্তার মনিরা সুলতানার চেম্বারের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল।
.
.
তামান্না পিটপিট করে নেত্রপল্লবদ্বয় খুলল। শরীরটা এ মুহুর্তে ভীষণ দুর্বল লাগছে। যেন মনে হচ্ছে হাত পা নড়াচড়া করার মতো সামান্য বোধশক্তিটুকুও অবিশিষ্ট নেই। চোখ খুলে সামনে শ্বশুরকে দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে চাইলে আশফাক শিকদার ইশারায় বাঁধা দিলেন। নিষেধ করলেন অসুস্থ শরীরের ওপর জোর না খাটাতে।

তামান্না আশফাক শিকদারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” বাবা আপনি এতো সকাল সকাল? ”

” তোমাকে দেখতে এলাম মা। ”

” কিন্তু আপনি অসুস্থ শরীর নিয়ে কষ্ট করতে গেলেন কেন? একটু বাদে তো আমরা ঠিক বাসায় ফিরতাম। ”

” সে নাহয় ফিরলে। এখন বলো তো মা এসব কি করে হয়েছে? ”

” জানি না বাবা। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি। ”
.

.
ডাক্তার মনিরা সুলতানা তামান্নাকে দেওয়া সবগুলো ঔষধ ভালো মতো পরখ করে দেখলেন। কিন্তু কোথাও তিনি নিজের এতোটুকু গাফিলতি খুঁজে পেলেন না। সাদিবকে অবগত করতে গেলে সাদিবের মনিরার কথা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না। উল্টো রেগে যায়। মনিরা তামান্নার কেবিনে এসে তামান্নাকে ঔষধগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” তামান্না দেখ তো তোমার ঔষধগুলো ঠিক আছে কিনা? এগুলোই কি আমি তোমাকে দিয়েছিলাম? ”

তামান্না ঔষধগুলো ভালো মতো দেখল। গত পাঁচদিনের ঔষধ সেবন করেছে। সবগুলো দেখা শেষে বলল, ” হ্যাঁ সব তো ঠিকই আছে। ”

মনিরা যেন স্বস্তি পেল। এতোক্ষণ ভয়ে ছিল সাদিব রেগে গিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিল। সেই হুমকি পরিণতি পেলে মনিরার ক্যারিয়ার শুরুতেই ধ্বংস হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না।

” দেখলেন তো? আপনি শুধু শুধু আমাকে এতোক্ষণ ব্লেম দিচ্ছিলেন! ”

সাদিব কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে মনিরার কথাগুলো শুনছিল। প্রতিত্তোরে জানানোর আগেই তামান্না বলে উঠে,
” কিন্তু ম্যাম এখানে আরো একটা ঔষধ ছিল। ” তামান্নার পরের কথাটা শোনা মাত্র মনিরা থমকে গেলেন। তবে ঘাবড়ালেন না। সাদিবের দিকে একবার তাকাল। বুদ্ধিমত্তার সাথে তামান্নার থেকে জানতে চাইল, ” আচ্ছা তুমি আমাকে বলতে পারবে ঔষধের নামটা কি? ”

তামান্না ঔষধের নাম বলতে মনিরা চমকে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড মৌনতা বজায় রেখে জানালেন,
” ডক্টর ইরফান সাদিব আমি ওকে এমন কোনো ঔষধই দেই নি। কারণ এই ঔষধের প্রতিক্রিয়া বেশ ভয়াবহ। এর জন্য শুধু তার বাচ্চা নষ্টই হতো না, পরবর্তীতে আপনার ওয়াইফ কখনো কনসিভ করতে পারতো না। ”

আশফাক শিকদার এতোক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন, ” এতো সাংঘাতিক ঔষধ ঔটা? ভাগ্যিস তার আগেই আমরা বুঝতে পেরে গেছি। ”

” হ্যাঁ, গড ব্লেস হার! যাকগে আমি এখন চলি। আপনারা ওকে এখন বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। আশা করি এরপর কোনো সমস্যা হবে না। তবে সামনের দিনগুলোতে আরো কেয়ারফুল থাকবেন ডক্টর ইরফান সাহেব। শত্রুরা বেশিরভাগ আপন মানুষেরাই হয়। হয়তো আপনার আপনদের মধ্যেই কেউ একজন এসব করেছে। ”
.

