দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-১২

0
139

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১২
(১৮+ সতর্কতা।)

-‘কী আর হবে? এতক্ষণেও যখন কিছু হলো না। বাকি রাতটুকুও ভরসা করা যায়।
আবির নিঃশব্দ হাসলো। সুপ্তির আত্মবিশ্বাস দেখে, ভাল লাগল। বলল,
-‘আমি পুরুষ মানুষ সুপ্তি। মহাপুরুষ নই। তুমি মেন্টালি আপসেট হয়ে আছো। সময় নাও। আমাকে ভাল করে চিনো, জানো! তারপর নাহয় দাম্পত্য জীবন শুরু করব আমরা! অনেক রাত হলো। এবার যাও..! ঘুমিয়ে পরো।
-‘আপনি যাবেন না?
আবির অকপটে বলল,
-‘না।’
সুপ্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। আবিরকে জোর করার ইচ্ছে থাকলেও সাহস পেল না। সংকোচ হচ্ছে খুব। আলতা রাঙা, নূপুর পরা পায়ে রিমিঝিমি ছন্দ তুলে ঘরে চলে গেল। বাইরে তখনো ঝুমবৃষ্টি। আবির মাথা বাঁকিয়ে, সুপ্তির গমন পথের দিকে তাকিয়ে, মনে মনে বলল,
-‘আর একটিবার বলেই দেখতে সুপ্তি! আমি ঠিকই তোমার পিছুপিছু ঘরে চলে যেতাম!

সুপ্তি বিছানার ফুলগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে, গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরল। ভাল লাগছে না। মনের ভেতর কেমন যেন গুমোট বাঁধা কষ্ট অনুভব হচ্ছে। শৌভিকের বলা কথাগুলো কিংবা ওই উড়ো ফোনকলটা না এলে, আজকের রাতটা হয়তো অন্যরকম সুন্দর হতে পারতো। বাবা-মাকেও এর জবাব দিতে হবে। কেন এতবড় একটা সিদ্ধান্ত সুপ্তির অগোচরে নিল তারা? আজ যদি সুপ্তি জেনেশুনে আবিরকে বিয়ে করতো! তাহলে হয়তো এমন কিছুই হতো না। মা সারাজীবন সুপ্তির ব্যাপারে উদাসীন থেকে গেল। সেই ছোটবেলা থেকেই সুপ্তির কিসে ভাল, কিসে মন্দ। না জিজ্ঞেস করেই হুটহাট সুপ্তির ঘাড়ে সবকিছু চাপিয়ে দেয় মা। কখনো প্রতিবাদ করা হয়নি। সবসময় মনের কষ্ট বুকে চেপে রেখে, নীরব চোখের জলেই বালিশ ভিজিয়ে অভ্যস্ত সুপ্তি। সুপ্তির বান্ধবী নিতা তো প্রায়ই বলে, “তোর মা অনেক লোভী আর স্বার্থপর রে সুপ্তি। তাছাড়া কোন মা বড়মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়া ছেলের সাথে ছোটমেয়ের বিয়ে দেয়? শুধু ভাল চাকরি আর পাঁচতলা বাড়িটাই দেখল! ঐশ্বর্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা তাদের কুৎসিত মনটা দেখতে পেল না। এই নিয়ে না একদিন আবার আফসোস করতে হয়! সুপ্তি বকে, ধমকে নিতাকে সবসময় থামিয়ে দিতো। এখন মনে হচ্ছে নিতা ঠিকই বলতো।”

