তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৪

0
135

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৪)
নুসরাত জাহান লিজা

শ্রেয়সী সোমার সাথে সাবলেটে উঠেছে। একজন মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে থাকত, মেয়ের এডমিশন টেস্ট হয়ে গেছে বলে বাসা ছেড়ে দিয়েছে। সোমা একজন পার্টনার খুঁজছিল। শ্রেয়সীরও বেশ সুবিধা হলো তাতে। ওর অফিস থেকে বাসাটা কাছেই। বাসা গোছগাছ করে মোবাইল ফোনের সাথে আরও কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারল। এরপর সে দীপ্তর টাকাটা পাঠিয়ে দিল। সাথে একটা এসএমএস করল,

“আবারও ধন্যবাদ সেদিনের জন্য। —- শ্রেয়সী।”

দীপ্তির নম্বর থেকে কল এলো ঘণ্টা দুইয়েক পরে।

“যাক, মনে করে টাকাটা পাঠিয়েছেন।”

“কেন? ভেবেছিলেন মেরে দেব?”

“হতেও পারত।”

“আপনাকে কেউ বলেছে কোনোদিন যে আপনি একজন অতি উচ্চতর প্রজাতির উইপোকা?”

“সেদিন আপনিই তো বললেন সবাই তার স্ব জাতিকে চিনতে পারে।”

“দীপ্ত, শুনুন, সেদিন আপনি আমার উপকার করেছেন, কৃতজ্ঞতা বশত একটা এসএমএস পাঠিয়েছিলাম৷ যেটা করা আমার উচিত হয়নি। কয়লা ধুইলেও ময়লা পরিষ্কার হয় না।”

ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। এরপর দীপ্ত স্বর পাল্টে হঠাৎ বলল, “আপনি জয়েন করেছেন?”

“হ্যাঁ আজই।”

“কংগ্রাচুলেশনস।”

শ্রেয়সী হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তনে খানিকটা বিস্মিতই হলো। তবুও কারোর অভ্যর্থনার বিপরীতে তো কর্কশ শব্দ প্রয়োগ করা যায় না। তাই সে হেসে বলল,

“থ্যাংক ইউ।”

“ট্রিট দেবেন না? সেদিন আপনার এত উপকার করলাম। অন্তত ব্যাগ টেনে দেবার জন্য হলেও তো একটা ট্রিট পাওনা হতেই পারে।”

এবার শ্রেয়সী ভাবল উত্তরে কী বলবে। প্রচণ্ড নাক উঁচু ছেলে, তবে হার্মফুল নয় বলেই ওর মনে হলো। সেদিন গাইগুই করলেও ভালো খেয়াল রেখেছে ওর। সাত-পাঁচ ভাবছিল তখন দীপ্ত’’র কথা শুনল,

“আপনি তো ভীষণ কিপ্টে মানুষ। থাক লাগবে না।”

শ্রেয়সী হেসে বলল, “মোটেই না। আমি বরং উল্টোই ভাবছিলাম। আপনি আমার কাছে ট্রিট চাইছেন বিষয়টা হজম করতে একটু সময় লাগছিল। আমার আপত্তি নেই, হতেই পারে।”

“নেক্সট ফ্রাইডে ফ্রি আছেন?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আপনার সুবিধামত একটা লোকেশন জানিয়ে দিয়েন। আমি চলে আসব।”

“ঠিক আছে। তবে আসার আগে আপনার ইগোর ড্রামটা প্লিজ বাসায় রেখে আসবেন।”

দীপ্ত রেগে কিছু একটা বলবে এটাই প্রত্যাশা করছিল, কিন্তু সে বলল,
“আপনিও আপনার চটকা রাগের বস্তাটা আপনার বেডরুমে ফেলে আসবেন প্লিজ।”