.
বাসায় ফেরার সময় পুরোটা পথ জুড়ে সাদিব চুপচাপ ড্রাইভ করেছে। পাশের সিটে তামান্না এবং পিছনের সিটে আশফাক শিকদার। আজ আর কেউ কাজে যাবেন না। কাল সারাটা রাত দু’চোখের পাতা বাপ ছেলে কেউই এক করতে পারেন নি। সরাসরি গিয়ে রেস্ট করবেন বলে ঠিক করেছেন। তামান্না সাদিবকে বারবার লক্ষ্য করছে। সাদিব দেখেও সেদিকে তাকাচ্ছে না। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে তামান্নার ওপর ভীষণ মনঃভ্রষ্ট সে।

আশফাক শিকদার আগেই চলে গেলেন। তামান্না ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সাদিবের অপেক্ষায়। সাদিব ফিরলে তবেই ঘরে যাবে। সাদিব দেখে কঠোর কণ্ঠে জানাল, ” দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বাসায় যাও। ”

তামান্না করুণ চাহনিতে তাকায়। সাদিবের এহেন রাগের সাথে সে পরিচিত নয়। অন্যসময় রেগে গেলে বকাঝকা করতো। কিন্তু আজ ভিন্ন আচরণ দেখাচ্ছে। ” ডাক্তার সাহেব…

” বলছি না ভেতরে যাও? ” সাদিব ধমক দিল।

” যাবো কিন্তু তার আগে বল আমার সাথে কথা কেন বলছো না? ”

” দেখ রাস্তায় কোনো সিনক্রিয়েট চাইছি না। বাসায় যাও বলছি। ” উপায়ান্তর না পেয়ে তামান্না ভেতরে চলে গেল।
.
#চলবে…

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৫৩)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
ডাইনিং কক্ষে বসে সবার আসার অপেক্ষা করছিলেন সামিরা। অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে স্বামী আশফাক শিকদারকে দেখে তাড়াহুড়োয় এগিয়ে এলেন সামিরা। জানতে চাইলেন তামান্নার অবস্থা। আশফাক শিকদারের কাছ থেকে আশানুরূপ কোনো খবর জানতে পারলেন না। ” ওরা আসলে জেনে নিও। ” কথাটা অকপটে বলে দাঁড়ালেন না তিনি। নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।

আশফাক শিকদার যেতে তামান্না বাসার সদরে প্রবেশ করল। তামান্নাকে আসতে দেখে বসা অবস্থায় থেকে বললেন, ” কেমন বোধ করছো? ”

গতকালের অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠার আগেই সাদিবের অবহেলা, এক মুহূর্তে তামান্নার মনটাকে ঘিরে ফেলেছে বিষন্নতায়। সামনে তাই সামিরাকে খেয়াল না করে মাথা নিচু করে ভেতরে চলে যেতে নিচ্ছিল সে। পরক্ষণে পা দু’টো সেখানেই থেমে গেল। শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ” হুম যেমনটা আপনি চেয়েছিলেন! ”

” বাচ্চাটা আছে নাকি নেই? সেটা বলো। ”

তামান্না চুপ করে রইল। এটা ঠিক উনাকে সত্যিটা বলা উচিত। তারপরও সংশয় থেকে চুপ করে থাকা। ঠিক জানে না উনাকে কোনটা বললে উনি খুশি হতে পারেন। এতোদিনে তামান্নার ভাগ্য বোধহয় তার ওপর প্রসন্ন হয়েছে। তামান্না কিছু বলার আগে সাদিবের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
” বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তুমি কি করে জানলে মা? ”

