দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-০৩

0
2

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ৩ (❌কপি করা নিষেধ❌)

“তোকে যা করতে বলছি, সেভাবে কর। সামনের মাসের শেষের দিকে ইলেকশন। কোনো জামেলা যেন না হয়।”

“জ্বী ভাই। যেভাবে বলছেন ঠিক সেভাবে হবে।”

মুগ্ধ ফোনে কথা বলতে বলতে বাড়ির পিছনের সাইডটায় চলে আসে। এখানে উপরে খুটির উপরে টিন দিয়ে নিচে পাকা করা একটা একটা জায়গা আছে। পিছনের পুকুরে গোসল করে বাড়ির মেয়েরা সাধারণত কাপড় বদলায় এই জায়গাটায়। মুগ্ধ সেখানে দাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে কথা বলছিল।

তখনই চোখ পড়ে কাছের একটা খালি ক্ষেতের উপর। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে সেখানটায়। সাদা ড্রেস পড়া খোলা চুলে একটা মেয়ে দু হাত মেলে ভিজছে। কখনো আবার পাশের বড় বড় ঘাসগুলোকে ছুয়ে দিচ্ছে।

পৌষের ঠান্ডা বাতাস কখনো কখনো ছুয়ে দিচ্ছে মেয়েটার সারা অঙ্গে। একটু আকটু কেপে উঠছে মেয়েটা। তবে ভিতরে যেন কোনো সংকোচ নেই। মুগ্ধ আরেকটু কাছে গিয়ে দেখতে লাগল। গ্রামের বলে মনে হচ্ছে না। গ্রামের ছোট পোকামাকড় থেকে শুরু করে তালগাছের ভুতটাকে অব্দি মুগ্ধ চিনে।

এইদিকে ভিজতে ভিজতে নবনী পাশ ফিরলে চোখ পড়ে কাছেই একটা বাড়ির উপর। পিছনের সাইড থেকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে বাড়িটা গ্রামের বাকি বাড়িগুলোর তুলনায় কিছুটা উন্নত। তবে বাড়ির সাথে গোসলখানা বা বাকিসব ফ্যাসিলিটিস হয়ত নেই। তবে মুগ্ধর উপর চোখ পড়তে নবনীও কিছুটা থেমে যায়।

দুজনেই দুজনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ বুঝে যায়, মেয়েটা গ্রামের না। গ্রামের মেয়েদের মাঝে খুব সংকোচ থাকে। যেগুলো শহরের মেয়েদের মাঝে থাকে না। হঠাৎ ঢাকায় গেলে তাকে নিয়ে ভার্সিটির মেয়েদের টানা হিচড়ের কথা মনে পড়তে বলে উঠে,

“সবগুলো এমনই। বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখাতে ব্যস্ত। যত্তসব।”

একটা ডোন্ট কেয়ার রিয়েকশন দিয়ে মুগ্ধ চলে যায়। এইদিকে নবনী ভাবে, ছেলেটার গেট আপ অনেকটা শহরের শিক্ষিত ছেলেদের মতো। তবে এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছিল? আর শেষে চেহারাটা অমন করল কেন? আজিবতো!

তাছাড়া নবনী যখন দেখেছে আশেপাশে কেউ নেই, তাইতো ভিজতে এলো। নয়ত পর পুরুষকে ভেজা শরীরের ভাজ দেখানোর তার কোনো শখ নেই।

মুগ্ধর ফেইসের রিয়েকশন দেখে নবনীর মেজাজটা বিগড়ে যায়। সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে আবার ওই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে,

“টিকটিকির কাটা লেজের বাচ্চা।”
……..

“নবনী কোথায় আন্টি?”

“এইতো কাপড় পাল্টাতে গিয়েছে। আর বলো না। বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে জ্বর না আনলেই হয়। তুমি চা টা নেও বাবা।”

বিহান নবনীর মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলো। সামনের ছোট বারান্দার চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক বসালো। তখনি চোখ পড়লো উঠানের পাশ ঘেষে খুব সাবধানে ধীরে ধীরে পা ফেলছে নবনী। মাত্র গোসল সেড়ে আসায় খুব ফ্রেস লাগছে।

লাল থ্রি পিছটা খুব ভালো মানিয়েছে। ভেজা চুল থেকে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। যেন সদ্য ফোটা কোনো লাল গোলাপের উপর পানির ফোটা পড়েছে। বিহান মাথা ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। ইশশ! মেয়েটার দিকে তাকালে হুশ থাকে না তার।

এতটা সুন্দর না হলেও তো পারত। পরে ভাবে, আসলে ও এতটাও সুন্দর নয়। হয়ত বিহারের মনে নবনীর জন্য অনুভূতিটা আছে বলেই তার চোখে সে এত সুন্দর। প্রত্যেক পুরুষের চোখে তার পছন্দের নারী সবচেয়ে সুন্দর।

“আরে, বিহান ভাই নাকি?” বুকে ওড়নাটা ঠিকঠাখ ভাবে ঢেকে দিয়ে প্রশ্ন করে নবনী। বিহান কালো শার্ট, কালো প্যান্ট পড়ে বসে আছে। কতটা বড় হয়ে গিয়েছে। একদম বিয়ের বয়সী পাত্রের মতো লাগছে। নবনী অবাক হয়। দু বছর আগেও তার বিহান ভাইকে কত ছোট মনে হতো। আর এখন সে কত বড় হয়ে গিয়েছে। অতঃপর খেয়াল হলো সে নিজেও তো এখন কত বড়। বিহান ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “কেমন আছিস?”

