নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৪০
সাদ তার ফুফু রুবিনা আর চাচা শফিকের সামনে বসে আছে। তার ফুফু আর চাচা এতক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বললেও শফিক মুখ ফুটে বলে উঠলো,, তা কি এমন ধরাবাঁধা ছিলো যার জন্য ওই মেয়েকে বিয়ে করতে হচ্ছে। এমনিতেই তোর নানার বাড়ির মানুষেরা আমার ভাই ভাতিজা সবাইকে আমাদের থেকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে। যেটুকু যোগাযোগ আছে ওই মেয়ে বউ হয়ে আসলে সেটাও থাকবে না।
সাদ নড়েচড়ে বসল।সাদের চাচি চায়ের কাপ সাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,, তোমার চাচ্চু ঠিক বলেছে সাদ। আরেকবার ভেবে দেখো।আমি নিজে দেখেছি তোমার বাবা মা*রা যাওয়ার পর কিভাবে তারা তোমাদের হাত করে নিয়েছে।
চাচির কথা শুনে সেই দিন গুলোতে ফিরে গেলো সাদ। মনে পড়ে গেল এই মানুষ গুলোর স্বার্থপরতার কথা। সেই দুর্বিষহ দিন গুলোর তিক্ততম স্মৃতি।
সাদ চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে মুচকি হেসে তাচ্ছিল্য করে বললো,, হ্যা চাচি আমিও তাই ভাবছি। আমার বাবার টাকা যারা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে শিখেছে তারা আমার বাবার চলে যাওয়ার পর পায়ে ঠেলে দিয়েছিল। যারা বাড়ি আসলে আমার মা আপ্যায়নের জন্য একপায়ে খাড়া থাকতো তারা তাকে অপয়া বলতে দুবার ভাবেনী। তাতেও তারা খান্ত হয়নি! বাবার মৃত্যুর জন্য আমার মাকে দায়ী করেছিল তারা। কি করে ভুলব সে সব চাচি?
সাদের কথায় শফিক চোখ সরিয়ে নিল। রুবিনা আর সাদের চাচির মুখে অন্ধকার ছেয়ে গেছে।সাদ যে সব কথা তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছে তা ঠিকই বঝেছে।
সাদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, আমি আমার বাবার মত নই। আমি খারাপ ভালোর পার্থক্য করতে পারি । যে যেমন তাকে তেমন ভাবে বুঝানোর মতো ক্ষমতা , সাহস দুটোই আমার আছে। তোমাদের ভাইয়ের ছেলে হলেও কিছু গুন তোমাদের পেয়েছি। রইলো বিয়ের ব্যাপারে,মেয়ে আমি নিজেই পছন্দ করেছি। কেউ জোর করেনি। এই বংশের বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা আশা করি সবাই সময় মতো পৌঁছে যাবে। আজকের মতো আসছি।আল্লাহ হাফেজ।
সাদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গট গট করে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলো। এই বাড়িতে এলে নিঃশ্বাস নেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।বাবা থাকা কালীন সব কিছুই সুন্দর ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর সবাই তাদের চেহারার উপর থেকে মুখোশ সরিয়ে ফেলেছে। এখানে ভালোবাসা বাবার টাকা পয়সা দিয়ে মাপা হয়। যার বাবার টাকা বেশি,তার ভাগে ভালোবাসাটাও বেশি। বার কয়েক চুলে আঙুল চালিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। অতঃপর গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
অনেক চেষ্টার পর রিমির খোঁজ পাওয়া গেছে। রিমিকে নিয়ে আসার গুরু দায়িত্ব রায়হানকে দেওয়া হলো।
