দাহন পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
188

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#শেষ_পর্ব

মিথিলার শ্বশুর বাড়িতে একদিনে দুইজনের চেয়ে বেশি ভিক্ষুক আসলে শাহানা বেগম অসন্তুষ্ট হয়। মিথিলার মনে হয়, ভিক্ষুকদের বদ দোয়া তার সন্তানের উপরই আরোপিত হয়। এই কথাটা বলার পেছনের কারণ হল মিথিলাই তার চাক্ষুষ প্রমাণ। এহসানের বয়স তখন এগারো মাস হবে। একদিনে চার থেকে পাঁচজন ভিক্ষুক এসেছিল বলে ভীষণ রাগ করেছিল। শেষে যেই ভিক্ষুক এসেছিল তাকে জুতা দিয়ে পেটাতে গিয়েছিল। তার পরের সপ্তাহেই এহসানের নিউমোনিয়া ধরা পড়লো। সারারাত মিথিলা ঘুমায়নি সেইরাতে ছেলেকে বাম কাঁধের উপর শুইয়ে সারারাত হেঁটেছে। ইমন অনেক চেষ্টা করেছিল এহসানকে নিতে কিন্তু মায়ের কোল ছাড়তেই বাচ্চাকা কাঁদতে শুরু করে।

রাত তখন আড়াইটা বাজে। এহসানের কান্নার আওয়াজ পেয়ে শাহানা বেগম ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। নাতনি কাঁদছে কারণ জিজ্ঞেস না করে মিথিলাকে বকতে শুরু করেন,” ঠান্ডা কি খাইছিলা। ফ্রিজের পানি? জিহ্বা থেইকা তো খাওন নামেই না। নিজের সন্তানের জন্য সাদা ভাত খাইয়াও পাড় করছি। তোমগোর তো কোনো হুঁশ নাই। যখন যা মন চায় খাইতে থাকো।”

এহসানের জন্মের পর থেকে মিথিলা ঠান্ডা পানি পান করা ছেড়ে দিয়েছে। আইসক্রিমও খাওয়া বন্ধ। আনারস খেয়ে দুধ খেলে নাকি বিষের মতো কাজ করে। মানুষের মৃত্যুও হয়ে যায় এতে। মিথিলা এহসান হওয়ার পর থেকে আনারস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। শাহানা বেগম এখন কি বলল! শাহানা বেগমের চিল্লানোতে বাচ্চাটা আবার কেঁদে উঠলো। মিথিলা কোনো উত্তর দিতে পারল না। বাচ্চার কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করা শুরু করল।

পূর্বের ঘটনা বলার কারণ হল, কয়েকদিন আগে একজন ভিক্ষুক মিথিলার কাছে দুই টুকরো গরুর গোস্তো চেয়েছিল। মিথিলার এতো মায়া হলো! শাহানা বেগমও বাড়ি ছিল না। শাশুড়ির অনুমতি ছাড়া দেওয়াও যাবে না। মিথিলা করলো কী, মহিলাটিকে দুইদিন পর আসতে বলল। মিথিলার মনে আছে কোরবানির কিছু গোস্তো একজন ভিক্ষুকের জন্য রেখে দিয়েছিল।

দুইদিন পর ভিক্ষুক আসলো। ইমনও তখন বাসায় ছিল। মিথিলাদের ঘরের ফ্যান নষ্ট হয়ে গেছে সেটাই ঠিক করছিল। মহিলা আসতেই মিথিলা শাশুড়ির কাছে গেল, গোস্তের কথা জিজ্ঞেস করলে শাহানা বেগম নলল,” খুঁজে দেখো আছে কী না।”

মিথিলা পেল না। আবারো খুঁজলো পেল না। একজন মানুষকে কথা দিয়েছে কিন্তু দিতে পারছে না। ভেবেই নিজের মধ্যে অপরাধবোধ অনুভব হল। মিথিলা আবারো খুঁজলো কিন্তু পেল না। মিথিলার দৌড়ঝাঁপ দেখে তার শ্বশুর কারণ জিজ্ঞেস করল। শাহানা বেগম শুয়ে আছেন কিন্তু কিছু বলছেন না। মিথিলা জানালো ভিক্ষুকের ঘটনা। সবটা শুনে মিথিলার শ্বশুর বলল,” না বুঝে কথা দেও কেনো? কথা দেওয়ার সময় আমাদের অনুমতি নিয়েছিলে? মাতব্বরি তো ভালোই করতে পারো।গরুর গোস্তো কী সবাই খেতে পারে? মহিলাকে না করে দাও।”

