দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-১৩+১৪

0
1

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ১৩ (❌কপি করা নিষেধ❌)

নবনী নিজের বাহুতে কারো স্পর্শ পেয়ে ধরফর করে উঠে পড়ে।

‘সরি সরি। তোমাকে জাগিয়ে দিলাম।”

ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকে নবনী। সামনে মুগ্ধ দাড়িয়ে আছে। নবনী কিছু বলার আগেই মুগ্ধ বলে উঠে,

“এখন প্লিজ বাংলা সিরিয়ালের নায়িকার মতো চিল্লিয়ে বলে উঠো না, কেন তোমার শরীরে স্পর্শ করলাম। তুমি আকা বাকা হয়ে শুয়ে ছিলে। তাই ভেবেছিলাম একটু ঠিক করে শুইয়ে দেই।”

নবনী কিছুই বলে না। মুগ্ধর সাথে আগেই ডিল হয়েছে। মুগ্ধ ওকে জোর করবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে যদি বিহানের কথা সত্যি হয়? মুগ্ধ যদি ওরকম ছেলে হয়? কিছুটা চাপা ভয় কাজ করে তার মনে।

মুগ্ধ কিছু না বলে টেবিলে রাখা খাবারের প্লেটটা সামনে এনে ধরে।

“নাও খেয়ে নেও। খিদাতো লেগেছে নিশ্চয়ই। খেয়ে তারপর ঘুমাও।”

মুগ্ধ নবনীর সামনে প্লেট রেখে খাটের অন্যপাশে গিয়ে বসে। আর বলে উঠে,

“শোনো মেয়ে। আমাকে আপন ভাবো আর না ভাবো। আমার ঘরটা আর পরিবারকে আপন ভেবে নিও।”

“আমরা আলাদা হচ্ছি কবে?”

মুগ্ধ এমন কথার প্রতি উত্তরে শুধু অবাক চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নবনীই হয়ত প্রথম মেয়ে যে নিজের বিয়ের রাতেই আলাদা হওয়ার কথা বলছে। মুগ্ধ ভেবেছিল নবনী বিয়ের পর একটু হলেও বদলাবে। তবে লোহা পোড়ালেও আগের রূপে ফিরে আসতে শুধু একটু ঠান্ডা আবহাওয়া হলেই চলে।

“যেদিন তোমার সব কথা সত্য মনে হবে। যেদিন প্রমান করতে পারবে, আমার বাবা আসলেই খারাপ কেউ। কথা দিলাম, বাড়ির দরজা খোলা থাকবে। তুমি চলে গেলেও, আমি একবারও তোমাকে আটকাবো না। তুমি যা চাও তাই হবে। তবে পরিবারের সামনে অন্তত বৌ হয়ে থেকো। আশা করি, বুঝতে পারছো কী বুজাতে চাচ্ছি?”

“হুমম।”

“খেয়ে নাও। পাশে শাড়ি রাখা আছে একটা। পাল্টিয়ে পড়ে নিও। তারপর ঘুমাও। আমি তাকাবো না। ডোন্ট ওয়ারি। তবে গল্পের নায়কদের মতো আমার রুমে সোফা নেই যে গিয়ে শুবু। তাই এক বিছানায় ঘুমাতে হবে।”

নবনী কিছু না বলে শাড়ি পাল্টাতে শুরু করে। কয়েকবার মুগ্ধর দিকে তাকায়। নাহ, ছেলেটা কথা রাখতে জানে। শাড়ি পাল্টিয়ে নবনী হালকা খাবার খেয়ে নেয়। মুগ্ধকে ডাকবে কি না দ্বিধাদ্বন্ধে পড়ে যায়।

“আপনি খেয়েছেন?”

