দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-১১

0
182

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১১

আবির চমকালো। সুপ্তির কান্নারত মায়া মায়া মুখের দিকে তাকিয়ে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। এইমাত্র কী বলল সুপ্তি? আবির, সুপ্তিকে ঠকিয়েছে? ‘ও’ এই কথাটা কেন বলল? আবির সাহস করে, কাঁপা হাতে সুপ্তির মুখখানি আঁজলায় তুলে ধরল। চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে, উদাস হয়ে বলল,
-‘ তুমি কাঁদছো কেন সুপ্তি?

সেদিনও ছিল ঝুম বৃষ্টিময় রাত। আজও হঠাৎ করেই আকাশ কাঁপিয়ে ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেদিন আবিরের কোকিল কণ্ঠের গান শুনে সুপ্তির চোখে, মুখে একরাশ মুগ্ধতা ঝরে পড়ছিল। আর আজ বিষণ্ণতায় ঘিরে ধরেছে। আবিরের আগের বউটা চলে না গেলে, আবির হয়তো সুপ্তিকে জীবনেও বিয়ে করতো না। তারমানে সুপ্তি, আবিরের জীবনে সেকেন্ড অপশন, সেকেন্ড চয়েস। সুপ্তির আগেও এই ঘর, এই মানুষটা অন্যকারো অতি আপন, প্রিয়জন ছিল। সুপ্তি তো কারো জীবনে সেকেন্ড অপশন হতে চায়নি! তারচেয়েও বড় কথা মানুষটা প্রথম বিয়ের কথা গোপন করে গেছে। তখন হঠাৎ শৌভিকের মুখে কথাটা শুনে খুব অল্প সময়ের জন্য উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সুপ্তি। ভেবেছিল, শৌভিক তো সুপ্তিকে দেখতে পারে না। তাই বোধহয় এমনটা মিথ্যে করে বলছে। তারপর এলো ওই উড়ো ফোনকলটা! একটা মানুষ কেন বানিয়ে বানিয়ে এতগুলো মিথ্যা কথা বলবে? এতে কী স্বার্থ লুকিয়ে থাকতে পারে? নাজুক মনটা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল ঠিকই। তারপরও মনের কোথাও না কোথাও একটুখানি আশার আলো জেগে ছিল। এই বোধহয় আবির এসে বলবে, যা শুনেছো, সব কথা মিথ্যা। তুমিই আমার জীবনের প্রথম নারী৷ সুপ্তি ভুল ছিল। মানুষটাকে জিজ্ঞেস করতেই কী দৃঢ় কণ্ঠে বলে দিল। “হ্যাঁ”। সুপ্তি না কী তার দ্বিতীয় বউ।
সুপ্তির চোখ দিয়ে অঝরে টপটপিয়ে জল ঝরে পড়ছে। আবির অধৈর্য হয়ে গেল। সুপ্তিকে জোর করে বুকে টেনে নিল। সুপ্তি ছটফটিয়ে উঠল। সরে যেতে চাইল! আবির ছেড়ে দিল না। আরও শক্ত করে, গভীর ভাবে সুপ্তির কোমর জড়িয়ে ধরল। সুপ্তির মাথা এসে ঠেকলো আবিরের বুকে। এই তো মানুষটার বুকের ভেতর শব্দ তুলে হৃৎস্পন্দন ধুকপুক ধুকপুক করছে। সুপ্তি তো আবিরের দয়া চায়নি? চেয়েছিল একটু সম্মান, একটু ভালোবাসা। অথচ মানুষটা কত সহজেই ধোঁকা দিল। আবিরের উষ্ণ স্পর্শও অসহ্য লাগছে সুপ্তির। মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। চোখের জল বাঁধ মানছে না।
সুপ্তির কান্না আবিরের সহ্য হলো না। সুপ্তিকে বুকের মাঝে চেপে ধরতেই সুপ্তি জোরে ধাক্কা দিয়ে আবিরকে সরিয়ে দিল। আবির ব্যালেন্স রাখতে পারল না। পরতে পরতে খাটের কোণা ধরে ফেলল। মরিয়া হয়ে বলল,
-‘তুমি এমন করছো কেন সুপ্তি?