শৌভিকের দুচোখে ঘুম নেই। পাশেই দীপ্তি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শৌভিক, দীপ্তির ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ফুলসজ্জার রাতের পর আর দীপ্তিকে আপন করে পাওয়া হয়নি। দীপ্তি অনেকদিন অসুস্থ ছিল। দীপ্তিকে অসুস্থ অবস্থায় রেখেই শৌভিককে কর্মক্ষেত্রে চলে যেতে হয়েছে। আজই আবির-সুপ্তির বিয়ে উপলক্ষে প্রথমবার বাড়ি এলো।
দীপ্তি এখন সুস্থ। শৌভিক মন চাইলেই দীপ্তিকে কাছে টানতে পারে। কিন্তু অবুঝ মনের ভেতরেই তো ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ তোলপাড় চলছে। দীপ্তিকে আপন করে পাওয়ার কোন আশা বা আকাঙ্খাই কাজ করছে না। যে বিষ সুপ্তির কানে ঢেলেছে শৌভিক। মনে তো হয় না, সহজে আবিরকে কাছে আসতে দেবে! যে জেদি মেয়েরে বাবাহ.. তারপরও ব্রো যদি জোর করে সুপ্তির কাছে যায়? ভাবনাটা মনে আসতেই অসহ্য, বিদঘুটে অনুভূতি হলো শৌভিকের। সবকিছু ভেঙেচুরে চুরমার করে দিতে ইচ্ছে করছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, ওই বন্ধ ঘরের ভেতর এই মুহূর্তে ঠিক কী কী চলছে! কিন্তু কীভাবে সম্ভব? সকাল না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই ছটফট করে কাটাতে হবে। উপায় নেই। সুপ্তির মায়া মায়া কোমল মুখখানি চোখের পাতায় ভেসে উঠতেই শৌভিক পাগল পাগল হয়ে যায়। দিনদুনিয়া অসহ্য মনে হয়। এত অস্থিরতা নিয়ে শুয়ে থাকা যায় না। শৌভিক উঠে বসল। হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা টেনে নিয়ে, অর্ধেক বোতল জল ঢকঢক করে গলায় ঢাকল। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত দীপ্তিকে দেখে, মাথায় ভয়ংকর সব ইচ্ছেরা ভর করল। আচ্ছা এখন যদি দীপ্তিকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলে শৌভিক? তাহলে কী হবে? সুপ্তি নিশ্চয়ই বরের সাথে ঘুমিয়ে না থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে আসবে?
শৌভিক চিন্তিত ভঙ্গিতে হাতে হাত ঘষে সারাঘর পায়চারি করছে! ভুল হয়েছে। বড্ড ভুল হয়েছে। কে জানত! সুপ্তিকে অন্যকারো পাশে দেখলে, সহ্য করতে পারবে না শৌভিক! বুকের ভেতর আত্মঃদহনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে! এই মেয়েটা শৌভিককে উন্মাদ করে দিয়েছে। সুপ্তিকে সারাজীবনের জন্য পাওয়ার বাসনা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে। সেই সাথে আফসোসের পাল্লা ভারী হচ্ছে। অনুভূতি তীব্র হচ্ছে।
সারাটা রাত ছটফট করল শৌভিক। খুব ভোরে উঠে দেখল, মামী উঠে হাঁটতে চলে গেছে। দুজন বুয়া রান্নাঘরে কাজ করছে। আর কেউ ওঠেনি। পুরো বাড়ি নীরব শুনশান। শুধু থেকে থেকে বাসনকোসনের টুংটাং শব্দ কানে ভেসে আসছে!
শৌভিক সোফায় বসে বসে লাইটার দিয়ে নিজের হাতের লম্বা পশমে আগুনের তা দিচ্ছে। পশম পুড়ছে। কেমন পশম পোড়া বিকট গন্ধ। সেই গন্ধ শুঁকতে বেশ লাগছে। শৌভিক ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোফায় একধ্যাণে বসে রইল। ক্ষীণ দৃষ্টি সিঁড়ির দিকে স্থির। ওই পথটুকু দিয়েই তো সুপ্তি নেমে আসবে। শৌভিক শুধু সুপ্তির মুখের অভিব্যাক্তি দেখতে চায়!
শৌভিককে নিরাশ করল না সুপ্তি। বোধহয় স্নান করেছে। কোমর ছুঁইছুঁই ভেজা চুলে, টিপটপিয়ে জল ঝরে পরছে। পরনে পাটভাঙা খয়েরী রঙা শাড়ি। সুখী সুখী মুখ। শৌভিকের পিলে চমকে উঠল। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেল। ঘরে এসি চলছে। তবুও কুলকুল করে ঘামছে শৌভিক। আশ্চর্য সুপ্তি সকালে স্নান করেছে কেন? সুপ্তি নেমে আসতেই শৌভিক খেয়াল করল, চওড়া সিঁথি ভর্তি লাল রঙা সিঁদুর পরেছে সুপ্তি। কপালের মাঝখানে একটা লালটিপ। একরাতেই মেয়েটার সৌন্দর্য যেন শতগুণ বেড়ে গেছে। শৌভিকের বুকের ভেতর ভূমিকম্প শুরু হলো। পা দুটো অসম্ভব কাঁপছে। মাঝা ঝিমঝিম করছে।

