গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:১৮
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেঁজুতি। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। আজ সকালে তার ভাইয়ের ফোনে একটা কল এসেছে তাও আবার হাসপাতাল থেকে। লোকটা জানিয়েছে নিশানকে কেউ বেধম পি*টি*য়ে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে। সেখান থেকেই কিছু লোক ধরাধরি করে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছে। অজ্ঞান অবস্থায় থাকায় পেশেন্টের বাড়ির লোকের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। এখন জ্ঞান ফিরেছে তাই পেশেন্টের বাড়ির লোকজনকে জানাচ্ছে।
রাতে নিশান বাড়ি ফেরেনি। মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিলো , অফিসের কাজে শহরের বাইরে যাচ্ছে। এরপর কেউ আর মাথা ঘামায়নি। সকালে হাসপাতালের কল পেয়েই সবাই কান্না জুড়ে দিয়েছে। সবার মাঝে সেঁজুতিই ছিল যে মুখে আফসোস করলেও মনে মনে বেশ খুশি। সেঁজুতির মতে একটা মেয়েকে যে ম*লে*ষ্ট করার চেষ্টা করে তার বেঁ*চে থাকার অধিকার নেই। সেইখানে এতো শুধু হাসপাতালে ভর্তি। সেঁজুতি মনে মনে তাদের শুকরিয়া আদায় করলো যারা নিশানকে বে*ধম পি*টি*য়েছে ।
নিশানের তথ্য মতে রাতে একদল ছেলে পেলে গাড়ি থামিয়ে হঠাৎ আ*ক্রমন করে বসে। গাড়ির চালককে ছেড়ে দিলেও তাকে ছাড়েনি। হাত পা বেঁধে জা*নো*য়া*রের মতো মে*রে*ছে।একটা সময় ব্যাথ্যার চো*টে সে সে*ন্সলেস হয়ে যায়।
ছেলের মুখে সবটা শুনে সাজির মামী লুনা আহাজারি করে কাঁদছে। সন্তানের এই অবস্থা মায়ের জন্য ঠিক কতোটা পীড়াদায়ক সেটা শুধু একজন মা-ই জানে। লুনা বুক থাবড়ে কাঁদছে। সেঁজুতি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার সন্তান সবার কাছে মূল্যবান লুনার ক্ষেত্রেও তাই। নিশান অ*পরাধ করলেও সে লুনার একমাত্র ছেলে যাকে লুনা নাড়ি ছেঁড়া ধন বলে আক্ষায়িত করে। তেমনি সাজিও সেঁজুতির একমাত্র মেয়ে, যে মেয়ের সাথে নিশান জ*গ*ন্যতম কাজ করতে চেয়েছিল। লুনাকে দেখে সেঁজুতির কষ্ট হলেও নিশানের জন্য বিন্দু পরিমাণ খারাপ লাগা কাজ করছে না। লুনাতো মা! কোনো মা কখনো চাইবে না তার সন্তান খারাপ হোক। তবে মা মা-ই হয়, সন্তানের জন্য পুরো পৃথিবীর বিপক্ষে যেতে দুবার ভাববে না, এইবার হোক সেই সন্তান জ*গ*ন্য অপ*রাধী।
এইদিকে আমজাদ স্ত্রীকে শান্তনা দিতে ব্যাস্ত। পুরুষদের কাঁদতে নেই।পুরুষ হওয়ার কারনে আমজাদ কাঁদতে পারছে না। তা নাহলে কষ্ট তারও হচ্ছে। তার মতে ঘরের পুরুষেরা যদি কাঁদে, তাহলে তাদের উপর ভরসা করে থাকা রমনীদের ভে*ঙে গুঁ*ড়িয়ে যেতে দেরী হবে না। এইজন্যই আমজাদ শক্ত হাতে সবটা সামলাচ্ছেন।