রায়হান রিমির বাড়ির ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। প্রায় সারে তিনঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে রিমিদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায়। সাততলা ভবনের মধ্যে রিমিরা থাকে পাঁচতলায়। রায়হান ভেবে রেখেছে লিফ্ট না থাকলে বাড়ির সামনে থেকে কেটে পড়বে। গাড়ি পার্কিং এরিয়াতে রেখে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো রায়হান। ওয়াচম্যানকে জিজ্ঞেস করলে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে লিফ্ট দেখিয়ে দেয়।
লিফ্টের সামনে দাঁড়িয়ে সাদকে কল দেয়। রায়হানের কথা বলার মাঝে পেছনে থেকে কেউ এসে আচমা ধাক্কা দেয়। যার ফলশ্রুতিতে রায়হান হুমড়ি খেয়ে লিফ্টের ভেতরে গিয়ে পড়ে।ভ্যাগিস চিৎপটাং হয়ে পড়েনি তার আগেই কেউ শার্ট ধরে আটকে দেয়। রাগে রায়হানের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। হাত মুঠ করে ঘুসি মারার জন্য হাত উঠিয়ে পেছনে ফিরে চমকে উঠে। রায়হান ভেবেছিলো কোনো ছেলে হবে। কিন্তু না ছেলে নয় , রায়হানকে ধাক্কা দেওয়া ব্যাক্তিটা একটা মেয়ে।
রায়হান হা করে তাকিয়ে আছে। কোমরে হাত গুজে রাগি চোখে তাকিয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে শান্ত হয়ে গেছে রায়হান। মুঠ করে রাখা শক্ত হাত দুটো সিথিল হয়ে এলো। রায়হান কিছু বলবে তার আগে বাজখাঁই গলায় রিমি বলে উঠলো,, যখন যানেন দুই প্রোগ্ৰাম এক সাথে কাজ করে না তখন চেষ্টা করতে যান কেন?
রায়হান চমকে উঠে বললো,, মানে!
রিমি দাঁতে দাঁত চেপে হিস হিস করে বলে উঠলো,, মানে! ফোন কানে নিয়ে হা করে লিফ্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে একটা মানুষ এতক্ষণ ধরে ডাকছে শুনতে পাননি? তার থেকে বড় কথা ফোনে কথা বলতে বলতেও লিফ্টে চড়া যায়। কিন্তু আপনি তো ফোন নিয়েই ম*রছেন। যত্তসব আজাইরা পাবলিক।
রিমি সামনের দিকে তাকিয়ে ফুঁসছে।
রায়হান আচম্বিত নয়নে রিমির দিকে তাকিয়ে বলল,, একটুর জন্য এতো কিছু শুনিয়ে দিলেন? আপনি যে ধাক্কা মে*রে*ছেন তার বেলায়?
রিমি ফু দিয়ে সামনে আসা চুল গুলো উড়িয়ে বললো, কখন দিলাম ধাক্কা ?কোনো প্রমাণ আছে?
রায়হান অবাকতার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। মেয়েটা যতোটা কিউট তার থেকে বেশি ডেইন্জারাস।কেমন পাল্টি বাজ মেয়ে।
রিমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,, কত তলায় যাবেন? রায়হান বিড়বিড় করে উত্তর দিলো, পাঁচতলায়।
রিমি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,, মনে হয়না পাঁচতলায়। দেখে আত্মীয় আত্মীয় ফিল আসছে না। সত্যি করে বলুন?
রায়হান কিছু বলবে তার আগেই পাঁচতলায় এসে থামলো লিফ্ট। রায়হান লিফ্ট থেকে বেরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে এই পাঁচ তলায় শুধু মাত্র একটা ইউনিট। বুঝতে বাকি নেই এই ইউনিটে শুধু রিমিরা থাকে। রায়হান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাবে তার আগে রিমি সামনে দাঁড়িয়ে হড়বড়িয়ে বলে উঠলো,, আপনি কে আগে সেটা বলুন!বাই এনি চান্স বিয়ের জন্য আসেন নিতো! যদি সেই সুবাদে এসে থাকেন তাহলে বলে রাখছি আমি এই ঘরের এক মাত্র মেয়ে। তবে বিয়ে করতে একটুও ইন্টারেস্টেড নই। তাড়াতাড়ি কেটে পড়ুন নয়তো খবর আছে!
