দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-০৭

0
2

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ৭ (❌কপি করা নিষেধ❌)

রাতের আকাশে আজ চাদঁ উঠেছে। তবে আলো ছড়িয়ে জানান দিতে সে ব্যর্থ। কুয়াশার নিচে অনেকটা ডাকা পড়ে যাচ্ছে চাদের উজ্জল আলো। নবনী রাতের বেলা পিছনের বাগানে একা বসে আছে। চারপাশে গাছগাছালি, খুব অন্ধকার।

মা এসে কয়েকবার ডেকে গিয়েছে। সে তাও যায় নি। বাগানে ছোট্ট একটা লাইট ঝুলানো থাকে। সেখান থেকে একটু আকটু আলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। অন্যসময় হলে কত ভয় হতো। তবে আশ্চর্য ! এখন একটুও ভয় করছে না তার।

বিকেলের কথা কোনোভাবেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না সে। এত সুন্দর মানুষটার মনটা এত নিকৃষ্ট। পাশে থু মেলে নবনী। আর একা একা বলে উঠে,

“তাও ভালো। নিজে থেকেই বিয়ে ভেঙে দিবে। এমন কুরুচিপূর্ণ মানুষের সাথে থাকতে হবে না আমার।”

তবে দুইটা বিষয় বেশ ভাবাচ্ছে নবনীকে। প্রথমত মুগ্ধ এখনো কল করে বিয়ে ভাঙছে না কেন? বিকেলের কথা কাউকে বলেনি নবনী। ভেবেছিল মুগ্ধ একাই কল করে সব বলবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে তার নানাকে নিয়ে।

নানাভাইয়ের হাফভাব একদম ঠিক ঠেকছে না নবনীর। কি এমন হলো যে, বিহানের বাবার সাথে সম্পর্ক খারাপ করে মুগ্ধর বাবা চাচার সাথে সম্পর্ক জুরতে গেল। সকালে ডেকেও এমনভাবে কথা বলছিল যেন, এই বিয়ে নবনীর করতেই হবে। এমন সময় কিছুটা দূরে, পুকুরের পারে কাউকে কথা বলতে শুনে নবনী। আগ্রহ নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে আড়াল থেকে দেখতে থাকে। তার নানাভাই কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে।

“আরে রাহেলা, চিন্তা করো না। ওরা কেউ কিচ্ছু বুঝবে না।”

“…….”

“আরে হ্যাঁ। তুমি যেভাবে বলছ সেভাবেই করছি। ওদের সাথে সম্পর্ক এতে আরো মজবুত হবে।”

“……..”

“কেউ কিছুই বুঝবে না। নবনীর বিয়ে আমি করিয়েই ছাড়ব। টাকাও তুমি পেয়ে যাবে রাহেলা।”

রাহেলা নামটা শুনে নবনীর বুকে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠল। নানা এখনো ঐ মহিলার সাথে সম্পর্ক রাখছে? ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসল নবনীর। সবার সামনে এত ভালো সেজে থাকে মানুষটা। অথচ ভিতরে ভিতরে প চে গলে শেষ।

রাহেলা হলো নবনীর নানার প্রাক্তন প্রেমিকা। নানি বেচে থাকতেও অনেক আগে এই মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল মানুষটা। তখন নবনীদের জন্মও হয়নি। মামিদের মুখে এসব শুনেছে। পরে অবশ্য সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে সে সম্পর্কের ইতিও টানে সে।

এসব ব্যাপারে বেশি একটা কথা বড়রা বলে না। তবে যতটুকু নবনী শুনেছে, রাহেলা মহিলাটা ভালো না।

নবনী কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। আর নানা কিসের কথাই বা বলছিল। এদিকে কল রেখে যেই না নানাভাই এদিক ফিরবে, নবনী আরেকটু আড়াল হয়। সে চলে গেলে, নবনী তার মায়ের কাছে যায়। তবে কিছুই বলে না। কারণ তার বলার সাহস নেই। প্রমাণ ছাড়া নিজের বাবাকে নিয়ে এমন বাজে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।

নবনী সিদ্ধান্ত নেয়। যেভাবেই হোক বিয়েটাকে আটকাতে হবে। হয়ত এই বিয়ের পিছনে তার নানা বসিরের বড় কোনো প্লান আছে। নিজের রুমে গিয়ে নামাজে দাড়ায় নবনী। একটু আগেই এশারের আজান দিয়েছে। খোদার কাছে সাহায্য যায়। এখন যে সে খুব অসহায়।
………

উঠোনের একপাশে একটা খালি জমি। জমির পাশ ঘেষে লিচুবাগান। সেখানেই এক সাইডে দাড়িয়ে আছে মুগ্ধ। দুহাত পকেটে ভরে দূরের নদীটার দিকে তাকিয়ে আছে। এখান থেকে স্কুল আর নদীটা খুব পরিষ্কার দেখা যায়।

মুগ্ধ ভাবে, মেয়েটার তেজ আছে খুব। তবুও, এই বাড়িতে টিকতে গেলে যতটা দরকার। ততটা হয়ত নেই।

এমন সময় পিছনে কারো উপস্থিতি টের পায় মুগ্ধ। তবে নবনীর চিন্তায় এতটাই মগ্ন ছিল, কে তা দেখার প্রয়োজন মনে করে না।

“কেমন দেখলি?”