মনে যতটুকু আশা-ভরসা ছিল। আবিরকে ভেজা চুল হাত দিয়ে ঝারতে ঝারতে নিচে নামতে দেখে, শৌভিক ধপ করে সোফায় বসে পরল। এতবড় প্রতারণার পরও সুপ্তি কেন নিজের কোমল শরীর ব্রো কে স্পর্শ করতে দিল? সুপ্তিকে অন্যরকম ভেবেছিল শৌভিক। না কী ব্রো জোর করেই..? আর ভাবতে পারে না শৌভিক৷ মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
আবির পাশে বসতেই শৌভিক রসিকতার সুরে, নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘কেমন এনজয় করলে ব্রো?
আবির মনে মনে বলল,
-‘আর এনজয়! দুইজন দুইপ্রান্ত ঘুমিয়ে ছিলাম। মুখে বলল,
-‘দারুণ।
আবিরের মুখে লাজুক হাসি দেখে, শৌভিক মনে মনে জ্বলে উঠল। কত কাঠখোর পুড়িয়ে সুপ্তির মনে সন্দেহের বীজ বপন করেছিল শৌভিক। সব কষ্ট বিফলে গেল। ব্যাপার না। সময় শৌভিকেরও আসবে! তখন সুপ্তিকে ভাল করে বুঝিয়ে দেবে, শৌভিককে নিরাশ করার ফল কতটা ভয়ানক।