রায়হান রিমির এমন কথায় না হেসে পারলো না। ভয়ে রিমির মুখটা এটুকুন হয়ে আছে। এতক্ষণে রায়হান বুঝতে পারলো এই রাগী মেয়েটা সাজির বেষ্ট ফ্রেন্ড রিমি। রায়হানের হাসি দেখে রিমি মুখ কাচুমাচু করে বললো,, প্লিজ চলে যান!!
রায়হান মনে মনে পন করে বসলো সামনের বার সত্যি বিয়ের জন্য আসবো। আপাতত কাজ সেরে যাই। রায়হান হাতে থাকা কার্ড রিমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, রিলেক্স!বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসিনি বরং দাওয়াত দিতে এসেছি। আপনার বান্ধবীর বিয়ের।
রিমি অবাক হয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল,, সাজির?
রায়হান মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো। রিমি টলমল চোখে কার্ড হাতে নিয়ে সুধালো,, সাজিঁ সুস্থ হয়ে গেছে?
রায়হান মুচকি হেসে বলল, অনেক আগেই সুস্থ হয়ে গেছে।
রায়হানের কথা শুনে রিমি ঠোঁট এলিয়ে হেসে ওঠে তার সাথে দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। রিমি কতোটা খুশি তা রিমির চোখের জল বলে দিচ্ছে। রায়হান অবাকচিত্তে রিমির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন বুঝতে পারছে কেন সাজি ম্যাম তার বান্ধবীর জন্য মন খারাপ করে ছিলো।
রিমি বিয়ের কার্ড খুলে সাদের নাম দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। রায়হান প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে। রিমি কলিং বেল চেপে বললো,, শেষে বদরাগী সাদ ভাই সাজির বর হচ্ছে! ওয়াও।
______
সন্ধ্যায় সাজি আর সাদের এংগেইজমেন্ট। সকাল থেকে দুই বাড়িতে বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। সাজিদের বাড়ি এখন মেহমানে ভরে উঠেছে। সাজির নানার বাড়ির মানুষেরা এসেছে, সাথে সেঁজুতির বাল্য কালের দুজন বান্ধবী আর তাদের পরিবার। সবাই হই হই করে বাড়িতে উপস্থিত। জুবায়ের এংগেইজমেন্ট অনুষ্ঠানের জন্য হল বুকড্ করার কথা বললে সাদ সাফ মানা করে দেয়। সাদের মতে বাইরের কেউ যখন নেই তখন হল বুকড্ করানোর কি দরকার। বাড়িতে সাদামাটা আয়োজন করলেই হবে। তাই সাদের কথা মতো সবটা সাজিদের বাড়িতে হচ্ছে। যার সম্পূর্ণ দায় ভার সাদ নিয়েছে। বাড়ির বাগানে বড় করে প্যান্ডেল করা হয়েছে। ওয়েডিং প্ল্যানার এসে স্টেজ থেকে শুরু করে বাড়ির গেইট ওবদি পুরো সাজিয়ে ফেলেছে। সাদামাটা বললেও ঠিক সাদামাটা লাগছে না।এখন বাকি রয়েছে কনে আর বর।
সাদের দাদার বাড়ি থেকে বড়রা কেউ আসেনি। তবে ছেলে মেয়ে গুলোকে আটকে রাখা যায়নি। সাদের কল পেয়ে শেফালী,বিন্দু, আজাদ, জিহাদ আর রশনি ব্যাগ পত্র গুছিয়ে হাজির। রশনি প্রথমে আসতে চায়নি,পরে শেফালী আর বিন্দু জোর করে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে এমডি-র এংগেইজমেন্ট বলে কথা। অফিসের স্টাফরা সবাই সেজে গুঁজে হাজির। মেহমানদের আপ্যায়নে কমতি রাখছে না অনিলা। হেঁটে হেঁটে সারভেন্টদের দেখিয়ে দিচ্ছে কাকে কি দিতে হবে। আনিস বোনকে সব কিছুতে সঙ্গ দিচ্ছে। জুবায়েদা খাতুনও কম নয়। সবাই নাতি নাতনির বয়সী হওয়াতে তিনি চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
পার্লার থেকে দুজন মহিলা এসেছে সাজিকে সাজাতে। সাজি মোবাইল হাতে নিয়ে রিমির নাম্বারে বারবার ডায়েল করে যাচ্ছে। এইদিকে রিমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সাজির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। সাজি মোবাইল পাশে রেখে মহিলা দুটোকে উদ্দেশ্য করে বলল,, কিভাবে সাজাবেন বলে দিয়েছে? মহিলা দুটো মাথা নেড়ে না বুঝালো।
সাজি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, এইবার কি হবে?
