#তোর_মায়ায়_আবদ্ধ
#পর্ব_১৭
#আঁধারিনী(ছদ্মনাম)
” অভ্র তুমি কিন্তু এবার অতিরিক্ত করছো!” রাগ দেখিয়ে বললেন তুর্জয় চৌধুরী।
অভ্রের কোনো হেলদোল নেই।কথাটা জেনো গায়েই মাখলো না।নিজের মতো করে বিয়ের জন্য নিজেকে বর সাজতে ব্যস্ত সে এখন।এসব দেখে তুর্জয় চৌধুরী আরো রেগে গেলেন।তেড়ে এসে অভ্রের হাত থেকে পারফিউম টা টেনে ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে।অভ্র বাবার দিকে বিরক্তি চোখে তাকালো এবার।
” বাবা পারফিউম টা ভেঙ্গে ফেললে কেনো!আমার ফেবারিট ছিলো।”
” অভ্র এবার কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো।আমি তোমাকে অনেকক্ষণ যাবত কিছু বলছি।আমি তো ভাবতেই পারছি সামান্য একটা মেয়ের জন্য তুমি বাবার বিরুদ্ধে যাচ্ছো।”
” তোমার কাছে ও সামান্য হলেও আমার কাছে গোটা দুনিয়া।এই কথাটা আমি তোমাকে এর আগেও অনেকবার বলেছিলাম।তোমার কথায় একবার আমি ওকে ছেড়ে অনেক বড় ভুল করেছিলাম।দ্বিতীয়বার আর সেই ভুল আমাকে দিয়ে তুমি করাতে পারবে।”
অভ্রের কথা শুনে তুর্জয় চৌধুরী একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অভ্রের কাঁধে হাত রাখলেন।শান্ত গলায় বলতে শুরু করলেন,
” তোমার কোনো ইচ্ছে আমি কখনো অপূর্ণ রাখিনি।তুমি কি পারবে না আমার এই একটা কথা রাখতে!ছেড়ে দেও ওকে আর পাঠিয়ে দেও যেখানে বাকী মেয়েদের পাঠাবে।তোমাকে আমি ওর থেকেও হাজার গুন বেশি সুন্দরী মেয়ে খুঁজে দেবো কথা দিচ্ছি।”
” আমার অন্য কোনো মেয়েকে চাই না আমার শুধু আমার ভালোবাসাকেই চাই বুঝতে পেরেছো তুমি! আর বারবার ওকে ছেড়ে দেওয়ার কথা কেনো বলছো তুমি ওকে নিয়ে তোমার কি প্রবলেম সত্যি করে বলো তো!” ভ্রু কুঁচকে বললো অভ্র।
অভ্রের শেষ কথাটায় জেনো তুর্জয় চৌধুরী ঘাবড়ে গেলেন।তা অভ্রের চোখ এড়ালো না।তাই অভ্র পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” কি হলো চুপ করে রইলে কেনো?বলো বাবা!তোমার তো আলমুনকে নিয়ে প্রথমে কোনো প্রবলেম ছিলো না।এমনকি বিয়ে বাড়িতে ঢোকার আগ অবধি তুমি বিয়েতে রাজি ছিলে।বিয়ে বাড়িতে ঢুকে তোমার হঠাৎ কি হলো বলো তো!”
” কারণ টা তো আগেই বলেছি… ”
বাবার কথা কেড়ে নিয়ে অভ্র বিরক্তির সুরে বলে উঠলো
” চুপ করো তো বাবা ওই বানানো গল্প আগেও বলেছো পুরো বিয়ে বাড়িতে আমি তো কারো মুখে আলমুনের মায়ের নামে কথা শুনিনি।আর তোমাকেও একবারের জন্য কারো সঙ্গে কথা বলতেও দেখিনি বাড়িতে ঢুকেই তুমি আমাকে বিয়ে ভাঙ্গার কথা বলেছিলে।এবার সত্যি টা বলো বাবা আলমুনকে নিয়ে তোমার এতো কিসের প্রবলেম?”
” ওকে নিয়ে আমার কোনো কালেই কোনো সমস্যা ছিলো না।আমার সমস্যা তো ওর মাকে নিয়ে।ওর মা কে ছিলো জানো?”
অভ্র কৌতূহলী হয়ে বললো ” কে? আর কি সমস্যা তাকে নিয়ে তোমার?”