সকালের জলখাবার খেয়ে সুপ্তি ঘরে চলে গেল। ঘরটা বুয়া এসে এরমধ্যে সুন্দর, পরিপাটি করে গুছিয়ে দিয়ে গেছে। সুপ্তি ফোন নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। টিয়াপাখি সুপ্তিকে দেখে লাল রঙা ঠোঁটদুটো নেড়ে মিষ্টি সুরে বলল,
-‘আবিরের বউ…আবিরের বউ.. কথা কও?
সুপ্তি লাজুক হাসল। বেলীফুলের সুঘ্রাণে চারপাশ মাতোয়ারা। মাকে ফোন দিল সুপ্তি। মা বোধহয় রান্নাঘরে ছিল। ফোন ধরতে একটু দেরি হলো। সুপ্তির ফোনকল পেয়ে সুর্বনারানীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। রিসিভ করে বলল,
-‘কেমন আছিস মা?
সুপ্তি নিঃশব্দ হাসল। চোখে জল টলমল করছে। বলল,
-‘ভাল থাকার জন্যই তো বিয়ে দিয়েছো মা।
সুর্বনারানী আহত হলেন। বলল,
-‘এভাবে বলছিস কেন সুপ্তি?
-‘আপদ বিদেয় করে এখন তোমরা সুখে আছো তো মা? ভালোই হয়েছে যৌতুক লাগেনি।
-‘কী হয়েছে সুপ্তি? কেউ কিছু বলেছে তোকে?
-‘কে কী বলবে মা? যেখানে নিজের মা হয়েই এতবড় কথাটা আমার কাছে গোপন করে গেলে।
-‘কী গোপন করেছি আমি?
-‘আবির আগেও বিয়ে করেছিল। আমাকে জানাওনি কেন?
-‘ওহ..এই ব্যাপার। আরেহ..আগের বউটা ছিল বজ্জাত। শুধু বিয়েই করেছে, সংসার হয়নি। বিশ্বাস কর?
-‘সংসার না হোক। অন্তত বিয়ের আগে আমাকে জানাতে পারতে! একজন সদ্য বিবাহিত মেয়ে হঠাৎ কথাটা জানলে, কেমন অনুভূতি হয়। ও তুমি বুঝবে না মা। আর বুঝেই বা কী করবে, আমি তো তোমাদের আপন মেয়ে নই। তোমার দাদার মেয়ে।
-‘সুপ্তি.? এতবড় কথাটা তুই বলতে পারলি? কিসের কমতি রেখেছি আমি তোকে? বৌদি মারা যাওয়ার সময় তুই ছিলি ছয়মাসের কোলে। দাদা গো ধরল আর বিয়ে করবে না। এই আমার তখনো কোন বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। আমি তোকে নিজের কাছে এনে রাখলাম। নিজের মেয়ের পরিচয়ে আদর-যত্ন, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে একটু একটু করে বড় করেছি।
-‘হ্যাঁ করেছো। তবে টাকাটা সবসময় আমার বাবাই পাঠাতো। সেই টাকার জোরেই লোক দেখানো ভালোবেসেছো তোমরা আমায়। আমার বাবার ব্যাংকে রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে তুমি দীপ্তিকে ধুমধাম করে বিয়ে দিলে। আমি কখনো অমত করেছি? করিনি। তারপরও আমাকে না জানিয়ে বিবাহিত একটা ছেলের সাথে কেন আমাকে বিয়ে দিলে মা তুমি?
-‘মুখ সামলে কথা বল সুপ্তি! বড় বুলি ফুটেছে আজ তোর? তোর ভালোর জন্যেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দীপ্তির থেকেও তোর শ্বশুর বেশি অবস্থাসম্পূর্ণ। তাছাড়া তারা যৌতুক নেবে না। আর তুই টাকার খোঁটা দিচ্ছিস আমাদের? আর তোকে যে পেলেপুষে কষ্ট করে মানুষ করেছি?
-‘বললাম তো মা। টাকাকে ভালোবেসেই আমাকে পেলেপুষে বড় করেছো তুমি। আমাকে মানুষ করার পেছনেও তোমার স্বার্থ লুকিয়ে ছিল।
-‘বাহ্…তোর সুখের জন্যই একটা বিষয় গোপন করে, বিয়ে দিয়েছি দেখে, তুই আমাকে এত বড় বড় কথা শোনাচ্ছিস?
-‘এই যে তুমি দীপ্তি ও আমাকে সবসময় দুই নজরে দেখতে, বৈষম্য করতে, আমি কী কখনো কিছু বলেছি তোমায়? কিংবা কোন অভিযোগ করেছি? করিনি মা। হয়তো জীবনেও করতাম না। কিন্তু এতবড় সত্যিটা তুমি কেন আমাকে লুকালে মা? এই ব্যাপারটা সবাই জানে! তোমার ছোটমেয়ে দীপ্তিও জানে, অথচ আমি জানি না। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না মা?
-‘তুই হঠাৎ কথাটা শুনেছিস, দেখেই হয়তো এভাবে আমার সাথে চড়া মেজাজে কথা বলছিস। কিন্তু একদিন বুঝবি। আবির কতটা ভাল ছেলে।
-‘আবির শত ভাল ছেলে হোক মা। ওকে নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। যেখানে তোমরা আমার রক্তের সম্পর্ক হয়েই কথাটা গোপন করে গেলে, সেখানে আবির তো পরের ছেলে। ওদের কাছে আমার কী দাম থাকল মা?
-‘তুই বেশি বুঝিস সুপ্তি।
-‘আমি বেশি বুঝি না মা। তুমি সব সময় এক লাইন বেশি বুঝো। তোমার এই বেশি বোঝার জন্যই একদিন আমাদের সবার জীবন এলোমেলো হয়ে যাবে! মিলিয়ে নিও।

