#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২৬)
নুসরাত জাহান লিজা
আজ অনেকদিন পরে দীপ্ত আবার রাত করে বাসায় ফিরল। তূর্যর সাথে কথা হবার পর থেকেই মনটা কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।
“আজ এত দেরি হলো, ফোনটাও ধরছিলে না…”
শ্রেয়সীর হাসিমুখের দিকে তাকিয়েও দীপ্তর মন কেন্দ্রীভূত হলো না।
“ইচ্ছে হলো তাই।” নির্লিপ্ত গলায় কথাটা বলেই ঘরে চলে যাচ্ছিল দীপ্ত।
মোহসীন সাহেব বললেন, “দেরি হবে সেটা কল করে জানিয়ে দিলেই তো হতো। বাড়িতে আমরা ভাবি তোকে নিয়ে…”
“আমাকে নিয়ে ভাবার কী আছে বাবা? আমি তো ছোট বাচ্চা না।”
কথাটা বলেই ভেতরে চলে গেল। শ্রেয়সী মোহসীন সাহেবের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু কেমন নির্জীব বলে মনে হলো।
“হয়তো অফিসের কোনো ঝামেলা নিয়ে আপসেট। তুমি শুয়ে পড়ো বাবা। আমি দেখছি।”
মোহসীন সাহেব নিজের ঘরে এলেন বটে, তবে শ্রেয়সীর কথা তাকে আশ্বস্ত করতে পারল না। দীপ্তর নাড়িনক্ষত্র পর্যন্ত তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন। ছেলের এমন নির্লিপ্ত আচরণ তার অস্বস্তি বাড়াল। সন্তান বড় হয়েছে, তার নিজস্ব স্পেস তাকে দেয়া উচিত, তবুও মনে হলো দীপ্তর সাথে তার সরাসরি কথা বলা দরকার। আবার ভাবলেন শ্রেয়সী আজ কথা বলুক, তিনি নাহয় পরে দেখবেন।
শ্রেয়সী ধীর পায়ে ভেতরে এলো মিনিট পনেরো পরে।
“খাবার দিয়েছি। খাবে এসো।”
দীপ্ত বিছানায় বসে মাথা মুছতে মুছতে বলল, “ইচ্ছে করছে না। তোমরা খেয়ে নাও।”
“বাবার টাইমলি ওষুধ খেতে হয় বলে জোর করে খাইয়ে দিয়েছি। তুমি খাবে না কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
দীপ্ত মুখে আসা কথাটা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করে বলল, “হ্যাঁ। এসিডিটি বোধহ..”
“তাহলে অল্প করে কিছু খাও। ওষুধ খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”
“তুমি খেয়ে না-ও প্লিজ। আমার এই মুহূর্তে ঘুম দরকার।”
শ্রেয়সী এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। দীপ্ত কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। এরপর বলল, “তুমি না খেয়ে শুয়ে পড়লে কেন?”
“আমারও ইচ্ছে করছে না।”
“এসো। খেতে চলো, আমিও খাব।”
শ্রেয়সী উঠে বসে দীপ্তর হাত ধরে বলল, “তোমার কী হয়েছে দীপ্ত?”
“কিছু না। চলো। ক্ষুধা পেয়েছে।”
শ্রেয়সী নড়ল না জায়গা ছেড়ে, “দীপ্ত, তুমি যাকে সব খুলে বলা যায় আমাকে তেমন বন্ধু ভাবো বলেছ। আমি তোমার একেবারে ব্যক্তিগত বিষয় যদি না বলতে চাও, শুনতে চাইব না। কিন্তু তোমার কথায় বাবা কতটা কষ্ট পেয়েছে তুমি জানো?”
