নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৩২
গেইটের সামনে গাড়ি থামতে নেমে পড়ে সাজি। গুটি গুটি পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। অনিলা রহমান এতক্ষণ সাজির অপেক্ষাতেই ছিলো। বাড়িতে ঢোকা মাত্র পানির গ্লাসটা সাজির দিকে বাড়িয়ে দেয়। সাজি মুচকি হেসে গ্লাস হাতে নিয়ে অনিলাকে জড়িয়ে ধরে। অনিলা রহমান স্মিত হেসে বললো,, অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছিস মা।যা রুমে যা। আমার রুমে তোর জন্য ড্রেস রাখা আছে, গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নে।পরে কথা হবে।
ফুপ্পির কথায় মাথা নেড়ে রুমের দিকে অগ্রসর হলো সাজি। অনিলা রহমান মুচকি হেসে কিচেনের দিকে ছুটলো। তিনি জানে সাজি আর যাই করুক রেষ্ট নিবে এমন মেয়ে নয়। তার ওপর ছেলে যা গন্ডগোল করেছে। রেষ্ট নিবে না বরং উল্টো পাল্টা বুদ্ধি খাটিয়ে ছেলের পেছনে লাগবে।
একেবারে শাওয়ার নিয়েই বের হলো সাজি। ফুপ্পির দেওয়া থ্রিপিস পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। সাদা-সবুজ কম্বিনেশনের থ্রিপিস। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই নিজেকে বলে উঠল,, নাহ বা*জে লাগছে না। বরং ভালোই লাগছে।
টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরোয় সাজি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। সবে মাত্র বারোটা, এখন নিশ্চয়ই সাদ ভাই ভীষণ ব্যাস্ত থাকবে! এই ব্যাস্ততার ভিড়ে আমি কি কোথাও নেই? একটা কল , একটা মেসেজ দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? নিজেকে নিজে সুধালো সাজি।
পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে ধীর পায়ে সাদের রুমের দিকে এগোও। কি আছে এই রুমে?যার জন্য কেউ এই রুমে ঢুকলেই সাদ ভাই রেগে যায়? এই ঘরটা ফুপ্পি ছাড়া আর সবার জন্য ব্যান করা। ক্লাস এইটের বছর পরীক্ষা শেষে সাজি এই বাড়িতে বেড়াতে আসে। তখনই ভুল ক্রমে সাদের রুমে ঢুকে পড়ে। রুমে গিয়ে ক্ষান্ত হয়নি সাজি বরং সাদের খুব প্রিয় ট্রফি ভে*ঙ্গে গু*ড়িয়ে দেয়। সাদ ভীষণ রেগে যায়। এতোটাই রেগে যায় যে ,সাদ সেই দিন প্রথম সাজির গালে ক*ষে চ*ড় মারে।
সেইদিনের থা*প্প*ড়ের কথা মনে পড়তেই আপনা আপনি হাতটা গালে চলে গেলো।ওই দিনের পর থেকে সাদ ভাইকে জমের মত ভয় পায় সাজি। ঢোক গিলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। রুমে ঢুকবে কি ঢুকবেনা ভাবতে ভাবতে দিশেহারা । এই লোকের বিশ্বাস নেই ধরা খেলে এইবার গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে থা*প্প*ড় মা*রবে।নাহ যাওয়ার দরকার নেই।
সর্বোপরি মানব জাতির একটাই দোষ। যেটার জন্য মানা করা হয় ,সেটার প্রতি কৌতুহল একটু বেশিই থাকে। সাজিও তার ব্যাতিক্রম নয়।মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে নিলো।হুহ এখন আর সাদ ভাইকে থোড়াই না ভয় পায়! কিছু বলতে আসুক সোজা সুজি ব্রেকাপ করে দিবো।
একবুক সাহস সঞ্চার করে ভীড়ানো দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে হড়বড়িয়ে রুমের ভেতর ঢুকে পড়লো। ফলস্বরূপ খাটের সাথে পায়ের আঙ্গুলের সংঘর্ষ। ব্যাথ্যায় চোখ মুখ কুঁচকে আর্তনাদ করে উঠলো সাজি। পুরো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার।দিনের বারোটা নয় দেখে মনে হচ্ছে রাত বারোটা।
এতক্ষণে ঘরের ভেতরে অবস্থা টের পেলো ।এমন পরিবেশ দেখে ঘাবড়ালো সাজি!একেতো অন্ধকার দ্বিতীয়ত রুমের টেম্পারেচার ভুতুড়ে টাইপের হিমশীতল। নিজেকে কেমন লা*শ ঘরের বাসিন্দা মনে হচ্ছে। থেমে থাকা পা জুগল বাড়ানোর সাথে সাথে হাত টান পড়লো। আকস্মিক ঘটনায় টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো সাজি ।
আচম্বিত হলো সাজি। আচমকা এমন হওয়াতে হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠলো, অজানা ভয়ে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে।মুখ থেকে কথা ওবদি বের হচ্ছে না। অনেকেই বলে যে ঘরে জিন ভুত থাকে সেই ঘরটা এমনই হয়। বাই এনি চান্স সাদ ভাই এমন কিছু সঙ্গে নিয়ে থাকে না তো? ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে যতক্ষনে উঠার কথা ভাবলো ততক্ষণে দুটো শক্ত পোক্ত হাত তাকে ব্লাঙ্কেটের ভেতরে মুড়িয়ে নিলো। দ*মব*ন্ধ কর পরিস্থিতিতে মুচড়া মুচড়ি শুধু করে দিলো সাজি।এমন সময় ভরাট কন্ঠে সাদ বলে উঠলো,, শুধু শুধু শক্তি অপচয় করছিস। যতক্ষন না আমি নিজের ইচ্ছায় ছাড়বো ততক্ষন ওবদি এই ভাবে থাকতে হবে। বিশ্বাস না হলে চেষ্টা করে দেখ।