মিথিলা আশ্চর্যিত হলো। সে কোন মুখে না করে দিবে! ভিক্ষুক দুয়ারে বসে আছে। অপেক্ষা করছে দুই টুকরো গোস্তের জন্য। মিথিলা কাঁদোকাঁদো হয়ে ইমনের কাছে আসলো। ইমন বলল,” কেনো কথা দিতে গেলা। নিজের সংসার হতো দুই টুকরো কেনো এক পলিথিন গোস্ত দিয়ে দিতা। কী যে বোকামি করো! সেধে সেধে মানুষের বদ দোয়া নাও।”

মিথিলার এবার সত্যি সত্যি কান্না এলো। মিথিলার শ্বশুর মহিলাকে তাড়িয়ে দিল। হিলাটি সেদিন হাউমাউ করে কেঁদে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছিল। কি জানি, সেই দোয়া কবুল হয়েছে কী না!

কয়েকদিন যাবত শাহানা বেগমের কোনো নড়চড় নেই। কথা বললেও আস্তে আস্তে কথা বলে। সারাক্ষণই ঘরের কোণায় শুয়ে থাকে। মিথিলাকেও কিছু বলে না। মিথিলা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিনই হল। ছেলের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু প্রাইভেট ছাড়েনি। পাঁচ ছয়জনের মতো এখনো তার কাছে পড়ে।
শাশুড়ির কথাবার্তা কম বলা মিথিলার কাছে ভালো ঠেকছে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মিথিলার কাজ হল, সারাদিন সে কী কী রান্না করবে সেগুলো জিজ্ঞেস করে নেওয়া। আজও তাই করল, সে ঘরে গিয়ে দেখল শাহানা বেগম বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। মিথিলা গা ছুঁয়ে তাপমাত্রা দেখল। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই তাপমাত্রা। আস্তে করে ডাকল, ” আম্মা কী হয়েছে? ”

শাহানা বেগম কুঁকড়ে বললেন,” ম’রে গেলাম গো বউ!”

ঘরের বাতি জ্বালিয়ে শাহানা বেগমকে ধরে বসালো মিথিলা। জিজ্ঞেস করল,” কোথায় খারাপ লাগছে?”

শাহানা বেগম কেঁদে বলল,” স্তনের নিচে বিষফোঁড়া হয়েছে। কী ব্যথা! নড়তেও পারি না। ও মা গো!”

মিথিলা দেখলো সত্যিই বিষফোঁড়া হয়েছে। ডাক্তার দেখাতে হবে। মিথিলার শ্বশুর বাইরে ছিল। শাহানা বেগমকে শুইয়ে দিয়ে ইমনের কাছে এসে বলল,” আম্মার তো অনেক খারাপ অবস্থা। কি করবেন?”

ইমন গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,” আমাকে বলছো কেনো? আমি কী কামাই করি?”

কথাটা ভুল নয়। টাকা দেওয়ার মালিক মিথিলার শ্বশুর।তারা শুধু রোগীকে কাঁধে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারবে। মিথিলার শ্বশুরকে জানানো হলে তিনি শাহানা বেগমের কাছে এসে বললেন,” চলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।”

শাহানা বেগম নাকচ করে বললেন,” আমার বোনের এমন হইছিল। গোপাল ঘি লাগাইছিল। ভাল হয়ে গেছে। আমাকে গোপাল ঘি আইনা দেন।”

ইমন বলল, ” ডাক্তার দেখাই। এসব গোপাল ঘি টি দিয়ে কিছু হবে না। ”