দু’জনেই হেসে ফেলল এবার৷

বাবা-মা টেনশনে পড়ে গিয়েছিলেন সেদিন। তাদের শান্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল ওকে। নতুন অফিসও খারাপ লাগছে না। দুই দিনেই কিছুটা হলেও মানিয়ে নিয়েছে। সোমার সাথে আগে থেকেই ভালো বোঝাপড়া ছিল। হলে ওরা একই ফ্লোরে থাকত। এখনো চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে, সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে। সামি’রও চাকরি হয়নি। যেকোনো একজনের একটা গতি হলেই বিয়ে সেড়ে ফেলবে।

তবে দীপ্ত হঠাৎ যেচে পড়ে ট্রিট চাইল বিষয়টা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই, দেখা যাবে সেদিন ওকে খাটিয়েছে, তার শোধ তুলতে কিছু একটা ছেলেমানুষি কাজ করে বসল।

***
মোহসীন সাহেব এই সপ্তাহেও আসবেন না। দীপ্তর ভীষণ রাগ হচ্ছে। বাড়িতে ওরা সেভাবে যায় না। ওর মায়ের সাথে ডিভোর্সের পর থেকেই যাওয়া কমে গেছে। তখন সে ছোট ছিল, আশেপাশের লোকজন ওকে জিজ্ঞেস করত, “তোমার মা কোথায়?”

“তোমার বাবার সাথে কি মায়ের খুব ঝগড়া হতো?”

“মোহসীন ভাই কি ভাবিরে মাইর দিত?”

কেউ কেউ আরও একধাপ উপরে গিয়ে চারিত্রিক সনদ বিতরণ করতেও পিছপা হতো না। ওর ভীষণ কান্না পেত তখন। বাসায় ফিরে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। মোহসীন সাহেব এসব পর্যবেক্ষণ করে নিজেই যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিলেন৷ ছেলের জন্য একটা সুস্থ সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করাই তার উদ্দেশ্য ছিল।

তিনি সেই যে গেলেন, তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, তিনি ফিরছেন না। জমিজমা সংক্রান্ত কীসের ঝামেলা, এসব দীপ্তর ভালো লাগে না। তাই চলে এসেছে। এই সাপ্তাহিক ছুটিতে সে দেখা করতে গিয়েছিল তখন বাবা বললেন,

“ওই ভূতের বাড়িতে যাওয়ার এত তাড়া নাই। তুই থাকগা।”

“ভূতের বাড়ি মানে?”

“ভূতের বাড়ি মানে জানিস না? যেই বাড়িতে ভূত থাকে। হন্টেড হাউজ।”

“ভূতের বাড়ির মানে আমি জানি বাবা। এখানে ভূত কই সেটা জানি না।”

“কেন, তুই আর আমি ছাড়া ওই বাড়িতে আর কে আছে? ভূতের আরামে রাজত্ব চালাচ্ছে। বাড়িতে মানুষ নিয়ে আয়, ভূত পালাক।”

“বাবা, তুমি ঘুরেফিরে এই এক টপিকে কথা টেনে এনে ক্লান্ত হও না?”

“তুই এসব শুনে বিরক্ত হয়েও তো একটা বিয়ে করে ফেলতে পারিস। দামড়া ছেলে বিয়ে করেনি, বিষয়টা কেমন জানিস?

মাথা দু’দিকে নেড়ে দীপ্ত বলল, “কেমন?”

“আমি এখন সমাজের চোখে একজন পুত্রদায়গ্রস্ত পিতা। যার বিবাহ উপযুক্ত ছেলে আছে, কিন্তু তার বিয়ে হচ্ছে না।”

“বিয়ে হচ্ছে না মানে কী? আমি চাইলেই হবে।”

“তাহলে চাইছিস না কেন? ওসব তোর ভড়ংয়ের কথা আমাকে বলিস না।”

দীপ্ত হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। বাবার মতো ড্রামাবাজ লোক সে আর একটা দেখেনি।