সাদের কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই থামকালো সাজিঁ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে একদম স্থীর হয়ে গেলো। সাদ হাত বাড়িয়ে মোবাইল ফোন খুঁজে ফ্লাশ লাইট অন করে বিছানার এক কোণে ছুঁড়ে মা*রলো।
জমাট বাঁধা অভিমান চোখের কোণে ভীড় জমাতে শুরু করলো। দুফোঁটা অভিমান গড়িয়ে পড়তেই কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। অভিমান যেন বাড়ছে ব-ই কমছে না। বাড়িতে আছে তাও একটা বার কল দিলো না? আছি ,নাকি ম*রে গেছি তা জিজ্ঞেস করার জন্যেও তো মানুষ একটা কল দেয়। একটা কল দেওয়ার সময় হয়নি তার। চোখের জল বাঁধ ভাঙার মতো করে গড়িয়ে পড়ছে। লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করলো সাজি।রাশ ভারী গলায় সাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,, ছাড়ুন! আমি বাইরে যাবো।
সাজির কথায় অভিমানের ছাপ স্পষ্ট।সেই অভিমান বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো সাদ। প্রনয়ীনির অভিমান ভাঙ্গাতে প্রেমিক মন সব সময় উদ্যত।সেই সুবাদে সাজিকে ছাড়লো না। বরং সাজিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ব্লাঙ্কেটের ভেতরে টেনে নিলো। দুহাত বাড়িয়ে নিবিড় ভাবে বুকে জড়িয়ে নিলো।
সাদের শরীরের উত্তাপ এতোটাই বেশি সাজি যেন ঝ*ল*সে যাওয়ার জোগাড়।
সাদ গম্ভীর গলায় বললো,, তুই তো কটন ক্যান্ডির মতো দেখছি।একদম তুলতুলে,সত্যি করে বলতো কি খাস তুই? ভাত ছেড়ে তিনবেলা নিয়ম করে কটন ক্যান্ডি খাচ্ছিস নাতো?
সাদের কোনো কথাই যেন সাজির কান ওবদি পৌছালো না।সাদের শরীরের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ে চিন্তিত সাজি। নড়ে চড়ে উঠে ব্যাতি ব্যাস্ত হয়ে বললো,, আপনার শরীর এতো গরম কেন?কি হয়েছে আপনার?
সাজি হাত বাড়িয়ে সাদের গালে হাত রাখলো।সাদ ঈষৎ আলোতে সাজির অশ্রুসিক্ত চিন্তিত মুখায়বব এর দিকে তাকিয়ে বলল,তেমন কিছু না। একটু জ্বর হয়েছে। চোখ পা*কা*লো সাজি। রাগান্বিত হয়ে শা*ষণে সুরে বলল,, একটু জ্বর? এই আপনার মা*থা ঠিক আছে? আপনার শরীরের উত্তাপ এতোটাই বেশি আমার গা জ্ব*ল*ছে রীতিমত। আপনি বলছেন একটু জ্বর?এতো জ্বর কখন বাধিয়েছেন?
সাজির অধিকার বোধ দেখে সাদ মুচকি হেসে বলল,, তুই জেনে কি করবি?আমার জ্বর হলে তোর কি? তুইতো রেগে আছিস। অভিমানের পাহাড় জমিয়ে রেখেছিস। আমার পাশে থাকতেই চাইছিস না।
সাদের কথা শুনে সাজি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, রাগ ,অভিমান করার মতো যথেষ্ট কারন কি ছিলো না সাদ ভাই?চার চারটা দিন পার হলো। না কোনো ফোন কলস্,না কোনো মেসেজ। রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক।
সাদ সাজির গালে হাত ছুঁইয়ে দুর্বল গলায় বললো,, বৃষ্টিতে ভিজার পর থেকেই জ্বর। তুই চিন্তা করবি দেখে তোকে বলতে চাইনি। মেসেজ কল সবাইটা সেইজন্য ইগনোর করেছি। কিন্তু আজ তোকে খুব বেশি দেখতে ইচ্ছে করছিলো সাজঁবাতি। একটু থাকনা পাশে!
সাদের এমন আবদারে চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। চোখের কোন বেয়ে নোনা গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে দিলো সাদ। আলতো করে সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে কোমলমতি গলায় বলল,, এই কটা দিন ঠিক করে ঘুমাতে পারিনি সাজঁবাতি। একদাম নড়বিনা আমি এখন ঘুমাবো।
সাজি কিছু বলবে তার আগেই সাজির গলায় মুখ গুঁজে চোখ বুঝলো সাদ। কেঁপে উঠলো সাজি, দ্বি*ধা সংকোচ নিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,, ফুপ্পি দেখলে কি ভাববে? উঠুন সাদ ভাই! হয়তো ফুপ্পি আমাকে খুঁজছে।
সাদ সাজির গলায় মুখ গুঁজে রেখে বললো,,মা তোকে মোটেও খুঁজছে না। মা জানে তুই এখন তার একমাত্র ছেলের কাছে আছিস।সো নো মোর ওয়ার্ডস্!
সাদের কথা শুনে থমকালো সাজি। ফুপ্পি জানে আমি এইখানে আছি? কি ভাবছেন উনি?
