দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০৬

0
4

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

—-তো, এখনকি আমায় প্রমান করতে হবে তুমি না,আমিই সারাজীবন তোমার গোলামি করে যাবো?
—-ফারাহ্, প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করো। উনি যে শতাব্দীর মানুষ তখন যুগটা এখনকার মতো উদার মানসিকতার ছিলো না। উনি উনার শাশুড়ীর কাছে যেরকম ব্যবহার পেয়েছেন উনিই এখন সেটাই দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এমনসময় আমার শাশুড়ী এসে বললেন,
—-ফারাহ্ উঠেছো?
—জ্বী মা,
—-তোমার শ্বশুর আর দাদীকে দুকাপ চা বানিয়ে দাও তো মা?
— আসছি মা।
আমার সাথে সাথে মনে হলো, বুড়িরে লবন আর ঝাল দিয়ে চা বানিয়ে দিলে কেমন হবে। তাহলে আমার হাতে আর কোনোদিন চা বানিয়ে খেতে চাইবে না। আমার বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মাহফুজ মনে হয় কিছু একটা আঁচ করতো পেরেছিলো। তাই আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-প্লিজ, এমন কোনোকিছু করো না যাতে আমার সম্মান হানি হয়।
আমি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে মুখে একটু লোশন চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা করে লিপলাইনার বুলিয়ে নিলাম। এরপর কিচেনে গিয়ে শাশুড়ী মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি চায়ের পানি আগেই চুলায় বসিয়ে দিয়েছিলেন। আমি চা,পাতা দিয়ে আর একটু ফুটিয়ে নিয়ে নামিয়ে নিলাম। দুধ মিশিয়ে চিনি আলাদা একটা পাত্রে নিয়ে উনাদের কাছে নিয়ে গেলাম। আমার শ্বশুর আর চাচাতো দাদীশাশুড়ী উঠোনে বসে গল্প করছিলেন। চায়ের ট্রেটা নিয়ে ছোটো টেবিলের উপর রেখে দিলাম। শ্বশুর আমাকে চিনি মিশিয়ে দিতে বললেন। আমি একচা চামচ চিনি মিশিয়ে দাদীশাশুড়ীর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলাম।উনি চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
—-কিগো নাতবৌ,এরকম কিপ্টামী করে চায়ে চিনি দিয়েছো কেন? ও মাহফুজের মা তোমার বৌমা তো দু,দিনেই তোমাকে পাঁচতলা বাড়ি বানিয়ে দিবে।
উনার কথাশুনে আমি বললাম,
—-দাদী এককাপ চায়ে আপনার কয় চামচ চিনি লাগে?
—-কমপক্ষে দুচামচ তো খাই। এর উপরে ছাড়া নীচে না।
—-আপনার তো ডায়াবেটিস হয়ে যাবে।
—+তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকলাম। এখন ডায়াবেটিস হলেই বা কি? দু,দিন পরে তো ঐ কবরেই চলে যেতে হবে।
আমার ভাসুর এসে ফিসফিস করে আমায় বললো,
—-উনার কোনোদিন ডায়াবেটিস হবে না। প্রতিদিন এই এলাকা দু,বার পুরো এলাকা চষে বেড়ায়। আর সবার ঘরের হাড়ির খবর কালেক্ট করে।
—-কিরে সবুজ,তুই নতুন বৌয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে কি বলছিস?
—–তেমন কিছু না,আমাকে এককাপ চা দিতে বললাম।
—–কি যুগ পড়েছে বাবা!এখন হাত বৌয়ের হাত জোর মিনতি করে ভাসুরকে চা চাইতে হয়।
দাদী শাশুড়ীর কথা শুনে আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। আসলে ঐ সময়কার নারীদের কথাবার্তার ধরণ একই রকম। কারণ আমার আমার দাদীকেও একই সুরে কথা বলতে দেখেছি। হয়ত উনারা উনাদের শ্বশুরবাড়িতে বহু নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। উনি আবার আমার শাশুড়ী মাকে হাঁক দিয়ে বললেন,
—-মাহফুজের মা,আজকের রান্না তো তোমার নতুন বৌকে দিয়ে করানো উচিত ছিলো। তুমি কি নিয়ম ভুলে গেছো?