সামিরা সাদিবের কথায় চমকে গেলেন। ভাবলেন, সত্যি তো তিনি করে জানলেন? তামান্না কি সব বলে দিয়েছে সাদিবকে? কিন্তু এটা কি করে হবে তিনি তো তামান্নাকে এ ব্যাপারে কিছু জানাননি, সাথে তামান্নাকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার পরপর তিনি ঔষধটাও সরিয়ে ফেলে, উল্টো ডাক্তারের ওপর সব দোষ চাপতে চেয়েছিলেন।

সামিরা ভাবনা ছেড়ে হাসি মুখে বললেন,
” এসেছিস বাবা। আয় দু’জনে আগে খেতে বসে পড়। তারপর নাহয় যত কথা হবে। কাল থেকে নিশ্চয়ই ভালোমন্দ কিছু খাস নি। ”

” তার আগে তুমি বলো মা? ”

” কি বলবো? ”

” কি করে বুঝলে যে বাচ্চাটা থাকবে না? ”

সামিরা ঘাবড়ালেন না। নিজেকে কৌশলে তৎক্ষনাৎ সামলে নিলেন। ” ওমা এটা না বোঝার কি আছে? হুটহাট এভাবে অসুস্থ হয়ে গেলে যে কেউই বুঝবে। ”

তামান্না জানে সাদিব নিজের মাকে কিছুই বলতে পারবে না। উল্টো প্রতিবারের মতো এবারো দোষটা তার ঘাড়েই এসে পড়বে। পড়বে বললেও ভুল হবে বরং শ্বাশুড়ি তার ঘাড়েই ফেলবেন। অনেক হয়েছে এবার চুপ থাকা বাদ দিয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করার পালা।

সাদিবকে তোয়াক্কা না করে তামান্না বলে উঠে,
” আপনি সত্যি কিছু জানেন না মা? ”

” আরে কি জানবো? দু’জনে মিলে কি জানার কথা বলছো? ”

” তামান্না তুমি চুপ থাকো। যা বলার আমি বলছি! ”

তামান্নার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। শরীরের রাগ সব মাথায় ছড়ে বসেছে যেন। কণ্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল, ” কি চুপ থাকবো আমি? আর কত থাকা যায় বলো, আর কত? আমি অব্ধি চুপ করে ছিলাম এখন দেখছি উনি আমার বাচ্চাটাকেও ছাড়বেন না। এভাবে চুপ থাকতে থাকতে এক সময় উনি আমার কাছ থেকে আমার নিশ্বাসটা পর্যন্ত কেড়ে নেবেন। ” অতিরিক্ত রাগে এবং দুঃখ, দুইয়ের সহিত কথাগুলো বলার সময় আচমকা ফুপিয়ে উঠে তামান্না।

সামিরা নিজেকে আত্নবিশ্বাসী প্রমাণ করতে সাদিবকে বললেন, ” কি করেছি আমি বলো? বলো সাদিবকে? ও তো তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ”

” হ্যাঁ মা, বলবো! আজ সব বলবো। অনেক চুপ করে থেকেছি আর নয়। সেবার আপনার ব্যবহারের জন্য একটা চড় নাহয় খেয়েছি, এবার যদি আপনার ছেলে আমাকে মেরে ফেলে তো ফেলুক। ”

তামান্না হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নিল। সাদিবের দিকে তাকিয়ে বলল, ” ডাক্তার যে ঔষধটার সাইড ইফেক্টের কথা বলেছে সেটা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে? ঐ ঔষধটা আমাকে কে দিয়েছে জানেন? আপনার মা। জ্বি আপনার মা-ই দিয়েছেন। ”

তামান্নার কথা সাদিবের বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো কিনা জানা নেই। নিজের মায়ের দিকে তাকালে তিনি ইশারায় মাথা নাড়িয়ে নেতিবাচক জবাব বোঝালেন। সাদিব তামান্নার বাহুতে স্পর্শ করল। ” কি বলছো তুমি জানো? ”