সাজি সাদকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও চুপ হয়ে গেল। সাদের তপ্ত নিঃশ্বাস সাজির ঘাড়ে আ*চ*ড়ে পড়ছে। নিঃশ্বাসের শব্দ জানান দিচ্ছে সাদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ভেপশা গরমে অস্থির হয়ে উঠলো সাজি তাও নড়লো না। কিছুটা সময় অতিবাহিত হতে ধীরস্থির ভাবে সাদ থেকে সরে আসলো। ঈষৎ আলোতে সাদের মুখায়বব স্পষ্ট। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখ নিচে কালসিটে দা*গ পড়ে গেছে। গুছিয়ে রাখা চুল গুলো ভীষণ এলোমেলো ঠেকছে। সাদের গালে হাত ছুঁইয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সাজিঁ।এতো রাগ অভিমান করে লাভ কি হলো? এই মানুষটার সামনে সব সময় রাগ অভিমান ফিকে পড়ে। কেমন করে জানি মূহুর্তে সকল রাগ, অভিমান বিলীন করে দেয়।সাদের এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে দিলো সাজি।কিছু সময় সাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে তার তপ্ত কপালে অধর ছোয়ালো।ঘুমে বিভোর হয়ে থাকায় টের পেলো না সাদ।ঘুম তার সুন্দরতম অনূভুতি লুফে নিতে দিলো না। অজানা রইলো এই আদুরে পরশ।
রুম ছেড়ে বের হতেই অনিলার সমনে পড়লো সাজি। ফুপ্পিকে দেখে ঘাবড়ে গেল । যার দরুন ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কি বলবে ঠিক ভাবে পাচ্ছে না। অনিলা রহমান সাজির ব্যাপরাটা বুঝতে পেরে বললো,, দেখেছিস মা! বে*য়া*দ*বটা কেমন জ্বর বাধিয়েছে? এই চার চারটা দিন আমার হাড় মাংস জ্বা*লি*য়ে খেলো। না ডাক্তার দেখাতে যেতে চাইছে,না ডাক্তার আনতে দিচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে বড় কোনো অ*সুখ বাঁধিয়ে ফেলবে।
অনিলার কথার ধরনে সাজি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, ডাক্তার দেখাতে কি সমস্যা ফুপ্পি?
অনিলা রহমান মুখ টিপে হেসে বলল, এইটা টপ সিক্রেট! আমার রাগী ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই সুই ভয় পায়।হাত কা*টে গেলেও টু শব্দ করবে না। কিন্তু ইনজেকশন দেখলেই অ*ব*স্থা খারাপ হয়ে যায়। অনিলা রহমানের কথা শুনে খিল খিল করে হেসে উঠলো সাজিঁ। সাদ ভাইয়ের মতো এমন শক্ত পোক্ত মানুষ নাকি ইনজেকশন ভয় পায়? অনিলা রহমান হেসে উঠে বলল,, কি করি বলতো?
সাজি পেট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,, ফুপ্পি আজ আমি আর তুমি সাদ ভাইকে ভয় দেখালে কেমন হবে বলোতো? চলো ডাক্তার ডেকে আনি?অসুখ-ও সেরে যাবে সাথে ভয় দেখানোর কাজটাও হবে।
অনিলা রহমান সাজির কথায় সায় জানিয়ে বললো,, আইডিয়া খারাপ না। তুই বোস আমি রায়হানেকে কল দিয়ে বলি।বিকালেই যেন ডাক্তার নিয়ে আসে।
ঘুম থেকে উঠে পড়েছে সাদ। জ্বর খানিকটা কমেছে।অনিলা রহমান সাদকে জোর পূর্বক ভাত আর ঔষধ খাইয়ে দিল। এর মধ্যে সাদ বার বার সাজির কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু অনিলার শক্ত পোক্ত উত্তর,” অনেক আগেই চলে গেছে” । এমন কথা শুনে ফুঁসে উঠলো সাদ। দুর্বল হাত জোড়া মুঠ করে দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলে উঠলো,, একবার বলেও গেলো না? কি এমন রাজ্যের কাজ পড়েছে? ভীষণ বে*য়া*দব হয়েছে মেয়েটা। সামনে পেলে থা*প্পর মে*রে দাঁত ফে*লে দিবো।
অনিলা রহমান ছেলের মুখের অবস্থা দেখে ভেতরের কথা আন্দাজ করে ফেললো। ভাতের প্লেট হাতে করে বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবার ঘুরে দাড়ায়। গম্ভীর গলায় সাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,, না রেগে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেই হয়। এমন চলতে থাকলে অন্য কোথাও মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিবো।এমন রাগী ছেলের কাছে কখনোই আমার ভাতিজির বিয়ে দিবো না।
মায়ের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাদ।বিস্মিত কন্ঠে বললো,,আমি তোমার ছেলে মা! তুমি মা হয়ে ছেলের না হওয়া সংসার ভাঙ্গার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো?আনভিলিবেবল!!
