তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৩

0
155

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা

“নির্লজ্জের মতো হাসছেন কেন?” দীপ্তর গা জ্বালানো হাসি থামানোর জন্য কথাটা বলল শ্রেয়সী। ভাগ্যিস সে একে বিয়ে করতে রাজি হয়নি৷ নিজের সিদ্ধান্তের উপরে আরেকবার পূর্ণ আস্থা পোষণ করল সে।

“চোরটা ব্যাগ টান দেবার সময় আপনার রিয়্যাকশনটা ভাবতেই হাসি থামাতে পারছি না।”

“আপনি তখন দেখেছেন? তাহলে মজা না নিয়ে তো হেল্প করতে পারতেন।”

দীপ্ত এবার হাসি থামিয়ে দুই পা এগিয়ে এসে কপাল কুঁচকে বলল, “মানে কী? কীভাবে হেল্প করতাম? এটা কি সিনেমা? নায়কের মতো উসাইন বোল্টের স্পিডে দৌড়ে চোর ধরে ক্যালিয়ে আপনার ব্যাগ উদ্ধার করব? সম্ভব এটা?”

শ্রেয়সী কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো। তবে সে হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। বাঁকা কথা সে হজম করতে শেখেনি।

“আপনার যে সেই যোগ্যতা নেই তা আমি জানি। কিন্তু কারোর বিপদে যে হাসতে হয় না সেই সেন্স আপনার নেই বোধহয়।”

“আমার হাসি পেলে কি কাঁদব নাকি? আমি সমসময় আমার মনের কথা শুনি। এত হাসি আটকে রেখে হার্টকে কষ্ট দেয়া ঠিক হবে বলেন?”

শ্রেয়সী জানে এখন এই ঝামেলাবাজ লোকটার সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই৷ ব্যাগটার জন্য চিন্তা হচ্ছে। ভাগ্যিস সার্টিফিকেট, পরিচয় পত্রসহ সব গুরুত্বপূর্ণ কাগজ লাগেজের মধ্যে তুলেছিল। তবুও ওর মোবাইল ফোন, টাকা এসব তো গেল। এগিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে দীপ্তর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,

“আপনি আমাকে ফলো করছেন না তো?”

দীপ্তর হাসি থেমে গেল, সে এবার একটু চড়া সুরেই বলল, “আপনাকে কেন ফলো করতে যাব? আপনি কি মিস ইউনিভার্স?”

“তাহলে এখানে কী করে এলেন? আবার একই বাসে, ব্যাগ ছিনতাই হতে দেখেছেন, তারমানে আগে থেকেই আমাকে দেখছিলেন। তো এখন এর উত্তর দিন।”

“আমি কাউকে এক্সকিউজ দিই না ম্যাডাম। আরেকটা কথা আমার এত খারাপ দিন আসেনি যে আপনাকে আমার ফলো করতে হবে।”

শ্রেয়সী তাচ্ছিল্য হেনে বলল, “জেনে ভালো লাগল।”

“আমি যা বলি তা কারোর ভালো লাগবে না এটা হতেই পারে না।” আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল দীপ্ত।

ওর বলার ভঙ্গিতে শ্রেয়সীর মনে হলো ছেলেটা কথাগুলো বিশ্বাস করেই বলেছে। এমন হামবড়া লোক সে কখনোই দেখেনি। সে বলল,

“একটা কাজ করুন, পপুলার রেডিও স্টেশনে আরজে হিসেবে জয়েন করুন, বা ক্যানভাসারদের মতো গাড়িতে গাড়িতে গিয়ে আপনার সুমিষ্ট কথাগুলো মানুষদের শুনিয়ে আসুন। কে জানে, তারা হ্যাপি হরমোন পেল আপনার কথা থেকে।”

এবার দীপ্ত হেসে বলল, “বাহ্! আপনি তো অনেক ইনোভেটিভ। আপনার সাথে আমার তিনদিন কথা হয়েছে এরইমধ্যে দু’টো বিজনেস আইডিয়া বেরিয়েছে আপনার মাথা থেকে। আপনিই এমন ক্রিয়েটিভ, নাকি আমার মতো একজন ইনটেলেকচুয়াল মানুষ আশেপাশে থাকলেই কেবল বুদ্ধি খুলে?”