সুপ্তি হাত দিয়ে চোখের জল মুছে৷ আবার দুচোখ ভিজে ওঠে। আবার মুছে, আবার ভিজে ওঠে। সুপ্তি ব্যর্থ হয়ে চোখ মোছা বন্ধ করে দিল। ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘আমাদের বিয়ের আগে আপনার ১ম স্ত্রীর কথা আমাকে একবার জানানো উচিৎ ছিল না? আপনি যতবারই আমার কাছে আসবেন! ততবারই আমার মনে হবে, আমি, আপনার জীবনে সেকেন্ড অপশন, সেকেন্ড চয়েস।
আবির অবাক হয়ে বলল,
-‘জানাইনি?
সুপ্তির বলতে খুব কষ্ট হলো। গলা ভেঙে আসছে! তবুও থেমে থেমে বলল,
-‘জানিয়ে ছিলেন বুঝি? কই আমি তো জানি না? বিয়ে করেছেন, বাচ্চা আছে। তারপরও ১ম স্ত্রীকে কেন ছেড়ে দিলেন? বাচ্চাটার কথা ভেবেও কী সংসার করা যেতো না?
আবির অবাক হয়ে বলল,
-‘সুপ্তি..? এসব কী বলছো তুমি আবোলতাবোল? বাচ্চা আছে মানে? মাথা ঠিক আছে তোমার? কে বলেছে, তোমাকে আমার বাচ্চা আছে?
সুপ্তি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আপনার ১ম স্ত্রী।
-‘হোয়াট..? পাপড়ি..পাপড়ি তোমাকে ফোন দিয়েছিল? কবে.. কখন?
-‘একটু আগে।
-‘ফোনে কল রেকর্ডটিং অপশন চালু করা আছে?
-‘হুম।
-‘দেখি ক্লিপটা?
সুপ্তি ফোনে কল রেকর্ডটা চালু করতে করতে আবির কাকে যেন ফোন দিল। তারপর কথা বলতে বলতে উঠে চলে গেল। দরজা খুলে দিতেই আবিরের মা ঘরে এসে ঢুকলো। আবির দরজা বন্ধ করে দিয়ে, মাকে সংক্ষেপে ঘটনা খুলে বলল। মাকে হাত ধরে সুপ্তির পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল,
-‘মা তুমি সুপ্তিকে বলোনি কেন? আমিও আগেও বিয়ে করেছিলাম?
-‘সেদিন সুপ্তি বাসায় ছিল না। কিন্তু আমি তো ওর বাবা-মাকে বলেছিলাম। এ-ও বলেছিলাম, সুপ্তিকে যেন তোর বিষয়ে জানানো হয়। তারা না জানালে আমার কী দোষ? আমি তো আর জানি না। এতবড় কথাটা সুপ্তির কাছ থেকে ওর মা-বাবা গোপন করে যাবে।
সুপ্তি কলরেকর্ডটা বের করে আবিরের হাতে ধরিয়ে দিল। আবির খুব মনোযোগ দিয়ে দুজনের কথোপকথন শুনলো। তারপর বলল,
-‘এটা তো পাপড়ির কণ্ঠ না। আবির পুনরায় সেই নাম্বারে ফোন দিল। নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে বলল,
-‘মা তোমার কাছে পাপড়ির বাবার নাম্বার আছে?
-‘আছে।
-‘তাকে ফোন দাও? ফোন দিয়ে পাপড়ির বর্তমান ফোন নাম্বার দিতে বলো৷
তৃণারানী ছেলের কথামতো পাপড়ির বাবাকে ফোন দিয়ে পাপড়ির ফোন নাম্বার চাইলো। ভদ্রলোক প্রথমে গাঁইগুঁই করল। মেয়ের নাম্বার দিতে চাইল না। তৃণারানী কথার মারপ্যাঁচে ফেলে পাপড়ির নাম্বার নিল। আবির, পাপড়িকে পাঁচ-সাত বার ফোন দেওয়ার পর পাপড়ি ঘুমঘুম কণ্ঠে ফোন রিসিভ করল। বলল,
-‘কে?
-‘আমি আবির।
আবির ফোনটা লাউডস্পিকারে দিয়ে বলল,
-‘কেমন আছো পাপড়ি? আমাদের মেয়ে কেমন আছে?
-‘এত রাতে ফোন দিয়ে ফাজলামো করছো? আমাদের মেয়ে আবার কবে হলো?
আবির, সুপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে, পাপড়িকে বলল,
-‘হবে না কেন? দুটো মাস তো একসাথে একঘরে সংসার করেছি আমরা৷ না হওয়ার তো কিছু নেই।
পাপড়ির মাথায় আগুন ধরে গেল। চিৎকার করে বলল,
-‘ফাজলামো রাখো আবির। আমার সংসারে আগুন ধরানোর জন্য এই মিথ্যে অভিযোগ তুমি দিচ্ছো, তাই না? যেন আমার বর্তমান স্বামী আমাকে ভুল বুঝে ছেড়ে দেয়।
-‘তাহলে তুমি আমার সাথে বিয়ে হওয়ার পরও একঘরে, এক বিছানায় থাকোনি? তাই বলতে চাইছো?