মুগ্ধ চোখ বন্ধ অবস্থায় মুচকি হাসি দেয় একটা। একটু হলেও দরদ তবে আছে বলা যায়।

“হুমম। ভাইয়া জোর করছিল তাই খেয়ে এসেছি। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো।”

নবনী আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে। কোলবালিশটা ঠিক মাঝ বরাবর রেখে শুয়ে পড়ে। এতটাই ক্লান্ত ছিল যে, বিছানায় গা এলানোর সাথে সাথেই ঘুমিয়ে যায়। মুগ্ধর চোখে ঘুম নেই। রাত বাড়ার সাথে সাথে তার একাকিত্বটাও খুব বেড়ে যায়। একটু উচু হয়ে নবনীর দিকে তাকায়।

কি নিশ্চিন্তে মেয়েটা বাচ্চাদের মতো করে ঘুমাচ্ছে। তার এই বিশ্বাসটা ভাঙার সাধ্য মুগ্ধর নেই। তার মনে হয়, এই মায়াবী চেহারা দেখেও সে যুগ যুগ পার করে দিতে পারবে। হয়ত এমন অনুভূতিই হলো পবিত্র ভালোবাসা। যেখানে কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। শরীরতো সব পুরুষরাই সহজে ছুয়ে দিতে পারে। মনটা ছুতে পারে কজন? যে পারে, সেই সত্যিকারের পুরুষ।

মুগ্ধ অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে, নবনীর কথা সত্যি হয়ে গেলে মেয়েটা তাকে ছেড়ে চলে যাবে? মুগ্ধ কি পারবে তাকে আর ফেরাতে? নানান চিন্তার ভাজ কপালে নিয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়ে।
…….

খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নবনী। উঠে খেয়াল হলো গোসল করতে এখন বাহিরে যেতে হবে। এই বিষয়ে ভেবে চোখে পানি চলে আসল। কাউকে বললে সবাই ভাববে হয়ত, ঢং। আসলে যে যেই পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত, সে সেখানেই বিয়ে করা ভালো।

নয়ত ছোট ছোট বিষয় নিয়ে থাকতে খুব অসুবিধা হয়। যেটা হয়ত বাকিদের চোখে খুবই সামান্য। নবনী মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে ভাবে ডাকবে কি না। তখনই মুগ্ধ চোখ খুলে উঠে বসে। তাদের বাড়িতে বৌভাত আজকে। নবনীর বাড়ি থেকে লোক আসবে। পরে ওদের নিয়ে যাবে। খুব কাজ পড়ে আছে।

“আমি গোসল করব কোথায়?”

“কোথায় আবার? পুকুরে গিয়ে করো। পাশে কাপড় পাল্টানোর জায়গা আছে। নিচে পাকা করা চারপাশে টিনের বেড়া দেয়া।”

নবনী হাতে কাপড় নিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। নবনীকে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে মুগ্ধ বলল,

“কি হলো? যাও।”

“আমি ম. রেই যাবো।”

“ইশশ, তোমার নেকামো দেখে হাসি পেল। পুকুরের পানিতে গোসল করলে কেউ মা. রা যায় না।”

“আমার আসলে ডাস্ট এ এলার্জি আছে। পুকুরের পানিতে গোসল করলে শরীরে কেমন যেন ফোসকা ফোসকা পড়ে যায়। পরে খুব চুলকায় আর ব্যাথা করে। নানু বাড়ি থাকতে এমন একবার হয়েছিল। তাছাড়া….”

নবনী আরো কিছু বলবে দেখে মুগ্ধই রুমে নেই। গেলো কখন? নবনী রাগে, জিদে পিছনের পুকুরেই গোসল করতে চলে গেল। দেখল পুকুরের ঘাটে মগ রাখা। সে নিজের পার্সোনাল ফেইস ওয়াস, সাওয়ার জেল, সব হাবিজাবি জিনিস ঘাটে সাজিয়ে রাখল।দেখল আশেপাশে কেউ নেই। যাক, একটা দিক দিয়ে বেচে গেল। তবে রাতে শরীরের কি হবে ভেবে এখনই অবস্থা খারাপ হচ্ছে।

এইদিকে মুগ্ধর একটা কল আসায় দ্রুত সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। শেষে নবনী কি বলতে নিয়েছিল তা একটুও শুনেনি। কল শেষে ঘরে ফিরে দেখে নবনী নেই।

“কোথায় গেল মেয়েটা? আমিতো আরো বলতে এসেছিলাম চাপ কলের ঐখানে চলো। আমি পানি চেপে দেই।”

মুগ্ধ একবার ভাবে পুকুরের পারে যাবে নাকি। পরে ভাবে শরীর ভিজিয়ে ফেলার পর গিয়ে তো লাভ নেই। উল্টো মেয়েদের শরীর দেখতে গিয়েছে এই অপবাদ নিয়ে ফিরতে হবে। এর থেকে না যাওয়াই ভালো। মুগ্ধ নিচে গিয়ে দেখে এখনো কেউ উঠেনি। শুধু মা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছে।

“কীরে? নবনী কোথায়?”