দীপ্তর মনে হলো ওর মনের দোদুল্যমান অবস্থার কথা শ্রেয়সীর সাথে শেয়ার করবে। কিন্তু পারল না। তাহলে সে-ই প্রসঙ্গে চলে যাবে কথা, যা ও একেবারেই চায় না।
“জানি। আমি বাবার সাথেই কথা বলতে যাচ্ছিলাম। তুমি খাবার দাও আমি কথা বলে আসি।”
দীপ্ত মোহসীন সাহেবের ঘরে এসে দেখল আলো নেভানো, কিন্তু তিনি যে জেগে আছেন তা বোঝা যাচ্ছে।
দীপ্ত ধীরে পায়ে মোহসীন সাহেবের মাথার কাছে বসে বলল, “স্যরি বাবা, তখন আমি ওভাবে কথাটা বলতে চাইনি।”
“হুম। যা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়, অনেক রাত হলো।”
“বাবা, তুমি আমাকে চেনো না? আমি মন থেকে কিছু বলিনি।”
“অনেক কিছুই আমরা মন থেকে বলি না দীপ্ত। তবুও এমন কিছু কথা বলে ফেলি যার মাশুল গুণতে অনেক মূল্য দিতে হয়। তোর জীবনের সাথে এখন আরেকটা জীবন জুড়ে গেছে। তুই যথেষ্ট পরিণত। আশা করি কী বলতে চেয়েছি, বুঝেছিস।”
দীপ্ত স্থানুবৎ বসে রইল মুহূর্তকাল। এরপর বলল, “বাবা, তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি? প্লিজ?”
মোহসীন সাহেব উঠে বসলেন সন্তানের ব্যাকুল আবদারে। দীপ্ত ছেলেবেলার মতো বাবার বুকে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিল।
তিনি দীপ্তর মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে আমাকে বলা যায়?”
“তূর্যর ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে বাবা। ওদের ছোট্ট একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। আমি আমার মতো দুর্ভোগ পোহাতে কাউকে দেখার মতো শক্তি ধারণ করতে পারিনি এখনো। ওরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল।”
মোহসীন সাহেব ছেলের অস্থিরতার কারণ অন্তর দিয়ে অনুধাবন করলেন। তার কাছে যদি কোনো রূপকথার জাদু কাঠি থাকত, তবে তিনি তা ছুঁইয়ে দিয়ে ওর ছেলেবেলার দুঃসহ স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতেন। সেই ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দেননি। মানুষ মাঝেমধ্যে বড্ড অসহায় হয়ে যায় তার ভাগ্যের কাছে। তিনিও এক হতভাগ্য পিতা আজ। যে ভীষণ অসহায়।
“বাবা রে, সবকিছু আমাদের হাতে থাকে না। আমি বা তূর্য পারিনি৷ কিন্তু অনেকেই তো আছে যারা সারাজীবন এক ছাদের তলায় কাটিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে। তাদের কথা ভাব। দেখবি জীবনটা কত সুন্দর। আল্লাহ আমাদের অপ্রাপ্তি দিয়েছেন, আবার সে-ই অপ্রাপ্তির মধ্যেও কত যে প্রাপ্তি তিনি আমাদের দেন তারও তো হিসেব রাখা উচিত আমাদের। শুধু অপ্রাপ্তি নিয়ে পড়ে থাকলে কষ্টই বাড়বে। অসুন্দরকে পাশ কাটিয়ে সুন্দরকে মনে ঠাঁই দে। দেখবি সবকিছু সুন্দর হয়ে উঠেছে। তোর পৃথিবীটা আনন্দময় হয়ে উঠেছে।”
খানিকটা থেমে আবারও বললেন, “শ্রেয়সীকে দেখ, মেয়েটা তোকে নিয়ে কতটা ভাবে। আজও ভীষণ চিন্তা করছিল কল রিসিভ করছিস না বলে। বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছিল, হয়তো কল করবি ভেবে। বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছিল, কখন কলিংবেলটা বাজবে। যখন বাজল, ছুটে গেল। এসব অনেক দামী রে। সবাই পায় না, তুই ভাগ্য করে পেয়েছিস। ধরে রাখ বাবা।”
বাবা দীপ্তর জীবনের সঞ্জীবনী, তার সাথে কথা বলে ওর মনের বিক্ষিপ্তভাব কেটে গেল ধীরে ধীরে।
“তুমি ওষুধ খেয়েছ?”
“হ্যাঁ। না খেয়ে উপায় আছে, মেয়ে আছে না এখন? সে একেবারে ঘড়ি ধরে মনে করিয়ে দেয়।”
দীপ্তর মুখে মেঘ সরে গিয়ে রোদ্দুর দেখা দিল। সে মৃদু হেসে বলল, “ঘুমিয়ে পড়ো বাবা। আমিও খাই, ও অপেক্ষা করছে।”
মোহসীন সাহেব হাসলেন, দীপ্ত উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়ে বলল, “বাবা…”
“বল!”