অনিলা রহমান হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়লো। ছেলেটাকে এইভাবে ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে শা*য়েস্তা করা যাবে না। সাদের মুখটা দেখার মতো ছিলো।
বিকেলে না হতেই রায়হান ডাক্তার নিয়ে হাজির হয়।
সাজি মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে রাহানের পাশে দাঁড়িয়ে সাদের ইনজেকশন ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা জানিয়ে দিলো। রায়হান যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে, পৈ*শা*চিক হাঁসি হেঁসে ডাক্তারের দিকে তাকায়।এমন দূর্বলতার খোঁজেই ছিলো রায়হান।
অনিলার রহমান ডাক্তারকে সাদের অসুখের ব্যাপারে জানাচ্ছে। এইদিকে সাজি আর রায়হান যেন অধৈর্য হয়ে পড়েছে। দুইজন পারলে এক্ষুনি ডাক্তারকে উড়িয়ে সাদের রুমে নিয়ে ফে*লে। অনিলা রহমান এই দুইজনের অবস্থা দেখে ডাক্তারকে নিয়ে সাদের রুমের দিকে অগ্রসর হয়।
সাজি আর রায়হান দাঁত কেলিয়ে মোবাইল নিয়ে তাদের পেছন পেছন ছুটলো।
সাদ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যাথ্যা হয়ে গেছে। মোবাইল হাতে নিয়ে রায়হানকে কল দিবে এমন সময় অনিলা রহমান সাদের রুমে ঢুকে পড়ে। সাদ মোবাইল রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,, মা তুমি! অনিলা রহমান মুচকি হেসে বলল, শুধু আমি না। সাথে ডাক্তারও আছে।
অনিলা রহমান বলতে বলতে ডাক্তার রুমে প্রবেশ করলো। তার পেছন পেছন সাজি আর রায়হান-ও এলো।
ডাক্তার নাম শুনতেই ঘাবড়ালেও সয়ং ডাক্তার উপস্থিত দেখে পুরো চেহারার রংটাই পাল্টে গেলো সাদের।
এই দিকে রায়হান আর সাজি মিলে সাদের এক্সপ্রেশন রেকোর্ড করছে। দুইজনই সাদকে ভীষণ ভয় পায়।সাদকে জব্দ করার জন্য আজ দুজনের কাছে সুযোগ আছে। এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে কেউই রাজি না। তাইতো সাদের অগোচরে ভিডিও রেকর্ড করায় ব্যাস্ত দুজন।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,
নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৩৩
ডাক্তারের ভয়ে বিছানার কোন চেপে বসলো সাদ। চেহারা যথেষ্ট স্বভাবিক রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। অনিলা রহমান সাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। অন্য দিকে রায়হান আর সাজি মুখটিপে হেসেই যাচ্ছে। ডাক্তার থার্মোমিটারের সাহায্যে সাদের জ্বর মাপতে নিবে এমন সময় সাদ রায়হান আর সাজির দিকে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,, মা এই দুইটাকে বাইরে যেতে বলো।
অনিলা রহমান কোনো কথা বলার আগেই সাজি আর রায়হান একসাথে চিল্লিয়ে বলে উঠল,, আমরা যাবো না!
দুইজনের চিৎকারে ডাক্তার ওবদি চমকে উঠলো। সাদ দাঁত কিড়মিড় করে রায়হানকে বলল,, ম*রার সখ জেগেছে না? রায়হান বরাবরের মতো দাঁত বের করে কেবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলল,, সমস্যা নেই! সেই শুভ কাজটা নাহয় ডাক্তার যাওয়ার পর হোক।
সাদ বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। সাজিকে কিছু বলবে এর আগেই সাজি হাত দিয়ে থামিয়ে বললো,, দেখুন সাদ ভাই ,চ*ড় থা*প্পড় সব সুস্থ হলে দেওয়া যাবে। আপাতত আপনার জ্বর সেরে তোলা ইম্পর্ট্যান্ট।
সাদ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল,, আপনি কি দেখছেন? চেক করুন না! দেখুন কি আছে।
অনিলা ছেলের রাগ দেখে চুপসে গেছে। এখন হাসা যাবে না। হাসলেই বিপদ।
ডাক্তার পরীক্ষা নীরিক্ষা শেষ করে রায়হানের দিকে তাকালো। রায়হান চোখ দিয়ে ইশারা করতেই ডাক্তার ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন সিরিজ বের করলো। এইদিকে ইনজেকশন তার প্যাকট থেকে বের হয়নি তার আগে সাদ ব্লাঙ্কেট থেকে বেরিয়ে পড়েছে। আঁতকে উঠলো সাদ ,ভীতু চোখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল,, আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? এইটুকু জ্বরের জন্য ইনজেকশন দিতে হয়? রাখুন বলছি! রাখুন ওটা!
রায়হান আর সাজি গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। দুইজন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। সাদের মতো মানুষকে এই অবস্থায় দেখে দুইজনে মজা লুটে নিচ্ছে। যেই লোকটা মানুষকে ধমক দিতে অভ্যস্ত সে আজ ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে।ব্যাপরটা বেশ ইন্টারেস্টিং।
অনিলা রহমান মুখে হাত চেপে সাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষ বেড়ে উঠলেও ছোট বেলার কিছু অভ্যাস কিংবা ভয় থেকেই যায়। তেমনি সাদেরও আছে।
সাদের চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ঠিক কতটা ভয় পাচ্ছে সে। ডাক্তার মুচকি হেসে ইনজেকশনটা ব্যাগে পুরে রেখে বললো,, কাম ডাউন মিষ্টার সাদ! ইনজেকশন দিবো না। এইটাতো এমনিতেই বের করেছি। ডাক্তার সাজি আর রায়হানকে দেখিয়ে বলল, এই দুইজন বলেছিল তাই এমনটা করেছি।
সাদ অবিশ্বাস্য নজরে রায়হান আর সাজির দিকে তাকায়। রায়হান জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,, স্যরি স্যার কিন্তু আমি কিছুই করিনি।ইভেন আমিতো জানতাম না আপনি ইনজেকশন দেখলেই বেহুঁশ হয়ে যান। আমাকে তো সাজি ম্যাম বলেছে এমনটা করতে।