সুপ্তি ফোন রেখে, শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে নিল। সামনে ঘুরে দাঁড়াতেই আবিরকে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, চমকে উঠল সুপ্তি। মাথা নিচু করে বলল,
-‘কখন এসেছেন?
আবির মলিণ হাসল। বলল,
-‘অনেকক্ষণ।
সুপ্তি আর কিছু বলল না। আবিরকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিল। আবির পিছু ডাকল। বলল,
-‘শোন?
সুপ্তির পা জোড়া থেমে গেল। মাথা ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। ইশারায় ‘কী?’ আবির বলল,
-‘তুমি বোধহয় আমাকে এখনো মন থেকে স্বামী হিসাবে মেনে নিতে পারছো না সুপ্তি।
-‘ওহ..সব কথা শুনে ফেলেছেন তাহলে?
আবির আবারও নিঃশব্দ হাসল। বলল,
-‘সরি। তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলছিলে, আমি ডিস্টার্ব করতে চাইনি।
-‘ভাল।
-‘এখনো সময় আছে সুপ্তি।
সুপ্তি চোখ তুলে তাকাল। বলল,
-‘কিসের সময়?
আবির অন্যদিকে তাকিয়ে, দুচোখ বন্ধ করে, ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সময়।
সুপ্তি থমকে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘বুঝলাম না?
আবিরের চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘আমি কারো দয়া চাই না সুপ্তি। এই যে তুমি আমাকে মন থেকে স্বামী হিসাবে মেনে নিতে পারোনি। হয়তো আমার থেকেও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করো। ব্যাপার না। আমরা এখনো যেহেতু দাম্পত্য শুরু করিনি। তুমি অন্যকাউকে নিয়ে ভাবতেই পারো।
সুপ্তি হাসল। আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘দাম্পত্য শুরু না হোক। আমাদের বিয়ে তো হয়ে গেছে। এখন আমি যদি আপনাকে ছেড়ে অন্যকাউকে চুজ করি। তাহলে সে হবে আমার দ্বিতীয় অপশন। যেমন আমি আপনার দ্বিতীয় অপশন হয়েছি। আপনিও আমাকে ঠকাননি। যদি কেউ ঠকিয়ে থাকে। সে হলো আমার পরিবার। তাদের সাথে রাগ করে আমি কেন আপনাকে ছেড়ে যাব? এই যে আপনার হাত থেকে, আপনার দেওয়া সিঁথি ভর্তি সিঁদুর রাঙিয়ে, আপনার বউয়ের পরিচয়ে এই বাড়িতে নতুন বউ হয়ে ঢুকেছি। যদি কখনো আপনাকে ছেড়ে চলে যাই! তাহলে আমি যাব না। আমার মরাদেহ যাবে। একবারে চির বিদায় নিয়ে, স’সম্মানে এসেছি, স’সম্মানেই চলে যাব।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই চোখের জল লুকাতে, তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে চলে গেল সুপ্তি। জলের কল ছেড়ে দিয়ে মুখে কাপড় গুঁজে অঝরে কাঁদতে লাগল।
আবির তখনো স্তব্ধ হয়ে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে। সুপ্তির শেষের কথাগুলো আবিরের হৃদয় গভীর ভাবে স্পর্শ করেছে। সেই সাথে মনটাও পুলকিত হলো খুব। আবির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আর যাইহোক সুপ্তি জীবনেও আবিরকে ছেড়ে যাবে না। আর সুপ্তিকে ভাল রাখার জন্য আবিরের একার ভালোবাসাই যথেষ্ট।

শৌভিক, দীপ্তিকে নিয়ে দুটো দিন আবিরদের বাসায় থেকে গেল। চলে যাওয়ার আগেরদিন রাতে একসাথে সবাই খেতে বসেছে। শৌভিক খেতে-খেতে আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ব্রো হানিমুনে যাবা না?
আবির আনমনে বলল,
-‘দেখি!
শৌভিক বলল,
-‘দেখি কী? আমরাও এখনো যাইনি। চলো একসাথে গিয়ে, কোথাও থেকে ঘুরে আসব।
আবির বলল,
-‘একসাথে যাব কেন?
শৌভিক সুপ্তির দিকে একপলক তাকাল। চোখ সরিয়ে নিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল,
-‘আমরা নিউ কাঁপল। ঘুরতে যখন যাব। একসাথেই যাই? সমস্যা কী?
-‘দেখি সুপ্তি কী বলে! পরে তোকে জানাব।