তুর্জয় চৌধুরী লম্বা একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলেন তারপর বলতে শুরু করলেন,
” ওর নাম ছিলো আলেয়া।অনেক ভালোবাসতাম ওকে।সেই কলেজে ওঠার প্রথম থেকে আমাদের সম্পর্ক ছিলো।যখন আমরা ইন্টারমিডিয়েট পাস করে অনার্সে ভর্তি হবো তখনই ওর বাড়ি থেকে ওর বিয়ে দেওয়ার তোরজোর পরে যায়।এইদিকে আমি ছিলাম সবে ইন্টারমিডিয়েট পাস করা একটা ছেলে। বেকার!এতিম ছিলাম টিউশনি চালায়ি আর মামাবাড়ি থেকে পড়াশোনা চালাচ্ছিলাম। এমন ছেলের কাছে কেই’বা মেয়ে বিয়ে দিবে।কিন্তু আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম ওকে ছাড়ার কথা ভাবতেও পারিনি।একদিন এক বখাটে বন্ধুর পাল্লার পরে এই নারী পাচারকারী দলের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি।ভালোই টাকা পয়সা কামাতে শুরু করি।আলেয়াকে বলেছিলাম আমি একটা চাকরি পেয়েছি ও যেনো আমার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। কারণ আমার বয়স আর ওর বয়স সেইম ছিলো তাই কোনোভাবেই আমাকে ওর বাড়ির লোক মেনে নেনে নিবে না।আগেও কয়েকবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম বন্ধুরে মাধ্যমে কিন্তু রাজি হয়নি ওরা।”
এইটুকু বলেই থামলেন।তুর্জয় চৌধুরীকে থামতে দেখে অভ্র কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলো ” উনি কি তোমার কাছে পালিয়ে এসে ছিলো?”
ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।তারপর আবার বলতে লাগলেন,
” এসেছিলো ঠিকিই তবে আমার কাছ থেকে একেবারে বিদায় নিতে।ও জেনে গিয়েছিলো কোনোভাবে আমি এই নারী পাচারকারী দলের সাথে যুক্ত।সেদিন আমাকে একটা চড় মেরেছিলো জানিস।ওর চোখে আমার জন্য ভালোবাসার পরিবর্তে সেদিন শুধুই ঘৃণা ছিলো।অনেক জ্ঞান দিলো আর বললো আমি এই পাপ কাজ থেকে জেনো সরে আসি।আমি বলেও ছিলাম তুমি আমার জীবনে চলে আসো আমি সব ছেড়ে দিবো। কিন্তু না ও ওর পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না।যার জন্য সব কিছু করেছিলাম সেই আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি স্তব্ধ ছিলাম।কয়েকদিন পরে শুনতে পেলাম ওর বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নিয়েছে।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওর মা হয়ে যাওয়ার খবরটা আর মেনে নিতে পারিনি।প্রচন্ড রাগ উঠেছিলো ওর উপর।তাই যেদিন ডেলিভারির ডেট ছিলো হসপিটালে ওর মেয়ের জন্মের পরই ওকে আমার লোকজন দিয়ে সরিয়ে ফেলি।আর পাচার করে দেই অন্য সব মেয়েদের সাথে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে পাচার করা হয়ে ওঠেনি।কারণ আমার লোকেদের ফাঁকি দিয়ে লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে মাঝ সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়ে।”
তুর্জয় চৌধুরী থামতেই অভ্র বলে উঠে ” কিন্তু এখানে আলমুনের অপরাধ কোথায়?”
” ওর একটাই অপরাধ ও আলেয়ার মেয়ে..”
তুর্জয় চৌধুরীর মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে শুভ্র বলে বলতে ঘরে প্রবেশ করলো,
” ওর অপরাধের কথা নাহয় পরেই ভাবলেন আগে নিজের গুলো গুনে রেখেছেন তো!নাকি ওগুলোর হিসেবও আমাদের করতে হবে?”