এমনসময় আমার শ্বশুর বলে উঠলেন,
—-ওসব আজকালকার মেয়েরা করবে না। শুধু শুধু অশান্তও বাড়বে। তুমি এসব বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং গোসল করে শহিদদের নিয়ে দাওয়াতে চলে আসো।
—-তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস।
উনি চলে যাওয়ার পর আমার শাশুড়ী মা ননস ভাসুর সবাই যেন হাত ছেড়ে বাঁচলো। ঐ রান্না করা নিয়ে আমার একটু কৌতূহল হলো। তাই শাশুড়ী মায়ের কাছে জানতে চাইলাম,
—-দাদী যে নতুন বৌয়ের রান্নার কথা বলছিলেন? বিষয়টা কি?
—-এ অঞ্চলে নিয়ম হচ্ছে বৌভাতের পরদিন নতুন বৌকে দিয়ে রান্না করা হয়। এবং রান্না যদি খুব স্বাদের হয় বৌকে তখন শ্বশুর শাশুড়ী সোনার জিনিস উপহার দেয়।
—-আপনি পেয়েছিলেন?
—-পেয়েছিলাম,তবে সোনা নয় দোয়া পেয়েছিলাম।
—-মানে বুঝলাম না,
আমার ননস এসময় আমাকে বললো,
—–তোমার এসব শুনতে হবে না। তুমি বরং ঘরে গিয়ে রেডী হও।
আমার শাশুড়ী মা তখন ননসের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-ও যখন এবাড়িতে বৌ হয়ে এসেছে শুনলে সমস্যা কি?
—-তোমার জন্যই বলছিলাম। এসব পুরোনো কথা মনে করলে তোমার তে মন খারাপ হয়।
—-এখন আর হয় না।
এরপর আমারদিকে তাকিয়ে বললেন,
—-আমার বিয়ের পরদিন তোমার শ্বশুর বাজার থেকে বড় মাছ,মুরগী,গরুর মাংস, খাসীর মাংস সব এনে দিলো। আমার বয়স তখন কতোইবা হবে। পনেরো কি ষোলো। প্রায় বিশ থেকে পঁচিশজন মানুষের রান্না করলাম।
—ঐ টুকু বয়সে আপনি সামলাতে পারলেন?
—-আমি তো গাঁয়ের মেয়ে। অল্প বিস্তর অভ্যাস ছিলো। তাই একটু চাপ পড়লেও সামলে নিতে পেরেছিলাম। সবাই রান্না খেয়ে প্রশংসা করতে লাগলো। এবার সোনা দেওয়ার পালা। আমার শাশুড়ী মা শ্বশুরকে বললেন,
—বৌকে এবার সোনার হারটা পরিয়ে দিন।
—-যে ওর গায়ের রং তাতে ঐ সোনার গহনা ফুটবে না।
—গায়ের রংয়ের সাথে সোনার গহনা দেওয়ার সম্পর্ক কি? কথা ছিলো নতুন বৌয়ের রান্না স্বয়াদ হলে আপনি ওকে সোনার গহনা দিবেন। ওতো ওর দায়িত্বটুকু করেছে। এবার আপনার টুকু আপনি পালন করুন। বাঁদরীর গলায় মুক্তোর মালা মানাবে কি?
একথা বলে আমার শাশুড়ী একটু দম নিলেন। তারপর আবারও বলা শুরু করলেন।
—আসলে আমার গায়ের রংটা ময়লা ছিলো বসে এসব কথা আমায় শুনতে হলো। আসলে ঐ যে একটা প্রবাদ আছে না,”আগে দর্শনদারী, পরে গুন বিচারী।”আমার অবস্থাটা সেরকমই হয়েছিলো। যদিও শাশুড়ী মা বলেছিলেন, আপনি তো গাঁয়ের রং দেখেই ওকে বৌ করে এনেছিলেন।
“তা এনেছিলাম বৈকি। তবে ঐ মেয়েকে আমার বাড়ী গছাতে ওর বাপের তো অনেক কিছু খোয়াতে হয়েছে। এমনি এমনি তো ওকে আমার বাড়িতে আনা হয়নি।”
—-ওরা আপনাকে এতো কথা বললো,আপনার মন খারাপ হয়নি?
—-হয়েছে। তবে শাশুড়ী মায়ের কথায় সব কষ্ট কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলো। উনি এসব দেখে আমায় বললেন,”ঐ গয়না তোমার নিতে হবে না। কারণ ঐ গয়নাটা তোমার যোগ্য উপহার হবে না। আমি তোমাকে ওর থেকে দামী উপহার তোমায় দিবো। আমার অন্তরের দোয়া আমি তোমায় দিয়ে গেলাম। শাশুড়ী মায়ের এ কথায় আমার আর কোনো কষ্ট রইলো না। ফারাহ্ ম্যালা বকবক হলো। তুমি ঘরে যাও। গোসল করে রেডী হও। একটু পরেই মেহমানরা আসতে শুরু করবে। আমারও রান্না প্রায় হয়ে এসেছে। শুধু পায়েসটা আর একটু জ্বাল দিয়ে নামিয়ে ফেললেই হবে।
—-আপনার অনেক কষ্ট হলো না।
—-না,রে মা। এসব আমার কাছে এখন পান্তাভাত। তুমি ঘরে যাও। জলদি গোসলটা সেরে ফেলো।