“পুকুরে গিয়েছে।”

“তুই গেলি না কেন সাথে?”

“আমিই!”

“এমন করার কি আছে? তোরই তো বৌ। যা গিয়ে দেখ মেয়েটা কি করছে। নতুন বৌকে কেউ এভাবে পুকুরের পারে গোসল করতে পাঠায়? পাশের বাড়ির কোনো ছেলেরা পুকুরের ঐ দিকে গেলে। তখন?”

“আচ্ছা গিয়ে দেখছি।”

মুগ্ধ ভাবে। এই কথাতো সে ভাবে নেই। তবে গিয়ে যা দেখে, তা হলো….

#চলবে …..

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ১৪ (❌কপি করা নিষেধ❌)

নবনী গত আধা ঘন্টা যাবৎ পুকুরের ঘাটে বসে আছে। গোসল শেষ। তবে সমস্যা হলো কাপড় পাল্টাবে কোথায়? তাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মেজাজটা এত খারাপ হচ্ছে, যেন পারলে পুকুরে লাফ দিয়ে ইহ জগৎ এর মায়া ত্যাগ করে দেয়।

“এভাবে বসে আছো কেন?”

মুগ্ধর কথায় উপরে তাকায় নবনী। গায়ে গামছা পেচিয়ে বলে,

“তো কি করব? কাপড় পাল্টাবো কোথায়?”

“আমি পাহারা দিচ্ছি। কেউ আসবে না। কুইক।”

“আমি পারব না। এত খোলামেলা সম্ভব না। আকাশও ফাকা।”

“তোমার কি মনে হয়, গ্রামের সব ছেয়েরা পাখা মেলে উড়ে উড়ে আকাশ থেকে তোমাকে দেখবে? প্লিজ তাড়াতাড়ি করো। তোমার বাড়ি থেকেও লোক আসবে একটু পর। বললাম তো, এই সময়ে কোনো বাড়ির পুরুষ এদিকে আসে না। আমি আছি তো।”

নবনীর হাতে আর কোনো উপায় নেই। মুগ্ধ অন্যদিক ফিরে দাড়িয়ে আছে। নবনী তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে উপরে চলে আসে।
……..

“সবকিছু ভিডিও ফুটেজ রেডি করছিস তোরা?”

ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে কেউ একজন জবাব দেয়। বিহান কল কেটে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবতে থাকে, পরশু রাতে মুগ্ধ কি খেলাটাই না দেখাল। প্লানমতো বিহান সেখানে দাড়িয়েও ছিল। তবে সমস্যা হয়েছিল শাওনের বাচ্চাটাকে নিয়ে।

ঐ ব্যাটা এক গ্লাস জুস এনে বিহানকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছিল। আর বলেছিল, ছেলে বাড়ি থেকে মেয়ের জন্য হাবাজাবি নিয়ে এসেছে ও আগেই। আর তার মুগ্ধ ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে নাকি এটা বিহানের ট্রিট।

” নিশ্চিত ব্যাটা জুসে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল।”

ঐ যে বিহান মাথা ঘুরে ঘুমিয়ে যায়। তারপর ঘুম ভাঙে গিয়ে পরেরদিন দুপুরের দিকে। ওকে নিয়ে কুড়েঘরের ভিতরে রেখে দিয়েছিল। সারারাত মশা কামড়িয়ে কি বেহাল অবস্থাটাই না করেছে চেহারার। তবে বিহান থেমে যায় নি, তার লোক দিয়ে মুগ্ধর বাবার কুকীর্তির বিরুদ্ধে সব প্রমাণ ঠিকই সে জোগাড় করে ছাড়বে। তখন নবনী নিজেই ওদের ঘর থেকে চলে আসবে।
……

“আইজ কাইলকার মাইয়াগো ঢং দেখলে বাচিনা। আমরা মনে হয় বিয়া করি নাই। কই? আমগো মা, খালারা বা বৌরা তো বিয়ের পরদিন এত বেলা অব্দি ঘুমায় নাই।”

খাবার খেতে খেতে কথাগুলো বলল শরীফ। এতদিন কম জালায় নি মানুষটা এ বাড়ির মহিলাদের। এখন হয়ত নতুন বৌকেও সেই শাসনের জালে বাধার পরিকল্পনা করছে। তবে শরীফের স্ত্রী এবার উত্তর দেয়,

“আমরাতো সেকেলে মেয়েমানুষ। আজকাল মেয়েরা ঐ একটু আকটু অন্যরকম চলেই। আর ও তো নতুন এসেছে। কদিন থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“তোরে কথা কইতে কইছি?”