পেছন থেকে রিমি বলে উঠলো,, আমি আছি না? কি হবে তা আমি বুঝে নিবো।
রিমির গলার আওয়াজ পেয়ে তৎক্ষণাৎ ফিরে তাকায় সাজি। অনেকটা সময় পর দুজন দুজনকে দেখছে। সাজি ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠে বললো,, বের হ ঘর থেকে!
~ বর বলেছে তার বউ আমার জন্য হা হুতাশ করে ম*র*ছে। এখন দেখছি ঘর থেকে বের হতে বলছে।
সাদি দৌড়ে রিমিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
~এই তোর আসার সময়? বে*য়া*দব মেয়ে! কোথায় ছিলি তুই? মিস করেছি না!
রিমি সাজির পিঠ জড়িয়ে ধরে বললো,, সেসব কথা পরে বলা যাবে। অলরেডি ছয়টা বেজে গেছে। তোকে তাড়াতাড়ি রেডি করাতে বলেছে। তা না হলে সাদ ভাই কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিবে।
বরের বাড়ি থেকে একটা একটা করে গাড়ি এসে থামলো গেইটে। একে একে নেমে এলো সবাই। দুই পক্ষের মানুষের মেলবন্ধনে জমে উঠেছে অনুষ্ঠান।
সাদা শার্টের সাথে কালো কোট ,প্যান্ট। হাতে সিলভার কালারের ওয়াচ। চুল গুলো বরাবরের মতই সেট করা। এই লুকে সাদকে দেখতে রাজকুমার থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না। সেঁজুতির বান্ধবীর মেয়ে দুটো সেই কখন থেকে হা করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে সেঁজুতি মুচকি মুচকি হাসছে। তার মেয়ে জামাই বলে কথা। আশেপাশের মেয়েরা জ্ব*লে পু*ড়ে ছাই না হলে কিসের জামাই!
এতক্ষণ সাদ বেশ খোশ মেজাজে থাকলেও নিশানকে দেখে মূহুর্তে সাদের মেজাজ বিগড়ে গেলো।
শেফালীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে নিশান। টালবাহানা করে কথা বলার চেষ্টা চালাচ্ছে। সাদ বুঝতে পারছে না এতো কিছু হওয়ার পর মামুনী কি করে এই কালপ্রিটকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। নিশানকে দেখে অনিলা ভয়ে জড়সড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়।
না জানি ছেলে তার কোনো কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেয়।
সাদ স্টেজ থেকে নামতে নিবে এমন সময় রায়হান হাত ধরে আটকে সামনে ইশারা করে। সাদের থমকানো পা দুটো আরো থমকে গেলো। সামনে থেকে এগিয়ে আসা রমনিতে দু’চোখ আটকে গেছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সাদ। এই রমনিকে তার কল্পনার চাইতেও বেশী সুন্দর লাগছে। সাদ বিড়বিড় করে,, এতোকাল পু*ড়ি*য়ে খান্ত হওনি মেয়ে! এখন আবার নতুন করে পো*ড়াতে এলে।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,
নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৪১
ডার্ক রেড কালারের মধ্যে হেবি স্টোন ওয়ার্ক গাউন পরেছে সাজি।সাজির ডাগর চোখ জোড়ায় কাজল ছোঁয়াতে নিষেধ করেছে সাদ।