ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে পর্ব-১৪

0
260

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ ১৪
#_আরজু_আরমানী

আমার ঘুম ভেঙেছে সন্ধ্যায়। নিজের রুমের মাঝে বসে আছি। এশা আপুর রুম থেকে ফিরে এসে ঘুম দেই। এরই মধ্যে সমস্ত আত্মীয়রা চলে যাচ্ছেন। আমি সকালের কথা মনে করতেই তাহমিদ ভাইযার প্রতি বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হলো। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠলো। এশা আপুর চোখে আমি কষ্ট দেখেছি। আমি ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ফ্রেশ হয়ে ড্রেস পাল্টে বাহিরে বের হতেই একটা শব্দ কানে এসে বাড়ি মারলো,

” রায়হান, তোর মেয়েটা এতো বেহায়া!”

বাবার প্রায় সেইম সেইম বয়স লোকটার। হয়তো বাবার বন্ধু হবে। তবে তিনি আমার সম্পর্কে এমন একটা ধারনা কেন করলেন? ছোট ফুপি আমাকে জানালেন,

” রাত্রি, তুই নাকি তাহমিদকে বিয়ে করতে চাস? এই অপপ্রচার হচ্ছে।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” ফুপি কে বলেছে এসব?”

” বড় আপা।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলাম,

” এশা আপুর বিয়ে কি হয়ে গেছে? ”

” না। তোর এশা আপু তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে। তামিম তিশাকে বিয়ে করে নিয়েছে। তাহমিদ তার রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। বড় আপা আর দুলাভাইয়ের লজ্জায় মাথা কাঁটা গেছে। কুলকুল আপা সমস্ত দোষ তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। তুই নাকি তাহমিদকে ছাড়া বাঁচবি না, সে নাকি তোর জীবন, তোকে ছাড়া সে অন্য কাউকে বিয়ে করলে তুই নাকি তার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিবি। এসবের জন্য এশা পালিয়েছে। তার বড় ছেলে বিয়ে করতে পারলোনা তোর জন্য। মানে তারা উপস্থাপনাটা এমনভাবে করেছেন যেনো সমস্ত দোষ তোর। তাই সবাই তোকে এভাবে বলছে।”

আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। এমন কেনো হলো আমার সাথে? কেনো আমার জীবনের সমীকরণ এতো জটিল? কেনো আমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো সাধারণ জীবন পেলাম না? কেনো এতো দুঃখ আমার? এসব আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার দম বন্ধ লাগছে। নিজের বারান্দায় এসে বসতেই আমার মনে হলো, আমি যদি মারা যাই তবে কারো কোনো কিছু হবেনা। কারো জীবন থেমে থাকবে না আমার জন্য। সবাই ঠিক মতো চলতে পারবে। তবে আমার মরে যাওয়াই ভালো। আমার জীবনে এখন দুটো পথ খোলা। ইস্পাত কঠিন হয়ে বাঁচতে হবে নয়তো বিষের পেয়ালা পান করতে হবে। এই মুহুর্তে দ্বিতীয়টাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করছে। ফোনটা বেজে উঠলো। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসছে। ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। লাগাতার ফোনে রিসিভ করতে বাধ্য হলাম,

” কেমন আছো? ”

মেজাজটা ধরাম করে গরম হয়ে গেলো। চিনিনা জানিনা আসছে কেমন আছো জিজ্ঞেস করতে। আমি ক্রুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

” কে আপনি? ”

” আমার কন্ঠও কি ভুলে গেছো?”

আমি তার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনতেই বুঝতে পারলাম তিনি সাদ। রাগটা যেন তড়াক করে উধাও হলো। আমি বিনয়ীকন্ঠে বললাম,

” আপনি এতো দিন পর?”

” অনেক কষ্টে তোমার সাথে কন্টাক্ট করলাম।”

” ওহ।” তার সাথে কথা বলার মতো কোনো শব্দ আর আমি খুঁজে পেলাম না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

” নেহাকে পড়াতে যাও এখন?”

” সেটাতো আপনি নেহাকে জিজ্ঞেস করতেই পারেন?”

” তুমি এখনো বাঁকা কথা ছাড়তে পারলে না?”

