#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-সতেরো
মাহবুবা বিথী
নারীরা যতই এগিয়ে যাক না কেন তবুও আমাদের সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণাটা এখনও বেশ প্রকট। মাহফুজকে দেখে আমি বুঝতে পারি। এটা ঠিক ও আমার বাবার মতো”আমি পুরুষ”এই অহমিকা দেখায় না তারপরও আমি অনেক বিষয় খেয়াল করেছি কিছু কিছু কাজ ও অস্বস্তি নিয়ে করে। যেমন বেশ কিছুদিন আগে আমার শরীর প্রচন্ড খারাপ থাকাতে ও নিজ থেকেই আমার পা,টা ম্যাসেজ করে দিয়েছে। তারপরও আমি ওর চেহারায় একটা অস্বস্তি ভাব দেখেছি। যে বিষয়টা
আমার ক্ষেত্রে থাকে না। আমিও তো ওর শরীর খারাপ থাকলে হাত পা ম্যাসেজ করে দেই।
আসলে ওর দোষ নেই। ও যখন বড় হয়েছে তখনকার বউদের তো স্বামী আর স্বামীর বাড়ির মানুষদের যত্ন আত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে। সেটা ওর মা হোক আর আমার মা হোক। বিষয়টা এমন যেন স্বামী অন্ত প্রাণ।উনারা যেন সেই দাসখত দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে আসেন। আমার চোখে আমি বাবাকে দেখেছি। দাদী যতদিন বেঁচে ছিলেন আব্বু পানিটাও আম্মুর দ্বারা ঢেলে খেয়েছেন। অথচ আব্বুকে আমি দাদীর কাপড় ভাঁজ করে দেওয়া ভেজা কাপড় মেলে দেওয়া মশারী খাটিয়ে দেওয়া এগুলো করতে দেখেছি। অবশ্য সবসময় আব্বু করেননি। যখন আম্মু কাজের চাপে আর পেরে উঠতেন না তখনি করতে দেখেছি। অথচ সেই মানুষটা দাদী মারা যাবার পর আম্মুকে ভালোই সহযোগিতা করে। এখন যেহেতু অবসরে গিয়েছে আম্মুকে অনেক কাজেই সাহায্য করে। ভাত রান্না করা,মেশিন থেকে কাপড় নিয়ে মেলে দেওয়া, শুকিয়ে গেলে আবার ভাঁজ করে ক্লসেটে তুলে রাখা,এমনকি কাজের লোক ছুটিতে থাকলে প্লেট বাসন ধুয়ে দেওয়া ইত্যাদি নানারকমভাবে আব্বু আম্মুকে সাপোর্ট দেয়। মাঝে মাঝে আমাকে আব্বু বলে,
—-এতো করেও তোর আম্মুর মন পাওয়া যায় না।
আমিও মজা করে বলি,
—-বিয়ের বত্রিশ বছরে যেহেতু মন পাওয়ার চেষ্টা করোনি তাই এখন তো কাঠখড় একটু বেশী পোড়াতে হবে।
আমি আম্মুর বিষয়টা বুঝি। আম্মুর বয়স যখন কম ছিলো তখন যদি আব্বুর এই প্যাম্পারটা করতো আম্মু ষনেক এনজয় করতো। কিন্তু এখন জীবন সংসারের জটিলতায় আম্মুর সেই সুকুমার মনটার বিনাশ ঘটেছে। তাই আব্বুর এই পরিবর্তনগুলো আম্মুকে আলোড়িত করে না।
তবে আমার বিয়ের পর আব্বু অনেক চেইঞ্জ হয়েছে। বিশেষ করে আমার প্রতি মাহফুজের কেয়ারিং আব্বুকে পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। সামনে আমার ছোটো বোন সারাহ্ র পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে। ওর গ্রাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ঢাকা ভার্সিটির টপার গার্ল। অলরেডী পিএইচডির জন্য ওয়াল্ডের বিভিন্ন প্রফেসরের কাছে এসওপি পাঠানো শুরু করেছে। তারমানে ও