এর পরেরদিন সে ঢাকায় ফিরল। তখন শ্রেয়সীর সাথে রাস্তায় দেখা হলো অপ্রত্যাশিতভাবে। ঘটনাবহুল একটা জার্নি শেষে সে বাসায় ফিরে এসেছে।

এই সপ্তাহেও বাবা ফিরবেন না। তিনি জানিয়েছেন, একেবারে তার পরের সপ্তাহে ফিরে আসবেন।

দীপ্ত অপেক্ষায় ছিল শ্রেয়সীর সাথে কথা বলার জন্য। এই মেয়েটা ওকে বারবার পাশার দানে হারিয়ে দিচ্ছে, এটা ওর সহ্য সীমার বাইরে। সেদিন বাসে এই পাজি মেয়ের কাছে নাজেহাল হতে হয়েছে। একটা ভালো খবর, সুযোগ বুঝে ট্রিট দিতে রাজি করানো গেল। এবার একটু কিছু জিনিস নিয়ে স্টাডি করা জরুরি।

সে গুগলে সার্চ করল, “মেয়েদের সহজে ইমপ্রেস করার উপায়..”

খানিকক্ষণ ঘাটাঘাটি করে মনে হলো, নাহ্! লাভ হলো না। সে এবার ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু শিমুলকে কল দিল। যার প্রেমের বিয়ে ছিল। প্রেমের ক্ষেত্রে এই ছেলে একেবারে কিংবদন্তীতুল্য।

“কী ব্যাপার, তোর কোনো খোঁজখবর নাই! অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছিস একেবারে।”

“তুইই তো ব্যস্ত থাকিস। বই নিয়ে আর বউ নিয়ে।”

“হ, তা আছি। বই পড়তে ভালো লাগে আর বউরে ভালোবাসে বিয়ে করলাম৷ সময় না দিলে উপায় আছে!”

“কেন? ভয় পাস না-কি?”

“বিয়ে করিস নাই তাই জানিস না। একটা ওপেন সিক্রেট কথা আছে না! পৃথিবীর সব পুরুষই তার বউকে একটু হইলেও ভয় পায়।”

মনে মনে দীপ্ত বলল, “খায়ে দায়ে মানুষের কোনো কাজকর্ম নাই, বউরে প্যাম্পার করা লাগবে! আজাইরা৷ এইজন্যই বিয়ে করার ইচ্ছা নাই৷ বাবা যে কেন বোঝে না!”

“শোন না দোস্ত, তোরে যে জন্য কল দিলাম, আচ্ছা, তুই তো প্রচুর বই পড়িস। ওই অমুকের একশো এক উপায়’ এরকম নামের তো প্রচুর বই আছে, ‘মেয়েদের মন জয় করার একশো এক উপায়’ এমন নামের কোনো বই আছে?”

প্রতিক্রিয়া হলো মারাত্মক, “তুই প্রেমে পড়েছিস? দোস্ত, মাইন্ড খাইলাম, এই সুখবর তুই এতক্ষণে দিলি মামা!”

“আরে ধূর তেমন কিছু না, জাস্ট আউট অফ কিউরিওসিটি।”

“আমি কালকেই তোর বাসায় আসতেছি। তোর হাতের স্পেশাল খিচুড়ি খাওয়াবি, আমি নিজে তোরে এক হাজার একটা উপায় বলব। বিফলে মূল্য ফেরত।”

শিমুক কোনোভাবেই দীপ্তর কথা শুনল না, নিজের মতো এটা-সেটা বলে কল কেটে দিল।

দীপ্ত মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকল, কেন যে বলতে গেল! কোনো মানে হয়। ওর নিজের কাজের জন্য রাগটা গিয়ে পড়ল সে-ই শ্রেয়সীর উপরেই। সে অপেক্ষা করতে লাগল শুক্রবারের, এরমধ্যে প্রস্তুতি নিতে হবে।
……..
ক্রমশ