নিশানের বাম পায়ের গোড়ালির হাড়ে ফ্রেকচার হয়েছে, বাঁ হাতের আঙ্গুল,আর ডান হাতের কব্জিতে ফ্রেকচার হয়েছে। কপালে কে*টে গেছে, সাথে পুরো শরীরে অসংখ্য মা*রে*র দা*গ যা হকিস্টিক দ্বারা করা হয়েছে। নিশানের অবস্থা দেখেই বুঝা যাচ্ছে যারা মে*রে*ছে তাদের নিশানের উপর কোনো ক্ষো*ভ ছিল। যা মে*রে মিটিয়ে গেছে।সব মিলিয়ে নিশানকে কমপক্ষে দুই মাস কিংবা তারো বেশি সময় ধরে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। আপাতত এক সপ্তাহ হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করবে। পরে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখানেই বেড রেষ্টে রেখে সেবা যত্ন করে সুস্থ করতে হবে।
একদিকে পুলিশ অন্যদিকে হাসপাতালে ফর্মালেটি সবটাই আমজাদকে দেখতে হচ্ছে। ভাইয়ের এই ক্রাইসিসের সময় তার পাশে সেঁজুতিকেই থাকতে হবে। দুই ভাই বোন একজন আরেকজনের খুঁটি। সেঁজুতি তার ভাইকে খুব ভালোবাসে। সেঁজুতির আজ বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও ভাইয়ের খাতিরেই এখনো ওবদি এইখানে আছে। মা আর লুনা দুইজনকেই তাকে সামলাতে হবে।জুবায়ের সবটা শুনে আর মানা করেনি। সাজি ওর ফুফুর কাছে আছে দেখে থাকার জন্য অনুমতি দিয়েছে।
____
এইদিকে আজ দুইদিন সাদ সাজির দেখা পায়নি। মাথার চুল টা*নতে টা*নতে পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে সাদ। একপ্রকার রাগে হিস হিস করছে।
~ এই মেয়েকে সবটা জানানো একদম উচিত হয়নি। দুই দুইটা দিন চোখের সামনেই পড়ছে না। একবার খালি সামনে পাই! ভালোবাসি বলেকি মাথায় উঠে নাচবে?থা*প্প*ড় মে*রে দাঁত ফেলে দিবো। উফ!!!এই জন্যই বলে বেশি ভালোবাসা দেখাতে নেই, অতি ভালোবাসায় মাথায় উঠে নাচে। অফিস থেকে ফিরে ছুটাচ্চি নাচ।
সাজি পা টিপে টিপে কিচেনে চলে গেলো। সাদের হাতে পড়লেই তার খবর আছে। এইদিকে রেনু টেবিল মুছতে মুছতে যোহুরির চোখ দ্বারা সাজিকে পর্যবেক্ষণ করছে। দুইদিনে সাদ ভাইয়া আর সাজি আপাকে নিয়ে তার গবেষণা করা শেষ। দুইয়ে দুইয়ে চার না হয়ে, দুই আর দুই পাশাপাশি বসিয়ে বাইশ মিলিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু হাতেনাতে ধরার অপেক্ষা।
সিংকের পাশের প্লেট বাটি সরিয়ে উপরে উঠে পা গুটিয়ে বসলো সাজি। এইভাবে ফুপ্পির পাশে বসে আবদার জুড়ে দেওয়া সাজির ছোট বেলার অভ্যাস। আজও তার ব্যাতিক্রম নয়।
সাজিকে কিচেনে দিকে আসতে দেখে অনিলা রহমান বাটি করে আমের আচার নিয়ে রাখলো। বিনা বাক্যে সাজির হাতে ধরিয়ে আবার রান্নার কাজে মনোযোগ দিলো।
~ ওয়াও ফুপ্পি! তুমি কি করে জানলে এখন আমার আচার খেতে ইচ্ছে করছে?
সাজির উচ্ছাস দেখে অনিলা রহমান হেসে বললো,, তোর জন্মের পর আমিই তোকে প্রথম কোলে নিয়েছি। জুবায়ের নিতে চেয়েছিল আমি দেইনি। তোর জন্মের পর সেঁজুতি অনেকটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এককথায় আমিই তোর দেখা শুনা করি। প্রথম মুখে ভাত আমিই দেই। তোকে আমি আমার মেয়ের মতো কোলেপিঠে করে বড় করেছি সাজি। তাহলে তোর ইচ্ছে অনিচ্ছে আমি জানবো না কেন?