রায়হান খুব সাবধানে সাজির ঘাড়ের উপর দো*ষ চাপিয়ে রুম ছেড়ে হড়বড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো।
সাজি নাকোচ করে বললো,, মোটেও না। আমি এমন কিছুই করিনি সাদ ভাই। দেখুন,,
সাদ সাজির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,, দেখা দেখি পরে হবে তুই এইখান থেকে এক পা-ও নড়বি না। সাজি অসহায় দৃষ্টিতে অনিলা রহমানের দিকে তাকালো। অনিলা রহমান সাজির দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বললো, আমি কিছুই জানি না। ফুপ্পির এমন জবাবে মুখ ফুলালো সাজি।
ডাক্তার হেসে উঠে বললো,, বাইদা ওয়ে মিষ্টার সাদ। আপনি বৃষ্টির পানি এড়িয়ে চলবেন। আপনার মায়ের কাছে শুনেছি বৃষ্টিতে ভিজলেই নাকি এমন হয়। তাই বৃষ্টিতে না ভেজাই উত্তম। আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি ওইগুলো নিয়ম করে খাবেন। ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
ডাক্তার অনিলা রহমানের হাতে প্রেসক্রিপশন দিয়ে উঠে পড়লো। অনিলা রহমান ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে সাজির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়।
অনিলা রহমান বের হতেই সাদ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সাজি ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। রায়হানযে তাকে এইভাবে ফাঁ*সিয়ে দিবে তা সাজি একটুও বুঝতে পারিনি। আগে জানলে থোড়াইনা এই পাল্টিবাজের সাথে দাঁড়িয়ে হি হি করতো। এখন সাদ ভাই নামক বদ রাগী মানুষটা থা*প্পড় মে*রে গালের চাপা না ভে*ঙ্গে দেয়।
সাদ দূরত্ব বজায় রেখে সাজির মুখামুখী দাঁড়ায়। সাজি মাথা উঠিয়ে সাদের দিকে তাকায়। সাদ এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,, এতক্ষণ খুব হাসি পাচ্ছিল তাই না?বেশ তো ওই বাঁদরের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁত দেখাচ্ছিলি! সাদের কথা শুনে সাজি মুখ ফুলালো। সাদ ধমকের সুরে বলল, একদম মুখ ফোলাবি না।মুখ ফুলিয়ে ইনোসেন্ট সাজা হচ্ছে? দুপুর থেকে কোথায় ছিলি? বাড়ি যাওয়ার সময় একবারো বলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলি না। একবারও মনে হলো না বলে যাই লোকটাকে? পা বেশি লম্বা হয়ে গেছে তাইনা? একা একা বাড়িতে যাওয়া আসা হচ্ছে। পা কে*টে ঘরে বসিয়ে রাখবো।
সাদের কথা শেষ হতেই সাজিঁর অশ্রুজলে টইটম্বুর চোখ জোড়ার বাঁধ ভাংলো। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে মুছে পুনরায় মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।আর যাই হোক সাদ ভাই এতোটা রুড হয়ে যাবে সাজি মোটেও আশা করেনি। সাজিতো শুধু একটু মজাই করেছে।
সাদ চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিজের উপরই বিরক্ত হলো।মনে মনে নিজেকে নিজে কঠিন কিছু গা*লি দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, শিট! দুপুরের রাগটা এখন দেখানো কি খুব জরুরী ছিল!দিলিতো সাজঁবাতিকে কাঁদিয়ে। এতো রুড হওয়া একদম ঠিক হয়নি সাদ।
সাজি হিচকি তুলতে তুলতে বললো,,আ’ম স্যরি। আর কখনো এমন হবেনা। কথা শেষ হতেই শব্দ করে কেঁদে উঠলো সাজি। সাদ কয়েক সেকেন্ড ঠোঁট চেপে নিজেকে ধাতস্থ করলো। সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। সাজি যেন অশ্রুজল বিসর্জন দেওয়ার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পেলো। সাদের টিশার্ট মুঠ করে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। সাদ সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,, আ’ম রিয়েলি স্যরি সাজঁবাতি। এতোটা রুড হওয়া মোটেও উচিত হয়নি।কি করবো বল! ঘুম থেকে উঠে তোকে দেখিনি। মাকে জিজ্ঞেস করার পর বললো, তুই বাড়ি চলে গেছিস। সেই জন্যই রেগে ছিলাম।
সাজি হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,, আমি বাড়িতে যায়নি এইখানেই ছিলাম।
সাদ অবাক হয়ে বললো,, এইখানে ছিলি মানে?
সাজি সাদ থেকে সরে এসে মাথা নিচু করে পুরো ঘটনা বললো। সাদ বিস্মিত হয়ে সাজির দিকে তাকিয়ে বলল,, আমার পিঠ পিছে এইসব করা হচ্ছে? অবাক হচ্ছি আমার নিজের মায়ের কথা ভেবে। কি ভাবে পারলি তোরা?
সাজি মিনমিনে গলায় বলল,, সোধবোধ হয়ে গেছে। এখন আর কিচ্ছু বলবেন না।
সাদ চোখ ছোট ছোট করে বললো, সোধ বোধ তাইনা? বাথরুমে ভেতরে আটকে যখন লাইট অফ করে দিবো তখন বুঝবি।
সাদের কথা শেষ হতেই মুচকি হাসলো সাজি। সাজি জানে সাদ বলছে সত্য, কিন্তু করতে গেলে সাদ নিজেই মরে যাবে। সাদের দ্বারা আর যাই হোক সাজির ক্ষতি কখনোই হবে না।
সাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,, এখন আবার হাসছিস কেন?
সাজি চোখ মুছে ঠোঁট প্রশস্ত করে বললো,, উম!! ভাবছি এখন আটকে দিবেন নাকি পরে। বাকির নাম ফাঁকি। চলুন এখনই বাথরুমে আটকে দিয়ে লাইট অফ করে দিন। সোধবোধ হয়ে যাবে।
সাজি সাদের হাত ধরে টেনে বাথরুমের দিকে নিতেই সাদ উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,, এই পা*গ*ল হয়ে গেছিস?ম*রে যাবি তুই,তার আগে হয়তো আমিই ম*রে যাবো।
সাজি হেসে উঠে বললো,, সাজি জানে তার সাদ ভাই নামক নরম গরম মানুষটা আর যাই করুক। সে তার সাজবাতির ক্ষ*তি কখনোই করবে না। ক্ষ*তি তো দূরে থাক সেই কথা চিন্তা করতে তার বুক কেঁপে উঠে। Because King saad love’s his queen saji very much.And you know what? he never ever gonna hurt his queen.