রিমিকে বলে দিয়েছে যতটা সিম্পল থাকা যায় ঠিক ততটাই সাজাতে। সাদের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী রিমি সাজির চোখে শুধু আইলাইনার দিয়ে দিতে বলেছে। পার্লারের মহিলা দুটো সাজিকে খুব সিম্পল লুকে তৈরি করে দিয়েছে। মুখে হালকা মেকআপ, ঠোঁটে গাড় লাল লিপস্টিক আর চোখে আইলাইনার। চুলে মাঝখানে সিঁথি কেটে খোঁপা করে দেয়। সেই খোঁপা পুরোটা লাল গোলাপ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। কানে বড় বড় ঝুমকো দুহাত ভর্তি চুড়ি ব্যাস এই টুকুই ছিলো সাজ। শেষে ওড়নার একপাশ ছেড়ে রেখে আরেক পাশ দিয়ে ঘোমটা দিয়ে দেওয়া হয়। সাজগোজ শেষ হওয়ার পর সাজি নিজে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নার মধ্যে বারকয়েক দেখে নেয়। নিজেকে নিজের কাছে খুব বেশি সুন্দর লাগছে। আচ্ছা সাদ ভাইয়ের পছন্দ হবে তো? নিজের করা প্রশ্নে নিজে লজ্জায় লাল হয় সাজি।
রিমি ,লতা আর রেনু মিলে সাজিকে স্টেজের দিকে নিয়ে গেলো। ঠিক তখনই সাদ দেখে হা হয়ে যায়। সাজি মাথা তুলে সাদের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়।সাজি মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় বলে উঠলো, লোকটা ভীষণ নির্লজ্জ এতো মানুষের মাঝখানে দাড়িয়ে হাবলার মতো তাকিয়ে আছে কেন!সবাই কি মনে করছে এখন!
রেনু মুখ টিপে হেসে বলল,, সাজি আপা সাদ ভাই তো শেষ। বেচারা হয়তো বেহুঁশ হয়ে যাবে।
রিমি সাজিকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বললো, বদরাগী সাদ ভাই কুপোকাত! রিমির পাশ থেকে লতা গলা খাকিয়ে রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,, সাজি আপার কথা বাদ দাও আপু। বরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতীয় হ্যান্ডসাম ছেলেটা চারবার তোমার খোঁজ করেছে। এখন দেখো কেমন করে হা হয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।
রিমি পিট পিট করে সাদের পাশে দাঁড়ানো রায়হানের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি বেটা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। রিমি দাঁত কিড়মিড় করে বললো,, এইটারে পরে দেখে নিবো।
সাজির একপাশে রেনু আর লতা অন্য পাশে রিমি তার সামনে গুটি গুটি পায়ে ফেলে এগিয়ে আসছে চাঁদ। সবাই মুচকি হেসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাজি স্টেজে ওঠার আগে চাঁদ সাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে ওঠার জন্য। যা দেখে সবাই খিলখিল করে হেসে উঠে।সাজি নিজেও হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার জোগাড়। চাঁদকে ছোট পরী থেকে কম লাগছে না। সাদা রঙের বার্বি ড্রেস পরেছে চাঁদ,যা সাদ নিজে এনেছিল। সাদ হাত বাড়িয়ে চাঁদকে কোলে তুলে দুগালে চুমু আটলো। রায়হান এগিয়ে চাঁদকে সাদের কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নেয়। অতঃপর সাদ হাত বাড়িয়ে সাজির হাত ধরে স্টেজে তুলে। সাজি লজ্জায় সাদের দিকে ঠিক করে তাকাতে না পারলেও, এইদিকে সাদ ঠিকই সাজির দিকে তাকিয়ে নিজেকে সবার সামনে কঠিন মাপের নির্লজ্জ প্রমাণ করে দিলো। রায়হান সাদকে খোঁচা মেরে বার কয়েক বলেছে , স্যার ম্যাম আখের আপনারই হবু বউ ।যাকে আজীবন চোখের সামনে দেখতে পাবেন। তার থেকে বরং আমরা যারা আছি তাদের দিকে একটু তাকান! আমরাতো চব্বিশ ঘন্টা আপনার সাথে থাকবো না। রায়হানের কথা শুনে সাদ বরাবরের মতো গম্ভীর গলায় বলল,, একবার কারো প্রেমে পড়ে দেখো। তাকে দেখার জন্য আজিবনও কম পড়বে। ব্যাস রায়হানের মুখ বন্ধ।
