#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৩
আলো ঝলমলে শ্রাবণের সকাল। নীল আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ভেলা।অরিন কোথা থেকে এক রকমের দুখানা শাড়ির ব্যবস্থা করেছে। হৈমন্তী শাড়ি পরে না তবুও অরিনের জন্য পরতে হবে। ছবি উঠার জন্য এই আয়োজন। আসমা বেগম দুজনকেই সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। ছবি তোলার মতো কেউ না থাকার জন্য এই মহান দায়িত্বটা রাসেল নিয়ে নিল। আবির বাড়িতে নেই ভোরবেলায় ক্লিনিকে ছুটেছে। অপারেশন আছে ফিরবে কখন বলা যাচ্ছে না। রাসেল এসেছে ওর সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। আবির অনেক রাতে বাড়িতে ফিরেছে আবার চলে গেছে ভোরসকালে। মায়ের থেকে শুনেছে। রাসেল আসার জন্য আবিরের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। বাড়িটা গড়ের মাঠ হয়ে উঠবে এটা ওর অজানা নেই। এই বাড়িতে অবাধ যাতায়াত চলবে আত্মীয়স্বজনের। অরিন নিজের মতো করেই হৈমন্তীকে সাজিয়ে নিয়েছে। রাসেল বেশ খুশী এই দায়িত্ব পালন করার জন্য। মহিত দোতলা থেকে উঁকি ঝুঁকি কাটছেঁ। মুখটা গম্ভীর। বাড়ির বাগানে ফটোগ্রাফি চলছে। কয়েকটা ছবি তুলে হৈমন্তী আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত ভেতরে চলে আসলো। অরিন আরও কিছু ছবি তুলে ক্যামেরাটা নিতে চাইলো রাসেল আটকে দিলো। বলল পরে দিবে। অরিন নাছোড়বান্দা ক্যামেরাটা ওর চাই। কিন্তু পারলো না। এর মধ্যেই হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো। ওরা আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত ভেতরে গিয়ে দেখলো হৈমন্তী পা ধরে সিঁড়িতে বসে আছে। ওর পাশে মহিত দাঁড়িয়ে। আসমা বেগমও ততক্ষণে চলে এসেছে। হৈমন্তীর পায়ে আগেই ব্যাথা ছিল হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় আরও ব্যাথা পেলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় মহিতের সঙ্গে ওর ধাক্কা লেগেছে। মহিত ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু হৈমন্তীর অবস্থা খারাপ। আসমা বেগম হৈমন্তীকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বরফ দিয়ে দিলেন। ভাবলেন আবিরকে ফোন করবেন কিন্তু সুযোগ হলো না তার আগেই বাইরের হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো। বাইরে তুমুল তর্কাতর্কি চলছে। মহিত আর রাসেল দ্রুত বেরিয়ে গেলো। আসমা বেগম হৈমন্তীর কাছে অরিনকে রেখে উঁকি দিলেন দরজা দিয়ে। আরাফাত এসেছে লোকজন নিয়ে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের সঙ্গে তর্ক করছে ভেতরে আসার জন্য। ও বোনের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। কিন্তু কেউ আসতে দিচ্ছে না। শেষমেশ না পেরে একজনের মুখে ঘুসি বসিয়ে দিল। তাতেই সব চোটে বাঘ। দুপক্ষের ঝামেলা শুরু হয়ে গেলো। এদের লোকেরা আরাফাতের লোকদের মারতে শুরু করলো ওরাও বসে থাকলো না। উত্তম মাধ্যম মারামারি চলছে। রাসেল দ্রুত গিয়ে সবাইকে আটকানোর চেষ্টা করলো। কাজের মেয়েটা বাড়ির ভেতরে গিয়ে সব বর্ণনা করে ফেলেছে। হৈমন্তী পায়ের ব্যাথা ভুলে গেলো। ভাইয়ের কিছু হয়ে যাবে সেই ভয়ে ছুটে গেলো। কেউ আটকে রাখতে পারলো না। মারামারির একপর্যায়ে মহিত লাঠি দিয়ে পেছন থেকে আরাফাতের মাথায় আঘাত করতে গেলো হৈমন্তী দ্রুত গিয়ে ভাইকে ধাক্কা দিয়ে দিলো। আঘাতটা সোজা গিয়ে লাগলো হৈমন্তী মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেলো। আরাফাত দ্রুত বোনকে এসে ধরলো। আবির গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে ছুটে আসলো। ঝগড়া ঝামেলা হঠাৎ থমকে গেলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। যার জন্য এতো মারামারি সেই যদি না থাকে তবে এতো ঝামেলা কিসের। আরাফাত হতভম্ব হয়ে পড়েছে। ওতো মারামারি করতে চাইনি। বোনের সঙ্গে দেখা করা জরুরি ছিল। এতগুলো দিন খোজখবর নেই বারবার মনে পড়ছিল তাই এসেছিল। যদি জানতো ওর জন্যই হৈমন্তীর এমন অবস্থা হবে তাহলে কখনও আসতো না। ও হৈমন্তীর কাটা মাথাতে হাত রেখে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করলো। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ওর সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আঘাত কতটা গভীর বোঝা যাচ্ছে না। আবির ছুটে এসে আরাফাতের থেকে হৈমন্তীকে কেড়ে নিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে আটকে ধরলো। মেয়েটার জ্ঞান নেই। আরাফাত অপরাধীর মতো চুপচাপ বসে আছে। আবির ফিসফিস করে বলল, “সবগুলোকে খুন করব ওর কিছু হলে।”। আরাফাত হৈমন্তীর দিকে হাত বাড়াতে গেলো আবির পাত্তা দিলো না ওকে দ্রুত কোলে নিয়ে মহিতের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> ফিরে এসে তোকে যেনো না দেখি। আমার বাড়িতে থেকে আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলেছিস তোর হাত আমি ভাঙব। অপেক্ষা কর দেখ কি হয়।
আবির হুমকি দিয়ে হাটতে হাটতে চলে আসলো। আরাফাতও চুপচাপ আবিরের পেছনে পেছনে ছুটলো। আবির ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আরাফাত নিজের গাড়িতে গিয়ে বসলো। রাজীব আর মাসুদ ঘনঘন ফোন দিচ্ছে। আরাফাত ফোন ধরতে সাহস পাচ্ছে না। এসবের জন্য নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। রাজীব সব শুনে নিয়েছে লোকজনের থেকে। বাড়ি থেকে ওরা রওনা দিয়েছে। চয়নিকা আর আমেনা বেগম ওদের সঙ্গে আসছে। সবাই টেনশন করছে। রাজীব অস্থির হয়ে উঠেছে। সব ঝামেলার মূলে ও নিজেই। কি দরকার ছিল বোনের বিয়ে শত্রুদের সঙ্গে দেওয়ার। মাসুদ চুপচাপ আছে। ও আইনি পদক্ষেপ নিবে। ও জানে আইনের ধারা। দরকার হয় প্রশাসন নিয়ে যাবে। ফাজলামি পেয়েছে। জোরজবরদস্তি করে ওর বোনকে আটকে রাখবে আর ও ছেড়ে দিবে কখনও না। রাজীব এমপি মানুষ। উপর মহলের সঙ্গে ওর ভালো হাত আছে। তাছাড়া মাসুদের হবু শশুর আর্মি অফিসার। আমেনা বেগম গাড়ির মধ্যে গুটিসুটি হয়ে চয়নিকার পাশে বসে আছে। চয়নিকা শাশুড়ির হাত ধরে সাহস দিচ্ছে। ছোট পিথু মাসুদের কোলে বসে আছে। মাসুদ পিচ্চিটাকে খুব যত্নে আগলে রেখেছে। বাড়িতে এই একটা মাত্র প্রাণ যার আধো আধো কথাকে ঘিরে এখনো খুশী আটকে আছে।
☆
হৈমন্তীর কপালে বেশ কিছুটা কেটে গেছে তবে রক্ত যতটা পড়েছে ততটা কাঁটেনি। হৈমন্তীর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। আবির ওকে ক্লিনিকে নিয়ে এসেছে। কপালে সেলাই দেওয়া হয়েছে। শরীর বেশ দুর্বল পায়ের কাছেও ক্ষত আছে। আবির চুপচাপ হৈমন্তীর হাত ধরে বসে আছে। অস্থির লাগছে। মহিত যখন আরাফাতের মাথায় আঘাত করতে গিয়েছিল আবির গাড়ির ভেতর থেকে দেখেছিল কিন্তু আসতে আসতেই যা হওয়ার হয়ে গেছে। মহিতকে যদি আচ্ছা করে ধোলাই করতে পারতো মনে শান্তি লাগতো। নিজেদের মধ্যে মারামারি করলে বাপ চাচার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। দাদিজান চিৎকার চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলবে। আবির সেসব কথা ভেবেই চুপচাপ বসে আছে। হৈমন্তীর জ্ঞান ফিরলে ওকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। এখানে রাখা যাবে না। অন্যদিকে
মহিত ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ফোন দিয়ে মা আর নানিজানের কাছে সব ঘটনা খুলে বলেছে। উনারা রওনা হয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
☆☆☆
হৈমন্তীর জ্ঞান ফেরা পযর্ন্ত আবির অপেক্ষা করলো না। দ্রুত ওকে নিয়ে পেছনের গেট দিয়ে চলে আসলো বাড়িতে। আরাফাত সামনের গেটে দাঁড়িয়ে আছে কেউ ওকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আবির চলে এসে দারোয়ানকে ফোন দিয়ে বলে দিল আরাফাতকে চলে যেতে। ওরা বাড়িতে চলে গেছে। আরাফাত বুঝলো এভাবে হবে না। আরাফাত ঘুরে আবিরের বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুড়ি গুড়ি পায়ে অরিন বেরিয়ে আসলো। আরাফাতের ঠোঁটে পৈশাচিক হাসি ফুঁটে উঠলো। প্রতিশোধ কাকে বলে কাজীরা এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
চলবে