-‘এই জানোয়ার, এই কুত্তার বাচ্চা। তোর সাথে কবে ছিলাম রে আমি? তোকে তো দুটো মাস বেলকনিতে আটকে রেখেছি এবং ঘরে শুয়ে শুয়ে সারারাত আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফোনে কথা বলেছি। যেন আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে ভুল না বুঝে।
পাপড়ির কথা বলার ধরণ দেখে, সুপ্তি অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এত উগ্র ব্যবহার কেন মেয়েটার? সবকথা যেন সুপ্তির মাথার উপর দিয়ে গেল। আবির ফোন রাখার আগে বলল,
-‘তুমি যদি একবাপের মেয়ে হও। তাহলে আমার যে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছো। ফেরত দিয়ে যেও।
-‘দেব না। কী করবি তুই? কথাটা বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন কেটে দিল পাপড়ি। আবির, পাপড়ির কথা শুনে বিদ্রুপ করে হাসল। সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘যে তোমাকে ফোনে আমার বউ বলে পরিচয় দিয়েছিল, আর যার সাথে আমি ফোনে এইমাত্র কথা বললাম! দুজনের কণ্ঠ কী এক সুপ্তি?
সুপ্তি মাথা নিচু করে ফেলল। বলল,
-‘না।
আবির বলল,
-‘আমার জীবনে কোন লুকোছাপা নেই সুপ্তি। পাপড়ি চলে যাওয়ার পর মেয়েদের প্রতি বিশ্বাসই উঠে গিয়েছিল আমার। কেমন যেন, মেয়ে দেখলেই বিরক্তিতে চোখ, মুখ কুঁচকে যেতো। অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভাল লেগেছে। মায়েরও তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল। আমিও আর দ্বিমত করিনি৷ লোককে মিথ্যা বলা, লোক ঠকানো এগুলো আমাদের স্বভাব না। আমার মা তো আমার ব্যাপারটা তোমার বাবা-মাকে জানিয়ে ছিল। এখন তারা তোমাকে কেন জানায়নি, সেটা তো আর আমরা জানি না। উত্তরটা তাদের কাছ থেকেই জেনে নিও তুমি।
আর মা তোমাকেও বলি, কেন এতদিন বিয়ে করতে চাইতাম না জানো? এইসব কাহিনির জন্যই বিয়ের প্রতি কোন ইন্টারেস্ট ছিল না আমার।
তৃণারানী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
-‘মাথা গরম করিস না বাবা। সুপ্তি ছোট মানুষ। কেউ হয়তো ওকে তোর ব্যাপারে না জানার ব্যাপারটা জেনেই ইচ্ছে করে, তোর নামে সুপ্তির কানে বিষ ঢেলেছে। তাছাড়া সুপ্তি হঠাৎ কথাটা শুনে রিয়্যাকশন দিবে এটা তো স্বাভাবিক। ওর জায়গায় আমি হলেও হয়তো আমিও এমন করতাম।
আর সুপ্তি তোমাকেও বলি, স্বামী-স্ত্রীর মনমালিন্য, ঝগড়াঝাটি সবসময় স্বামী-স্ত্রীর মাঝেই গোপন রাখবা। ভুলেও যেন তোমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি না ঢুকে। ভুল বোঝাবুঝির জন্য আজ হয়তো তোমাদের সংসারটা ভেঙেও যেতে পারতো। আর আবিরের নামে যখনই যা শুনবে, সবার আগে আবিরকে প্রশ্ন করবা! যাইহোক অনেক রাত হয়েছে। এত রাতে তোমার মা-বাবাকে ফোন দিয়ে টেনশনে ফেলার কোন দরকার নেই। সকালে কারণটা জেনে নিও। অনেক রাত হয়েছে। এখন দুজনে ঘুমাও। তৃণারানী উঠে চলে গেল। যেতে যেতে বলল,
-‘আবির দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ঘুমা?
আবির দরজা লাগিয়ে দিয়ে বেলকনিতে যেতে যেতে বলল,
-‘শালার কপাল আমার! এই পোড়া কপালে বাসর নাই। ধেৎ….