সাজি মুখে লেগে থাকা তেল মুছে অনিলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। দুগালে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলল,, এই জন্যই বেশি ভালোবাসি তোমায়।
অনিলা সাজির কাজে হেঁসে উঠে বললো,, ঠিক আছে ছাড়! মাংস গুলো পু*ড়ে যাচ্ছে।
~ ছেড়ে দিলাম। এখন আমাকেও শেখাও। তুমি কিভাবে কি রান্না করছো।
~ রান্না পরে শেখাবো। আগে বল সাদের সাথে ঝগড়া হয়েছিলো কেন?
অনিলা রহমানের কথায় সাজি শুকনো ঢোক গিলে বললো, কি বলো ফুপ্পি? ঝগড়া! সাদ ভাইয়ের সাথে? তোমার রাগী ছেলের সাথে ঝগড়া করার মতো সাহস আমার কি আছে?
অনিলা রহমান ঠোঁট টিপে হেসে বলল,, আমার ছেলে অতোটাও রাগী নয় যতটা তুই মনে করিস। আর রইলো সাহসের কথা। এই সাহস তোর বেশি থাকার কথা।
ফুপ্পির কথায় সাজি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার কথার আগা মাথা কিছুই বোধগম্য হলোনা।
~ তোর বেলায় একটু রাগ দেখায় সত্য তবে সেটা তোর ভালোর জন্যই। আমার রাগী ছেলেটা তার রাগের আড়ালে তোর জন্য যত্ন, ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে।
অনিলা রহমানের কথা কর্ণোগোচর হতেই মনে পড়লো দুইদিন আগে সাদের সাথে কাটানো সেই মূহূর্তের কথা। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সাজি। সাজির ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে পাজা কোলে তুলে নিলো । সাদের কোলে থাকা অবস্থায় ঘুম ভেঙ্গে গেল সাজির। কোল থেকে নামতে ছুটোছুটি করেছিল ঠিকই কিন্তু সাদ নামতে দেয়নি। উল্টো ধমকে চুপ করিয়ে দিলো। মায়ের সামনে দিয়ে রুমে নিয়ে বিছানায় রেখে তবেই খান্ত হলো।তখনই সাজি রেগে বলেছিলো এমন করলে আর চোখের সামনেই পড়বে না।
সব শুনে সাদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সাদ বেরিয়ে যেতেই সাজির টনক নোড়লো।শাড়ির কুচি অবস্থা শোচনীয়,দুইকদম হাঁটলেই মানসম্মান সব পায়কারী দরে বিক্রি করে দিতে হতো। ভাগ্যিস কোলে তুলে নিয়ে এসেছিল।নয়তো সাদ ভাই আর ফুপ্পির সামনে খুলে গেলে মুখ দেখানো মুশকিল। সেই লজ্জায় আজ দুইদিন সাদ ভাইয়ের সামনে পড়েনি সে। সত্যি সাদ ভাইয়ের রাগের আড়ালে ভালোবাসা,যত্ন লুকিয়ে রাখে। সাদ ভাই নামক মানুষটা যত্ন করে ভালোবাসতে জানে। আগে বুঝতে পারেনি সত্য তবে এখন সেই মানুষটির বসবাস পুরো হৃৎপিণ্ড জুড়ে। কখন যে এতোটা জায়গা দখল করেছে কে জানে!
~ কিরে কোথায় হারালি? আচার গুলো শেষ কর পরে না হয় মুচকি মুচকি হাসবি!
অনিলা রহমানের কথায় সাজি ভাবনার জগৎ থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কোনোরকম আমতা আমতা করে আচারের বাটি নিয়ে রুমের দিকে ছুটলো। এইখানে থাকলে লজ্জায় ম*রে যাবে।বিড়বিড় করে নিজেকেই নিজে ধি*ক্কার জানালো।ছিঃ সাজি তোর এই অ*ধঃপ*তন! প্রেম ভালোবাসা তোকে ডোবালো। মুচকি হেসে নিজেকে নির্লজ্জ প্রমাণ করছিস তুই। কি লজ্জা! কি লজ্জা!