মুগ্ধ কন্ঠটা শুনে বুঝে এটা স্নিগ্ধ। ভাইয়ের কাছে কিছুই লুকায় না সে। কিছুটা সময় চুপ থেকে বলতে শুরু করে,

“💜তার চোখ! যেনো জীবন্ত কোনো সমুদ্র! চোখের মণিটাকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল সমুদ্রের মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপ। যার কাছে এই আমিটা, যার জন্য এত মেয়ের এতো পাগলামি, সবটাই খুব তুচ্ছ। আর তার ঠোটদুটো? মনে হচ্ছিল কেউ রং তুলি দিয়ে হার্ট সেইপ একে দিয়েছে।

তার কথা বলা? ব্যক্তিত্ব? এত শক্ত মনোবল, সাহসী ব্যক্তিত্বর কাছে আমার এত রাগ, তেজ, অর্থ, সম্পদ, সবকিছু যেন বিশাল বালুচরের মাঝে একমুঠো ভেজা বালু। কিংবা তার থেকেও নগন্য।

আমি পরিষ্কার চোখের সামনে ঐ মেয়েটার কাছে নিজের আত্মাকে সপে দিতে দেখছি। অথচ আমার শরীরটা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে। কিছুই করতে পারছে না। যেন সে একটুখানি পবিত্র ছোয়া না পেলে একদম শেষ হয়ে যাবে। একদম শেষ!”

স্নিগ্ন হা করে তাকিয়ে থাকে। তার ভাই আবার কবে কাব্যিক হয়ে গেল।

“আরে বাস….! মুগ্ধ ভাইয়া দেখি মাইয়া মাইনসের রূপে আটকাইছে। হি হি।”

স্নিগ্ধ, মুগ্ধ দুজনেই পিছে তাকায়। শাওন দাত কেলিয়ে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধ বলে,

“তুই কখন এলি?”

“এইতো মুগ্ধ ভাইয়ের মনে যখন শহরের মাইয়া সাতার কাটছিল তখন।”

মুগ্ধ কিছুটা লজ্জা পায়। শাওনকে দেখলে কখনোই এসব বলত না সে। এই ছেলে প্রথমে পুরু বাড়ি করবে, পরে পুরু এলাকা। পারলে বড় রাস্তার মোরে মাইক লাগিয়ে ঘোষনা দিবে মুগ্ধ প্রেমে পড়ছে। মুগ্ধ পকেট থেকে পাচশ টাকার একটা নোটবের করে শাওনের হাতে দিয়ে বলে,

“ভুলেও কাউকে কিছু বলবি না। এটা রাখ।”

শাওনও নির্লজ্জের মতো টাকাটা নেয়। তবে মনে মনে ভাবে, কাউকে না বললেও মাহিকে বলবে। ঐ মেয়ে তাকে খুব অপমান করে। এই সুযোগে ভালো চেতানো যাবে। তবে এটাযে কত বড় ভুল তা ও নিজেও জানে না।

সবাই বাড়ি চলে আসে। আজ আর কাউকে এ বিষয় নিয়ে কথা বলবে না মুগ্ধ। আগামীকাল ইলেকশনের ব্যানার বানাতে হবে। সেদিকে কতো জামেলা।

……

রাত পোহাতেই সূর্যিমামার আলো জানালার ফাকা দিয়ে একটু আকটু উকি মারতে শুরু করে। তবে যতটা হওয়ার কথা ততটা না। শীতে একদম বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না নবনীর। তাও সে একটু আগে উঠেছে আজান পেয়ে।

নামাজ শেষে ফোনটা হাতে নিতেই দেখে বিহানভাইয়ের মিসড কল। সাথে একটা মেসেজ,

“আমি এখন বাগানে আছি। একটু আয় তো। তোর সাথে কথা আছে।”

নবনী উঠে বসে। যাবে কি যাবে না ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় যাবে। বিহান ভাই তার নিজের কাজিনদের মতোই। যাওয়াই যায়। নবনী ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দরজা খুলে পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। গিয়ে দেখে একটা হুডি পড়ে হাতে হাত মুজা পড়ে বিহান দাড়িয়ে আছে।

“বিহান ভাই? এত সকালে?”

“তোকে কিছু বলার ছিল। আসলে সাবধান করতে চাইছিলাম।”

“কোন ব্যাপারে?”

বিহান তারপর বলতে শুরু করে। যেই ছেলেটার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাদের বাড়ির সব ইতিহাস। মুগ্ধ ছেলেটাও ভালো না। মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করে। গ্রামের কেউ নাকি তাকে দেখতে পারে না। আরো হাবিজাবি। যদিও এসব কথার সিংহভাগ জুড়ে ছিল বিহানের মিথ্যা বানানো গল্প।

তবে নবনী সবকিছুই বিশ্বাস করে নেয়। কারণ গতরাতে নানার কথা শুনে বুজেছে, যেখানে তার স্বার্থ লুকিয়ে আছে। ছেলেটা ভালো না হবারই কথা।

“আচ্ছা ভাইয়া। আমি দেখছি কি করা যায়।”

“কি করা যায় দেখলে হবে না। বিয়ে ভাঙতেই হবে। তোকে আমি অন্যকারো হতে দেখতে পারবো না।”

নবনী ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, “মানে?” বিহান কিছুটা গাবড়ে গিয়ে কথা বদলিয়ে বলে,

“মানে ভুল কারো হয়ে জীবন নষ্ট করতে দেখতে পারব না।”

নবনী সেখান থেকে চলে আসে। মা ঘুম থেকে উঠলেই সব বলে দিবে। নানাভাইকে নিয়েও। এতে যা হবে হোক। এদিকে বিহান একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলে একা একা বলে উঠে,

“তুই আমার নবনী। তোকে আমি কখনোই অন্য কারো হতে দিবো না।”

#চলবে …..