“শুভরাত্রি।”
তিনি বুঝলেন ছেলের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, তার জন্য। একটু আগে যে গুমোট হাওয়া মনে দানা বেঁধেছিল, তা সরে গেল সহসা। এবার তার ঘুম হবে।
***
শ্রেয়সী অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নামার সময় দীপ্তকে বলল, “টিফিন বক্সের খাবার যেন আজ বাসায় ফিরে না আসে।”
দীপ্ত হেসে বলল, “ইদানিং তুমি আমাকে শাসন করার চেষ্টা করছ বাবার মতো।”
“বাচ্চাদের মতো খাবারে অরুচি কেন তোমার? আগে তো দেখিনি?”
“হয়েছে তো। খাব আমি। তোমার বক্সের খাবার শেষ হবে চিন্তা করো না।”
“কল করলে রিসিভ করবে। দেরি হলে জানিয়ে দেবে। আমার টেনশন হয় তুমি বোঝো না?”
“আর কী কী উপদেশ আছে একটা লিস্ট করে দাও, আমি সেই লিস্ট আমার ডেস্কে ঝুলিয়ে রাখব।”
“ফাজলামো একদম নয়। যাও তো।”
দীপ্ত হাসল, তার এই শাসন ভালো লাগছে।
অফিসে বসে কাজ করার ফাঁকে শ্রেয়সী আর বাবার সাথে মাঝেমধ্যে কথাও বলল কয়েকবার ফোনে। লাঞ্চ আওয়ারে টিফিন বক্স খুলেছে সবে তখনই শ্রেয়সীর টেক্সট পেল, “খেয়েছ?”
“ঘ্রাণ নিচ্ছি, শুরু করব। তুমি খেয়েছ?”
“আমিও খাব এখন।”
দীপ্ত খাওয়া শুরু করেছিল, মাঝপথে বাঁধা পেল।
“স্যার, একজন ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করতে আসছে।”
“ভদ্রমহিলা? কে?”
“বলল খুব আর্জেন্ট।”
দীপ্ত ভাবতে ভাবতে বলল, “ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও এখানে।”
সে হাত ধুয়ে গুছিয়ে বসতে না বসতেই যে এই কক্ষে প্রবেশ করল, তাকে দেখে বলা বাহুল্য সে মোটেও খুশি হয়নি। মধ্যাহ্ন বেলার এই অপ্রত্যাশিত অতিথির জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। বিরক্তিতে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
শোভা সদর্পে ভেতরে ঢুকে ওর ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারে বসল।
“কেমন আছিস খোকা?”
………
(ক্রমশ)
#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২৭)
নুসরাত জাহান লিজা
শোভা দীপ্তর উত্তরের অপেক্ষায় চাতকের মতো নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ছেলের মুখের দিকে। বিনিময়ে মিলছে তিক্ত উপেক্ষা।
“কথা বলবি না আমার সাথে?”
দীপ্ত মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “কেন এসেছেন এখানে? এটা আমার কাজের জায়গা।”
“তাহলে বাসায় যাব?”
“ভুলেও না।” ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল দীপ্ত।
“আমি তোর মা খোকা।”
“আমার মা নেই। যখন সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেদিন থেকেই সে আমার কাছে মৃত।”
“এভাবে বলিস না প্লিজ। আমি তো তোকে সাথে নিতে চেয়েছিলাম, তুই..”
“কেন নিতে চেয়েছিলেন? আমি তখন বাচ্চা ছিলাম, কিছুই বুঝতাম না, এখন বোকা নই। আপনি আমাকে কেন সাথে নিতে চেয়েছিলেন সেটাও জানি।”
“তুই একজন মায়ের সন্তানকে কাছে রাখতে চাওয়ার মধ্যে স্বার্থ খুঁজছিস!” বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করেন শোভা।
“স্বার্থই তো। আপনার হাজব্যান্ডের সাথে ওটা আপনার হারজিতের লড়াই ছিল তো। জিততে হতো। তাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিতে চেয়েছিলেন। দিয়েও ছিলেন, শুধু আমার জন্য পুরোপুরি তা সম্ভব হয়নি।”
“দীপ্ত, তুই কী বলছিস তুই জানিস? তুই আমার মাতৃত্বের উপরে প্রশ্ন তুলছিস। ওটা আমার আত্মসম্মানের লড়াই ছিল। আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিলাম।”
“সেই জন্য ওই মধ্যবিত্ত স্ট্রাগলের জীবন আপনার সহ্য হয়নি। তাকে প্রতিনিয়ত অপমান করতে আপনার বাঁধেনি।”
“দীপ্ত, তুই আমার জীবনে বাঁচিসনি। তাই আমাকে উপলব্ধিও করিসনি। আমি ওকে ভালোবেসে সব জেনেশুনে ওর হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলাম। তার কী মূল্য সে দিয়েছিল? ওর ফার্স্ট প্রায়োরিটি আমি ছিলাম না। ওর ওই সারাদিন অফিস, কাজ এসবই ইম্পর্ট্যান্ট ছিল।”
“কেন তাকে ওতটা ছুটতে হতো? আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে তাকে তাল মেলাতে হতো৷ নইলে টাকা আসবে কোত্থেকে!”