সাদ অবাক চোখে সাজির দিকে তাকিয়ে আছে। সাজি মুচকি হেসে সাদের রুমে থেকে বেরিয়ে গেলো।সাজি দৃষ্টি অগোচরে যেতেই সাদের ধ্যান ভাংলো। সাজির কথা গুলো মনে মনে রার কয়েক আওড়াতে লাগলো। পরক্ষনেই শব্দ করে হেসে উঠে বললো,, Saad’s Queen!
সকালে সাজির ক্লাস থাকার কারণে সাজি বাড়ি চলে গেছে। অনিলা রহমান রায়হানকে দিয়ে সাজিকে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সাদের অবস্থা আগ থেকে বেটার। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো সাদ।
অনিলা রহমান টেবিল গুছিয়ে রুমের দিকে যেতেই হাতে থাকা মোবাইটা স্ব-শব্দে বেজে উঠল।
ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা।এতো রাতে সেঁজুতির কল দেখে চিন্তিত হলো অনিলা। ওবাড়িতে কোনো বিপদ হলো নাতো? সাজি ঠিক আছে? জুবায়েরের ঠিক আছে? মনে মনে হাজার বিপদের কথা ভাবতে ভাবতে কল রিসিভ করলো।
সেঁজুতি ব্যাতি ব্যাস্ত হয়ে বললো,, আপা কি ঘুমিয়ে গেছিলেন? বিরক্ত করলাম মনে হয়।
অনিলা তড়িগড়ি করে বললো,, না না ঘুমাইনি। কি হয়েছে সেঁজুতি? বাড়িতে সবাই ঠিক আছেতো?
~ হ্যা আপা সব ঠিক আছে। আসলে আপনাকে কাল সকালে একবার আসতে হবে।
~ সকালে? কিন্তু কেন? কি হয়েছে?
~ ওহো আপা কিছুই হয়নি। আসলে কাল সাজিকে দেখতে আসবে। ওনারা বলেছে বিকালে আসবে। এখন আমাদেরকেও তো একটু তৈরি থাকতে হবে।আপা আপনি তো জানেন এই সব ব্যাপারে আমি একটু কম বুঝি তাইতো আপনাকে আসতে বলছি।
সেঁজুতির কথা শুনে অনিলা চুপ করে গেছে।কি বলবে,ঠিক কি বলা উচিত সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।
অনিলা রহমান দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে বললো,, এতো তাড়া কিসের? আমাদের সাজিটা কতটুকুই বা বড় হয়েছে? তাড়াহুড়ো করে কিছু করা মোটেও ঠিক হবে না। তাছাড়া ছেলে কেমন, কি করে না করে, কোথায় থাকে, চরিত্র কেমন? এই সব না জেনেই হুট করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?
অনিলার কথা শুনে সেঁজুতি উদ্ধিগ্ন হয়ে বললো,, আপা তাড়াহুড়া কোথায় করলাম। তাছাড়া সব কিছু জেনে শুনেই এগোচ্ছি। ছেলেও ভালোই হবে সাজির ভার্সিটির প্রভাষক বলে কথা। সাজিকে সেখাই দেখে পছন্দ করেছে। এখন পরিবার নিয়ে দেখতে আসবে।
সেঁজুতির কথা শেষ হতেই অনিলা রহমান তাড়া দিয়ে বললো, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি কাল সকালেই চলে আসবো।
সেঁজুতি খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,, ঠিক আছে আপা। তাহলে এখন রাখছি।
সেঁজুতি কল কাটতেই অনিলা রহমান পুরো ঘর জুড়ে পায়চারি করতে লাগলো। টেনশনে কপালের ঘাম ছুটে গেছে। মোবাইল বিছানায় রেখে ছুটে বেরিয়ে গেলো। দরজা নক না করেই সাদের রুমে ঢুকে পড়লো। সাদ তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অনিলা লাইট অন করে সাদকে জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল। হঠাৎ এমন হওয়াতে চমকে উঠে বসলো সাদ। চোখ খুলে মাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বললো,, কি হয়েছে মা? তুমি এইখানে? সব ঠিক আছেতো? সাদ মায়ের দুগালে হাত ছুঁইয়ে বললো,, তুমি ঠিক আছো?
অনিলা রহমান আসফাস করতে করতে বললো,, না ঠিক নেই। কাল সাজিকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে। ছেলে খুব ভালো। সাজির ভার্সিটির প্রভাষক, সাজিকে ভার্সিটিতে দেখে পছন্দ করেছে। কাল পরিবার সহ দেখতে আসবে। এমন ঘটনা শোনার পর আমি কি করে ঠিক থাকবো বল?
