দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-১৮

0
99

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-আঠারো
মাহবুবা বিথী

কোয়ার্টারটা গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়লাম। আরো আগেই হয়তো উঠে পড়তাম পরীক্ষার চাপ থাকায় আমি মাহফুজকে সময় দিতে পারিনি। পরীক্ষা থাকলে মাথায় বাড়তি চাপ থাকে। সিলেবাস ঠিক সময়ে শেষ করতে হয়। প্রশ্নপত্র রেডী করা খাতা দেখার চাপ তো আছে। এখন একটু ফ্রী আছি। যদিও পরীক্ষার খাতা এখনও জমা দেওয়া বাকি আছে।
মাহফুজের অফিস থেকে দুটো পিয়ন এসে ফার্ণিচার সেটিং করতে সাহায্য করেছে তারপরও কাপড়গুলো গুছিয়ে ক্লসেটে নিজেকেই তুলে রাখতে হয়। কিচেনটাও নিজেদের গুছাতে হয়। মাহফুজ জানালার পর্দাগুলো লাগিয়ে দিয়েছে। সোফার কুশনের কভারগুলো লাগিয়ে ড্রইংরুমটা গুছিয়েছে। দু,জনের উপরেই খুব চাপ গেল। ডরমেটরীতে মাহফুজের একটু সমস্যা হচ্ছিলো। তাছাড়া আমার শাশুড়ী মা আসতে চেয়েছেন। আমিও ভাবলাম,যদি আমাকে বৃটেনে চলেই যেতে হয় সেক্ষেত্রে শাশুড়ী মা এসে থাকলে মাহফুজের সময়টা ভালোই কাটবে। আর মাস্টার্সের প্রোগ্রাম একবছরের। দেখতে দেখতে সময় চলে যাবে।

মাহফুজের কাছে আমার বাইরে চলে যাবার কথাটা আর চেপে রাখা ঠিক না। ভাবছি আজকে ওকে সব জানিয়ে দিবো। সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমাকে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাতে হবে। ক্লাস শেষ করে কলেজ থেকে বের হবার সময় আবার ও আমার ঐ স্টুডেন্টের ভাইয়ের সাথে চোখাচোখি হলো। সেই দৃষ্টিতে আমি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেখতে পাই। এখন যেন সেটা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাহফুজ ওকে জেলে ভরতে চেয়েছিলো। কিন্তু আগাম জামিন নিয়েছে। একারনে হাসির সাথে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার দিকে ছুড়ে দেয়। তাতে আমি খুব অস্বস্তি বোধ করি। বদলি নিয়ে অন্য জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু শুনলাম সব জায়গাতে একই অবস্থা। তার উপর মাহফুজ বদলি হয়ে এসেছে কেবল চারমাস হলো। এরমধ্যে আবারও বদলি হওয়া যাবে না। এখানেই আমাকে আরো কিছুদিন থাকতে হবে। সেদিক থেকে বাইরে চলে যাওয়াটাই আমার কাছে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়।

আমি ক্লাসে পারতপক্ষে ঐ ছাত্রীর সাথে কথা বলি না কিংবা ওকে একটু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কারণ অন্যায়ের কাছে আমি কখনও মাথা নত করিনি। একটা অন্যায়কে ঢাকতে গেলে হাজার অন্যায় করতে হয়। প্রিন্সিপাল ম্যাম উনার ক্ষমতা বলে মেয়েটা ফেল করা সত্বেও পাশ করিয়ে দিয়েছেন। অথচ ঐ ছাত্রী আমার সাবজেক্টে ফেল করেছে। আমি পাশ করিয়ে দেইনি বলে ছাত্রীর ভাই এসে রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছে পাশ মার্ক আদায় করে নিয়েছে। কারণ হিসাবে ম্যাম বলেছে, এই সামান্য কারনে উনি উনার গদি হারাতে চান না। এই যদি হয় চাকরির অবস্থা কিংবা শিক্ষকদের এভাবে স্টুডেন্টের সামনে মাথা নোয়াতে হয় তাহলে একটা সুশিক্ষিত জাতি কিভাবে গড়ে উঠবে? আর শিক্ষকরা যদি তার ক্ষমতা প্রতিপত্তির লোভে পরে এভাবে নতজানু হয়ে অন্যায়কে সমর্থন করে তাহলে সুশিক্ষিত জাতি গঠনে তারাই বা কি ভুমিকা রাখবে?