ইনশাআল্লাহ চলবে,,
গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:১৯
মেঘ বিহীন আকাশে তারার মেলা বসেছে। তার সাথে মৃদু মন্দ বাতাসে ভেপশা গরমের ভাব কেটে গেছে। এই পরিবেশ উপভোগ করার জন্য প্রেয়সীর সঙ্গ অনিবার্য। প্রেয়সী বলেতেই সাদের ঠোঁটে কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠল।ড্রাইভ করতে করতে ছোট খাটো একটা পরিকল্পনা করলো সাদ।
ঘড়ির কাঁটা বরাবর নয়টা। ঘড়িতে নয়টা বাজেনি যেন সাজির ক্ষিদে জোয়ার এসেছে। ক্ষিদে লেগেছে করে করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। অনিলা রহমান চিন্তিত ভঙ্গিতে সাজির দিকে তাকিয়ে থেকে টেবিলে খাবার সাজায়। যেই মেয়েকে ভাত খাওয়ানোর জন্য রিতিমত পেছনে পেছনে ছুটাছুটি করতে হয়, সে আজ নিজেই ভাতের জন্য ছুটাছুটি করছে? বিষয়টা সন্দেহ জনক। অনিলা রহমান একা নয় তার সাথে রেনুও সন্দেহে দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাজিকে দেখছে।অনিলা রহমান আজ লক্ষ করলেও রেনু বিগত দুইদিন ধরে ব্যাপারটা খেয়াল করছে। যার দরুন তার দৃষ্টি প্রগাঢ়। রেনু মনে মনে ছপকষে রেখেছে।আজই হাতে নাতে ধরবে। সাদ ভাইয়া আর সাজি আপায মধ্যে কি চলছে তা বের করেই ছাড়বে।
আজ সাজি রাফির সাথে বসে ডিনার কমপ্লিট করে ফেলেছে। খাওয়ার দাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই তড়িঘড়ি করে তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেলো। সাজি যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই সাদ এসে উপস্থিত। রেনুর অ*ক্ষিজুগল বেরিয়ে আসার জোগাড়। তাহলে এই ব্যাপার? সাজি আপা সাদ ভাইয়ার জন্যই এতো হড়বড় করে খেয়ে ভেগে গেছে! রেনু আফসোস করে নিজের মাথা চাপড়ালো। এতো বুদ্ধীমতি হওয়ার পরেও অংক মেলাতে পারলো না সে। এ জিবন রেখে লাভ কি!
অনিলা রহমান ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে রহস্য করে বললো,, কেউ একজন ঘড়ির কাঁটা দেখে বলতে পারবে আমার ছেলের আসার সময় হয়েছে। অথচ আমি মা হয়েও বুঝতে পারলাম না।
সাদ ল্যাপটপের ব্যাগ টি-টেবিলের উপর রেখে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। হঠাৎ মায়ের এমন কথায় হকচকিয়ে উঠে বসলো।
~ কি বলছো মা? কে ঘড়ির কাঁটা দেখে বলতে পারবে?
অনিলা রহমান মৃদু হেসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। রেনু টিভির অন করে ক্রা*ই*ম পে*ট্রোল দেখতে দেখতে বলল,, কে আবার! যে এই দুইদিন আপনি আসার আগে আগে খাবার দাবার সেরে লুকিয়ে পড়ে সে।
সাদ পানির গ্লাস রেখে চোখ পাকিয়ে বলল,, রেনু তুই ইদানিং পুলিশের চাকরি নিয়েছিস? আজকাল তোকে দেয়ালে আশেপাশে ঘেঁষে ঘেঁষে চলতে দেখি। ক্রা*ইম পে*ট্রো*ল দেখে দেখে ভোতা মাথা ধারাচ্ছিস তাইনা?
রেনু ভীতু চোখে তাকিয়ে টিভি বন্ধ করে কিচেনের দিকে ছুটলো। এইখানে থাকা বি*প*জ্জনক। যেকোনো সময় হাত পা ভে*ঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিতে পারে। সাদ ভাইয়াকে বিশ্বাস নেই।
অনিলা রহমান মুচকি হেসে ছেলের শিয়রে বসলো। মমতা মাখা হাত ছেলের মাথায় বুলিয়ে আদুরে গলায় সুধালো,, মেয়েটাকে ভ*য় দেখাস কেন তুই? আজ দুইদিন ধরে দেখছি। তুই বাড়িতে থাকলেই তোর ভয়ে মেয়েটা আমার আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ায়। তোর আসার আগে খেয়ে দেয়ে রুমে চলে যায়। কি করেছিস বলতো?সব সময় রে*গে কথা বলাকি খুব দরকার সাদ?
