তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-৪০

0
94

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৪০)
নুসরাত জাহান লিজা

গত তিন মাস ধরে দীপ্তর কাউন্সেলিং চলছিল। আজ শেষ সেশন হবে। শ্রেয়সী ওকে প্রেসক্রাইবড প্ল্যান ধরে ধরে ওষুধ দিয়েছে, এক্সারসাইজ করিয়েছে, ম্যাডিটেশন করিয়েছে। রাতে যেন পর্যাপ্ত ঘুম হয় সেজন্য সাজেশন অনুযায়ী সমস্ত প্রক্রিয়ায় সবসময় সতর্ক নজর রেখেছে।

দীপ্তরও ইচ্ছাশক্তি ছিল প্রবল। ধীরে ধীরে নিজের উপরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে। ভেতরের ভয় একেবারে না কাটলেও এই ভয়ের সাথে মুখোমুখি মোকাবেলা করার মতো দৃঢ়তা তৈরি হয়েছে।

রুটিন ধরে চলতে গিয়ে দীপ্ত যখন হাঁপিয়ে উঠত তখন শ্রেয়সী আর মোহসীন সাহেব তা কাটিয়ে দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। বিনা নোটিশে উৎসবমুখর হয়ে উঠত বাড়িটা। শ্রেয়সীর বাবা-মাও কখনো কখনো আমন্ত্রিত হতেন।

শ্রেয়সী আর দীপ্তর মাঝে যে দূরত্ব এসেছিল তা কেটে গিয়ে দুজন আরও অনেক কাছাকাছি এসেছে। এবার সম্পর্কে দায়িত্বের পাশাপাশি নির্ভরতা এসেছে, বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে, ভালোবাসা হু হু করে বেড়েছে আর সম্পর্কের ভিত মজবুত হয়েছে। শেকড় গেঁড়ে বসেছে ওরা একে অন্যের হৃদয়ে। শেকড়ের ভিত এবার শক্ত মাটিতে।

কখনো দীপ্ত দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে শ্রেয়সী ওকে বেঁধে নিয়েছে মায়াময় আলিঙ্গনে। সেই আলিঙ্গনে মাখা ছিল অতলান্ত ভরসা। দীপ্ত সেই ভরসায় ডুবে এখন বিশ্বাস করে শ্রেয়সী কখনো ওকে ছেড়ে যাবে না। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হবার সুযোগ সে দেবে না।

শিমুলও সাথে ছিল সবসময়ের মতো। আরমান ভাইয়ের স্কুলে যেত ওরা প্রায়ই। এখানে এসে দীপ্ত একদিন দেখল একটা শিশুর মা মারা গেছে কিছুদিন আগে। বাবা আরেকটা বিয়ে করে কোথায় চলে গেছে অনেক আগে। এতটুকু একটা শিশু অথচ একেবারে একা। মাথায় হাত রাখার জন্যও কেউ নেই। স্নেহছায়া নেই। তবুও কীভাবে যেন এই একলা পৃথিবীতে এগারো বছরের শিশুটা কেমন মানিয়ে নিয়েছে৷

দীপ্ত ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। ফেরার সময় গুম হয়ে বসেছিল। শ্রেয়সী দীপ্তর হাত ধরে বলেছে, “দীপ্ত, পৃথিবীটা কারো কারো জন্য ভীষণ নিষ্ঠুর একটা জায়গা হয়। অনেক প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাতে কি জীবন থমকে যায়? যাওয়া উচিত? তারপরও তো মানুষ বেঁচে থাকে। তার আয়ু যতক্ষণ আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছে ততদিন তারা বাঁচে। আয়ু যেহেতু আছে, তার মানে পৃথিবীকেও তাদের কতকিছু দেবার বাকি আছে! এই সুযোগটা কাজে লাগানো উচিত না? প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে বন্ধুর পথকে মসৃণ করে অভীষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে চলাই তো জীবন। তোমার চাইতে আরও অনেক খারাপ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে ওই বাচ্চা ছেলেটা, তবুও তো সে হাসতে পারছে। তুমি কেন পারবে না? তোমার সাথে আমরা সবাই আছি। সবসময় থাকব।”