তামান্না সাদিবের রাগী স্বরকে ভয় পেল না। আগের মতো একই রকম জোর কণ্ঠে বলল, ” হ্যাঁ জানি। খুব ভালো করেই জানি। ”

” না জানো না তুমি। উনি আমার মা হয় তামান্না। মা হয়ে উনি আমার ক্ষতি কেন করতে চাইবে? ”

সামিরা আঁচলে মুখ গুঁজল। কাঁদো কণ্ঠে ছেলেকে অভিযোগ জানাল, ” দেখেছিস বাবা? দেখেছিস? তোদের বাপ ছেলের কারণে আমাকে কিভাবে কথা শোনাচ্ছে ও। ”

সাদিব তামান্নার দুগালে আলতো হাতে স্পর্শ করল। নরম কণ্ঠে বোঝাতে লাগল, ” তামান্না দেখ তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। তোমাকে উনি অপছন্দ করেন এটা আমি জানি। কিন্তু বিশ্বাস কর উনি এমন কিছুই করেননি। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। ”

” আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না ডাক্তার সাহেব। সেদিন উনি আমাকে ঔষধটা দিয়ে বলেছিলেন মিনা আমার ঘর থেকে নাকি ওটা পেয়েছে। আমিও তোমার মতো উনাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আল্লাহ সহায় হলেন, আমাদের ভাগ্য ভালো আমাদের সন্তানের কিছু হয়নি, ও এখন অব্দি সুস্থ আছে। ”

” তাহলে কি তুই এনে দিয়েছিলি সাদিব? ” নিজের রুমের বাহিরে চেচামেচির আওয়াজ শুনে আশফাক শিকদার দেখতে এগিয়ে এলেন। দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনে কোনো কিছুই তার বোঝার অবকাশ রইল না। সাদিব নিজের বাবাকে দেখে বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলল, ” বাবা তুমিও? ”

” হ্যাঁ আমিও। ”

সামিরাও একইভাবে স্বামীর কথায় হতভম্ব হলেন। ভাগ্য আজ পুরোদমে তার বিপক্ষে অবস্থান করছে যেন। তবুও তিনি দমে যাওয়ার পাত্রী নন। যতই দোষ করুক না কেন, দায়ভার কোনোভাবে নিজের কাঁধে তুলে নেবেন না। বললেন, ” এখন তুমিও আমাকে অবিশ্বাস করবে? ”

” অবিশ্বাস করার তো কিছুই নেই সামিরা। তোমার ব্যবহার তোমার ছেলে না জানলেও আমি জানি। কমবেশি চোখে দেখেছি আর এও বুঝতে পেরেছি, আমার উপস্থিতিতে তোমার ব্যবহার এমন রূঢ় হলে আমার অনুপস্থিততে কেমন হবে? আপসোস শুধু যার বোঝার কথা ছিল সেই বুঝল না। ” শেষের কথাটা সাদিবের দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে তাকে তাচ্ছিল্যের সহিত আশফাক শিকদার বললেন।

তামান্নাকে বললেন, ” তামান্না রুমে গিয়ে এক্ষুনি তোমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেও। তোমার বাবা আসছেন তোমাকে নিয়ে যেতে। এখানে এদের কাছে তুমি নিরাপদ নও। ”

” আমার অনুমতি ছাড়া ও কোথাও যাবে না বাবা। ” সাদিবের দৃঢ় কণ্ঠ।

” তুমি অনুমতি দেওয়ার কে? ”

” আমি ওর হাসবেন্ড! ওর একমাত্র অভিভাবক। আমার উপস্থিতিতে ও কারোর কথায় কোথাও যাবে না। না তোমার কথায় আর না তো মায়ের কথায়! ”

সাদিবের কথায় আশফাক শিকদারের কণ্ঠে পুনরায় পুনরায় তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেল। ” হাসবেন্ড! হাসবেন্ড হওয়ার কোন দায়িত্বটা পালন করেছ বলতে পারবে? ”

সাদিব চুপসে গেল। বাবার কথার কোনো যোগ্য জবাব যে তার কাছেও নেই। তিনি পুনরায় হতাশ গলায় বললেন, ” বলতে হয় স্বামী হিসেবে একজন ব্যর্থ পুরুষ তুমি সাদিব৷ ভুল করেছিলাম তোমার হাতে মেয়েটাকে তুলে দিয়ে। বুঝতে পারিনি মেয়েটার ভালো করতে গিয়ে এভাবে জীবনটা শেষ করে ফেলব। ”
.