“টাকা আমার কাছে কোনোদিন প্রায়োরিটি ছিল না। আমার বাবার সেটা যথেষ্ট ছিল। তুই ভুল বুঝছিস। আমি একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ওর হাত ধরেছিলাম। ভালোবাসা পাবার জন্য। আমি কোনোদিন রান্না করিনি। তখন আমাকে রান্না, কাপড় কাচা থেকে শুরু করে একটা সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। সেখানে আমি ওকে পাইনি। আমি যে ওকে বিয়ে করেছি একটা আবেগের মোহে, সেটা আমি উপলব্ধি করতে শুরু করলাম। এরমধ্যে তোর জন্ম হলো। আমি নিজে চাকরি করতে চাইলাম। এটা ওর পছন্দ হলো না। তোর নাকি অযত্ন হবে। ও বাবা, ওর দায়িত্ব ছিল না তোর উপরে? আমি চাকরি করলে সে আমাকে ঘরের চার দেয়ালে ধরে রাখতে পারত না। এতে ওর ইগো হার্ট হতো। আসলে ও আমাকে ডিজার্ভ করত না। আমার মতো একজনকে কোনো সাধনা ছাড়াই পেয়ে গিয়েছিল তো, তাই মূল্য বুঝতে পারেনি। হাজব্যান্ডের চাইতে ওয়াইফ সবদিকে যোগ্য হলে তো তার প্রতি ঈর্ষা থাকবেই। ওর মেল ইগো স্যাটিসফাই করতে হবে তো। তাই দাবিয়ে রাখতে চাইত৷ ওর চাওয়া আমি কেন মেনে নেব? তাই ওকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, যে সন্তানের অযত্ন করতে চাইলে সেটা চার দেয়ালেও করা যায়৷ ওর প্রতি এত বিতৃষ্ণা জমেছিল যে ওর সব কথাই আমার অসহ্য লাগত। ও যেটা বলত তার বিপরীত কাজ করে ওকে ওর প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতাম৷ তার জন্য তুই আমাকে ভুল বুঝেছিস নাকি ওই লোকটা এসবের বীজ ঢুকিয়েছে বল তো?”
দীপ্তর ক্রোধ উত্তরোত্তর বাড়ছিল।
“সন্তান শুধু উনার ছিল না৷ আপনারও। তাকে কীসের শাস্তি দিয়েছেন আপনি? তার কী দোষ ছিল?”
“তোর সাথে যে অন্যায় হয়েছে এটা আমি বুঝি। তাই তোর সাথে এমন উতলা হয়ে দেখা করতে আসি। তুই আমাকে প্রথম মা ডেকেছিস। আমার বুকটা খাঁ খাঁ করে। একবার তোকে জড়িয়ে ধরতে দিবি?”