মায়ের কথা কর্ণোগোচর হতেই ঘুমের ঘোর ছুটে পালালো। সাদ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। অনিলা রহমান কিছু বলবে তার আগে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,, আমি একটু বেরোচ্ছি মা। আমার কাজ আছে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
অনিলা রহমান ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। ছেলের কি কাজ সেটা ভালো করেই জানে। অনিলা রহমান দৌড়ে রুমে গিয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে রায়হানকে কল দিলো। রায়হান তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
সাদ গাড়িতে বসে আছে। মায়ের কথা শোনার পর থেকেই সাদের ভেতরটা শূন্য শূন্য লাগছে। মনে হচ্ছে খুব প্রিয় কিছু একটা ক্রমশো হারিয়ে যাচ্ছে। মাথার রগ গুলো যেন ছি*ড়ে যাওয়ার জোগাড়। সাদ একহাত দিয়ে চুল টানছে,অন্যহাত দিয়ে ড্রাইভ করছে।আজ যেন পথ শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না।
অন্যদিকে রায়হান সব কিছু শুনে থ হয়ে গেছে।অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে পড়লো। এতো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছে যে পরনে থ্রীকোয়াটার প্যান্ট আর গায়ে হাত টিশার্ট জড়ানো সেটাই ভুলে গেছে। রায়হান মনে মনে একটাই দোয়া স্যারকে যেন সুস্থ এবং গন্ডোগল বিহীন অবস্থায় পায়।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,
নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৩৪
সাদের গাড়ি সাজিদের বাড়ির গেটের সামনে এসে থামলো। হর্ণ বাজাতেই দারোয়ান দৌড়ে গেইটের কাছে এলো। সাদের গাড়ি এইসময় এইখানে দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়।সাজি অসুস্থ থাকা অবস্থায় এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটেছে। কিন্তু এইবাড়ি থেকে যাওয়ার পর সাদ আর কখনো এই সময় এইখানে আসেনি। তাহলে আজ কি হলো? দারোয়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে গেইট খুলে দেয়। অন্য সময় হলে সাদ মুচকি হেসে দারোয়ান চাচার সাথে কুশলাদি বিনিময় করতো। কিন্তু আজ যেন দারোয়ানের দিকে তাকানোর সময় ওবদি নেই। সাদের এমন ব্যাবহারে দারোয়ান কিছুটা ভাবুক হলো।
সাদ গাড়ি নিয়ে সাই করে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। সাদের গাড়ি পার হতেই আরেকটা গাড়ি এসে গেটের কাছে থামলো। সেই গাড়িটা চিনতে দারোয়ানের খুব একটা সময় লাগলো না। এইটা যে সাদের পিএর গাড়ি তা দারোয়ান ভালো করেই জানে। রায়হান দারোয়ানের উদাসীন ভাব দেখে রেগে গেলো। জানালার কাঁচ নামিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠল,, চাচা গেইট খুলে দিবেন নাকি ভে*ঙে ঢুকবো?
রায়হানের কথা শুনে দারোয়ান হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি গেইট খুলে সরে দাঁড়ায়।গেইট খুলতেই রায়হান গাড়ি নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
সাদ ব্যাতি ব্যাস্ত হয়ে গাড়ি থেকে বের হয় । এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত কলিং বেল বাজাতে শুরু করলো। যে ছেলেটা কলিংবেল একবার চেপে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থেকে, দরজা খুলার অপেক্ষা করে।সে আজ লাগাতার কলিং বেলে বাজিয়ে যাচ্ছে। সাদ কলিং বেল চেপে ধরে রাখলো। আজকের সাদকে দেখলে কেউ বলবেই না এই ছেলেটা কঠিন মাপের ধৈর্যশীল।
কলিং বেলের শব্দে কান চেপে ধরল সেঁজুতি। সবে মাত্র বিছানায় পিঠ লাগিয়েছে। এই দিকে জুবায়েরের এক ঘুম হয়ে গেছে। সেঁজুতি কলিং বেলের এমন শব্দে চোখ মুখ কুঁচকে জুবায়েরকে ধা*ক্কা দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, উঠবে তুমি? বাড়িতে চোর এলো নাকি ডাকাত এলো কে জানি। এই দেখো বাড়ির এক মাত্র পুরুষ হয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। জুবায়ের উঠবে তুমি??
বউয়ের চিল্লাচিল্লি আর টিপ্পনি কে*টে কথা বলায় ঘুম টিকলো না। বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। কে এমন কলিং বেল বাজাচ্ছে? থামার নামই নিচ্ছে না। জুবায়ের বিছানা থেকে উঠে চশমা পরে মনে মনে ঠিক করে নিলো। কালই এই কলিং বেলের তার কেটে দিবে।
জুবায়েরের পেছন পেছন চললো সেঁজুতি। বারোটার বাজার পাঁচ মিনিট বাকি আছে। দারোয়ান থাকতে এই মধ্য রাতে বাড়িতে হা*না দিলো কে? চিন্তিত জুবায়ের।
লতা আর রেনুর ছেলে মেয়ে দুটো অনেক আগেই ঘুমিয়েছে। লতা আর রাফি স্কুলে পড়ে। লতা নবম শ্রেনিতে আর রাফি প্রথম শ্রেনীতে। দুটোকে পড়তে বসার কথা বললেই ঘুম চোখে ভীড় করে। দুই পড়া চো*র দশটার মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু রেনুর চোখে ঘুম নেই। সে কালকের ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত। সাজি আপাকে দেখতে আসবে তা যদি সাদ ভাইয়া জানতে পারে তাহলে সব ধ্বং*স করে দিবে। রেনু আগাম সব জল্পনা কল্পনা করতে করতে ঘামছে। কলিং বেলের এহেন শব্দে রেনুও ছুটে বের হলো।এতো রাতে কে এলো?
জুবায়ের লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে বাইরে কে আছে তা দেখতে চেষ্টা করলো। দেখতে পেলো কিন্তু আন্দাজ করতে পারেনি। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তি মাথা নিচু করা।তবে হাত খানা ঠিকই কলিং বেলের উপর রাখা।
অপেক্ষা করলো না জুবায়ের। হাট করে দরজা খুলে সামনে তাকালো।
সাদ দাঁড়িয়ে আছে। বি*ধ্ব*স্ত অবস্থা তার। পরনে ট্রাউজার, গায়ে টিশার্ট। মুখটা শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। সেট করে রাখা চুল অগোছালো হয়ে আছে।
সব মিলিয়ে তার অবস্থা ভালো ঠেকছে না। জুবায়ের চশমা ঠিক করে পুনরায় তাকালো। সেঁজুতি জুবায়েরের পেছন থেকে মাথা বের করে সামনে তাকায়। দরজায় দাড়ানো সাদকে দেখে ব্যাতি ব্যাস্ত হয়ে বেরিয়ে এলো । উৎকণ্ঠা হয়ে সাদের হাত ধরে বললো,, কি হয়েছে সাদ?