” ছাড়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।”

” রাখছি।”

সাদ ফোন কেটে দিলেন। আমি ফোন রেখে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করেছি মাত্র। গোটাকয়েক থাপ্পড় পরলো আমার মুখে। আমি হকচকিয়ে তাকিয়ে দেখি মা অগ্নিচোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছু বলার আগেই তিনি আমাকে উদ্ভান্তের মতো মারতে লাগলেন। একটা থাপ্পড় এসে নাকে পরতেই আমি অচেতন হয়ে গেলা।

———————————

ফুল স্পিডে তিন পাখাযুক্ত ফ্যানটা চলছে। কেবিনটা সম্পূর্ণ চুন করা। অন্য কোনো রঙের ছিটেফোঁটা নেই। আমি শুয়ে আছি হসপিটালের বেডে। নাকের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। চোখ মেলে বুঝতে পারলাম না এখন সকাল না কি বিকেল। আশে পাশে কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না। হাত নাড়া দিয়ে গালে রাখতেই বুঝলাম ফেস বেন্ডিজ করা হয়েছে। কিন্তু নাক আর চোখ দু’টো খোলা। আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। কি এমন আঘাত হলো যাতে মুখে বেন্ডিজ করতে হলো। সেদিনের সন্ধ্যায় মায়ের করা প্রতিটা আঘাতের কথা মনে পরতেই চোখ হতে জল গড়ালো। এতো কষ্ট কেন আমার? আমার হিচকি দিয়ে কান্না আসছে। পানি পিপাসা পেয়েছে প্রচন্ড। বাম হাতে ক্যানোলা লাগানো। তখন একজন নার্স ঢুকলেন। আমি ওনাকে কিছু বলতে পারিনি। ওনি দৌড়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। দু’ মিনিট যেতে না যেতেই উনি আবার ঢুকলেন সাথে সিনিয়র ডাক্তার অরুপ ঘোষ। তিনি আমার সামনে এসে আমার ক্যানোলা খুললেন খুবই ধীরে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে জানালেন,

” আমি এখন আপনার বেন্ডেজ খুলবো। কোনোরকম নড়াচড়া করবেন না। ওকে। ”

উনি ধীরে ধীরে আমার মুখের সম্পূর্ণ ব্যান্ডেজটা খুললেন। আমার সামনে একটা আয়না ধরে বললেন,

” কি কোনো পরিবর্তন চোখে পরছে?”

পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক। আমার প্রশস্ত, চওড়া কপাল এখন ছোট হয়েছে। আমার চাপা গাল থলথলে হয়েছে। আমার সরু ঠোট এখন ঈষৎ চওড়া হয়েছে। আমি কাপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,

” এটা কে? এটা কার রুপ দিয়েছেন আপনি? এটা আমি নই। বুঝতে পারছেন আপনি এটা আমি নই।”

” এই কাজটা আপনার বাবার সম্মতি নিয়েই আমি করেছি।”

আমি এখন আরো ঘামছি। নার্স আমাকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। আমি ঢকঢক করে এক চুমুকে পুরো গ্লাস ফাকা করে দিলাম। ডাক্তার তার ফোনটা আমার কানে ধরলেন। তখন বাবার কন্ঠ শুনতে পেলাম,

” রাত্রি, তুমি কোনো চিন্তা করিওনা। আমি দুপুরে ফিরছি। সব তোমাকে জানানো হবে। এই একমাস তোমাকে নিয়ে আমরা সবাই খুব চিন্তায় ছিলাম। বিশেষ করে, আমি, তোমার ছোট ফুপি, এবং সা….। রাখছি।”

বাবা ফোন রেখে দিলেন। আমি অবাকের চূড়ায় পৌছালাম। একমাস হসপিটালে ছিলাম আমি। কি এমন গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো আমার যাতে এতোদিন হসপিটালে থাকতে হলো। ডাক্তার অরুপের ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি। তিনি হাসছেন কেন? আমি হাসির কি বললাম? আমি মুখে জড়তা নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

” আপনার ফোনটা কি পাঁচ মিনিটের জন্য দেয়া যাবে। একটা জরুরী কল করবো।”

উনি নিজের ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি লক খোলা। আমি দ্রুত নেহাকে কল করলাম। ফোনটা সাথে সাথেই রিসিভ হলো। আন্টির কথা শুনতে পেলাম। তিনি বললেন,

” কে? ”

” আমি রাত্রি আন্টি।”

” তুমি মেয়ে এতোদিন পর কল দিলে? আমি তোমার নাম্বারে কত কল দিয়েছি। ধরোনি কেন? আমার বুঝি চিন্তা হয়না তোমার জন্য? তুমিওতো আমারই মেয়ে।”

আমি হেসে ফেললাম ওনার এতো উৎকন্ঠা দেখে। উনি আমার জন্য এতো ভাবেন? আমি তাকে জিজ্ঞেস করে ফেলি,

” আমার জন্যও আপনার চিন্তা হয়?”

” বাব্বাহ, তুমি তো দেখছি বেশ চতুর মেয়ে। মানে আমাকে ভালোবাসো। আমি বাসি কিনা সেটা ইমোশনাল করে বের করতে চাইছো?”

” ধরুন ওরকমই।”

” কবে আসবে আমার বাসায় বলো?”

” কয়েকদিন পর ফিরবো।”

আমি ফোন কেটে দিলাম। অরুপ স্যার আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন নির্নিমেষে। আমি ফোনটা তার হাতে দিয়ে বললাম,

” এই এরিয়াটা কি একটু ঘুরে দেখতে পারি?”