শৌভিক আগেই দীপ্তিকে উস্কে দিয়েছে। চোখের ইশারায় দীপ্তিকে কিছু বলতেই দীপ্তি, সুপ্তির হাত টেনে ধরে এক কোণায় নিয়ে গেল। বলল,
-‘প্লিজ দিদি না করিস না। আমরা একসাথে ঘুরতে যাব। শৌভিকের সাথে একা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনলে আমার খুব ভয় লাগে।
সুপ্তি অবাক হয়ে বলল,
-‘ভয় লাগে কেন?
দীপ্তি চোখ নামিয়ে নিল। দিদিকে শৌভিকের ব্যাপারে সত্যিটা বলতে পারল না। কী হবে বলে! শুধু শুধু দুটো সংসারেই অশান্তি সৃষ্টি হবে। তাছাড়া শৌভিক ওই ব্যাপারটার জন্য অনেকবার দীপ্তির কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বন্ধ ঘরে দীপ্তির পা পর্যন্ত ধরেছে। সেই রাতে বন্ধুরা না কী জোর করে কিসের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিল। সেই বিশেষ ঔষধ খেয়েই শৌভিক নিজের মাঝে ছিল না। কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিল। তাছাড়া নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথে অমানবিক পশুর মতো আচরণ করে কেউ? তারপর থেকে একঘরে থাকলেও আর কখনো দীপ্তিকে কষ্ট দেয়নি শৌভিক। আর না ভালোবেসে দীপ্তির খুব কাছে এসেছে। যেহেতু মানুষটা ভুল করে ক্ষমা চেয়েছে। একবার ক্ষমা করাই যায়। কিন্তু ওতদূর মানুষটার সাথে একাকী ঘুরতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। আবার ঘুরতে যেতেও ইচ্ছে করছে খুব। সাথে দিদি গেলেই বরং ভাল হবে। ঘুরে বেড়ানোও হবে। আবার শৌভিক উল্টাপাল্টা কিছু করতেও পারবে না। দীপ্তির মোটা মাথায় এত থেকে সুবুদ্ধি আর উদয় হলো না।
সুপ্তি খেয়াল করেছে বিয়ের পর থেকেই দীপ্তির মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকে। আগের মতো মুখে হাসিও লেগে থাকে না। সব সময় আনমনা হয়ে থাকে। দীপ্তির দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া লাগল। তাছাড়া সুপ্তি তো আর একা যাবে না। সাথে আবিরও যাবে। দীপ্তি কত উচ্ছ্বাস নিয়ে আবদার করেছে। ছোটবোনটাকে নিরাশ করতে ইচ্ছে করল না। দীপ্তির মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে স্মিত হাসল সুপ্তি। বলল,
-‘যখন যাই তোকে সাথে নিয়ে যাব। টেনশন করিস না।
দীপ্তি আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
-‘যখন যাই না দিদি। খুব শীঘ্রই যাব। প্লিজ?
-‘এত তাড়া কিসের?
-‘বাহ্..রে.. বিয়ের আগে মা আমাদের দুই বোনকে কোথাও ঘুরতে যেতে দিছে? কত স্কুল পিকনিক, কলেজ ট্যুর। অথচ মা আমাদের কোথাও যেতে দিতো না। শুধু বলতো, বিয়ে হো! বরের সাথে ঘুরো। আজ যখন সুযোগ এসেছে। হাতছাড়া করব কেন?
সুপ্তি একটু ভেবে বলল,
-‘তাও ঠিক।

তৃণারানী বলল,
-‘শৌভিক তো ঠিকই বলেছে আবির। কোথাও থেকে একটা ট্যুর দিয়ে আয়। মন রিফ্রেশ হবে।
-‘আর ক’টা দিন যাক মা।
-‘দ্যাখ..সুপ্তির সাথে কথা বলে!

রাতের খাবার খেয়ে আবির-সুপ্তি ঘরে চলে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ করে আবির বলল,
-‘যাবে না কী ঘুরতে?
-‘যাওয়া যায়।
আবির বলল,
-‘কোথায় যাবে?
-‘আপনার যেখানে ইচ্ছে।
-‘আচ্ছা। শৌভিক আর দীপ্তিকেও সাথে নেই? কী বলো?
-‘আচ্ছা।