শাহানা বেগম শুনলেন না। গোপাল ঘি এনে লাগালেন। সাথে ফার্মাসি থেকে ঘা পেকে যাওয়ার ঔষধ খেলেন। মিথিলা ও ইমনের কথা আমলে নিলেন না। অথচ অসুস্থতার পুরোটা সময় মিথিলাই তার সেবা করল।

কিছুদিন পর, শাহানা বেগমের বিষফোঁড়ার অবস্থা খুব খারাপ হলো। আক্রান্ত স্থান শক্ত ও জমাট বেঁধে গেল। জায়গাটা ব্যথায় টনটন করতে শুরু করল। মিথিলা এতো করে বলল ডাক্তার দেখাতে শুনলো না। উলটো আরেকজনের কথায় আক্রান্ত স্থানে তুকমা ( পানীয়জলের সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়) ভিজিয়ে কাপড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে রেখে দিল। ইমন যেহেতু ফার্মাসিতে ট্রেনিং নিয়েছে সে জানাল এটা করলে আরো ক্ষতি হবে। শাহানা বেগম শুনলো না।
একদিন কী হলো! শাহানা বেগমের বিষফোঁড়া হওয়ার স্থানটা জুড়ে এপাশটায় ব্যথা শুরু হলো। এনার মিথিলা শুনলো না। বাড়ি থেকে ময়মনসিংহ সদর বেশি দূরে না। সকালে শাহানা বেগমকে সাথে নিয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ডাক্তার দেখানোর কথা আসতেই শাহানা বেগম বলল তিনি মহিলা ডাক্তার দেখাবেন। ইমন তাই করল। প্রথমে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মহিলা ডাক্তারকে দেখালো সে রেফার করলো সার্জারী বিশেষজ্ঞ মহিলা ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার জানালো যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে। শাহানা বেগম ভয় পেয়ে গেল। মিথিলা খেয়াল করে দেখল, তার শাশুড়ি ভয়ে ঘামছে। মিথিলা অভয় দিল যতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে সে থাকবে। দরকার হলে এহসানকে বাবার বাড়ি রেখে আসবে। শাহানা বেগম কী ভাবল কে জানে! মিথিলার কথায় প্রত্ত্যুত্তর না দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসলো। ইমন ও মিথিলা পিছনে আসলো। শাহানা বেগম কাকে যেনো ফোন করল। কল রিসিভ হতেই বলল,” এই বউ, আমাদের ঐদিকে কোনো মহিলা সার্জারীর ডাক্তার নাই?”

অপরপাশের জন কি বলল শুনতে পেল না মিথিলা ও ইমন। কথা বলা শেষ করে শাহানা বেগম ছেলের উদ্দেশে বলল,” বাড়ি চল। সানির মাকে কল করছিলাম।আমাদের ঐখানেই মহিলা ডাক্তার আছে। বাড়ির কাছে ডাক্তার রাইখা এতো দূরে পড়ে থাকমু কেন?”

মিথিলা জোর গলায় বলল,” আম্মা ঐখানের চিকিৎসা ভাল না৷ আপনি এখানেই করান।”

শাহানা বেগম শুনলো না। নিজের ইচ্ছাতে বাড়িতে চলে আসলো। ঠিক সেদিন ঠিক সেদিন দুপুর দুইটায় ভাইয়ের বউয়ের সাথে চলে গেল পাশের একটি সস্তা হাসপাতালে। উল্লেখ্য, শাহানা বেগমের ভাইয়ের বউ বাড়ির পাশের একটি ক্লিনিকে কাজ করতো। ওষুধের ব্যপারে অভিজ্ঞতা আছে তার। আশেপাশের যত হাসপাতাল আছে সেখানে রোগী নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় সে। বিনিময় সে কিছু পয়সা কড়িও পায়। ইমনকেও সাথে নিল না। মিথিলা রাগ করে খবর নিল না।

বিকাল চারটায় শাহানা বেগম মিথিলাকে ফোন করে জানাল চার হাজার টাকা নিয়ে ইমন যেনো হাসপাতালে যায়। মিথিলা জিজ্ঞেস করল কী কী পরীক্ষা দিয়েছে?