“এইতো আলহামদুলিল্লাহ। আপনি হঠাৎ এ সময়ে।”

“কেন আসতে পারি না?”

“না না। ওই ভাবে বলতে চাই নি।”

“নবনী একটু এদিকে আয় তো।” মায়ের গলা পেয়ে নবনী পাকের ঘরের দিকে চলে যায়। বিহান উকি দিয়ে ওর যাওয়ার আগ অব্দি ওকে দেখতে থাকে। হঠাৎ যেন তার বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠল। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করল।

“ভিতরে উঠা ঝড় থামাতে হলে তোকেই লাগবে।”

বিহান চা শেষ করে নিজের বাড়ি ফিরে যায়। কাল আবার আসবে। এবাড়ির সবার সাথে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো। আত্মীয় না হলেও বেশ আপন তারা। কারণও অবশ্য আছে। সাথে কিছুটা রহস্য।
…….

দুপুরে খাবারের সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে রেডি রেখেছে বাড়ির মহিলারা। আজ যেন আবার কোনো শনি না হয়। মতিসুর খেতে খেতে বলল,

“তোমার জন্য মেয়ে দেখছি একটা। বিয়েটা এবার করেই ফেল।”

মুগ্ধ খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে একবার তাকায়। এসব কি শুরু করেছে বাবা। কয়েকদিন যাবৎই এক কথা।

“আমি এখন বিয়ে করব না, বাবাহ।”

“তোমার কাছে অনুমতি চাইনি। আদেশ করছি। এক সপ্তাহ পর থানার ঐ খানে যে একটা রেস্টুরেন্ট খুলছে না নতুন, ঐ খানে গিয়ে মেয়ের সাথে দেখা করবে। পরিবারের সাথে কথাও হয়েছে।”

মুগ্ধ হাতের মুষ্টি শক্ত করে মায়ের দিকে তাকায়। মুগ্ধর মাও ছেলের বিয়ের কথা শুনে অবাক হয়। সে মুগ্ধর মা। অথচ তাকে জানানোর একটুও প্রয়োজন মনে করেনি মানুষটা। রাতে একটা বার অবশ্য বলতে পারত।

পরে খেয়াল হয়, সেতো বাইজি শালার মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। এসব কথা কি আর বলবে। মুগ্ধকেও জানতে দেয় না সেসব। মুগ্ধ জানে তার চাচার এই অভ্যাস থাকলেও বাবার নেই। মুগ্ধ এইদিকে আর চুপ থাকতে না পেরে বলে উঠে,

“আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট না করলে হয় না?”

“মুগ্ধ…!”

হুংকার দিয়ে উঠে মতিসুর।

“চিল্লাবেন না বাবা। যা সত্য তাই বলছি। এ বাড়ির প্রতিটা মেয়ের জীবনতো নরক বানিয়েই দিয়েছেন। খামোখা আরেকটা মেয়েকে এনে কষ্ট দেয়ার কি দরকার।”

শরীফ পাশ থেকে এই সুযোগটাই খুজছিল। আরেকটু আগুনে ঘি ঢালা যাক। সে ছিহ ছিহ করতে করতে বলে উঠল,

“এই পোলা নিয়া তুমি মুখ দেখাবা কেমনে ভাইজান। এ দেখি মাইয়া মাইনষের আচলের তলে থাকে। আর শুনলাম ঐ মেয়ে নাকি শহরের। আরো তলে ডুইকা থাকব। ঐসব মাইয়ারাতো আরো…”

“এনাফ। যেই মেয়েটা এ বাড়িতে আসে অব্দি নেই। তাকে নিয়েও বাজে কথা শুরু করেছেন আপনারা।”

মতিসুর ছেলের দিকে তাকিয়ে ইশারা দিয়ে চুপ থাকতে বলে। মুগ্ধ বুঝে যায়, তার বিয়ে করলে চলবে না। সে একা এতো চেষ্টা করেও এদের ঠিক করতে পারে নি। তার বৌ হয়ে যে আসবে, তার জীবনটা আরো জাহান্নাম হয়ে যাবে। মুগ্ধ কিছু একটা ভেবে শান্ত হয়। প্লান অনুযায়ী সব করলে মেয়েটা নিজেই বিয়ে ভাঙবে।
………