“আপনি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান প্লিজ।”
“দীপ্ত, এভাবে বলিস না বাবা।”
“আপনি মাতৃত্বের কথা বলছিলেন না? মা মানেই জানেন না আপনি। আপনি ভালোবাসতেই জানেন না।”
‘’ভালোবাসা বলে আসলেই কিছু আছে? ওসব বলতে বা সিনেমা উপন্যাসে দেখতেই ভালো শোনা যায়। ফ্যান্টাসাইজ করতে ভালো লাগে৷ কিন্তু বাস্তবতার মাটিতে ধাক্কা লাগলে ওসব বুকিশ ইমোশন কোথায় হারিয়ে যায়। সব বোকা বোকা টার্ম। আমি নিজে বোকা ছিলাম, সেসবে বিশ্বাস করেছিলাম।”
দীপ্তর মাথায় শেষের কথাগুলো আলোড়ন তুলল। শোভা ততক্ষণে দীপ্তর কাছে চলে এসেছেন।
ওর হাত ধরে বললেন, “একবার মা বলে ডাক, আমি চলে যাব।”
দীপ্ত কয়েক কদম পিছিয়ে গেল, “আমি আপনাকে যতটা ঘৃণা করি, পৃথিবীর আর কোনোকিছুকে তার কোটি ভাগের এক ভাগও করি না। আশা করি উত্তর পেয়েছেন। আপনার জীবনের প্রায়োরিটি লিস্টে আমি কোনোদিনও ছিলাম না। এখন এতটা উতলা কেন হয়েছেন? আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না। যান প্লিজ আমি সহ্য করতে পারছি না।”
শোভা কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল, ওর চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, চোখ টলমল, যেন বহু কষ্টে আটকে রেখেছে। শোভার সামনে সেটা ঝরুক তা চাইছে না। ওর শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে এসেছে প্রবল রাগে।
শোভা দীপ্তর টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি চলে যাচ্ছি খোকা। তুই শান্ত হ। পানিটা খা প্লিজ।”
দীপ্ত গ্লাসটা নিয়ে একবার তাকিয়ে দেখল, এর ছুঁড়ে ফেলে দিল। ঝনঝন শব্দ হলো টুকরো টুকরো হয়ে যাবার। দীপ্তর ভেতরেও কিছু একটা ওরকম করেই যেন চুরেভেঙে যাচ্ছিল।
শোভা ধীর পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে তাকালেন। ছেলেকে আরেকবার দেখে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। তিনি কাঁদছেন, আজ তার কান্নায় সত্যিকার একজন মায়ের কষ্ট ঝরে পড়ছে।
দীপ্ত নিজেকে ধাতস্থ করার সময় পেল না, কয়েকজন ওর কেবিনে ঢুকল। দীপ্ত ওদের আশ্বস্ত করে বলল, “হাত থেকে পড়ে গেছে৷ স্যরি, আমি জায়গাটা পরিষ্কার করছি।”
মঈন এসে বলল, “দীপ্ত সাহেব, আপনি বরং আজ বাসায় চলে যান। শরীর খারাপ মনে হচ্ছে।”
“ঠিক আছে। ধন্যবাদ।”
কোনোমতে বলে সবার কাছ থেকে যেন প্রাণপণে লুকাতে চাইল দীপ্ত। এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো খোলা আকাশের নিচে। আকাশে তখন মেঘের গর্জন, পুরো আকাশ তখন গ্রাস করে নিয়েছে কালো মেঘ। দীপ্তর ভেতরকার মতো। পুরনো ক্ষত জেগে উঠেছে নতুন করে, সাথে নতুন গড়ে উঠা বিশ্বাসের ভীতও কেমন নড়বড়ে হয়ে যেতে চাচ্ছে।
ওর মাথার মধ্যে প্রবল যন্ত্রণা হচ্ছে। সে গাড়িও নিল না। ফুটপাতে হেঁটে হেঁটে পার্কে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসে মাথা এলিয়ে দিল।
***
শ্রেয়সী অফিস শেষে অপেক্ষা করছিল দীপ্তর জন্য। ওরা একসাথে ফেরে৷ কয়েকবার কল করল, কিন্তু বন্ধ। প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে বেরিয়ে এলো।
বাসায় ফিরল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। মোহসীন সাহেব বললেন, “ভিজে গেছিস তো। যা ফ্রেস হয়ে নে। দীপ্ত কখন আসবে?”
শ্রেয়সী বলল, “আমি তো কল দিলাম৷ তোমার ছেলের ফোন বন্ধ। হয়তো আড্ডা দিয়ে ফিরবে।”
“এই ঝড় বৃষ্টির দিনে তো ওর তোকে আনতে যাওয়া উচিত ছিল। তোর আবার জ্বর আসবে। যা, তুই ভেজা জামা কাপড় পাল্টে ফেল মা।”
রাত দশটার দিকে শ্রেয়সীর চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হলো। শিমুলকে কল দিল, সে কিছু জানে না। আজ নাকি কথা হয়নি।
মোহসীন সাহেব অফিসের রিসিপশনে কল করে শুনলেন, দীপ্ত নাকি লাঞ্চ আওয়ারের পরে পরেই বেরিয়ে গেছে।
“ছেলেটা কোথায় গেল?”
প্রশ্নটা শ্রেয়সীর মাথায়ও ঘুরপাক খাচ্ছে।
………
(ক্রমশ)