উত্তরে শাহানা বেগম জানাল,” এক্স-রে, ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট ও আলট্রাসোনগ্রাফী।”

মিথিলা বলল,” এতো পরীক্ষা দিল কেনো? উনার তো ক্যান্সার হয়নি।”

শাহানা বেগম ফোনের ঐপাড়েই ধমক দিলেন,” ডাক্তার থেইকা বেশি বুঝো? ডাক্তার না বুইঝা কী পরীক্ষা দিব? সব মিলাইয়া বারো হাজার টাকা খরচ হইবো। অন্য হাসপাতালে আরো বেশি চাইবো।”

মিথিলা ফোন কে’টে দিল। তার কথা শুনেনি এখন অযথা কথা শোনানোর কোনো মানেই হয় না। মিথিলা ইমনকে ফোন করে বাসায় আসতে বলল। শ্বশুর আসলে মিথিলা পরীক্ষার ব্যপারে জানালো। শাহানা বেগমের রায়ের উপর কী আর কেউ কথা বলতে পারে? মিথিলার শ্বশুরের কথাও শুনল না। ইমনের কথা শুনবে ভাবাও বোকামি। ইমন টাকা নিয়ে চলে গেল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে মিথিলাকে শাহানা বেগম ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলল। এও বলল যেনো কিছু রেঁধে নিয়ে আসে। এত অল্প সময়ে মিথিলা ডাল, ভাত ও ডিম ভুনা করে নিল। আটটার দিকে হাসপাতালে গেল। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে নেমপ্লেটে নাম দেখে মিথিলা ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। কেননা এই নামে সেখানে কোনো হাসপাতাল ছিল না। মিথিলা হাসপাতালে আসলো। ভেতরের পরিবেশ দেখে বলল, মা গো, আমার এখানে সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। চলেন অন্য হাসপাতালে যাই।”

শাহানা বেগম বললেন,” আমার ভাইয়ের বউ কোনোদিনও আমারে খারাপ হাসপাতালে আনবো না। আর ডাক্তার কইছে আমারে অজ্ঞান করে নিবো। একটু টেরও পামু না।”

মিথিলা কিছু বলল না। কেবিনে বসে অপারেশনের সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। প্রায় বিশ মিনিট পর একজন নার্স ইনজেকশন ও কিছু ঔষধ নিয়ে আসলো। ইমন এহসানকে নিয়ে দোকানে গিয়েছে। মিথিলার শ্বশুর এসে বাড়ি খালি দেখে চলে গেছে। নার্স পরিধানের অতিরিক্ত কাপড় আনতে বলল। মিথিলা ইমনকে ফোন করে আসতে বলল। ইমন আসলে এহসানকে রেখে পরিধানের কাপড় ও অন্যান্য জিনিস আনতে চলে গেল।

হাসপাতালে এখন মিথিলা একা। শাহানা বেগম ভাইয়ের বউয়ের সাথে কথা বলতে থাকলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে শাহানা বেগম বললেন,” তোমার মামীকে খাবার বেড়ে দাও।”

মিথিলা তাই করলো। এরমধ্যে বাহির থেকে রুটি কলা এনে শাহানা বেগম খেলো কিন্তু একবারের জন্যও মিথিলাকে খাবে কী না জিজ্ঞেস করলো না। খাওয়ার পর্ব শেষ হলেই শাহানা বেগমের ঘুম পেলো। মিথিলা ভাবলো, ঔষধের রিয়াকশন হয়তো। ইমন তখনো আসেনি। মিথিলা সোফায় বসে এহসানের সাথে দুষ্টুমি করেছিল। এমন সময় একজন বুয়া গ্লাভস পরে কেবিনে আসলো। মিথিলা বুঝতে পারল, এই বুয়া অপারেশন থিয়েটারের কাজে নিয়োজিত। মিথিলা জিজ্ঞেস করল, ” আলাদা কাপড় পরাবে না?”

