দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-১৮+১৯

0
2

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ১৮ +১৯ (❌কপি করা নিষেধ❌)

“এসব কি স্যার? আপনি আমার ভাইকে জেলে আটকে রেখেছেন কোন সাহসে? আপনি জানেন আমরা কারা?”

ইনডায়রেক্টলি ধমকির সুরে কথাটা বলল স্নিগ্ধ। বাড়ির বাকি সবাইও এসে গিয়েছে শুধু মতিসুর বাদে। সে হয়ত কিছু সময় পর পৌছে যাবে। নবনী জেলের সামনে গিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।

মুগ্ধ একবার মলিন মুখে তার দিকে তাকায়। যেন চোখ দিয়ে বলতে চাইছে, এসবের জন্য তুমি দায়ী। নবনী ওর চোখের ভাষা কিছুটা বুঝে যায়।

এইদিকে ইনসপেক্টর বারবার বুঝাচ্ছে তিরা মুগ্ধকে এরেস্ট করেনি। সে নিজে এসেই নিজেকে এরেস্ট করতে বলেছে।

“ও বলল আর আপনারা তাই করলেন?”

“দেখুন আইন সবার জন্য সমান। এখন কেউ যদি নিজে এসে তার সব অপরাধ স্বীকার করে নিজেকে ধরিয়ে দেয় আমরা কি করব?”

“কি করেছে আমার ভাই শুনি।”

“সে অনেকগুলো ইলিগেল বিষয়ের সাথে যুক্ত ছিল। মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করা, শিশু পাচার। সাথে কয়েকজনের জমিতে জোর করে দখল এসব কিছু।”

মুগ্ধর মা সেখানেই বসে পড়ে এসব শুনে। শাওন আর তার মা তাকে বারবার শান্ত করার চেষ্টা করে। এসব মুগ্ধ কোনোদিনও করেনি সে জানে। এইদিকে মতিসুর মেম্বার মাত্র থানায় ঢুকছিল। এসব অপরাধের কথা শুনে সে থেমে যায়। এগুলো তো…. এগুলো তো তার করা কারসাজি।

মতিসুরকে দেখে মুগ্ধ উঠে দাড়ায়। মতিসুর মুগ্ধর সামনে এসে বলে,

“এসবের কি খুব দরকার ছিল। কোনোকিছু করার আগে আমাকে একবার জানাতে।”

মুগ্ধ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তার বাবার কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“তখনতো দেখা যেত আপনি সব প্রমাণ সরিয়ে দিতেন। হয়ত এই শহুরে মেয়েটাকে দুনিয়ায় আর বাচতেই দিতেন না।”

“কি সব বলছ? তুমি আমাকে এত ঘৃণা করো?”

“হ্যা করি। আপনার মতো খারাপ লোককে নিজের বাবা বলে পরিচয় করিয়ে দিতে আমার লজ্জা হয়। আমি যদি পারতাম, নিজের শরীরের শেষ বিন্দু রক্তের ফোটা অব্দি বের করে ফেলতাম। কারণ আপনার মতো অমানুষের রক্ত আমার শরীরে বইছে।”

“মুগ্ধ!”

“আওয়াজ নিচে করে কথা বলুন মেম্বারসাহেব। আপনি এত খারাপ যে, আমি ম\রে গেলেও হয়ত আপনার যায় আসে না। তবে কাউকে না কাউকে তো পাপের সাজা পেতেই হয়।
আপনার মতো অমানুষ আমাকে জন্ম দিয়েছে। এর শাস্তি হিসেবে জেল হাজতে থাকাটাও খুব তুচ্ছ।”

“হ্যা আমি মানছি আমি খুব খারাপ মানুষ। তবে আমি খারাপ বাবা নই। তুই আমার ছোট ছেলে। সবসময় তোকে নিজের হাতে মানুষ করেছি আমি।”

“আরে রাখেন আপনার ফিলমি ডায়লোক। এতই যদি ভালোবাসতেন তাহলে ঐ মেয়েগুলোর কথা একবার হলেও ভাবতেন। যাদের জীবনটা আপনি নরক বানিয়েছেন। ওরাও তো কারো বোন, কারো মেয়ে। অবশ্য আমি কাকে কি বলছি। আপনার এই শরীরটাও তো…”

আর কিছু বলতে পারে না মুগ্ধ। ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নেয়। মতিসুরের আজ এই প্রথম নিজেকে খুব পাপী মনে হচ্ছে। এত টাকা পয়সা সবকিছু থেকেও যেন সে খুব অসহায়। তার নিজের ছেলেকে বাচাতে হলে, তাকে সব সত্য স্বীকার করতে হবে।

মতিসুর আস্তে আস্তে পুলিশের সামনে গিয়ে দাড়ায়। আর বলে উঠে,

“আমি বয়ান দিতে চাই।”
…….