আবির বালিশ নিয়ে বেলকনির দিকে যেতেই সুপ্তি পিছু ডাকল।
-‘শুনুন?
আবির ঘুরে দাঁড়াল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-‘কী?
সুপ্তি নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘বিছানায় ঘুমান। আমার কোন অসুবিধে হবে না।
আবির পা টিপে টিপে হেঁটে এসে বিছানার একপাশে শুয়ে পরল। সুপ্তিও বিছানার ওপর পাশে শুলো। আবির হাত বাড়িয়ে ঘরের লাইটটা বন্ধ করে দিল। বেলকনিতে টিমটিমে হলদে আলো জ্বলছে। বাতাসের সাথে বেলীফুলের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। সারাঘরে নিভু নিভু আলো। পিনপতন নীরবতার মাঝে থেকে থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অসাবধানে হয়তো সুপ্তির হাতের সাথে আবিরের হাতের স্পর্শ লেগেছে। দুজনই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে কেঁপে উঠল। ভালোবাসার মানুষটা চোখের সামনে থেকেও ভালবাসতে না পারার যন্ত্রণা যে কতটা ভয়ানক হয়! এ ব্যথা না যায় সওয়া, না যায় মুখে কওয়া। আবির অনেক চেষ্টা করেও নিজের কামুক পুরুষসত্তাকে আটকে রাখতে পারল না। মন ও মস্তিষ্কের নীরব যুক্তিতর্কে মস্তিষ্কের পরাজয় হলো। মন জিতে গেল। আবির হাত বাড়িয়ে সুপ্তিকে কাছে টেনে নিল। সুপ্তির নিঃশ্বাস ক্রমশ বাড়ি হয়ে এলো। মুখে কিছু বলতে চাইল, আবির একটা আঙুল সুপ্তির অধরে রাখল। ইশারায় চুপ থাকতে বলে, সামান্য ঝুঁকে সুপ্তির কপালে কপাল ঠেকাল। নাকে নাক ঘষে, আবেশে বুঁজে আসা কণ্ঠে বলল
-‘সরি সুপ্তি। আমার বেহায়া পুরুষসত্তাকে আমি আটকে রাখতে পারলাম না।
সুপ্তি চোখ নামিয়ে নিল। বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শব্দ হচ্ছে। সুপ্তির অধরে অধর মিলাতেই সুপ্তি বেসামাল হয়ে আবিরকে দুহাতে আঁকড়ে ধরল। বুকের ভেতর কামনার অনাবিল সুখ সুখ অনুভূতি। কে যেন বলেছিল, দুটি নর-নারীর নতুন দেহ নির্জনে থাকলে, বেশিক্ষণ সংযমী হয়ে থাকতে পারে না। ঠিকই অঘটন ঘটে যায়।
মনে ভালোবাসা না থাকুক, শারীরিক আকর্ষণ তো আছে। আবিরের অসহ্য ভালোবাসায় একটু একটু করে সমুদ্রের ঢেউ তোলা স্বচ্ছ জলে ভেসে গেল সুপ্তি। এত সুখ, এত আদর, এত ভালোবাসা। পায়ে ঠেলার সাধ্যি কার?
সুপ্তির নারী শরীরের গভীরে মাদকতা ছড়িয়ে দিতে দিতে আবির মুখ তুলে তাকাল। সুপ্তির নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারি হচ্ছে। বুকের ভেতর তীব্র সুখ সুখ জ্বলুনি। মনে বা শরীরে আবিরকে বাঁধা দেওয়ার কোন জোর নেই। যা হচ্ছে হোক। মানুষ একভাবে ভেবে রাখলে কী হবে! বিধাতার ভাবনা সম্পূর্ণ অন্যরকম।
শুনশান রাতের আঁধারে নিস্তব্ধতাকে সাক্ষী রেখে ওরা এক নতুন ভালোবাসার রঙিন দুনিয়ায় বিচরণ করল। আবিরের অনাবিল ভালোবাসায় স্নিগ্ধ হলো সুপ্তি। আবির ওকে স্বর্গ সুখের সন্ধান দিল। সেই সাথে দিল স্বস্তি।

রাতের আঁধার একটু একটু করে কেটে যায়। দিনের আলো ফুটে, পাখিরা মনের সুখে কিচিরমিচির করে, গাছে গাছে বাশি ফুল ঝরে গিয়ে নতুন করে ফুল ফুটে। আবিরের ঘুম ভেঙে যায়। সুপ্তি আবিরের বুকের ভেতর মুখ গুঁজে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত মুখখানি জুড়ে সুখি সুখি আভা। আবির সুপ্তির কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে, গাঢ় চুমু এঁকে দিল। ফিসফিস করে বলল,
-‘তুমি আমার জীবনে হঠাৎ আসা, দ্বিতীয় বসন্ত। আমি তোমায় ভালোবাসি সুপ্তি।

(চলবে)