.
আশফাক শিকদারের জরুরি ফোন পেয়ে তালিব আবসার এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। ভাবলেন নিশ্চয়ই মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। নাহলে আশফাক তাকে এভাবে তাড়াহুড়োর বশে দু’টো কথা বলেই ফোন রেখে দিতেন না। অফিস থেকে সরাসরি ছুটি নিয়ে সোজা চলে এসেছেন তাই। সাদিবের তামান্নাকে আটকানোর কোনো চেষ্টাই সফল হতে দিচ্ছেন না আশফাক শিকদার। শান্ত স্বভাবের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রবল কঠোর মনের মানুষ। তামান্নার সাথে বিয়ে হওয়ার সময়ও সাদিব এতো বলেও নিজের বাবাকে দিয়ে বিয়েটা আটকাতে পারেনি, এখনো পারছে না। শুধুমাত্র পায়ে ধরাটা বাকি আছে। প্রয়োজন হলে তাই করবে। তামান্নাকে রুমে পাঠানোর পর সাদিব আশফাক শিকদারের পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল। পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই। পুরুষ মানুষ তখনই কাঁদেন যখন তার জীবন থেকে তার ভালোবাসার মানুষটা হারাতে নেয়। সাদিবের বেলায় এর ব্যতিক্রম হয়নি। না চাইতেও পবিত্র বন্ধের সুতোয় দু’টো বিপরীত প্রান্তের মানুষের মনের মিলন ঘটেছে।

সাদিব আশফাক শিকদারের পা চেপে কাকুতি জানাতে শুরু করে। ” বাবা এমনটা করবেন না প্লিজ। আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না বাবা। আপনি বললে আমি ওকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবো। তবুও ওকে আমার থেকে আলাদা করে দিয়েন না বাবা। ”

একমাত্র ছেলের কাকুতিতে আশফাক শিকদারের মন গলতে চাইলেও তিনি নিজেকে শক্ত করলেন।
” সাদিব আমার পা ছাড়। আমার ভুলটা শোধরানোর সুযোগ দে আমাকে। ”

” না বাবা, আপনি কোনো ভুল করেননি। যা করেছি আমি করেছি। ওকে আমার থেকে দূরে পাঠানো ছাড়া আপনি যা শাস্তি দেবেন, আমি মাথা পেতে নেব। তবুও আপনি ওকে যেতে দিয়েন না। দয়া করুন, আমি থাকতে পারবো না বাবা। ”

” নিজের মায়ের জন্য এতটুকু ত্যাগ করাই যায় সাদিব। সন্তান হিসেবে তুই তোর মাকে খুশি রাখ। তামান্নার জন্য নাহয় ওর সন্তান করবে। ” বলে তিনি পা ছাড়িয়ে চলে গেলেন।

তালিব আবসারকে সবটা খুলে বললেন আশফাক শিকদার। তালিব আবসারের মনে হলো তার পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। মানুষ এতোটা নিচে নামতে পারে তা তার মোটেও জানা ছিল না। তামান্নাকে নিয়ে যাওয়ার আগে সামিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে গেলেন, ” ভাবী কাজটা ঠিক করলেন না। আপনার থেকে আমি এটা মোটেও আশা করি নি। ”

সামিরা ফোড়ন কেটে বললেন, ” আপনি কি আশা করেছিলেন আমার আপাতত জানারও দরকার নেই। আপনি আপনার মেয়েটাকে নিয়ে চলে যান। ”