মায়ের কথায় ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো সাদ। এই মেয়ে তাকে জ্বা*লি*য়ে মা*রছে। না ঠিক মতো ঘুমাতে পারছে ,না খেতে পারছে কাজের সাথে তো প্রায় ব্রেকাপ হবার দশা। এতো লজ্জা কই থেকে আসে! নাহ আজ এই মেয়েকে সায়েস্তা করতেই হবে। আপাতত মাকে সামলাই।
~ তেমন কিছু না মা। দেখো গিয়ে কোনো সয়তানি করে আমার জিনিস পত্র ভেঙ্গেছে। এখন মা*র খাওয়ার ভ*য়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।
অনিলা রহমান ছেলের কথা শুনে কুঁচকে রাখা ভ্রু জুগল সিথিল করলো।সাদের কথা সত্য। সাজি আগেও একবার এমন করেছিল। ছুটোছুটি করতে গিয়ে সাদের ক্রীক্রেট টুর্নামেন্টে পাওয়া ম্যান অফ দা ম্যাচ ট্রফিটা ভেঙে লুকিয়ে পড়ে। যার জন্য সাদ সাজির উপর ভিষন ক্ষে*পে যায়। এর পর থেকেই তো সাজি সাদকে ভয় পেতে শুরু করে। যদিও এই ঘটনার বছর ছয় হয়ে এসেছে তাও, সাজিতো আর বদলাইনি। এখনো সেই ছোট্ট সাজিই আছে।
~ মা আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি খাবার গরম করে দাও।
সাদের কথায় অনিলা রহমান উঠে কিচেনে চলে গেল। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী দশটা মানেই সবাইকে খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকতে হবে। যদিও বা মাঝে মাঝে এর হেরফের হয়। কিন্তু সাদের বাবা বেঁ*চে থাকা অবস্থায় এই নিয়মটা কড়াকড়ি ভাবেই পালন করতো।
খাবারের পাট চুকিয়ে সবাই সবার রুমে ঘুমাতে চলে গেল। একটা বেজে গেছে,সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম নেই শুধু সাদের চোখে। এই দিকে সাজি বেচারি চক্ষু লজ্জার কারনে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যেই মেয়েকে রাত বারোটায়ও টিভির সামনে থেকে উঠাতে পারতো না, কিন্তু সে এখন দশটা বাজার আগে আগে ঘুমিয়ে পড়ে। অন্যের ঘুম হা*রাম করে নিজে চিৎ পটাং হয়ে ঘুমাচ্ছে। এতক্ষণে হয়তো শত শত স্বপ্ন দেখাও শেষ।
সাদ কিছুক্ষণ পায়চারি করে রুমের বাইরে উঁকি মে*রে সব রুমের লাইট চেক করলো। লাইট অফ দেখে স্বস্থীর নিঃশ্বাস ফেলে পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরোয়। অসয্য!! এই মেয়ের কারনে নিজের বাড়িতে নিজেকে চোরের মতো ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। জংলি মেয়ে কোথাকার। থা*প্প*ড় মে*রে মে*রে সব দাঁত আজই ফে*লে দিবো।
দাঁতে দাঁত পিষে রাগ সংবরণের চেষ্টা চালাতে চালাতে সাজির রুমে পৌছে গেলো সাদ। কোলস্টফোবিয়া থাকার কারণে ছোট বেলা থেকেই দরজা খোলা রেখে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমায় সাজি। তাই রুমে ঢুকতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।
হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে সাজি। ছাই রঙা লেডিস ট্রাউজারের সাথে হালকা বেগুনি রঙের লং টিশার্ট পরে ঘুমাচ্ছে । চুল গুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর পড়ে আছে, ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে রেখেছে। কে বলবে কিছুদিন পর মেয়েটা ভার্সিটিতে ভর্তি হবে? এখনো বাচ্চাই রয়ে গেছে।
এতক্ষণ এই মেয়ের জন্য যতোটা রাগ পুষে রেখেছিল তার ছিটেফোঁটাও নেই এখন। মাথা চুলকাতে চুলকাতে মুচকি হাসলো সাদ। এই মেয়ে সত্যি তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। শক্ত পোক্ত ধৈর্য্যের অধিকারী মানুষটার ধৈর্য শক্তি ভে*ঙে গুঁ*ড়ি*য়ে দিচ্ছে। কি আছে এই মেয়েতে? কেন এই মেয়ে তার অন্তঃস্থলে বি*না*ষি*নি রূপ নিয়েছে?এই মেয়ের ক্ষমতা এতো প্রখর কেন? সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে হাসলো সাদ। কিছুই জানে না সে, শুধু জানে এই মেয়েটাকে তার জিবনে লাগবে। সাজি নামক মেয়েটা তার জিবনে অপশনাল নয় বরং মেন্ডেটোরি বিষয়ের মতো। যাকে ছাড়া চলবে না, একদম চলবে না।
বালিশের পাশ থেকে ছাই রঙা ওড়নাটা পকেটে পুরে নিলো সাদ। এলোমেলো চুল গুলো আলগোছে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে পাজা কোলে তুলে নেয় । ঘুম কাতুরে মেয়ে, কোথায় রাত জেগে প্রেমিক-কে সময় দিবে!তা না করে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। কি মেয়েরে বাবা!
ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলো।সাজি তখনও ঘুমে। সাদের মতে এই মেয়েকে ঘুমে রেখে দেশান্তর করে দিলেও টের পাবে না। কেউ যদি চায় তো ক্লো*রো*ফর্ম ছাড়াই কি*ড*ন্যা*প করতে পারবে।
ছাদের একপাশে পেতে রাখা চেয়ার টেবিল। অন্ধকারে পা টিপে টিপে আন্দাজ করে সেই ওবদি পোঁছে গেলো সাদ। পা দিয়ে চেয়ার টেনে সাজিকে নিয়ে বসে পড়লো। রাত গভীর হওয়াতে আকাশের বুকে তারা গুলো আরো বেশি প্রগাঢ় হলো। বড় তারা গুলোর পাশাপাশি ছোট ছোট তারা গুলোও মিট মিট করে জ্বলছে। সেই মিটমিটে আলো তারার চারপাশে ঈষৎ আলোকিত করছে। তার সাথে মৃদু মন্দ বাতাসে ঝাপটা পরিবেশটাকে আরো বেশি রোমাঞ্চিত করে তুলছে।
সাদ বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো। বাতাসের ঝাপটায় কিছু চুল সাজির চোখে মুখে আঁচড়ে পড়ে। এতে সাজি বেজায় বিরক্ত, বিরক্তে চোখ মুখ কুঁচকে সাদের বুকে মাথা গুঁজে মুখ ঘসলো। সাদ সাজির এহেন কান্ডে প্রথমে চমকে উঠলেও পরক্ষনেই শব্দ করে গা দুলিয়ে হেসে উঠে।
সাদের হাসির শব্দে নড়েচড়ে উঠে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো সাজি। চারপাশে অন্ধকার দেখে ঘা*বড়ে গেল।বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলতেই পুরো শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠে। পুরো শরীর ইতিমধ্যে ঘামতে শুরু করে। ভয়ে জড়সড় হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলতে নিয়ে থেমে যায়। কথা সব গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে যেন।
ততক্ষণে সাদ হাসি থামিয়ে সাজির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে।হুট করে সাজির সমস্যার কথা মনে পড়তে,ওহ শিট!! বলে পকেটে হাত গলিয়ে মোবাইল খুজে বের করে। তাড়াতাড়ি মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করে সাজির দিকে তাক করায়। এতক্ষণে সাজির চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। হাত পা অবশ হয়ে এসেছে প্রায়। লাইট অন হওয়াতে টেনে নিঃশ্বাস নেয় সাজি। সাদ একহাতে সাজিকে বুকের সাথে আলতো করে চেপে আশ্বস্ত করে বললো,, আমি আছিতো। ভয় পাচ্ছিস কেন? শান্ত হয় এই দেখ তোর সাদ ভাই এইখানেই আছে।
সাজির অবস্থা দেখে নিজেকেই নিজের কাছে অপরাধী লাগছে। ইস! কি করে এই ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো? কি জন্য এনেছে আর কি হয়ে গেল!
সাজি খানিকবাদে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। মাথা তুলে সাদের দিকে তাকিয়ে দেখে সাদের মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে। সাজি চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে এইটা তার ফুপ্পির বাসার ছাদ। সাদ ভাই তাকে এইখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কেন?