বিন্দু রশনির পাশে দাঁড়িয়ে সাদ আর সাজির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,, রশনি আপু ! সাজি ঠিকই বলেছে আসলেই তাদের জুটি দেখলে যে কেউ বলবে ” মেইড ফর ইচ আদার। দে লুক কিউট টুগেদার”। দেখ না দুজনকে কি সুন্দর মানিয়েছে! সাজিকে পুরো পাকিস্তানি বউদের মতো লাগছে। আমি একশো পার্সেন্ট শিওর সাদ ভাই নিজে বলেছে সাজিকে এইভাবে সাজাতে।
টলমল চোখে দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে রশনি। তার একতরফা ভালোবাসা কখনো পূর্নতা পাবে না তা রশনি অনেক আগ থেকেই জানতো। তাও কেন জানি ভালোবাসাটা ছাড়তে পারেনি। না ছাড়তে পেরেছে সাদকে নিয়ে কল্পনা জগৎ সাজানো। কিন্তু আজ সব কিছুর ইতি টানতে হবে।রশনি টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ জোড়া আলতো হাতে মুছে বললো,, হ্যা ঠিক বলেছিস। দুজনকে একসাথে খুব সুন্দর মানিয়েছে।
বিন্দু চশমা ঠিক করে রশনির দিকে তাকিয়ে বলল,, যা হচ্ছে তা মেনে নেওয়া মুশকিল হলেও মেনে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। তোমার জন্য বেষ্ট কিছু অপেক্ষা করছে আপু। তুমি কারো লাষ্ট প্রায়োরিটি হয়ে নয়, বরং তুমি ফাস্ট প্রায়োরিটি হবে। তুমিও কারো জন্য মেন্ডেটোরি বিষয়ের মতো হবে। যার শুধু তোমাকেই লাগবে।
রশনি বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে মুচকি হেসে বলল,, হ্যা তুই ঠিক বলেছিস। চল ওইদিকটায় যাই একটু পরে রিং পরানো হবে। এইপাশ থেকে ছবি ছবি ভালো আসবে না।
বিন্দু ঠোঁট এলিয়ে হেসে রশনির হাত ধরে স্টেজের পাশে দাঁড়ালো। রশনি বুঝতে পেরেছে এতেই অনেক। রশনির জন্য সাদ ভাই মরীচিকা ব-ই কিছুই না। কারন সাদ ভাইয়ের ফাষ্ট এন্ড লাষ্ট প্রায়োরিটি শুধুই সাজি। যেখানে রশনি নামের কারো অস্তিত্ব নেই,আর না হবে কখনো।
যেখানে সকল আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে সাদ সাজিকে আংটি পরিয়ে দেয়, সেখানে সাজিঁ আংটি হাতে নিয়ে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে বসে রইল। না জানি আজ এতো লজ্জা কোথা থেকে আসল। সাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বললো,, বাই এনি চান্স অন্য কারো খেয়াল মাথায় আসলে সাথে সাথে ঝেড়ে ফেল। এই সাদ তোর পিছু এতো সহজে ছাড়বে না। তাড়াতাড়ি রিং পরিয়ে দে। নয়তো থা*প্প*ড় মে*রে দাঁত ফেলে দিবো।
সাদের কথা শুনে অবাক হলো সাজি। মুখ তুলে সাদের দিকে তাকিয়ে সাদের মত ফিস ফিস করে বলল, কতো বড় সাহস! বেশি করলে এক্ষুনি বাবাকে বলে বিয়ে ক্যানসেল করে দিবো। এমন বদরাগী ছেলেকে বিয়ে করবো না। আপনার হাতের বামে তাকিয়ে দেখুন পাত্র তৈরি আছে সাথে স্টেজ, আংটি আর পাত্রী সব। ইশারা করার দেরি আর আপনাকে রিপ্লেস করার দেরী। এখনো সময় আছে সুন্দর করে আদুরে গলায় বলুন। নয়তো গেলাম!