” হুম। কেন নয়? তবে এখন নয়।”

তিনি চলে গেলেন। একজন নার্স এসে আমাকে জামাকাপড় দিলেন। আমি ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিলাম। জলপাই কালারের থ্রি-পিস পরে কেবিনের বারান্দায় এসে বসলাম। বাহিরে কত মানুষের আনাগোনা। কত মানুষ চলছে। কারো কোনো দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। সবাই নিজেকে নিয়ে ভীষন ব্যস্ত। আমার পরিবারেও তো কম মানুষ নেই। কিন্তু আমি তাদের কাছে একেবারেই নিতান্ত মানুষ। কোনো স্নেহের জায়গা নেই তাদের মধ্যে আমার জন্য। আমাকে এই একমাসে কে কে দেখতে এসেছে তাও জানিনা। নিজের ফোনটাও কাছে নেই। হাতের কাছে কোনো বইও নেই। পরার জন্য কিছু খুজে পাচ্ছিনা। আমার জীবনে একটা একান্ত মানুষের অভাব। যার সাথে বসে গল্প করা যায়। কোনোরকম দ্বিধা ছাড়া তাকে সব কথা বলা যাবে সেরকম কেউ নাই। আমার হৃদয়ের দুঃখগুলো বোঝারও কেউ নাই। আমি একা। শুধু একা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো বুকচিড়ে। দরজা টোকার শব্দ শুনে রুমে এসে দেখি তিহা এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

” তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ।”

আমি ওর সামনে এসে দুই হাত ভাজ করে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” সেদিন সন্ধ্যায় ঠিক কি কি হয়েছিলো আমার সাথে তার সব কিছু ক্লিয়ার কর।”

ও যেন থতমত খেলো। মুখ লুকাতে চাইছে। বেডে বসে মিনমিনে কন্ঠে বললো,

” এ ব্যাপারে তোমাকে জানাতে বারন করেছে মামা।”

” তিহা, তুই আমাকে সবটা বল।”

” আপা….

হাত উচিয়ে ওকে থামিয়ে দিলাম। জানালার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললাম,

” এখানে এসেছিস কেন? চলে যা।”

তিহা নিঃশব্দে রুম ছাড়লো। আমি বাবার অপেক্ষা করছি। তিনি এলেই সব কিছু জানতে পারবো। তখন অরুপ স্যার ঢুকে বললেন,

” নিজের প্রতি খেয়াল রাখবে রাত্রি। এই জীবনটা তোমার অন্য কারো নয়। তুমি মারা গেলে কারো কোনো সমস্যা হবে না। সবাই সবার মতো চলবে। এই যে একমাস তুমি এখানে আছো, তোমার বাবা, ছোট ফুপু, তিহা ছাড়া এখানে কেউ আসেনি। তোমার নানু নাকি তোমাকে ভীষন ভালোবাসে? সেও তো একদিনও আসেনি।”

তিনি থামতেই আমি বললাম,

” নানু দেশের বাহিরে।”

” রাত্রি, তুমি এদের থেকে দূরে চলে যাও। এরা তোমাকে শান্তিতে বাঁচতে দেবেনা।”

আমি কিছু বলবো তখন দরজায় টোকা পরলো। বাবা ঢুকলেন। তিনি আমার কপালে হাত রেখে অরুপ স্যারকে বললেন,

” অরুপ ওকে আজ নিয়ে যেতে পারি?”

” হ্যাঁ, আঙ্কেল। ”

অরুপ স্যারের ব্যবহার আমাকে বিমোহিত করছে। তিনি আমার বাবার বন্ধুর ছেলে। ওনার ফ্যামিলির সবাই আমেরিকার সিটিজেনশিপ পেয়েছে। উনি ওই দেশ থেকে পড়াশোনা করে বাংলাদেশে চিকিৎসা করছেন। আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুপুরের পরপরই বেরিয়ে পরলাম। কলেজের পাশের একটা এ্যাপার্টমেন্টে উঠেছি আমি। সম্পূর্ন ফ্ল্যাটটা সাজানো-গোছানো। আমার রুমটায় সব আছে। বড় একটা বারান্দাও আছে। বাবা আমায় বললেন,

” পাকা দশদিন বাসা খুজেছি। সবই ঠিক ছিলো। কিন্ত তোমার মনমতো বারান্দা ছিলো না। এই একটা পেয়েছি।”

” ধন্যবাদ। ”

” শোনো এখন থেকে নো টিউশনি অনলি পড়াশোনা।”

” একটা বাচ্চাকে পড়াতেই হবে। ও আমাকে ছাড়া কারো কাছে পড়বে না।”

” ওকে। ”

বাবা চলে গেলেন। আমি পুরো বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করেছি।

চলবে…….