কাজ শেষে রুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে দেখতে থাকে শ্যামলী। নামের সাথে গায়ের রঙটাও যে বেশ শ্যামল। না নাহ! শ্যামল বললে হবে না। তার স্বামী তো তাকে কালো বলেই ডেকেছিল। হুমম, সে কালো। এজন্য বাসর রাতে স্নিগ্ধ কেদে কেদে তাকে বলেছিল,

“আমার কাছে কখনো স্ত্রীর অধিকার চাইবে না । তোমার মতো কালো মেয়েকে আমি কারো সামনে নিয়ে গেলে আমার সম্মান থাকবে না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। তুমি কষ্ট পেও না আমার কথায়। কিন্তু বুঝো প্লিজ, তোমার মতো মেয়ে কোনোদিন আমার স্বপ্নের রানি ছিল না।”

নিজের স্বামীর মুখে অন্যের কথা শোনাটা একটা মেয়ের জন্য মৃত্যুর থেকেও যন্ত্রণা দায়ক। মানুষটা কাদতে কাদতে এমন ভাবে শুয়ে পড়েছিল, যেন তাকে কেউ জাহান্নামের আগুনে ফেলে দিয়েছে। শ্যামলী সেদিন পুরোটা রাত শুধু শুয়ে শুয়ে স্নিগ্ধর মলিন চেহারাটা দেখছিল। কি সুন্দর মানুষটা! কতটা কষ্ট পেলে পুরুষ মানুষ এভাবে কাদে?

বিয়ের ছ মাস একবার তাকে ছুয়েও দেখেনি স্নিগ্ধ। দেখবেই বা কেন? তার সাথে তো কোনদিক দিয়েই এই মানুষটার যায় নাহ। কোথায় মেট্রিক পাশ করে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়া, কালো বর্ণের, বয়সে অনেক ছোট একটা মেয়ে। আর কোথায় দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র আর বর্তমান প্রফেসর! তাদের বয়সের মাঝেওতো কত তফাৎ। এই মানুষটা চাইলেই শহরের কোনো সুন্দর মেমসাহেবকে বিয়ে করে কত সুখে বন্ধুদের সামনে গর্ব করে বৌকে দেখাতে পারত।

তবে তার পোড়া কপাল। নিজের বাড়ির কাজের লোকের কুৎসিত মেয়েকে তার বিয়ে করতে হয়েছে। এজন্য হয়ত বিয়ের এক সপ্তাহ পরই পড়াশোনার নাম করে শহরে চলে যায় স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধর সাথে ওই কয়দিনে তার সাথে স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। দূরে দূরে থাকত মানুষটা। তবে তার সাথে খারাপ ব্যবহারও করত না। বুঝত যে এই মেয়েটারও তো দোষ নেই। তবে স্নিগ্ধর কষ্টের ছাপ চেহারায় ভেসে থাকত। এমন বৌকে স্ত্রীর স্বীকৃতি দেয়া তো দূরে থাক, বৌ হিসেবে পরিচয় করানোটাও পাপ হবে।

চোখের কোণে পানি জমতে থাকে শ্যামলীর। আচ্ছা, কালো হয়ে জন্মানোটা কি পাপ? তার লম্বা চুলের সৌন্দর্য, টানা টানা চোখ, শহুরে মেয়েদের মতো কথা বলতে চাওয়ার একটু ক্ষুদ্র চেষ্টা। এসব কি তার চোখে পড়ে না? ফোন দিয়ে একটু কথা বলতে নিলেও ব্যস্ততার নাম করে কেটে দেয়।

একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নিচে বসে পড়ে শ্যামলী। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে, স্নিগ্ধকে জোর না করাই ভালো। এসে তাকে দেখে আরো কষ্ট পাবে মানুষটা। তার থেকে সে পালিয়ে একটু খুশি থাকতে চাচ্ছে থাকুক না। তবে এসব কথাতো আর বাড়ির মানুষকে বলা যায় না। সবাই যখন জিগ্গেস করে, স্নিগ্ধ তার খোজ নেয় কিনা? শ্যামলী তখন সুন্দর করে মিথ্যে বানিয়ে বলতে থাকে,

“সেতো প্রতি রাতে আমার সাথে কথা বলে। আমি তো তার বাচ্চা বৌ। খোজ নিবে না কেন?”

কথা স্নিগ্ধ ঠিকই বলে, তবে সেটা বাস্তবে নয়। শ্যামলীর কল্পনায়। হঠাৎ কষ্টটা চেপে ধরে তার সমস্ত রিদয়। মুগ্ধকেও জোড় করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাতেই কী? নতুন বৌকে ঠিকই তার দেবর মেনে নিবে। শুনেছে মেয়েটা নাকি খুব সুন্দর দেখতে। শহরের ফ্লাটে থাকা মেয়ে বলে কথা।

সুন্দর মেয়েদের না মেনে নেয়ার কিছুই নেই। কিচ্ছু নাহ। দুনিয়ার সব দুঃখ কষ্ট শুধু কালো মেয়েদের জন্য।

#চলবে ……