শ্রেয়সী এমন ঝগড়াটে ছেলে কখনো দেখেনি। এর কি খেয়ে দেয়ে কাজ কর্ম নেই নাকি! ভাবল সে।
“নিজেকে নিয়ে এত গর্ব করবেন না দীপ্ত, আপনি একজন বোকার হদ্দ, আপনার মাথায় গোবর ভর্তি।”

আকর্ণবিস্তৃত হেসে দীপ্ত বলল,
“সে কী! আপনার চোখে কি স্ক্যানার বসানো আছে নাকি? খালি চোখে আমার মাথার ভেতরটা দেখে ফেললেন!”

দাঁতে দাঁত চেপে শ্রেয়সী বলল, “ফাজলামো করছেন?”

“ছিঃ ছিঃ। ফাজলামো কেন করব! আমি ভাবছিলাম ল্যুভর কিংবা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সাথে যোগাযোগ করব কিনা। অবশ্য বড় বড় রিসার্চ ইন্সটিটিউটগুলোও আপনাকে লুফে নেবে। এমন হিউম্যানয়েড স্ক্যানার হাতছাড়া করতে চাইবে না।”

শ্রেয়সীর মনে হলো এখন ওর নিজের মাথায় যদি একটা পাতিলে চাল আর পানি দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়, কিছুক্ষণ পরে নিশ্চিত তা ফুটে ভাত হয়ে যাবে।

“আপনি আমার ব্যাগ ছিনতাই হতে দেখে কিছু বলেননি। একটা মেয়ের হ্যান্ডব্যাগে তার কত প্রিয় আর প্রয়োজনীয় জিনিস থাকে আপনার ধারণা আছে? প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলে তার কত মন খারাপ হয় জানেন? আপনার উচিত ছিল অন্তত আমাকে খানিকটা স্পেস দেয়া। তা না করে এতক্ষণ ধরে যা করলেন এটা একটা গর্হিত অন্যায়।” সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল শ্রেয়সী।

ওদিকে দীপ্তর মুখে এখনো ক্যাটকেটে হাসি। সে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,

“তা অন্যায় যখন করেই ফেলেছি, তার তো প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। কী প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার শুলে চড়ানোর শাস্তি মওকুফ করা হবে?”

“আমার কাছে মোবাইল নেই, কোনো টাকাও নেই। বাস থেকে নামার পরে আমার গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত যত খরচ হবে, তা আমাকে ধার হিসেবে দিতে হবে। নেমেই জিডি করতে হবে। সেখানে আমি নিশ্চয়ই একা যাব না৷ কাউকে ডাকতেও পারব না কারণ মোবাইল সাথে নেই। আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে।”

“আপনি সিরিয়াস?”

“অবশ্যই।”

দীপ্তর অভিব্যক্তি বদলে গেল এবার। রেগে গেছে।

“এটা মগের মুল্লুক নাকি? আমি কেন এটা করতে যাব?”

“কারণ আপনি মাত্রই অপরাধ স্বীকার করে প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছেন। তাই।”

“গাধার মতো কথা বলছেন কেন?”

এবার শ্রেয়সী দীপ্তর ভঙ্গি অনুসরণ করে একিই টোনে বলল, “সর্বনাশ! আপনি গাধার কথা শুনে ফেলেছেন নাকি? আমি কখনো শুনিনি গাধা কীভাবে কথা বলে। তাই জানি না কীসের মতো কথা বলছি। তবে শুনেছি..”

গলা খাঁদে নামিয়ে চূড়ান্ত ইতর প্রজাতির ছেলেটার দিকে খানিকটা মাথাটা এগিয়ে নিয়ে ষড়যন্ত্রীর মতো শ্রেয়সী বলল, “সব প্রাণী না-কি স্বজাতির ভাষা বুঝতে পারে। আপনি যেহেতু গাধার ভাষা জানেন…”

এই পর্যন্ত বলে থামল শ্রেয়সী। বাস হর্ন বাজাচ্ছে উঠতে হবে। দীপ্তির দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেছে। এমন ফাজিল মেয়ে সে কখনো দেখেনি। ওর মতো বুদ্ধিমান আর মেধাবী ছেলেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কি-না গাধা বলেছে৷ ওর ফাজলামো করে বলা কথাটার ফায়দা নিচ্ছে! ভালো হয়েছে এই মেয়ের ব্যাগটা ছিনতাই হয়েছে। ওই লোককে পেলে সে বড় ধরনের একটা পুরষ্কার দিত চুরি করার জন্য এক্কেবারে সঠিক মানুষকে বাছাই করার জন্য।

“কী হলো, আসুন! না-কি পালানোর ফন্দি করছেন?”