শুভ্রের সঙ্গে একে একে ছয়-সাতজনের একটা পুলিশের টিমও ঘরে ঢুকলো।তাঁরা সবাই অভ্র আর ওর বাবাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে।সবাইকে দেখে অভ্রের বাবা ঘাবড়ে গেলেও অভ্র একটুও ঘাবড়ালো না বরং শুভ্রকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
” তুইই তাহলে সব কিছু মূলে!আমার আগেই ডাউট হয়েছিলো।”
” হায় শিকার তার শিকারীর গন্ধ পাবে না তা কি কখনো হয়।”হাই তুলতে তুলতে বললো শুভ্র।
” একটা গেইমে জিতেই নিজেকে অনেক বড় খেলোয়াড় মনে করে ফেলছিস অফিসার।”
এরমধ্যেই অভ্র আর ওর বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করে ফেলছে।অভ্রকে নিয়ে যাওয়ার সময় ঠিক শুভ্র বরাবর এসে একটু থামলো। শুভ্রের কানের কাছে এসে ফিসফিসে বললো,
” মানতেই হবে তুই খুব লাকী!কিন্তু আমার ভালোবাসার গায়ে একটা আঁচও যদি কখনো লাগে তাহলে তোর এই লাক টা আর থাকবে না।ফিরে আসবো আমি বড্ড বেশিই ভালোবাসি যে!”
ফিসফিসিয়ে বললেও আমার কান অধবি সবটা স্পষ্ট এলো।কারণ আমি শুভ্রের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।শুভ্রকে বলা শেষ হলে আমার দিকে এক পলক তাকালো অভ্র।আজ এই দৃষ্টিতে কোনো চাওয়া ছিলো না কোনো পাওয়া ছিলো।তবে তাও আজ আমার পক্ষে এই দৃষ্টির দিকে তাকানোর সামর্থ্য নেই।অভ্রকে নিয়ে যাচ্ছে ওর যাওয়ার পানে তাকানোরও যেনো কোনো সাহস পাচ্ছি না।হ্যাঁ অভ্র হয়তো অনেক খারাপ কাজ করেছে জীবনে কিন্তু আমার প্রতি ওর ভালোবাসা টা এক বিন্দুও মিথ্যে ছিলো তা আজ আমার বুঝতে আর অসুবিধে হলো না।অভ্রের জন্য আজ আমার সত্যিই ভিষণ খারাপ লাগা কাজ করছে।জন্ম থেকে নিজের বাবা মাকে পেলো না। একটু বড় হওয়ার পর একজন যাও ওকে দত্তক নিয়ে বাবার ভালোবাসা দিয়ে নতুন জীবন দিলো তাও কিনা এই কালো জগতের সাথে জীবন টা জুড়ে দিয়ে আবার জীবন টাকে এভাবে করে দিলো।
একটু আগের অভ্র আর অভ্রের বাবার কথোপকথন গুলো আমরা প্রত্যেকে আড়াল থেকে শুনছিলাম।মিহিকে উদ্ধার করার জন্য ওই ঘরটাতে যাওয়ার পর শুভ্রই আমার কাঁধে তখন পিছন থেকে হাত রেখেছিলো।শুভ্র আর শুভ্রের টিম ততোক্ষণে এসে পরেছিলো।মিহি সহ সব মেয়েদেরকে ওরা বের করে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়েছে।এখানে থাকা প্রত্যেককেই আটক করা হয়েছে।শুধু অভ্র আর অভ্রের বাবাকে বাদে কারণ তাদের থেকে আমার মায়ের ব্যপারে তথ্য বের করার ছিলো। এতোদিন একটা সুক্ষ্ম আশার আলো ছিলো যে আমার মা পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ঠিক বেঁচে আছে। কিন্তু আজ থেকে আর সেই আশাটা রইলো না ভাবতেই গলা ধরে আসছে।তবে একটা জিনিস আমার কাছে ধোঁয়া হয়ে গেলো আজ।এতোদিন যাবত আমি জানতাম আমার বাবার আর মায়ের প্রেমের বিয়ে ছিলো কিন্তু অভ্রের বাবা কেনো বললো উনার সাথে মায়ের সম্পর্ক ছিলো।না আমি ভাবতে পারছি না আর সবটা কেমন ধোঁয়াসা লাগছে।বাবার থেকেই জানতে হবে।
” কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? চলো বাড়িতে তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।”
শুভ্রের কথায় আমার ভাবনার ইতি ঘটলো।এতোক্ষণে শুভ্রের দিকে তাকালাম।এই মানুষ টাকে আজ আমার খুব রহস্যময়ী লাগছে।অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে।আমাকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ্র নিজে থেকেই বলে উঠলেন,
” বাড়ি চলো ওখানে গিয়েই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।তোমার বাবাও আছে ওখানে।”
বলেই আমার হাত ধরে হাঁটা ধরলেন শুভ্র।
চলবে,,,,,,
রিচেক করা হয়নি ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।