বাইজি শালায় আজ মেয়েরা খুব খুশি। বড় একটা টিম তাদের উদ্ধার করতে এসেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, কোনো মেয়েই তার পরিবারের কাছে ফেরত যাবে না। এমনটা নয় যে যেতে চাচ্ছে না। ঐ যে আমরা সভ্য সমাজ। রাতের আড়ালে শরীর ছুয়ে দিতে পারি, তবে দিনের বেলা এদের মর্যাদা দিতে পারি না।

তাই বড় একটা সেচ্ছাসেবক টিম এদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। এখানকার বাচ্চাদের আশ্রমে পাঠানো হবে, সেখানে ওরা আট দশটা বাচ্চাদের মতো পড়াশোনা করবে। খেলবে, ঘুরবে। দুনিয়াটার প্রকৃতি দেখবে। আর মহিলাদের একটা কারখানায় কাজ করতে পাঠানো হয়েছে।

নিতা বাইজি। যে এখানে সবার সিনিয়র। এখানে সবাই তাকে খুব ভয় পায়। নতুন কেউ এলে তাকেই সব বুঝিয়ে দিতে হয়। ইনিও আজ খুশি। কোন এক খোদার পাঠানো মানুষের জন্য আজ থেকে সেও একজন মানুষ হয়ে বাচতে পারবে। পতি/তা নাহ।
…….

“উনি ঠিক আছেন ডক্টর?”

মুগ্ধর কথায় ডাক্তার সাহেব নিজের চেকআপ বন্ধ করে বলেন,

“ঠিক আছে। তবে একটু খেয়াল রাখবেন। হয়ত পরপর হঠাৎ বড় কিছু তার সাথে হয়ে গিয়েছে তাই এভাবে জ্ঞান হাড়িয়েছে। একটু খেয়াল রাখবেন। আর এই ঔষুধগুলো এনে খাইয়ে দিয়েন।”

স্নিগ্ধ ডাক্তারের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বলল,

“চলুন। আমি আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি।”

স্নিগ্ধ ডাক্তারকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। একটু আগেই সবাই বাড়ি ফিরেছে। শুধু একজন বাদে। যিনি সব পাপের শাস্তি পাবেন। মতিসুর নিজের ছেলেকে বাচাতে সব সত্য স্বীকার করেছে। শাওন মুগ্ধর দিকে তাকায়। তার মুগ্ধ ভাই যে এমন কিছু করতে পারে তার ইঙ্গিত সে সকালে পেয়েছিল।

সকালে যখন নবনী রুম থেকে বেরিয়ে যায় তখন মুগ্ধর টেবিলের নিচে চোখ যায়। সে সব প্রমাণ আর ভিডিও ক্লিপ হাতে পেয়ে বসে পড়ে। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে কখনো ভাবেনি তার বাবা এত খারাপ মানুষ হতে পারে।

তবে সে একটা জিনিস বুঝে গিয়েছিল, এসব প্রমাণ পুলিশকে দিয়ে কোনো লাভ নেই যদিনাতার বাবা নিজে নিজেকে ধরা দেয়।

এসব মুগ্ধর চাল ছিল। সে জানত পুলিশকে এসব প্রমাণ দিলে উল্টা নবনী ফেসে যাবে। তাই নিজেই নিজেকে সেক্রিফাইস করার ডিসিশনটা সে নিয়েছিল। তবে এতকিছু এত কম সময়ে হয়ে যাওয়ায় তার মা সেখানেই সেন্সলেশ হয়ে পড়ে।
…..

মুগ্ধ নিজের রুমে এসে চুপচাপ জানালার পাশে বসে আছে। তার চোখ বেয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। এত রাতের মাঝেই সে কতকিছু হারিয়ে ফেলতে চলছে হিসাব নেই।

নবনী একপা এক পা করে রুমে এগুচ্ছে আর তার বুকের ধুকধুকনি বেড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, এইযে বাড়ির সাজানো সংসারটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, এসবের জন্য কি সে নিজে দায়ী। এর কোনো উত্তর নবনীর কাছে নেই। রুমে ঢুকতেই মুগ্ধ বলে উঠে,

“বেরিয়ে যাও এ বাড়ি থেকে।”

নবনী অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। মুগ্ধ তাকে চলে যেতে বলছে? মানে এসব কিছুর জন্য মুগ্ধ তাকেই দোষী ভাবছে। তবে নবনীরতো কোনো দোষ নেই।

শর্ত অনুযায়ী নবনীর নিজেরই তো চলে যাওয়ার কথা। অথচ আশ্চর্য ! মুগ্ধর মুখে এই একটা লাইন শুনে তার কলিজাটা মনে হয় ছি/ড়ে যাচ্ছে। অথচ তার খুশি হওয়ার কথা ছিল।

“কি হলো? কথা কানে যায় নি? চলে যাও এখান থেকে। আমি তোমার মুখটাও দ্বিতীয়বার দেখতে চাই না।”

“আমার কথাটা…”

“প্লিজ যাও। মুক্তি চাইতে না তুমি সবসময়। আজ তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। সময়মতো কাগজ পাঠিয়ে দিও। সাইন করে দিবো। যাও প্লিজ।”

নবনী আর এক মুহূর্ত সেখানে দাড়ায় না। যেই মানুষটা নিজে থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, তার কাছে জোর করে থাকার কোনো মানে হয়না। নবনী কাদতে কাদতে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। শাওন দেখতে পায় নবনী বাড়ির বাহিরে চলে যাচ্ছে।

“ভাবী এত রাতে কোথায় যাচ্ছো?”

