#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ১৩)
নুসরাত জাহান লিজা
জামাই আদরের নামে খাবারের অত্যাচার নিয়ে যে আতঙ্ক ছিল দীপ্তর মনে, তা কেটে গেল। আয়েশা ওকে জিজ্ঞেস করলেন,
“খাবার কেমন হয়েছে বাবা? খেতে পারছ?”
“ভীষণ মজা হয়েছে আন্টি।” আরও কিছু মুখে এসেছিল, কিন্তু বলল না দীপ্ত। সবসময় বাবা আর নিজের রান্না খেয়েই সে অভ্যস্ত। বাবার রান্না ভীষণ ভালোও হয়। আজকের রান্নায় কেমন অন্যরকম এক আন্তরিকতা মেশানো আছে, ওর সব বন্ধুরা তাদের মায়ের রান্নার ভীষণ প্রশংসা করত। ও বলত,
“আমার বাবার রান্না আমার সবচাইতে প্রিয়।”
তবুও অবচেতনে মায়ের রান্না কেমন হয়, তা জানার একটা লোভ ছিল দীপ্তর মনে। নিজের মায়ের রান্নার স্বাদ ওর মনেই নেই। আজ অবচেতনেই যেন সেই তৃষ্ণায় প্রলেপ লাগল খানিকটা হলেও।
“কী খেতে পছন্দ করো বাবা?”
আয়েশার ইচ্ছে দীপ্তকে ওর পছন্দের খাবার খাওয়ানো। কী ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে ছেলেটা৷ শ্রেয়সী খাওয়া নিয়ে ভীষণ হাঙ্গামা করত আগে। এটা খাব না, সেটা খাব না করে জ্বালাতন করত। মাছ খাওয়াতে তার জান বেরিয়ে যেত। সবজি মুখেই তুলতে চাইত না। বকাবকি করে খাওয়াতে হতো। এখন তবুও অনেকটা উতরে গেছে।
“আমার তেমন বাছবিচার নেই। সবই খাই, তবে ঘন দুধের পায়েশ আর গরুর মাংস ভুনা আর আচার দিয়ে খিচুড়ি আমার সবচাইতে প্রিয়।”
এমন অকপট স্বীকারোক্তি ভীষণ ভালো লাগল আয়েশার। কাউকে জিজ্ঞেস করলে দেখা যায় অনেকে ভদ্রতাবশত বা বিনয় করে বলতে চায় না। দীপ্ত তো বলল, তবে বিনয়ের অভাব সেখানে ছিল না। ভীষণ আপন মনে হলো। তিনি রান্না করে খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসেন।
দীপ্তর প্লেটে দই আর মিষ্টি দিতে দিতে আয়েশা বললেন, “শ্রেয়সী কিন্তু একেবারেই খেতে চায় না। যখন পড়তে বাইরে চলে গেল, শুকিয়ে একেবারে হাড্ডিসার হয়ে এসেছিল। বকে, ধমকে খাওয়ানো লাগে। তুমি কিন্তু একটু খেয়াল রেখো বাবা।”
শ্রেয়সী মায়ের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল, ঘরের শত্রু বিভীষণ বুঝি একেই বলে। দীপ্ত ওকে দেখে হেসে বলল, “চিন্তা করবেন না আন্টি। আমিও ওকে বকে-ধমকে খাওয়া শেখাব।”
দীপ্ত, শ্রেয়সীর পাশেই বসেছিল, ওর মেজাজের পারদ চড়ে গেছে। কী পাজি ছেলে, সে বাম পায়ে দীপ্তর পায়ে খোঁচা দিল। সে ভড়কে গিয়ে ওর দিকে তাকাতেই ফিসফিসিয়ে বলল,
“ঢং করবে না, আমাকে বকলে, তার দ্বিগুণ উশুল করা হবে।”
দীপ্ত আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল, “অবশ্য আপনি যদি অভয় দেন আন্টি। আপনার মেয়ে ভীষণ ডেঞ্জারাস। আমার মাথার সাধের চুলগুলো হারাতে চাই না।”
শ্রেয়সী বিরক্তি নিয়ে বলল, “ধূর, আর খাবই না।”
আয়েশা হেসে বললেন, “তোর তো খাওয়া শেষই, এখন রাগ দেখিয়ে লাভ কী।”
শ্রেয়সী উঠে চলে গেল, দীপ্ত আর আয়েশা হেসে ফেললেন। শাফকাত সাহেব বললেন, “দিলে তো রাগিয়ে। রাগ তো আমারই ভাঙাতে হবে।”
আয়েশা বললেন, “আহ্লাদ দিয়ে দিয়েই এই অবস্থা করেছ, আমাকে দোষ দেবে না, খবরদার।”
স্ত্রীকে সামলানোর জন্য বললেন, “আজকের রান্না কিন্তু খুব ভালো হয়েছে, আমাকে গরুর মাংসটা আরেকটু দাও তো?”