সুপ্তির ধাতস্ত হতে সময় লাগল। কিন্তু আবিরকে মন থেকে স্বামী হিসাবেও সহজে মেনে নিতে পারল না। বার বার মনে হচ্ছে, পাপড়ি ছেড়ে চলে না গেলে, আবিরের জীবনে সুপ্তির কোন জায়গা ছিল না। হয়তো সুপ্তির ভাবনাটা অন্যরকম হলেও পারতো।

আবির বেলকনিতে গিয়ে দোলনায় ধপাস করে বসে পরল। টিমটিমে হলদে আলোতে টিয়াপাখি আবিরকে দেখে, ডানা ঝাপটে, নেচে নেচে বলল,
-‘আবির.. আবির…আবির..?
আবির হেসে দিল৷ বলল,
-‘তুইই সুখে আছিস রে বিবিসি। মানব জীবনে জন্ম নেওয়া কী যে প্যারা রে.. এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বিয়ে করলাম দুটো। অথচ একটাও বাসর করতে পারলাম না। এটা কোন কথা হলো? দুইবারই একই কাণ্ড। এই বেলকনিতে তোর পাশে বসে, আমাকে রাত কাটাতে হচ্ছে। কী রে তুই আবার আমার প্রেমে-টেমে পড়লি না কী? আমার দুঃখ বিলাস দেখে?
টিয়াপাখি ডানা ঝাপটে, সারা খাঁচা ঘুরে ঘুরে বলল,
-‘আবির বৃষ্টি হচ্ছে। গান গাও..? গান গাও..?
আবির হাত বাড়িয়ে গিটারটা টেনে নিল। কণ্ঠে দরদ ঢেলে, গলা ছেড়ে সুর করে গান ধরল,

যার কথা ভেবে শিহরণ
যে আমার জীবন মরণ
এলো যেন সে ভালবেসে
ভরে দিতে আজ এ মন

যে ছিল আমার আপন
যার সাথে বাঁধা এ জীবন
এলো যেন সে ভালবেসে
ভরে দিতে আজ এ মন

যেন এক নতুন সকাল
ভেঙে দিয়ে ঘুমেরি জাল
যে ছিল মরিচীকা
দিতো শুধু যে দেখা
তাকে যেত না ছোঁয়া কোন দিন
তার হয়ে আকাশে
থাকতো মেঘেতে ভেসে
সে ছিলো যে অধরা প্রতিদিন

কাটতো যে দিন তবু তারই আশায়
কত যন্ত্রণা বুকে বয়ে
মুছে গেল সেই ব্যথা তাকে পেয়ে

সে যেন আজও শ্রাবণ
না বলা সুখের প্লাবণ

এলো যেন সে ভালবেসে
ভরে দিতে আজ এ মন

সুপ্তি ধীর পায়ে হেঁটে এসে, দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। দুচোখ বুঁজে আবিরের গানের কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল। একই সাথে অনুভব করল, শরীরে রোমাঞ্চকর শিহরণ জাগানো গাঢ় অনুভূতি। সেই সাথে কী যেন এক অজানা ব্যাপার ঘটে গেল সুপ্তির ভেতরে।
আবির বেখেয়ালে সুপ্তির দিকে একপলক তাকাল। সুপ্তির মায়াবী মুখ, কাজল কালো, জলে টইটম্বুর পদ্ম পুকুরের মতো টানা টানা চোখ, কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো বড্ড টানছে আবিরকে!
আবির ওঠে দাঁড়াল। একপা দুপা করে হেঁটে গিয়ে, ঘোর লাগা দৃষ্টিতে সুপ্তির মুখপানে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকাল। আবিরের এক আঙুল সুপ্তির কপাল স্পর্শ করতেই আবেশে দুচোখ বুঁজে ফেলল সুপ্তি। আবির, সুপ্তির কপালে আঙুলের রেখা টেনে অবাধ্য চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। হৃদপিণ্ড এত জোরে শব্দ তুলে ধুকপুক করছে। আবির নিজের বুকে একহাত চেপে ধরে দুটো গানের লাইন গুনগুন করে গেয়ে উঠল।
‘মনে হয় আমি নেই আমাতে’
‘হারিয়ে..গেছি সেই তোমাতে!’