সবাই সাদ আর সাজির দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। না কেউ তাড়া দিচ্ছে ,না কেউ শব্দ করছে। সবাই তাদের এই খুনসুটি ভরা মুখের এক্সপ্রেশন দেখায় ব্যাস্ত।
সাজির এহেন কথায় অবাক হলো সাদ। পাশে তাকিয়ে দেখে সত্যি রিসাদ দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। সাদ চোখ ছোট ছোট করে বলে,, তোকেতো আমি পরে দেখছি।
সাজি আংটি হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে বিড়বিড় করে বললো,, তাড়াতাড়ি করুন।নয়তো গেলাম!
সাদ জানে এই মেয়ে তাকা নাকানিচোবানি ঠিকই খাওয়াবে। তাই সাদ মুচকি হেসে আদুরে গলায় বলল,, তোমার কোলাহল পূর্ণ ব্যাস্ত শহরে এই নিঃসঙ্গ আমিকে একটু সঙ্গ দিবে?
সাদের কথা কর্ণগোচর হতেই সাজি মুচকি হেসে সাদের আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিলো। এমন সময় সবাই হই হই করে উঠে। সবির নজর এড়িয়ে সাজি সাদের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো, সেইতো আমার ব্যাস্ততম শহরটা আপনাকে ঘিরে। যেখানে আপনি কখনোই নিঃসঙ্গ নন। বরং কেউ প্রতিনিয়ত আপনাকে তার কল্পনার জগত জুড়ে আঁকছে।
ঈষৎ ভেজা চোখে হাসলো সাদ। জীবনের শ্রেষ্ঠ চাওয়া যেন এখনই পূর্নতা পেলো। বোহু প্রতিক্ষার পর ভালোবাসার মানুষটা আরেকপা এগিয়ে তার নামে নিজেকে জুড়ে দিলো। এর চেয়ে সুখ কর বোধহয় আর কিছুই হয় না।
রাত প্রায় এগারোটা এংগেইজমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে আরো আধা ঘন্টা আগে। খাওয়া দাওয়া শেষ এখন যে যার যার গন্তব্যে পৌঁছানোর তাগিদে ছুটছে।সাদ আর রায়হান গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানাচ্ছে।।বাগানে বসে রশনি,বিন্দু, শেফালী, ইরিনা, জিহাদ আর আজাদ মিলে আড্ডা দিচ্ছে।রিমিকে বারবার মানা করার সত্বেও থামেনি।রিমি লতা আর রেনুর সাথে ঘর গোছানোর কাজ করছে। অপর দিকে বড়রা সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা ব্যাস্ত।
সাজি তার ঘরে গেছে চেন্জ করেতে।ওড়না ফেলে আয়নার সামনে বসে খোঁপায় লাগানো ফুল গুলো খুলে রাখলো সাজি ।জিবনটা কোথা থেকে কোথায় মোড় নিলো তা ক্রমশো ভেবে চলেছে। একটা সময় সাদ ভাই নামক মানুষটাকে ভীষণ ভয় পেতো আর এখন! সেই মানুষটি একান্ত তার ব্যক্তিগত হতে চললো। কেন জানি তার সার্নিধ্যে এলে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হয়।সাদের তখনকার কথা ভেবে মুচকি হেসে জামার চেইন খুলতেই খট করে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেলো। সাজি চেইন টানতে টানতে বললো,, সেই কখন বলেছি আসতে । এখন এলি? তাড়াতাড়ি চেইনটা খুলে দে লতা। জামাটা গায়ে বিঁধছে।
সাজির কথা শেষ হতেই দুটো হাত অবাধ্য বিচরন করতে লাগলো সাজির উন্মুক্ত পিঠ জুড়ে। চমকে উঠলো এই স্পর্শে ঘা ঘিন ঘিন করছে তার। সাজি পেছনে ফিরে হকচকিয়ে গেল। ভয়ে দুপা পিছিয়ে যেইনা ওড়না নিতে যাবে তার আগেই নিশান বিভৎস হেসে ওড়না হাতে মুড়িয়ে নিতে নিতে বলল,, কি দরকার ওড়না পরার? এইভাবে তোকে দেখতে দারুন লাগছে। আগের থেকে বেশি এট্রাকটিভ হয়েগেছিস।
কেঁপে উঠলো সাজি। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। পিছিয়ে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে নিজেকে ঢেকে নিলো।
নিশান বাঁকা হেসে বলল,দিলিতো মুডটা নষ্ট করে!