“দীপ্ত কখনো মাঠ ছেড়ে পালায় না।”

“বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে।” শ্রেয়সী কথাটা বলেই গটগটিয়ে হেঁটে বাসে উঠল৷ এবার শান্তি লাগছে কিছুটা। মোক্ষম জবাব দিয়েছে। আজ এই ছেলেকে সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে তার বুদ্ধি হাঁটুতে।

দীপ্ত নিজের সিটের দিকে যাচ্ছিল, কিন্তু শ্রেয়সী রাজি হলো না। যদি ওকে বিপদে ফেলার জন্য কোনো মতলব করে পালায়? পাশের লোকের সাথে সিট এক্সচেঞ্জ করতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। কেন যে ফাজলামো করতে গেল এই পাগল মেয়ের সাথে! তবে সে-ও দীপ্ত। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদেনী’ কথাটা ওর মাথায় ঘুরছিল। মোক্ষম জবাব সে দেবে।

***
বাস থামার পরে দেখা গেল শ্রেয়সীর কাছে দুইটা বিশাল সাইজের ব্যাগ। একটা ছোট লাগেজ৷ এগুলো ধরে ধরে সিএনজিতে তুলতে সাহায্য করতে হলো দীপ্তকে। এখন যাচ্ছে থানায়। মোবাইলের জন্য জিডি না করলেই নয়৷ সিএনজির ভাড়া দিল তিনশো টাকা।

জিডি করে বাইরে এসে একটা কোল্ড ড্রিংকস কিনে শ্রেয়সীর হাতে দিয়ে দীপ্ত বলল, “এখন পর্যন্ত ছয়শো পঁচিশ টাকা হয়েছে। এখন আর কোথায় যাবেন?”

“বাসায়।”

“আচ্ছা চলুন।”

“আমার বাসা আপনার চিনতে হবে না। আমাকে আর ব্যাগগুলোকে একটা সিএনজিতে তুলে দিন আর তিনশো পঁচাত্তর টাকা দিন। আমি একেবারে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দেব। আপনার নম্বর লিখে দিন।” শ্রেয়সী খেয়াল করেছে বাস থেকে নেমে দীপ্ত কোনো ধানাইপানাই করেনি৷ বরং স্ব প্রনোদিত হয়েই সাহায্য করছিল।

“আপনি যদি এক হাজার টাকা না পাঠান, তাহলে আপনাকে কোথায় পাব? আপনার নম্বর দিন।” নিজের মোবাইল ফোন বের করে বলল দীপ্ত।

“আমার ফোন হারিয়ে গেছে দেখলেন না?”

“নাম্বার তো আর চেঞ্জ করবেন না, তাই না? আমার কষ্টের এক টাকাও আমি ফাও খরচ করি না।”

“আমি ফাও টাকা নিতেও চাই না।”

দীপ্ত নিজের নম্বর একটা কাগজে লিখে দিল, শ্রেয়সীর নম্বর সেভ করে নিল। এরপর খুব সুন্দরভাবে সিএনজিতে তুলে দিল। সিএনজি ছাড়ার আগে মাথা বের করে মিষ্টি হেসে শ্রেয়সী বলল,

“অনেক ধন্যবাদ, দীপ্ত।”

সেই হাসির দিকে তাকিয়ে দীপ্তর মনে হলো মেয়েটা হয়তো আসলেই সুন্দরী। ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটল। শ্রেয়সীর নম্বর আছে ওর কাছে। এটার দরকার ছিল।

দীপ্তকে আজ পর্যন্ত কেউ রিজেক্ট করেনি। শ্রেয়সী সেটা করেছে৷ এরপর শ্রেয়সী নিজে ওকে বিয়ে করতে চাইবে৷ একে রিজেক্ট করতে দীপ্তর কেমন লাগবে? ভাবতেই তো ভালো লাগছে।

ওর চার্মকে কতদিন অগ্রাহ্য করতে পারবে মেয়েটা? খেলায় ইন্টারেস্ট ফিরে এলো দীপ্তর। অবশ্য ওকে একটু বেশি ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে পুতুপুতু করে ইমপ্রেস করতে হবে সেটা এক মস্ত যন্ত্রণা। তা হোক, যে পৈশাচিক আনন্দ হবে ভাবতেই সে এখনই শিহরিত হচ্ছে।
………..
(ক্রমশ)