বেশ হুংকার দিয়ে উঠে শরীফ। ভয়ে চুপ হয়ে যায় পাশে দাড়িয়ে থাকা ব্যক্তি। আর রাগালে এখনি গায়ে হাত তুলবে। এমন সময় মুগ্ধ নবনীকে সাথে নিয়ে সবার মাঝে আসে। নবনী সবাইকে সালাম দেয়। এতক্ষণ এখানে কি হয়েছে, সেটা তার অজানা।

মুগ্ধর মা দূর থেকে ওদের দেখে থু থু দেয়। দুজনকে কি সুন্দর মানিয়েছে।

“এদিকে আয় মা। আমার কাছে আয়।”

মুগ্ধর মায়ের গলা শুনে নবনী তার কাছে রান্নাঘরে চলে যায়। মুগ্ধ গিয়ে টেবিলে বসে।

“চাচা। নবনী হয়ত খেয়াল করেনি। তুমিযে চাচীর সাথে কেমন করছিলে আমি দূরর থেকে দেখেছি। মেয়েটা নতুন এসেছে। সাথে সাথে এসব শুরু করো না।”

শরীফ গাল বাকিয়ে হেসে বলে,

“হুহ। এইসব ঢং এর কারণে আইজকাল তোগো সংসার টিকে না। আমরা দেখ। কি সুন্দর বুড়া বয়সে ঘর করছি। শোন বাবা মুগ্ধ। আমরা তোর খারাপ চাইনা। প্রথম রাত, প্রথম দিন থেকেই মেয়েগো চাপের উপর রাখতে হয়। সুযোগই দিবি না মাথায় উঠার।”

মুগ্ধ কিছু বলে না। মেয়েদের জোর করে শরীরে হয়ত দখল নেয়া যায়। তবে তাদের জয় করা এত সহজ না। পায়ের নিচে রাখলে যদি সংসার সুখেরই হতো, তবে এ বাড়িতে কোনো শান্তি নেই কেন? বাবার কাজের ব্যস্ততায় ঘরে না ফিরতে চাওয়া। শরীফের রাত অব্দি বাইজি শালায় ফূর্তি করা। ম/দের বোতলে এক চিমটে সুখ খোজা। এসব কী ঠিক?

এদিকে নবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মুগ্ধর মা বলে,

“মাশাআল্লাহ্ মা। তোকে খুব সুন্দর লাগছে। মুগ্ধর পাশে দারুণ মানিয়েছে তোকে।”

নবনী হাসে। অতঃপর উত্তর দেয়,

“কোনো কাজ করা লাগলে বলুন মা। আমি সাহায্য করে দিচ্ছি।”

“না নাহ। কিচ্ছু লাগবে না। তুই গিয়ে খাবারের টেবিলে বস।”

“আপনি বসবেন না?”

মুগ্ধর মা একটু অন্য চোখে নবনীর দিকে তাকায়। আজ এত বছর এ বাড়িতে তারা কখনো এক সাথে খায়নি। তার শাশুড়ি তাদের নিয়ম করে দিয়ে গিয়েছিল, আগে বাড়ির সব পুরুষেরা পেট ভরে খাবে। পরে কিছু থাকলে, মহিলারা খাবে। নয়ত না খেয়েই থাকতে হবে।

বিয়ের পর প্রথম প্রথম যখন সংসারের দায়িত্ব তার শাশুড়ির হাতে ছিল, প্রথম প্রথম কত বেলা না খেয়ে থাকতে হয়েছে এসবের ঠিক নেই। আর আজ এতো বছর পর এসে এক অভিমানের জোরেই টেবিলে বসে আর খায় না মুগ্ধর মা। সে নবনীকে বলে,

“আমরা বাড়ির মহিলারা কর্তকে রেখে আগে খেলে কেমন দেখায়।”