সাজি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,, আর এক পা এগোলে চিৎকার করে সবাইকে ডাকবো। এগোবেন না। চলে যান এইখান থেকে।
নিশান মাথা কাত করে হেসে উঠে পা বাড়ায়। সাজি যেইনা চিৎকার করতে নিবে তার আগে নিশান সাজিকে দেয়ালে ঠেসে মুখ চেপে ধরে। মূহূর্তে সাজির নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হতে লাগল। চিৎকার করে ডাকতে চেয়েও পারলো না। সাজি নিশানকে সরানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু একটা ছেলের গায়ের জোরের সাথে পেরে ওঠা মুশকিল। সাজি মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছে কেউ যেন রুমে চলে আসে, একবার এসে তাকে বাঁচিয়ে নেয়।
সবাইকে গাড়িতে তুলে দিয়ে সাদ আর রায়হান বাড়ির ভেতরে ডুকলো। ড্রয়িংরুমে সবাই আছে শুধু সাজি নেই।সাদ নজর ঘুরিয়ে দেখে সাজি বাদে রিমি,লতা,রেনু সবাই এইখানে আছে। শুধু সাজি নেই। সাদ সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,, সাজিঁ কোথায় মামুনী? তোমরা সবাই এখানে সাজি নেই কেন?
অনিলা রহমান সাদের কথা শুনে বললো,, হয়তো ইরিনার সাথে আছে। সাদ নাকোচ করে বললো,,না নাই, ইরিনা,রশনি এরা সবাই বাগানে।
লতা হড়বড়িয়ে সাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,, ভাইয়া আপুতো রুমে গেছে চেন্জ করতে।
লতার কথা শুনে সাদের মনে পড়লো নিশানের কথা। সাদ চমকে উঠে সেঁজুতিকে জিজ্ঞেস করলো,, মামুনী!সাজি রুমে হলে নিশান কোথায়? এখানে তো নেই,বাইরেও দেখিনি।
সেঁজুতি কিছু বলবে তার আগে নিশানের মা বললো,, ওতো ওপরে গেছে রেষ্ট নিতে।
নিশানের মায়ের কথা শেষ হতেই সেঁজুতি অনিলা দাঁড়িয়ে গেল। সাদ হাত মুঠ করে দাঁতে দাঁত চেপে চিৎকার করে বললো ,, নিশান এইবাড়িতে আছে জেনেও তোমরা সাজিকে একা ছাড়লে কেন? নিশানকে এইবাড়িতে এনে প্রথম ভুল করেছো। আবার যদি সাজির কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করে সত্যি বলছি খু*ন করে ফেলবো।সাদ এক মূহূর্ত না দাঁড়িয়ে সিড়ি বেয়ে দৌড়ে উপরে উঠে গেল। অদ্ভুত এক ভয়ে সাদের হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। সাদ নিজেও জানে না আজ নিশানের সাথে কি করবে। হয়তো আজ একটা অনর্থ হয়েই যাবে।
কেউ কিছু না বুঝলেও সেঁজুতি, অনিলা,রেনু আর রায়হান ঠিকই বুঝেছে। তারা সাদের পেছন পেছন ছুটলো। জুবায়ের এতোটা সময় চুপ থাকলেও সাদের কথা , সেঁজুতি আর নিজের বোনের চেহারায় ভয় দেখে ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। না জানি নতুন কোন বিপদ আসতে চলেছে।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,
(ভুল গুলো সুধরে দিবেন।)