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা অটো পেলাম। আমি অটো তে উঠা মাত্রই আমার ঐ ছাত্রীর ভাই তার বোনকে নিয়ে বেশ জোরে বাইক চালিয়ে ধুলো উড়িয়ে আমার অটোর পাশ দিয়ে চলে গেল। আমিও বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম। ব্যাগের ভিতর ফোনটা বেজে উঠলো। মোবাইল বের করে দেখি মাহফুজ ফোন দিয়েছে।
—-হ্যালো,তুমি কি রওয়ানা দিয়েছো?
—-হুম,
—-আমি বাসায় চলে এসেছি। তুমি তাড়াতাড়ি আসো। কথা আছে।
ফোনটা রেখে আমি একটু অবাক হলাম। কি এমন কথা যার জন্য এতো জরুরী তলব। অটো ড্রাইভারকে দ্রুত চালাতে বললাম। বাসায় পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ডোরবেল বাজাতেই মাহফুজ এসে দরজা খুলে দিলো। আমি ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—কি কথা বলতে চেয়েছিলে?
—-জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় থেকে চিঠি এসেছে। আমাকে ওএসডি করা হয়েছে। এটা নাকি শাস্তিমূলক আদেশ।
—-তুমি তো কোনো দোষ করোনি তাহলে শাস্তির আদেশ হবে কেন? ডিসি স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছো? তোমাকে এমন পোস্টিং কেন দেওয়া হয়েছে?
—-করেছিলাম,
—–উনি কি বলেছেন?
—-উপরের আদেশে হয়েছে। এ ব্যাপারে উনি কিছু জানেন না।
আমার তখন কলেজের সামনে ঐ ছাত্রীর ভাইয়ের দৃষ্টিটার কথা মনে পড়লো। একটা অজানা ভয় আমাকে কেন যেন চারিদিক থেকে গ্রাস করে নিতে চাইছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে মাহফুজকে সান্তনা দিয়ে বললাম,
—- এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ভয় পেলে তুমি সামনে এগুতে পারবে না। দেখি না কি হয়? তোমাকে আমার একটা কথা জানানো হয় নাই। আমি মাস্টার্স প্রোগ্রামে কমনওয়েলথ স্কলার্শিপ পেয়েছি। এই সেপ্টেম্বরে আমাকে যেতে হবে।
—-কবে এতো কিছু করলে আমি তো কিছুই জানলাম না।
—স্কলার্শিপ পাবো কিনা তার তো কোনো ঠিক ছিলো না। এই কারনে কাউকেই বলিনি।
—-যাক ভালোই হয়েছে। চাকরির নোংরা পলিটিক্স থেকে কিছুদিন দূরে থাকতে পারবে।
মাহফুজ কথাগুলো খুব মলিনভাবে বললো। ওর কথাগুলো শুনে আমার ভীষণ খারাপ লাগলো। আমি ওকে উৎসাহিত করার জন্য বললাম,
—–তুমিও পিএইচডওর জন্য আবেদন করো।
—–তা,না হয় করলাম। কিন্ত এই ওএসডি হওয়ার ব্যাপারটা কিভাবে সামলাবো সেটাই ভাবছি। যখন অফিসে যাবো না সবাই ভাববে আমার চাকরি নাই। তাছাড়া আর দু,দিন পরেই রোজা শুরু হবে। এরপর ঈদের ছুটিতে বাড়ি গেলে এই ইস্যু নিয়ে নানাজনে নানাকথা বলবে।
—-ওসব নিয়ে এখন আর ভেবো না। তুমি বরং পিএইচডির এপ্লাই করো। আর ওএসডি হওয়ার খবরটা কাউকে বলো না। এবার আমরা রংপুরেই ঈদ করবো।
—-এসব খবর চাপা থাকে না। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সুতরাং সবাই জেনে যাবে। ঈদটা বাড়িতেই করতে হবে। তা,না হলে আব্বু আম্মু কষ্ট পাবেন।
ওকে আর কিছু বললাম না। তবে আমি নিশ্চিত এই কাজ আমার ঐ ছাত্রীর ভাই করেছে।