আমি ঘরে এসে দ্রুত গোসল করে হালকা সাজুগুজু করে নিলাম। মাহফুজও একটা আড়ংয়ের পাঞ্জাবী পড়লে। ভাইয়া আমার শ্বশুরও এমনকি দুলাভাই সবাই আজকে আড়ংয়ের পাঞ্জাবী পড়েছে। আমি ভাবি আপু মা আমরা মিরপুরের কাতান পড়েছি। আমার কাছে অবশ্য দেশীয় প্রেডাক্টের চাহিদা সবার উপরে। একটু যদি দামও বেশী হয় তাও এটা ভেবে ভালো লাগে টাকাটা আমার দেশেই রয়ে গেল। যাইহোক গেস্ট আসতে শুরু করেছে। খাওয়া শুরু হয়েছে। আমি মাহফুজ মিলে সার্ভ করছি। সবারই এক কথা,” রান্না কি নতুন বৌ করেছে।” আমার শাশুড়ী মা একসময় বিরক্ত হয়ে বললেন,
—-রান্না কে করেছে সেটা বড় কথা নয়। খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে কিনা সেটা বলো।
তখন আমার এক চাচাতো ভাসুর বলে উঠলেন,
—-রান্না আমাদের বড় মা করেছে। খেয়ে বুঝতে পারছে না। এস্বয়াদ তো আমাদের চেনা।
সেসময় আমার এক ফুফাতো ননদ বললেন,
—-বড় মা তো সোনার ডিম পাড়া হাঁস বৌ করে এনেছে। তাকে দিয়ে রান্না করাতো বোকামী।
শাশুড়ী মা একটু রেগে গিয়ে বললেন,
—-সখিনা জিভে লাগাম দে। এতোর কেমন তরো কথা।
—-বড় মা, একটু ঠাট্টাও করা যাবে না।
—-কেন যাবে না? তবে ঠাট্টার একটা লিপিট থাকা দরকার। যেটা কখনও ক্রস করা উচিত নয়। দাওয়াত খেতে আসছিস তৃপ্তি করে খেয়ে যা।
এর মাঝে আমার সেই বিখ্যাত দাদী শাশুড়ী বলে উঠলেন,
—-মাহফুজের মা,তুমি শুধু শুধু সখিনার উপর চটলে। ওতো ভুল কিছু বলেনি। ছেলে তোমার হাকিম,বৌ তোমার প্রফেসর। পাঁচতলা দালান তোমাদের বাড়িতে উঠলো বলে। কারণ বড় বৌকে তুমি কিন্তু বিয়ের দু,দিন পরেই হেঁসেলে পাঠিয়েছিলে ।
—-হুম, তা পাঠিয়েছিলাম। তবে বৌ তো আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করুন তো ওকি সেদিন রান্না করেছিলো নাকি?
আমি ওদের কথা শুনে মনে মনে ভীষণ অবাক হলাম। কারণ জীবনকে এতো জটিল করে কখনও দেখিনি। এরা কতোকিছু ভেবে রেখেছে।

চলবে