সমস্ত অভিমান, অভিযোগ একপাশে সরিয়ে রেখে আবির, সুপ্তির একহাত আলতো করে ধরল। সুপ্তিকে দোলনায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসল। টিয়াপাখি ঠোঁট নেড়ে, সুর করে বলল,
-‘আবিরের বউ ভাল..আবিরের বউ ভাল।
আবির পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা গিফট বাক্স বের করল। তাতে ছিল স্বর্ণ ও হিরের মিশেলে সিম্পলের মধ্যে খুব সুন্দর একটা গলার হার। আবির নিজের হাতে হারটা সুপ্তির গলায় পরিয়ে দিল। আবিরের পুরুষালি হাতের স্পর্শ পেয়ে ভেতরে ভেতরে বেসামাল হয়ে যাচ্ছিল সুপ্তি। আবিরের উত্তপ্ত গরম নিঃশ্বাস সুপ্তির গলায় জোয়ারের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরল। আবির হার পরানোর বাহানায় চট করে সুপ্তির গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল। সুপ্তির সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। নিঃশ্বাসের গতিবেগ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। আবির দাঁত দিয়ে হারের আংটা লাগিয়ে দেওয়ার সময় সুপ্তির গলায় গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে সরে গেল। অন্যদিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। আবিরের খুব বলতে ইচ্ছে করল, “তুমি আমার জীবনে দ্বিতীয় অপশন নও সুপ্তি। তুমি আমার জীবনে ১ম গা শিরশিরে উষ্ণ অনুভূতি জাগানো দ্বিতীয় বসন্ত।”
বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে৷ বৃষ্টির ছাট এসে ওদের বারংবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কড়া বেলীফুলের মাতাল করা ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে গেল দুজন। সুপ্তি ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘ঘরে যাবেন না?
আবির উদাস হয়ে বলল,
-‘যেতে ইচ্ছে করছে না।
সুপ্তি কী বলবে! ভেবে পেল না। আবির বলল,
-‘তুমি যাও? অনেক রাত হলো। ঘুমিয়ে পরো!
সুপ্তি ওঠে গেল না। আবিরের পাশেই চুপটি করে বসে রইল। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সুপ্তি বলল,
-‘সরি।
-‘সরি কেন?
-‘আমার ওভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিৎ হয়নি।
-‘সরি তো আমার বলা উচিৎ সুপ্তি। অবিবাহিত একটা মেয়েকে বিয়ে করা ঠিক হয়নি।
-‘কথা শোনাচ্ছেন?
আবির বলল,
-‘যা সত্যি তাই তো বললাম।
-‘কিন্তু আমি যে অন্যকিছু শুনলাম!
-‘কী শুনেছো সুপ্তি?
-‘শুধু নামমাত্র বিয়ে করেছিলেন।
-‘এই কথাটা যদি পাপড়ির মুখে না শুনে, আমার মুখে শুনতে, তুমি বিশ্বাস করতে? অনেস্টলি উত্তর দিবা?
-‘জানি না। তবে বিয়ের আগে কথাটা জানলে হয়তো আজকের রাতটা অন্যরকম হতো।
আবির বলল,
-‘অন্যরকম বলতে, তুমি আমাকে বিয়েই করতে না। তাই না?
-‘আপনার কী মনে হয়?
-‘জানি না।
সুপ্তি বলল,
-‘ঝগড়ার মুডে আছেন আপনি!
-‘আমি কোন মুডেই নাই। তুমি ঘুমাও.. যাও।
-‘আপনিও চলুন?
-‘চোখে ঘুম নেই।
-‘না থাকুক। তবুও শুয়ে থাকবেন।
টিমটিমে হলদে আলোতে আবির, সুপ্তির দিকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে, গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আগুন আর ঘি এক জায়গায় থাকলে, এর পরিণাম কী হবে, জানো তো?

(চলবে)