যেহেতু কখনো মিথিলা অপারেশনের কার্যক্রমে দেখেনি। এহসান হওয়ার সময় তার সাথে যা,যা করা হয়েছিল সবই ভিন্ন। উত্তরে বুয়া বলল,” আরে কিছুই লাগবো না। চলেন মুরুব্বি।”

শাহানা বেগম হেঁটে হেঁটে অপারেশন থিয়েটারে চলে গেল। মিথিলা সিনেমাতে দেখেছিল, অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার আগে আলাদা কাপড় পরিধান করিয়ে নেয় শাহানা বেগমকেও সেভাবে কাপড় পরিয়ে নেওয়া হবে। অথচ এমন কিছুই হলো না। তিনতলায় অপারেশন থিয়েটার। গেইটের পাশেই রিসিপশন তারপর দুই গলির পর অপারেশন থিয়েটারের ঘর। মিথিলাকে রিসিপশনের কাছেই দাড়িয়ে থাকতে হলো। এহসানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ইতিমধ্যে ইমনকে ফোন করে শাহানা বেগমের কথা জানাল সে। মিথিলার মত ইমনও জানার পর অবাক হলো। প্রায় পনেরো মিনিট পর মিথিলা দেখতে পেল শাহানা বেগমকে যেভাবে হেঁটে হেঁটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেভাবেই নিয়ে আসা হচ্ছে। মিথিলা আম্মা সম্বোধন করে এগিয়ে আসলো। বুয়া শাহানা বেগমের হাত ধরে রেখেছিল। মিথিলাকে দেয়কতে পেয়ে হাত ছেড়ে দিল। মিথিলা শাশুড়ির হাত ধরে বুঝতে পারল, হাত হিম শীতল হয়ে আছে। শুধু হাত নয়, সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। মিথিলা শাহানা বেগমকে জিজ্ঞেস করল,” এভাবে বের করলো কেনো, আম্মা। অন্ততপক্ষে হুইলচেয়ারে করে কেবিনে দিয়ে আসতো!”

এহসানের জন্মের পর মিথিলাকে হুইলচেয়ারে করে কেবিনে আনা হয়েছিল। মিথিলা ভেবেছে, শাহানা বেগমকে হুইল চেয়ার অথবা স্ট্রেসারে করে নিয়ে আসবে। অথচ শাহানা বেগম আসলো হেঁটে হেঁটে।

কেবিনে শুইয়ে দেয়ার সাথে সাথে শাহানা বেগম গগনচুম্বী চিৎকার শুরু করলো। মিথিলা একা কী করবে ভেবে পেল না। শাহানা বেগমের মাথার কাছে দাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকলো,” আম্মা কী হয়েছে?ব্যথা করছে? ডাক্তার ডাকবো?”

মিথিলার এতটুকু ধ্যান নেই যে, শাহানা বেগম বলেছিল ডাক্তার তাকে অজ্ঞান করে নিবে। শাহানা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করল,” আমারে কইছিল অজ্ঞান কইরা নিব। অজ্ঞান করল না, আমারে ঐ জায়গাটুকুও অবশ করল না। জ্যান্ত মানুষটারে কেমনে কা’ই’ট্টা ফেলল। ও আল্লাহ গো!”

মিথিলা কী করবে, কোথায় যাবে,কার কাছে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে সে আগে কখনো পড়েনি। মামী শাশুড়িকে মিথিলা জিজ্ঞেস করল,” মামী আপনি নিয়ে আসলেন। আম্মার সাথে এরা কী করলো?”

শাহানা বেগম তখন পুনরায় বিলাপের সুরে বলতে শুরু করল,” আমাকে বলছে মহিলা ডাক্তারকে দিয়া অপারেশন করাইবো। ডাক্তার বেডি ঘরে ঠিকই আছিল কিন্তু আমারে ছুঁয়াও দেখে নাই। দূরে দাঁড়াইয়া আছিল। আমাকে বেডা
ছুঁইল। আল্লাহ গো মাফ করো।”

মিথিলা শাশুড়িকে কেবিনে রেখে রিসিপশনে গেল। নার্সকে কারণ জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে পারল না। এবার মিথিলা তার মামী শাশুড়ির কাছে গেল। ভদ্রমহিলা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতার সাথে ফোলকলে কথা বলছিল। মিথিলা মামী শাশুড়ির কান থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,” আপনারা কীসের জন্য বারো হাজার টাকা রেখেছেন। আমার শাশুড়িকে তো তারা অবশ করেও নেয়নি।”