নবনী শাওনের কথায় কোনো উত্তর দেয় না। সে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। শাওন কিছু বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি মুগ্ধর কাছে গিয়ে বলে,

“ভাই। ভাবীতো চলে যাচ্ছে। আটকাও তাকে।”

“যেতে দে। এতেই ওর ভালো।”

“মানে। কি সব আবোলতাবোল বলছো। ভাবীকে আটকাও ভাই। সে চলে যাচ্ছে।”

“বললাম তো যেতে দে। ভালোবাসি বলেই যেতে দিচ্ছি। এখন বাবার দলের সব লোকদের টার্গেট ও। দূরে গেলেই ওর জন্য ভালো। ওর কথা ভেবেই ওকে দূরে সরাচ্ছি।”

শাওন ধীরে ধীরে মুগ্ধর কাছে গিয়ে দাড়ায়। এই প্রথম মুগ্ধকে কাদতে দেখছে সে। তার কাছে এটা একটা আশ্চর্য। তার মুগ্ধ ভাই একটা মেয়েকে এত ভালোবাসে?

“এতটা ভালোবাসো তুমি ভাবীকে মুগ্ধ ভাই? কী দেখে এতটা প্রেমে পড়লা ?”

“জানিনা।”

“সৌন্দর্য দেখে?”

“নাহ।”

“সাহস দেখে?”

“নাহ।”

“ভালো রেজাল্ট দেখে?”

“সেটা দেখে কেউ প্রেমে পড়ে?”

তাও যদি না হয়, তবে কি?শাওন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

“সে সত্যিই চলে যাচ্ছে ভাই। তাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না আমি জানি। খুব ভুল করলে ভাই। খুব ভুল করলে।”

মুগ্ধ চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। আসলেই তার আর কিছুই করার ছিল না। কিছুই না।

…….

নবনী বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছে। এত রাতে একা একটা মেয়ে শুধু সাইড ব্যাগটা সাথে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। আর কিছু না। তবে ওর একটুও ভয় করছে না। নিজের মানুষটাকে হারিয়ে এখন আর কিসের ভয় করবে সে?

আর একবার পিছনের পথটায় তাকায় নবনী? সত্যিই কি সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। তাদের গল্পটার ইতি কি এখানেই? এই গ্রাম, এই নদী, এই পথ।

এসবে আর কোনোদিন কি আসা হবে না তার? বুকের চাপা আর্তনাদ আর আটকে রাখতে না পেরে কেদে ফেলে সে।

“কেন আমাকে বুঝলে না মুগ্ধ?”

আর কিছু বলেনা নবনী। এখন সে সোজা তার হোস্টেলে চলে যাবে। তাদের নানি বাড়িতেও জামেলা হচ্ছে নবনী জানে। তার নানাভাইও এসবের সাথে জড়িত। নিজেদের সম্পর্ক শক্ত করতেই তাদের বিয়ে দেয়া হয়। এসবের মাঝে শুধু দুটো মানুষের রিদয় টা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। নবনী আর দাড়ায় না।

যত এখানে থাকবে ততই যেন কষ্ট হবে। এক প্রকার নিজের অনুভূতি থেকে পালাতেই সে চলে যায়। বহুদূর।
……

এদিকে বিহান ভেবেছিল নবনী হয়ত তাকে মেনে নিবে। তবে নবনী তাকে না জানিয়েই চলে যায়। যাওয়ার আগে শুধু একটা টেক্সট দিয়ে বলে,

“আপনি যা করেছেন এজন্য আমি চির ঋণি বিহান ভাই। তবে আমি শহরে ফিরছি। মুগ্ধকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি খুব। তবে হয়ত সে আমার ভাগ্যে নেই। পড়ে কথা হবে আপনার সাথে সব নিয়ে।”

বিহান বিরহ নিয়ে মলিন হাসি দেয়। কি ভাগ্য তার! একজনকে সে সবটা দিয়ে ভালোবেসেও পেলো না। আর কেউ একজন এমনি এমনি তার ভালোবাসা পেয়ে গেল। দুনিয়াটা এতো নিষ্ঠুর কেন?

বিহান মেনে নেয় তার ভাগ্যকে। হয়ত এসবের শেষটা এভাবেই ছিল।

#চলবে ….