“এখানে আবার কেমন দেখানোর কি আছে? আমরা তো স্বার্থপরের মতো আগেই সব সাফার করে দিচ্ছি না। একসাথে সবাই মিলে খাবো। শহরে তো আমার মাও আমাদের সাথে খেত।”

“ওটা শহর। এটা গ্রাম। এখানে ওসব হয় না।”

“করলেই হয়। সব পুরোনো নিয়ম সময়ের সাথে পাল্টানো উচিত। আগে মেয়েরা পড়াশোনা করত না। এখনতো করে। আরো কত কিছু। অথচ আমরা খারাপ বিষয়গুলোকে হাইলাইট করে, ভালোটাকে চাপিয়ে দেই। চলুনতো।”

মুগ্ধর মা বারবার না করার পরেই নবনী তাকে টেনে এনে টেবিলে বসায়। মুগ্ধর চাচীকেও ধরে জোর করে বসিয়ে দেয়। শরীফ আর মুগ্ধ হা করে শুধু নবনীর কাজ দেখছে। নবনী এক এক করে সব খাবার এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখে।

তারপর সবার প্লেটে সবকিছু দিয়ে, নিজেও মুগ্ধর পাশে খেতে বসে। মুগ্ধর মা চাচীর খুব লজ্জা লাগছে এভাবে খেতে। তার উপর মাছের দুটো মাথাই নবনী তার শাশুড়িদের প্লেটে তুলে দিয়েছে।

“আমি মাছের মাথা খাই না। শাওনের বাবাকে দিয়ে দেই।”

শাওনের মায়ের এমন কথা শুনে শরীফ বলে,

“তোমাকে দিয়েছে তুমিই খাও। তোমার এটো আমি খাবো না।”

কারো আর কিছু বলার থাকে না। সবাই চুপচাপ খেতে থাকে। মুগ্ধর বিষয়টা ভালো লাগল, নাকি খারাপ ঠিক বুঝল না। এতদিন এক নিয়মে জন্মের পর থেকে দেখে আসছে। আজ হঠাৎ অন্যরকম। তবে তাদের মায়েরা যে মনে মনে মাথা খেতে পেরে খুশি তা চেহারায় একটু আকটু ফুটি উঠেছে।

এমন সময় শাওন আর মতিসুরও খেতে আসে। শুধু তাদের আরেক ভাই ও তার পরিবার আসে না। তারা তেমন একটা সবার সাথে মিশেও না। অহংকার আছে বললেই চলে। মাহির মাতো সারাদিন ঘরে পড়ে পড়ে ঘুমাতেই থাকে।

স্নিগ্ধ আর শ্যামলীও এসে বসে। শ্যামলী প্রথমে বসবে কিনা বুঝছিল না, তবে তার শাশুড়ি ইশারায় নবনীকে দেখিয়ে বলে বসতে। মতিসুর বাড়ির মহিলাদের একসাথে খেতে দেখে যত অবাক হয়, তার চেয়ে বেশি চমকায় তাদের প্লেটে মাছের মাথা দেখে। তবে নতুন বৌয়ের সামনে কিছু বলে না। খেতে বসলে মুগ্ধর মা এটি সেটা বেড়ে দেয়। এই প্রথম সবাই একসাথে খাবার খাচ্ছে।

শরীফ মুখে না বললেও, তারও বিষয়টা ভালো লেগেছে। এই প্রথম সবাইকে এত খুশি মনে হচ্ছে। খাওয়া শেষে সবাই যার যার রুমে চলে যায়। নবনী অন্য শাড়ি পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে রেডি হচ্ছিল। নতুন বৌকে কত মানুষই তো দেখতে আসবে। তাই মুগ্ধর মা বলেছে, একটু সেজেগুজেই থাকতে।

এমন সময় মুগ্ধ ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে আসে। কথার মাঝে ফাকে ফাকে সে নবনীকে দেখতে থাকে। আকাশি রঙের শাড়িতে নবনীকে একদম বৌ বৌ লাগছে। হেই? ওয়েট? নবনীতো তার বউই হয়।

“লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কিছু নেই। এমনিই তাকাতে পারেন। কিছু বলব না।”

মুগ্ধ কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে উঠে,

“ভালোভাবে তাকাচ্ছি না। তাকালেতো আরো বেশি কিছু করতে মন চাইবে। ঐটাতো পারব না। তাই।”

এবার নবনী খুব লজ্জা পেয়ে যায়। প্রসঙ্গ পাল্টাতে সে বলে,

“আজ ত্রিশ বছর পর আপনার মা মাছের মাথা খেল।”

মুগ্ধ অবাক হয়ে বলে,

“মানেহ!”