লোকটা বলল সে দেখছে। মিথিলা মামী শাশুড়ির দিকে ঘৃণিত দৃষ্টি ফেলে কেবিনে চলে আসলো। ইমন আসলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। এসেই মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” মা গো, একটু সহ্য করো।আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলছি।”

সবাই ভেবেছিল৷ অপারেশন করতে অনেক সময় লাগবে কিন্তু এতো অল্প সময়ে হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি।

ডাক্তার এসে জানাল, ষাট বছরের উপরের রোগীদের অজ্ঞান করা যায় না। এতেকরে জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনা কম থাকে। মিথিলা কিছুতেই মানতে পারল না। হাজার প্রশ্নবিদ্ধ করার পরও কোনো বিচার পেল না।

——-
রাত বারোটায় শাহানা বেগমকে বাড়ি আনা হলো। নরম খাবার খাইয়ে ব্যথার ঔষধ সেবন করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল মিথিলা। মাঝরাতে শাহানা বেগম ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। মিথিলা শাশুড়ির ঘরে আসলো। ব্যথার ডোজ দিল। সারারাত শাশুড়ির সেবা করে পাড় করলো।

শাহানা বেগমের বিষফোঁড়া অঙ্গের এমন জায়গায় হয়েছে যে যে কেউ দেখতে পারে না। তাছাড়াও আক্রান্ত স্থানে চার আঙুল পরিমান গর্ত হয়ে গেছে। যা প্রতিদিন ড্রেসিং কররা মাধ্যমে পূরণ হবে। মিথিলা সংসারের কাজ করে, প্রাইভেট পড়িয়ে বিকালে শাহানা বেগমকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। ড্রসিং করিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। ড্রেসিং করানোর সময় শাহানা বেগম মিথিলাকে জাপটে ধরে। মা গো মা গো বলে গলা ভেজায়। মিথিলা হাসে। মানুষ এভাবেই তার কৃতকর্মের প্রতিফল পায়। মিথিলা তখন ভাবে, ” বারো হাজার টাকা অন্যকে ধ্বংস করার জন্য দিয়েছেন সেই বারো হাজার টাকাই আপনার ধ্বংসের কারণ হতে যাচ্ছিল।”

দীর্ঘ আড়াই মাস শাহানা বেগম যন্ত্রণা ভোগ করলেন। এই আড়াই মাস মিথিলার সেবা করা দেখে শাহানা বেগমের মন নরম হলো। শাহানা বেগমকে যে কেউ দেখতে আসলেই বলত, ” ওয় আমার ছেলের বউ না! আমার মাইয়া। আমার সব কাজ করে দেয়। আল্লাহ ওরে বাঁচাইয়া রাখুক।”

মিথিলা আড়াল থেকে শুনে চোখ মুছে। মিথিলার জীবন অন্যরকম হয়ে গেল। শাহানা বেগমও এখন আর মিথিলার পিছু লাগে না।

পুনশ্চঃ বাস্তবতা খুবই কঠিন। সব শাহানা বেগম কৃতকর্মের ফল ভোগ করে না। সব মিথিলা দিনশেষে শক্ত হতে পারে না। সব ইমন বাবা মা বেঁচে থাকাকালীন কর্ম করে চলতে পারে না। বাবা মায়ের হাতের পুতুল হয়েই থাকতে হয়। মিথিলার মতো মেয়েরা আমাদের সমাজে আছে। যারা কখনোই পরিবারের সমর্থন পায় না। মিথিলাদের মতো মেয়েদের উদ্দেশে একটাই কথা বলা উচিত, তোমরা শক্তিশালী হও নীরবে অন্যায় সহ্য করো না। শাহানা বেগমরা ভাল হয় না। সত্যিই কখনো ভাল হয় না। গল্পে শাস্তি পেল বলে বাস্তব জীবনে তারা শাস্তি পায় না।

চলবে।