রেনু পেছন থেকে উঁকি মে*রে সাদকে দেখে নিলো। মনে মনে যা ভেবে রেখেছে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে দেখেই ঘাবড়ে গেল।
সাদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তার মামার দিকে তাকালো। জুবায়ের বিচক্ষণ দৃষ্টি দিয়ে সাদকে একবার পরখ করে বললো,, ভেতরে আয়।
জুবায়ের পেছনে ঘুরে এক পা বাড়াতেই সাদ নিরেট স্বরে বলে উঠলো,, আমি সাজিকে বিয়ে করতে চাই!
সাদের কথার মাঝেই দৌড়ে আসলো রায়হান। সদের বলা কথাটা শুনে কপালে চা*পড়াতে লাগলো। ওও শিট!!দেরি হয়ে গেছে।
সাদের বলা কথা শুনে মুচকি হাসলো রেনু। ভাবাবেগ হলো না সেঁজুতির।সেঁজুতি যেন আগ থেকেই জানতো সাদ এমন কিছুই বলবে। সেঁজুতির চোখ মুখ হাসলেও চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ নেই।
জুবায়ের থমকালো। বাড়ানো পা গুটিয়ে নিয়ে পুনরায় পেছন ফিরে তাকালো। আচম্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,, এই কথা বলার জন্য এতো রাতে এইখানে এসেছিস?
রায়হান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মুখ ফুটে কিছু বলতে নিবে তার আগেই সাদ বলে উঠলো,, এইটা কোনো সামান্য কথা নয়। তাই ধীরে সুস্থে আসতে পারিনি। গুরুত্বপূর্ণ কথা আর কাজ কোনোটাতে সময় দেখতে হয় না। শুধু গুরুত্ব দিতে হয়।
~ কথা ভুল নয়। তবে সে ক্ষেত্রে দুই পক্ষ সমান গুরুত্ব দিতে হয়। এক পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কাজে আর কথায় অন্য পক্ষ কেন গুরুত্ব দিবে?
জুবায়েরের এমন শক্ত পোক্ত কথায় চমকালো সেঁজুতি। অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে বললো,, পা*গ*ল হলে জুবায়ের? এমন করে কথা বলছো কেন?
সেঁজুতির কোনো কথাই যেন জুবায়েরের কান ওবদি পৌছালো না। জুবায়ের নিরেট স্বরে সাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,, তোমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কথায় সামনের মানুষ তখনই গুরুত্ব দিবে, যখন তুমি তোমাকে গুরুত্ব দিবে। তোমাকে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। But,Look at yourself! Now you look absolut irresponsible. As a Father ! আমি এমন irresponsibleছেলের কাছে কখনোই আমার মেয়ে দিবো না। যে নিজেকে গুছাতে পারে না,সে কিভাবে আমার মেয়ের খেয়াল রাখবে?
জুবায়েরের কথায় চমকে উঠলো সেঁজুতি তার সাথে রেনুও।
রায়হান সাদের হাত ধরে জুবায়েরকে উদ্দেশ্য করে বলল,, কিছু কিছু সময় দায়িত্ববান মানুষ গুলো দায়িত্বজ্ঞান হীনের মতো কাজ করে বসে। আসলে এইটা তাদের দোষ নয় পরিস্থিতির কারন মাত্র।তার মানে এই নয় আপনি হুট করে আপনার রায় জানিয়ে দিবেন। বাইদা ওয়ে পুনরায় দেখা হবে।আর হ্যা, তখন আপনার দেখা একজন দায়িত্বশীল মানুষের সাথেই হবে। আল্লাহ হাফেজ।
রায়হান সাদের হাত ধরে একপ্রকার টা*নতে টা*নতে নিয়ে গেল।
রেনুর দুগাল চোখের পানিতে জবজবে হয়ে আছে। রেনুর বিশ্বাস হচ্ছে না খালু এমন কিছু করবে। সাজি আপাতো ঘুমোচ্ছে। সে জানতেই পারলো না তার পিঠ পিছে কি ঘটে গেলো, এবং ঘটতে চলছে।
রেনু হা হুতাশ করে কাঁদতে কাঁদতে রুমের দিকে ছুটলো।
সেঁজুতি বুকে হাত গুজে জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে জুবায়ের সাদের সাথে এমন ব্যাবহার করেছে।এক মূহুর্তের জন্য সব কিছু দেখে আনন্দিত হলেও এখন সেঁজুতির ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
জুবায়ের দরজা বন্ধ করে পেছনে ফিরে সেঁজুতির দিকে তাকালো। সেঁজুতি ধরা গলায় সুধালো,, এমন করা কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? তুমি তোমার মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিবে ভালো কথা। কিন্তু সাদের সাথে এইভাবে কথা বলার কোনো অধিকার তোমার নেই । সাদকে দায়িত্ব জ্ঞানহীন বলার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে বলো। ছেলেটাকে এইভাবে কথা বলে কষ্ট দিতে পারো না তুমি জুবায়ের।
জুবায়ের সেঁজুতির টলোমলো করা চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে নিরেট স্বরে বলল,, সাদকে তোমার চাইতে আমি বেশি চিনি সেঁজুতি। যাকে তুমি সব সময় দেখে এসেছো তার বাইরেও তার আরেকটা সত্বা আছে। সে কতোটা কষ্ট পেয়েছে কি পায়নি সেটা আমি বুঝে নিবো। আপাতত যাও ঘুমিয়ে পড়ো। কাল মেহমান আসবে সকাল সকাল উঠতে হবে।
জুবায়েরের কথা গুলো সেঁজুতির গায়ে কাঁ*টা*র মতো বিঁধ*লো। সেঁজুতি জুবায়েরের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধুপধাপ পা ফেলে রুমে চলে গেল।
ইনশাআল্লাহ চলবে….
(ভুল গুলো সুধরে দিবেন।)