“হুম। ঠিকই বলছি। আপনাকে একটু ভিন্ন ভেবেছিলাম। তবে আপনিও হয়ত বাবা চাচাকে দেখে যা শিখেছেন, সেভাবেই চলেন। আপনার চাচার তখন রাগ হওয়াটা আমি শুনেছিলাম। এ বাড়িতে মেয়েদের মূল্যায়ন করা হয় না। আপনার কি এত বছরে মনে হয় নি, বাড়ির মহিলারা যারা সারাদিন এত কাজ করে ক্লান্ত হয়। তারা খেয়েছে কিনা, এসব ব্যাপারে আপনাদের খোজ নেয়া উচিত। তাদের শরীরও তো একদিন অসুস্থ থাকতে পারে। ”

“সেভাবে ভাবিনি কারণ আগের দিনেও তো মা, খালারা এভাবেই চলছে। আর মাতো সবসময় পরেই খায়।”

“পরে খায় কারণ কোনোদিন আপনারা খেতেই ডাকেন নি। কোনোদিন নিজের প্লেট থেকে মাছের মাথা, মুরগির রান উঠিয়ে তাদের প্লেটে দেন নিহ। আগের দিনেতো মাত্র পাচ বছর বয়সের মেয়েরা বিয়ে করেও বাচ্চা সুস্থভাবে জন্ম দিতো। এখনতো ১৬ বছরেও বিয়ে করলে বাসরের পরদিন হসপিটালে ভর্তি করতে হয়।”

নবনী একটু থেমে আরো বলে,

” আগের মেয়েদের শরীর, মন সবকিছুর সাথে এখনকার মিলালে তো চলবে না। এটা ঠিক যুগের সাথে বেহায়াপনা আর বাজে মেয়েদের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। তবে আপশোস কুসংস্কারগুলো ঠিকই রয়ে গিয়েছে। এখন একটু বদলানোর সময় এসেছে মিস্টার মুগ্ধ।”

মুগ্ধ কিছু বলে না। আসলেই কি তারা ভুল ছিল। হয়ত ছিল। মেয়েদের আসলে পুরুষ জাতির একটা বড় অংশ সবসময় মেয়েই মনে করে। মানুষ মনে করে না। দুটোর ভিতর অনেক তফাৎ আছে। এমন সময় শাওন দরজায় কড়া নাড়ে।

“ভাই আসব?”

“আয়।”

শাওন দরজা ঠেলে ভিতরে এসে মুগ্ধকে বলে, “ভাই একটু নিচে চলো। ইলেকশনের কাজের জন্য লোক এসেছে।”

মুগ্ধ শাওনের সাথে নিচে যায়। এমন সময় নবনীর কল আসে। একটা আননোন নাম্বার। কল রিসিভ করে সালাম দিতেই, সে শুনে ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে বলছে,

“নবনী আমি। বিহান।”

নবনী নামটা শুনে চুপ হয়ে যায়। একটু অদ্ভুত লাগে তার। ঐ দিকে বিহান তাকে কিছু অবাক করা তথ্য সবাইকে নিয়ে দেয়। সাথে এটাও বলে, সে খুব দ্রুত মুগ্ধর বাবার কালো দুনিয়ার পর্দা ফাঁস করবে। এরপর আর নবনীকে এ বাড়ি থাকতে হবে না।

নবনী ভাবে, সত্যিই সবটা সামনে এলে কি সে চলে যাবে?

দুপুরে নবনী তার সেকেন্ড শাড়ি পড়ে সেজেগুজে বসে আছে। তার বাড়ি থেকে লোক এসেছে। একটু পর তাকে আর মুগ্ধকে নিয়ে যাবে। মামিরা ইশারা ইঙ্গিতে বারবার মজা করছে নবনীর সাথে। নবনী চুপ করে বসে আছে মূর্তির মতো। খাওয়া দাওয়া শেষে নতুন দম্পতিকে নিয়ে সবাই রওনা হয়।

#চলবে …..