আয়েশা রেগে বললেন, “ভুলেও না। নিজের স্বাস্থ্যের খেয়াল আছে? আজ এমনিতেই অনেক তৈলাক্ত খাবার খেয়েছ, আর একটুও না।”
দীপ্ত দেখল এখানেও দু’জন ঝগড়া করছে, কিন্তু তাতেও ভালোবাসা, বোঝাপড়া মিশে আছে। কী মিষ্টি খুঁনসুটিময় সম্পর্ক দু’জনের। অথচ ওর বাবা-মা…
কেমন একটা বুকচেরা কষ্ট বুকে জমাট বাঁধল ওর।
***
আজ ফুপুর বাড়িতে দীপ্ত আর শ্রেয়সীর দাওয়াত। তিনি অসুস্থতার জন্য বিয়েতে যেতে পারেননি। আজ ভাইঝিকে ফোন করে রীতিমতো হুমকি দিয়ে আসতে বলেছেন।
শ্রেয়সী লাল রঙের একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে। এই গরমে এটাই আরামদায়ক। দীপ্ত একটা শার্ট বের করেছিল, শ্রেয়সী ওর হাতে একটা লাল সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা পরো।”
দীপ্তর একবার মনে হলো বলে, এখন নিজের মতো পোশাক পরার স্বাধীনতাও নেই নাকি! এটাও বিয়ে করতে না চাইবার আরেকটা কারণ। তবে শ্রেয়সীর উৎসাহ ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু বলল না। ওটাই পরল।
“আজ একটু তাড়াতাড়ি রেডি হবে। ঠিক আছে?”
“আমার বাথরুমে কতক্ষণ থাকা উচিত সেটারও একটা টাইম সেট করে দিও।”
শ্রেয়সীর হাসি ম্লান হয়ে গেল৷ সে মৃয়মান গলায় বলল, “আমি বাইরে বসছি। তোমার যতক্ষণ সময় লাগে নাও। আমি বিরক্ত করব না।”
দীপ্ত বুঝল এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু এসবে সে অভ্যস্ত নয়। ওর চলাফেরা নিয়ে বাবা ছাড়া অন্য কারোর মতামত সে কখনো শুনেনি। তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
দীপ্ত পেছন থেকে ডাকল, “শ্রেয়সী…”
সে পিছু ফিরল না, বেরিয়ে গেল। দীপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। চেষ্টা করল যথাসম্ভব দ্রুত তৈরি হবার। তবুও আধাঘণ্টা পার হয়ে গেল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিল। শ্রেয়সী কোনো কথা বলছে না। বসেছেও খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে। দীপ্ত বলল,
“স্যরি, তখন ওভাবে বলাটা ঠিক হয়নি।”
শ্রেয়সী ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যাস হুট করে পরিবর্তন করা যায় না। আমিও নিজের মতামত তোমার উপরে চাপিয়ে দিয়েছি। সেজন্য স্যরি।”
দীপ্ত বুঝল শ্রেয়সী এখন রেগে নেই, কিন্তু খানিকটা আশাহত হয়েছে। সে হাত বাড়িয়ে শ্রেয়সীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আলতো করে ধরল। মুখে কিছু বলল না। বাতাস গায়ে লাগছে। শ্রেয়সীর খোলা চুল উড়ছে। দীপ্তর মুখে এসে লাগছে, কিন্তু ওর বিরক্ত লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। সূর্য তার উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। দীপ্ত খেয়াল করল মেয়েটা ঘামছে, চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে রোদের জন্য। দীপ্ত রিকশার হুড তুলে দিল।
শ্রেয়সী ওর দিকে তাকাতে বলল, “রোদটা চড়া। সেজন্য…”
দীপ্ত জিজ্ঞেস করল, “তোমার ব্যাগে টিস্যু আছে?”
শ্রেয়সী ঘাড় নাড়ল, এই ব্যাগে আসার আগে কেবল টাকা, মোবাইল, বডি স্প্রে, ফেসপাউডার আর লিপস্টিক ছাড়া আর কিছু তোলা হয়নি।
দীপ্ত পকেট থেকে ওর রুমাল বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা রাখো, তোমার দরকার হবে।”
শ্রেয়সীর মন সহসা ভালো হয়ে গেল। এই ছোট্ট ছোট্ট কেয়ার যে ওর বড্ড আরাধ্য। সে নিজের অন্য হাতটা দিয়ে দীপ্তর ওর হাত ধরে রাখা হাতের উপরে রাখল, মুখে হাসি। মুহূর্তটা একরাশ ভালো লাগায় ভরে উঠল।
***
শোভা মোহসীন সাহেবের সাথে ডিভোর্সের পরে বিয়ে করেছে নাজমুল আলমকে। সেখানে তার আরও দুটো সন্তান আছে। এখানেও যে তিনি খুব সুখী তা-ও না। সন্তানরা তাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বন্ধুবান্ধব, ইন্টারনেট এসবই তাদের প্রায়োরিটি। নাজমুলও ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি বলতে গেলে নিঃসঙ্গ।
হাজার হলেও দীপ্ত তার প্রথম সন্তান। তাকে দিয়েই তিনি মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন। তার খুব ইচ্ছে করে ওকে সামনা-সামনি দেখতে, কথা বলতে। কিন্তু ছেলে তাকে পছন্দ করে না। সব মোহসীনের কারসাজি, তিনি জানেন। নিশ্চিত তার নামে বিষ ঢেলেছেন ছেলের কানে ছোটবেলা থেকে। সেই ছেলে বিয়ে করল, তাকে জানানো পর্যন্ত হয়নি। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে।
এত বড় একটা সিদ্ধান্তে মা হিসেবে তার তো কিছু মতামত ছিল। তাকে এভাবে হারিয়ে দিয়ে লোকটা নিশ্চয়ই পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। আরেকবার জিতে গেল লোকটা। তাকে না জানিয়ে দীপ্তর বিয়েটা শোভার কাছে হারজিতের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তিনি দীপ্তর সাথে অবশ্যই কথা বলবেন, দরকার হলে ওর অফিসে যাবেন। তার সন্তান তো। তার অধিকার আছে ছেলের উপর, ছেলের স্ত্রীকে দেখার। ওই লোক তাকে আটকাতে পারবে না।
………….
(ক্রমশ)