বাইরে চলে যাবে। আর আমার ভাই শাদাফ তো বুয়েটে মেকানিক্যাল পড়ছে। জানি না ও কি করবে। আসলে আব্বু খুব কৌশলি। এখন আম্মুর পাশে ঘুরঘুর করার একটাই কারণ আম্মু যেন আব্বুকে কেয়ার কিংবা ভালোবাসার মধ্যে রাখে। আসলে পুরুষ মানুষগুলো বুঝে না। তারা প্রেমিক থাকা কালীন প্রেমিকার জুতোটাও বইয়ে নিতে সমস্যা হয় না কিন্ত স্বামী হওয়া মাত্রই প্রতিমুহুর্তে স্বামিত্ব ফলানোর চেষ্টা করে। যদিও এখন পর্যন্ত মাহফুজ আমার সাথে তেমন আচরণ করেনি। আসলে স্বামী হওয়ার থেকেও সুখ দুঃখের সাথী কিংবা বন্ধু হওয়াটা জরুরী।
নানা কথার ভাবনায় বেলা অনেকটা আমার গড়িয়ে গেল। আসলে আমার মনটা ভালো লাগছে না। মাহফুজকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার কমনওয়েলথের মতো এতো বড় সম্মানের একটা স্কলার্শিপ মিস করতে মন চাইছে না। এটা আমার জন্য একটা খারাপ রেকর্ড হতে পারে। তাছাড়া এখন চাকরির যা অবস্থা আমি এরকম তেলবাজী করে চাকরি করতে পারবো না। আজ বেশ গরম পড়েছে। চৈত্রের শেষ তাতেই গরমে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এপ্রিল মাসের আজ দুই তারিখ। রংপুরের আবহাওয়াটা আমার কাছে মনে হয় একটু চরমভাবাপন্ন। শীতকালে যেমন প্রচন্ড শীত পরে তেমনি গরমটাও বেশ তীব্র হয়। তার উপর বিদ্যুত চলে যাবার প্যারা তো আছে। যদিও আইপিএস আছে তারপরও বিদ্যুত না থাকলে চুলা জ্বালাতে পারি না। রান্নার সমস্যা হয়। ফ্রীজ থেকে খাবার বের করে ওভেনে গরম করা যায় না। এখনও বিদ্যুত নাই। রান্নাটা করতে পারছি না।আজ কলেজে আমার ক্লাস ছিলো না বলে বাসাতেই আছি। পরীক্ষার খাতাগুলো দেখতে হবে। সব চোখের সামনে টাল হয়ে আছে। ওদিকে কোয়ার্টারে আমাদের ফার্ণিচারগুলো প্যাকিং করা অবস্থায় আছে। ওগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
মাথার উপরে ফ্যানটার গতি হঠাৎ বেড়ে গেল। মনে হয় বিদ্যুত চলে এসেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বারোটা বাজে। বিছানা থেকে উঠে কিচেনে গিয়ে ভাতটা রাইস কুকারে চাপিয়ে দিলাম। করল্লা কুচি করে কেটে নিলাম। তার সাথে একটা আলুু কুচি করে কেটে নিলাম। ইলেকট্রিক চুলাটা অন করে তাতে কড়াই বসিয়ে করল্লার ভাজি চাপিয়ে দিলাম। দুটো পেয়াজ কুচি করে কেটে দিলাম। লবন হলুদ তেল দিয়ে একটা ঢাকনি দিয়ে কিছুক্ষনের জন্য ঢেকে দিলাম। আর একটা তরকারী রান্না করবো। বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ। এই রেসিপিটা আমার দাদী কাছে শিখেছি। পেয়াজ ছাড়া তরকারী। ভালোই লাগে। আমার আসলে পেয়াজ কাটতে মন চায় না। কাটার আগেই দু,চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরতে থাকে। পেয়াজ কাটাতো দূরের কথা কান্নার ঠেলায় কিছুই আর দেখা যায় না। মাহফুজ বাসায় থাকলে ও বরাবর পেয়াজ কেটে দেয়। আজ আবার কাজের খালা ছুটি নিয়েছে। ওর স্বামী নাকি ওকে প্রচন্ড মেরেছে। শরীরের ব্যথায় বিছানা থেকে উঠতে পারছে না।