” চিন্তা করবেন না। চলেই যাচ্ছি। আমার অবস্থা এতোটাও খারাপ হয়নি যে এখানে ফেলে রেখে মেয়েটাকে মেরে ফেলবো। চল মা। ”

তামান্না বাবাকে বলল, ” দাঁড়াও বাবা, এক মিনিট। ” তামান্না এগিয়ে গেল আশফাক শিকদারের দিকে। তিনি ছলছল নয়নে তাকিয়ে ছিলেন তামান্নার চলে যাওয়ার পানে। মায়া জিনিসটা বড্ড অদ্ভুত। ছোট থেকেই মেয়েটা তাকে তার মতোই ভীষণ মায়া করতো। বড় শখ করে তাই ছেলের জন্য নিয়ে এসেছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন নিজের কাছে সারাজীবন সাজিয়ে রাখতে। কিন্তু তার চাওয়াটা পূর্ণ হলো না। সাদিবের মতো তারও মনটা চাইছে না তামান্নাকে যেতে দিতে। কিন্তু এ ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় হাতের কাছে ফেলেন না।

কান্নারত কণ্ঠে তামান্না আশফাক শিকদারকে বলল, ” বাবা আমার কি যাওয়াটা সত্যিই জরুরি? ”

আশফাক শিকদার তামান্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ” হ্যাঁ মা। ওটাই যে তোমার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। ”

” কিন্তু বাবা আমার যে আপনাদের ছাড়া থাকতে ভীষণ কষ্ট হবে? ”

” ক্ষমা করো মা। তোমাকে আমি আমার কাছে এনে নিরাপত্তা দিতে পারিনি। পারিনি তোমাকে তোমার মনের মতো স্বামীর হাতে তুলে দিতে। আমার ছেলেকে আমি মানুষ করতে পারিনি মা। তাই যে হাতে তোমার বাবার কাছ থেকে তোমাকে চেয়ে এনেছিলাম, আজ সে হাতেই তোমার বাবার কাছে তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। পারলে এই হতভাগাটাকে ক্ষমা করে দিও। ” আশফাক শিকদার চোখ মুছলেন। এতোক্ষণ চেয়েও চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলেন না।

তামান্না যাওয়ার আগে শেষবারের মতো সাদিবের দিকে তাকাল। আশা ছিল এই বুঝি সাদিব তাকে শেষবারের মতো আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সাদিব হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারল না…!

চলবে…..

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৫৪)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সময় পেরোয় আপন গতিতে। কোথাও তার থামার অবকাশ নেই, মানুষের মতো কোথাও তার কারোর প্রতি পিছুটান নেই। চলতে থাকে আপন গতিতে। ইশ যদি মানুষের মতো সময়কে অল্প সময়ের জন্য হলেও আটকে রাখা যেত! কতই না ভালো হতো। অতীতের করা যত ভুল আছে পিছনে ফিরে গিয়ে সেসব অনায়াসে শুধরে আসা যেত। আপসোস এসবের কোনো সুযোগ সৃষ্টিকর্তা রাখেননি। তাইতো সৃষ্টির শুরু থেকে সময়ের সাথে মানিয়ে চলতে হয় সবার।

তন্ময় তৈরি হচ্ছিল অফিসে বেরুবার উদ্দেশ্যে। তনিমা কিচেনে যাওয়ার আগে তন্ময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পোষাক আশাক বিছানার এক কোণে রেখে গেছে। সকালের কাজের সূচনা ঘটে তন্ময়ের এরূপ খেয়াল রাখার মাধ্যমেই। সুখী হতে গেলে কোটি টাকার মালিক হতে হয় না, শুধুমাত্র জীবন সঙ্গীনির সামান্য খেয়ালই পারে দাম্পত্য জীবনটাকে সুখ সাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলতে। এজন্যই বোধহয় মধ্যবিত্তের ঘরে সবচেয়ে বেশি সুখী পরিবারের দেখা মেলে। সেরকমই তনিমার এসব খেয়াল তন্ময়কে সারাটাদিন প্রফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। আজও তার ব্যক্তিক্রম ঘটেনি। তৈরি হওয়ার এক ফাঁকে জোর কণ্ঠে তনিমার নাম ধরে ডাকল তন্ময়। দুই তিনেক বার ডাকার পর তনিমা সংসারের পাকাপোক্ত গিন্নিদের মতো আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো।