এরপর আমাদের সাজানো গোছানো জীবনটায় ঝড়ের আভাস দেখা গেল। মাহফুজকে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে সিফট করা হয়েছে। মাহফুজকে মানুষের নানা রকম কথা হজম করতে হচ্ছে। মাহফুজের ওএসডি হওয়ার কারনে আমার শ্বশুর শাশুড়িও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। এই সুযোগে অবশ্য আমি আত্মীয়স্বজন চিনলাম। মাহফুজ ঢাকায় গিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে জয়েনিং লেটার জমা দেওয়ার সময় আমিও সাথে গিয়েছিলাম। ঐ সময় আমার ভাসুরের বাসায় বড় জায়ের বাবা মায়ের সাথে দেখা হলো। আমার জায়ের বাবা তো মাহফুজকে বললেন,
—-তুমি কিছু মনে করো না। কিন্তু আমি যতটুকু জানি দূর্নীতি করলে এ ধরনের শাস্তিমুলক পোস্টিং হয়। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে কেন হলো বুঝলাম না। তবে কি জানো বাবা দূর্নীতির টাকা সবার সহ্য হয় না। অনেক সময় বউয়ের চাহিদা মেটানোর জন্য স্বামীরা দূর্নীতি করে। বউয়ের শাড়ি গয়না এমনকি বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, এসব টাকা যোগাড় করতে গিয়ে স্বামীরা হিমশিম খায়। তখন বাধ্য হয়ে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে।
কথাগুলো আমার আর মাহফুজের জন্য হজম করা কঠিন হয়ে গেল। কারণ ক,দিন আগে আমি আর মাহফুজ থাইল্যান্ডে ঘুরতে গিয়েছিলাম। এটা সম্পূর্ণ আমাদের হালাল টাকা। কিন্তু মানুষের চরিত্র এমন সুযোগ পেলেই খোঁচা দিতে দ্বিধা করে না। তাই ঢাকায় না থেকে সে রাতেই বাসে করে আমরা রংপুরে চলে আসি। বেশ খারাপ সময় যাচ্ছে আমাদের। মাহফুজ সারাদিন বাসায় মনমরা হয়ে বসে থাকে। আমি ও শুধু ক্লাস থাকলে বের হই। তা,না হলে পুরোটা সময় বাসায় থাকি। রমজান মাস থাকাতে ইবাদত বন্দেগীতেই আমাদের সময় কাটে। এদিকে আমার শ্বশুর মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে ওর পোস্টিং এর খবর জানতে চায়। চাকরির জন্য হা হুতাশ করে। আমার বাবাও ফোন দিয়ে মাহফুজের পোস্টিং এর বিষয় জানতে চায়। ইদানিং মাহফুজ কারো ফোন রিসিভ করতে চায় না। অগত্যা আমাকেই ধরতে হয়। সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে হয়। ঘরে থাকলেও বলি নাই। কিংবা ওয়াশরুমে আছে।এরমাঝে আমি আমার কাগজপত্র সব রেডী করতে থাকলাম। অবশেষে মাহফুজ রংপুরেই ঈদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যদিও বিয়ের পর প্রথম ঈদ আমাদের খুব সাদামাটা ভাবেই কাটলো।

এভাবে দু,মাস পার হয়ে গেল। মাহফুজ মানসিকভাবে ভালো নেই। মুখ ভর্তি দাঁড়ি। সারাদিন নামাজ বন্দেগীতে সময় কাটায়। কিন্তু হঠাৎ করেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠে। কারণ এরমাঝে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের রিটের ফলে ২০১৮সালের “কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন” বাতিল ঘোষণা করে। এতে ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ওরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু তৎকালীন সরকার ছাত্রদের এই আন্দোলন আমলে নেয় না। এমনিতেই গুম খুন বিনা ভোটে নির্বাচন দ্রব্যমুল্যের উর্দ্ধগতি, আকাশ ছোয়া দুর্নীতি,চাঁদাবাজি,ব্যাংক দেওলিয়া হয়ে যাওয়াতে জনগন ক্ষোভের আগুনে পুড়ছিলো। যার ফলে ছাত্রদের এই আন্দোলনে সাধারণ মানুষ অংশ নেয়। আমার কলেজের ছাত্রীরাও এই আন্দোলনে অংশ নেই। এমনকি প্রিন্সিপাল ম্যামের চোখরাঙ্গানীকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দলেদলে ছাত্রীরা মিছিলে অংশ নেয়।

চলবে