কথাগুলো এবং আশ্রমের ওই ছেলেটা দীপ্তকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। দুঃখ-কষ্টকে সাথে নিয়েও তাকে প্রশ্রয় না দেবার মনোবল তৈরি হয়েছে। আশ্চর্য এমন কথা সে আগেও বহুবার শুনেছে কিন্তু কখনো উপলব্ধি করেনি, এখন পারছে কারণ এখন ওর অন্য দৃষ্টি খুলে গেছে। উপলব্ধি করেছে কারণ সে উপলব্ধি করতে চাইছে। আগে এভাবে চায়ইনি সে কোনোদিন। বাবার পাশাপাশি শ্রেয়সী ওর জীবনে সঞ্জীবনী সুধা হয়ে এসেছে। ওর মনের একটা প্রগাঢ় অন্ধকার কোণে সে আলো ফেলেছে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যেমন আলো হাতে ঘুরে ঘুরে আর্ত মানবের সেবা করত, ওর জীবনে আলো নিয়ে এসেছে শ্রেয়সী। হঠাৎ করে সেই মহীয়সী নারীর সাথে শ্রেয়সীকে তুলনা করতে ভালো লাগছে, ওর জীবনে তো এই মেয়ে ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’। বাবা তো বাবাই, ওর নিজের বেঁচে থাকার প্রেরণা, উৎস।

নিলুফার রায়হান তার সহজাত হাসিতে দীপ্তকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কেমন বোধ করছ দীপ্ত?”

“খুব ভালো আন্টি। এত নির্ভার কখনো মনে হয়নি।”

“শুনে ভীষণ ভালো লাগছে তোমাকে দেখে। কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি পরিবারের সাপোর্ট অত্যন্ত জরুরি। তুমি সেটা দারুণভাবে পেয়েছ। আরেকটা জিনিস লাগে, সেটা হচ্ছে নিজের ইচ্ছাশক্তি। তোমার মধ্যে সেটা প্রবলভাবে ছিল। তুমি নিজেও ভীষণ সাহসী দীপ্ত। পরিস্থিতিকে স্পিরিটের সাথে এক্সেপ্ট করেছ। তাই এখন উত্তরণ ঘটেছে।”

“আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না।”

শ্রেয়সীর কথায় নিলুফার রায়হান বললেন, “এটা আমার ডিউটি। তবে ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আরেকটা কথা, আরও তিনমাস রুটিনগুলো ফলো কোরো। আরেকবার আমার সাথে দেখা কোরো। গুড লাক।”

শুভকামনা সাথে নিয়ে ওরা যখন বেরিয়ে এলো তখন আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। শ্রেয়সীর খুব ইচ্ছে করছে আজ বৃষ্টিতে ভিজতে। আজ দীপ্ত আপত্তি করল না। হুড খোলা রিকশায় প্রিয়জনের পাশে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে খারাপ লাগার প্রশ্নই আসে না। রিকশা এগিয়ে চলছে। ফুটপাতের দোকানগুলোতে কেনাকাটা চলছে। শ্রেয়সী কাঁচের চুড়ি দেখল তাকিয়ে।

দীপ্ত যেন ওর মন পড়তে পারল। নেমে গিয়ে চুড়ি হাতে নিয়ে ফিরে এসে রিকশায় বসে শ্রেয়সীর দিকে বাড়িয়ে দিল। শ্রেয়সী নিল না, বরং হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“পরিয়ে দাও।”

দীপ্ত হাত ভর্তি করে কাঁচের চুড়িগুলো শ্রেয়সীর হাতে পরম মায়ায় পরিয়ে দিল। চুড়ি পরা হাত দুটো শ্রেয়সী দীপ্তর চোখের সামনে তুলে নাড়ছিল। রিনরিনে শব্দ যেন দীপ্তকে বলছিল,

“ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।”

চুড়ির শব্দের সাথে সাথে আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি। মুহূর্তটা যেন অপার্থিব হয়ে উঠল এক ঐন্দ্রজালিক ভালোবাসায়।
………….
ক্রমশ