সাজি সাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,, মুখটা এমন করে রেখেছেন কেন? আর আমিই-বা এইখানে কেন? কি মতলব সাদ ভাই?
সাদ মুখ ফুলিয়ে বললো,, প্রেম করার জন্য নিয়ে এসেছি কিন্তু কপাল করে প্রেমিকা পেয়েছি,লাখে একটা। প্রেম আর হলো কই প্রেমিকার হুশ ফেরাতে ফেরাতেই জান যায়। কোথায় ভাবলাম এই সুন্দর রাতে লং ড্রাইভে যাবো!
সাজি দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে বললো,, ইহো জন্মে শুনিনি ছাদে উঠে লং ড্রাইভে যায়।
সাদ ফুঁসে ওঠে বললো,, মাথা মোটা আমিকি বলেছি ছাদে উঠে লং ড্রাইভে যাবো? ষাঁড়ের মত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস দেখে ছাদে নিয়ে এসেছি। নয়তো ঠিকই নিয়ে যেতাম।
~ এতো বড় সাহস আমাকে ষাঁড় বলে? আপনি র*গচটা শেয়াল যার বদ বুদ্ধি আর রাগ দুটোই নাকের ডগায় থাকে। আসছে লং ড্রাইভে নিতে।
~ আমি র*গচটা শেয়াল? এখন এই রগচটা শেয়ালের কোলেই বসে আছিস। বেশি করলে উপর থেকে ফেলে কোমর ভে*ঙে দি*বো। গিয়েছিস কখনো রাতের বেলা লং ড্রাইভে ?
সাজি দাঁত কিড়মিড় করে সাদের গেন্জি টেনে ধরে হিস হিস করে বলে উঠলো, এখন এতো বড় বড় কথা বলছেন,নিয়ে গেছিলেন কখনো?
সাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,, আমি কেন নিয়ে যাবো?
সাজির রাগ আকাশ ছুঁই ছুঁই। একপ্রকার রেগে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,, বাবা দেশে নেই সব দায়িত্ব আপনার। আপনিই তো ফা*লতু নিয়ম করে দিয়েছিলেন যেখানেই যাই যেন বিকলে পাঁচটার আগে বাড়ি ফিরি। তাহলে এই কথা বলছেন কোন সাহসে? আপনার ভয়ে একটা প্রেম ওবদি করিনি। নয়তো কলেজ বাংক করে ঠিকই প্রেমিকের সাথে লং ড্রাইভে যেতাম। আসছে এখন ভ্রু কুচকাতে!
সাজির কথায় সাদ বেকুবের মত তাকিয়ে রইল। সাজির কথা গুলো আসলেই সত্যি। সাদ অপরাধীদের মত সাজির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই সাজি হুঙ্কার দিয়ে বললো,, কোলে তুলে নিয়ে এসেছেন কোলে তুলে ঘরে দিয়ে আসুন। এইটা মোটেও আশা করবেন না, আমি পায়ে হেঁটে যাবো। তাড়াতাড়ি ঘরে দিয়ে আসুন।কুইক!
এই প্রথম সাজির কথায় সাদ ভয় পেলো। ভীষণ ভয় পেলো। সাজির হাতে মোবাইল ধরিয়ে সাজিকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাদ। মিটমাট করতে এসে আরো বেশি রাগিয়ে দিলো। কে বলেছে এই মেয়ের প্রেমে পড়তে! প্রেম বাঘের মতো আমিটাকে বিড়াল বানিয়ে ছাড়লো। ছিঃ!!
____
বিঃদ্রঃ যারা গল্প পড়বেন ধৈর্য নিয়ে পড়বেন। গল্পের প্রতি পর্বে রোমাঞ্চকর কিছু থাকবে এমনটা কিন্তু নয়। তবে প্রতিটা পর্বে প্রতিটা চরিত্র একটা গল্পকে “গল্প” হিসেবে গড়ে তুলতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।তাই সবাই ধৈর্য নিয়ে পড়বেন❤️। সাথে আপনাদের মতামত গুলো শেয়ার করবেন। এতে লেখার আগ্ৰহ বাড়বে এবং গুছিয়ে লিখতে পারবো।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,
( ভুল গুলো সুধরে দিবেন।)