” বলুন, ডাকছিলেন কেন? ”

” এদিকে তাকাও! ”

তনিমা তন্ময়ের দিকে তাকাতে নজর গেল তন্ময়ের উন্মুক্ত বুকের দিকে। ইশারায় বোঝাল তার শার্টের দুটো বোতাম উধাও। তনিমা কপালে হত চাপড়ানোর ভঙ্গিমা করল। বলল, ” দ্যাত আমি তো খেয়ালই করিনি। আপনি খুলে রাখুন। আমি অন্য আরেকটা এনে দিচ্ছি। ”

তনিমা তাড়াহুড়ো করে আলমারি থেকে শার্ট আনতে গেলে তন্ময় পেছন থেকে তনিমার হাত ধরে তাকে আটকায়। তনিমা থেমে গিয়ে তন্ময়ের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে তন্ময় বলে,
” তোমাকে একবারো বলেছি অন্য আরেকটা লাগবে? ”

তনিমা ভ্রু কুঁচকালো। ” নয়তো কি বোতাম ছাড়া এভাবে যাবেন? ”

” আরে না’রে বাবা! এমন হলে তো নিজেই নিয়ে নিতাম তোমাকে ডাকতাম না। ”

” এখন কি করবেন তবে? ”

তন্ময় আয়নায় চোখ জোড়া নিবদ্ধ করল। চুলে চিরুনি ঠেকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ” আমার গায়ে থাকা অবস্থায়ই সেলাই করে দেবে। ”

” যাহ্। এও হয় নাকি। আপনি খুলে দিন তো। ”

তন্ময় চোখ রাঙাল। ” বেশি কথা বলো না মেয়ে। যা বলছি তাড়াতাড়ি কর, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ” তনিমা বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেল সুই সুতার সন্ধানে। তন্ময়ের কথা মতো কাজে নেমে পড়ল। তন্ময় মনোযোগ সহকারে তনিমার কাজ দেখছিল। তন্ময়ের নিঃস্বাসে তনিমা সেলাইয়ের সময় বেশ ইতস্তত বোধ করল। তনিমার ইতস্তত ভাব বুঝতে পেরে তন্ময় তনিমাকে টুকটাক কথা বলল।

” আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। ” তনিমা বলল।

” হুম বলো শুনছি। ”

তনিমা চোখ তুলে তন্ময়ের দৃষ্টি তার দিকেই লক্ষ্য করল। অতঃপর বলল, ” আমি একটু বাসায় যেতে চাই। ”

” কবে যেতে চাও। ” তন্ময়ের কণ্ঠ শান্ত শোনাল।

” আপনি ফিরে এসে নিয়ে যাবেন? ”

” আচ্ছা, তাই হবে। তুমি তৈরি থেকো, ফিরে এসে নিয়ে যাবো। ” তন্ময় যাওয়ার আগে তনিমার কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিল।
.

.
তামান্নার দিন কাটে চারটে বন্দী দেয়ালের মাঝে। আগে মতো প্রাণোচ্ছল তামান্না এখন আর নেই। আগে সবার সাথে মিশুক মেয়েটা কোনো এক ঝড়ের কবলে পড়ে পুরোদমে নিশ্চুপ স্বভাবের মেয়েতে রূপান্তরিত হয়েছে। আগেকার সময়ে অত্র এলাকা ঘুরে বেড়াতে যেখানে বাবা মা ঘোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল সেখানে সেই মেয়েটাকে এখন শত বলেও চার দেয়ালের বাহিরে বের করা যায় না। নীলিমা প্রতিদিন যায় মেয়ের কাছে। জানতে চায় তার চাওয়া পাওয়া সম্পর্কে। প্রতিদিনই নিশ্চুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে। নিজেকে বড্ড একা লাগে বোধহয় কিনা কে জানে!