ভাজিটা হয়ে এসেছে। এরমাঝে ইলিশ মাছটা লবন হলুদ মাখিয়ে হালকা ভেজে নিলাম। চুলায় একটা পাতিলে পরিমানমতো পানি দিয়ে বসিয়ে দিলাম। তাতে লবন হলুদ, মরিচের গুড়া আর পরিমানমতো তেল দিয়ে বসিয়ে দিলাম। এর মধ্যে বেগুন আর আলু কেটে নিয়েছি। পানিটা ফুটে উঠা মাত্রই বেগুন আর আলু ফুটন্ত মশলাযুক্ত পানিতে ছেড়ে দিলাম। কয়েকটা কাঁচা মরিচ দিয়ে দিলাম। দশ মিনিট ফোটার পর ইলিশ মাছটাও দিয়ে দিলাম। এরপর ঝোলটা ঘন হয়ে এলে ভাজা ঝিরেগুরো আর ধনে পাতা দিয়ে নামিয়ে নিলাম। ইলিশ মাছের এই রেসিপিটা মাহফুজের খুব পছন্দ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো বাজে। ডোরবেলটা বেজে উঠলো। মনে হয় মাহফুজ এসেছে। দরজা খোলা মাত্রই মাহফুজ একগাল হেসে দিয়ে বললো,
—-তোমার রান্নার সুবাস একদম সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। নিশ্চয় আমার সেই ঐতিহাসিক ইলিশ মাছের কারিটা রেঁধেছো।
—-হুম,
—-তুমি এখনও শাওয়ার নাওনি? ঘেমে তো ম্যাক্সিটা গায়ের সাথে লেগে আছে। শরীরের সৌন্দর্যটা বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে।
—-চোখটাকে একটু সামলে রাখো।
ও আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-আল্লাহপাক বলেছেন, আজলা ভরে বৌয়ের রুপসুধা পান করতে। যাতে পরনারীর দিকে দৃষ্টি না যায়।
নিজেকে ওর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
—-যে পুরুষের নজর খারাপ তার নিজের বউয়ের থেকে পরের বউ বেশী ভালো লাগে।
—-মেরি জান,এ বিষয়ে ডিবেট শুরু হলে কত রাত আর দিন যে পার হয়ে যাবে তার কোনো অন্ত নাই। আমার ক্ষিদে লেগেছে জান,তুমি তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে আসো।
আমি শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। মাহফুজের এই দুষ্টমিগুলো আমার ভীষণ ভালো লাগে। যদিও আমি ওর সামনে কপট রাগ দেখাই কিন্তু বাস্তবে আমি খুব এনজয় করি। যদি ইংল্যান্ডে চলে যাই তাহলে মাহফুজের এই ছোটো ছোটো ভালোবাসার কিয়দংশগুলো আমি খুব মিস করবো। এগুলোই ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি দ্রুত শাওয়ার নিয়ে এসে যোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। কিচেনে গিয়ে দেখি আমার উনি টেবিলে ভাত বেড়েছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমিও খেতে বসলাম। মাহফুজকে খুব তৃপ্তি করে খেতে দেখলাম। এরকম করে আমার হাতের রান্না এতো তৃপ্তি করে মাহফুজ ছাড়া কেউ খায়নি। এজন্য আমার রাঁধতে ভালো লাগে। আমার যতই কষ্ট হোক মাহফুজের জন্য রাঁধতে আমি খুব ভালোবাসি। ও এতো তৃপ্তি করে খায় যেটা দেখলে আমার দুচোখ জুড়িয়ে যায়। রান্না করার স্বার্থকতা খুঁজে পাই।
চলবে