তামান্না বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি শুকিয়ে স্পষ্ট ছাপ ফেলে দিয়েছে। নীলিমা বুঝতে পারে আজও সে কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তে দেখে নীলিমা। তারওপর এভাবে অসময়ে ঘুমোতে দেখে নীলিমার চিন্তা হয়। নীলিমা তামান্নার পাশে গিয়ে বসে। মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলোয়। মিহি গলায় ডাকে। ” তামান্না মা আমার, অসময়ে ঘুমচ্ছিস কেন? ”

নীলিমার কণ্ঠে তামান্না চোখ মেলে তাকায়।
” আমার আবার সময় অসময়! ” তামান্নার কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের রেস বুঝতে পারেন নীলিমা। ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জন্মদাত্রী মা নাইবা হলেন, ছোট থেকে লালন পালনের ভার তো তুলে নিয়েছিলেন। তাতেই তার বুকটা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। যদি কখনো তনিমার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে, জানেন না কেমন হবে! আল্লাহ মাফ করুক! এক মেয়ের বেহাল দশা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সেখানে অন্য মেয়েটা ভালো অন্তত ভালো থাকুক। মনে মনে ভাবলেন নীলিমা।

নীলিমা প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন। বললেন, ” তনিমা ফোন দিয়েছিল, বলল ওরা বিকেলে আসবে। ”

তামান্না ছোট বাক্যে জবাব দিল, ” ওহ্! ”
.

.
তালিব আবসার রুমের বাহিরে পায়চারি করছিলেন। নীলিমাকে মলিন মুখে বেরিয়ে আসতে দেখে এগিয়ে গেলেন। বললেন,
” কিছু বুঝলে? ”

নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ” আগের মতোই। কোনো উন্নতি নেই। ”

তালিব আবসার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করলেন। মেয়ে তার চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেটা আর দেখতে পারছেন না। আবার তাকে বিপদের মুখে ফিরিয়ে দেয়াও যে বারণ। গত দুই মাসের মধ্যে একটাবারের জন্যেও তাকে প্রাণ খুলে হাসতে কিংবা কথা বলতে দেখেননি তারা। স্বামী নিশ্চুপ থাকায় নীলিমা বললেন, ” এভাবে আর কতদিন? দিন দিন মেয়েটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারওপর ওর শরীরের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। নাওয়া, খাওয়া, ঘুম সব অনেকটা ত্যাগ করার মতো হচ্ছে। এভাবে চলতে দিলে তার সাথে সাথে বাচ্চাটাকেও তো আমরা বাঁচাতে পারব না। ”

” দেখছি কি করা যায়! ” তালিব আবসার নিজের রুমের দিকে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেলেন। নীলিমা পেছন পেছন গেলে দেখতে পেলেন তালিব আবসার কাউকে ফোন করছেন। অপর পাশের লোকটা রিসিভ করতে তিনি বলে উঠলেন, ” কিছু ভেবেছিস? ”

” তামান্না কেমন আছে এখন? ” আশফাক শিকদার জানতে চাইলেন।

” আগের মতোই। সেজন্যই জানতে চাইছি কি করবি? ”

আশফাক শিকদার গম্ভীর গলায় বললেন,
” সাদিবেরও একই দশা। তাকে আমি এবং ওর মা শেষ কবে দেখেছি মনে করতে পারছি না। ”

সাদিবের ব্যাপারে এহেন মন্তব্য শুনে তালিব আবসার অবাক হলেন। তিনি বুঝতে পারেননি ছেলেমেয়েদের একে অপরকে বোঝাতে গিয়ে তাদের এভাবে কষ্ট দিয়ে ফেলবেন। এখন না পারছেন তাদের আলাদা করে পরিস্থিতি বদলাতে, না পারছেন সম্পর্কটাকে জুড়ে দিতে।

চলবে….