#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ২১ (শেষ পর্ব)
#_আরজু_আরমানী
স্রোতের মতো বহমান সময়টা এগিয়ে এসে দাড়িয়েছে পাঁচ বছরে। প্রকৃতি তার ঠান্ডা বাতাস ছেড়ে আবরন মুক্ত হচ্ছে। ভোরের কুয়াশায় ভেজা পিচঢালা শহরের রাস্তা। প্রকৃতির প্রতি মানুষের বিরুপ আচরন ফুঁটে উঠছে। প্রকৃতিও তার রুক্ষ ও কষ্টদায়ক রুপ দেখিয়ে দিচ্ছে। তবুও শীতের এই স্নিগ্ধতা আমার বড্ড ভালো লাগে। নরম ঘাসের উপর শিশির কনায় খালি পা রেখে হাঁটায় আনন্দ আমার। এমনি এক কুয়াশায় মোড়ানো সকালে হাজির হলাম হাসপাতালে। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছি। সাদ আমার পাশেই বসে আছেন। তিনি অবশ্য এখন আমার পাশেই থাকেন। তার ডিউটি টাইম ছাড়া তিনি সর্বদা আমার পাশেই থাকেন। আন্টিও আজকাল আমাকে সংসারে তেমন বেশি মনোযোগ দিতে দেননা। সবসময় শুধু একটা কথা বলেন,
‘ তোমার বাচ্চা এখন ছোট। ওর দিকে আগে নজর দাও তারপর সংসার।’ হ্যাঁ, আমার মেয়ের বয়স মাত্র দুই মাস। আমি আমার মাকে স্মরণে রাখতে আমার মেয়ের নাম দিয়েছি ‘ মীরা’। সাদ তো এসব শুনে অবাক। অবশ্য বাবা বেশ খুশি হয়েছেন। তিনি সেদিনও হাসতে হাসতে বলে ফেললেন,
‘ মীরার চেহারা আমি তোমাকে দিয়েছি, তুমি তোমার মেয়ের নাম দিয়েছো। বুঝতে পারছো, আমি কত ভাগ্যবান?’
বাবা এখনও প্রতিদিন মায়ের নাম মনে করে। রোজ আমার বাড়িতে আসে মীরাকে দেখার জন্য। তিনি এসে অনেকক্ষন ওর সাথে কথা বলেন, ওকে নিয়ে বাগানে ঘোরেন। ফুল গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে ওর হাতে দেন। সেদিন দেখলাম বাবা মীরাকে বলছেন,
‘ শোনো নানুভাই, তোমার নানুর নামও ছিলো মীরা। সেও দেখতে তোমার মতো সুন্দরী ছিলেন। সে ছিলো শরতের প্রথম শিউলি ফুলের মতো কোমল আর স্নিগ্ধ। জানো তার শীতকাল খুব প্রিয় ছিলো। আচ্ছা, তোমারও কি শীতকাল খুব প্রিয়? তোমার হাসি একেবারে তার মতো। তুমি নিশ্চয়ই দ্বিতীয় মীরা।’
আমার মেয়েটা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে খেলছে। আবার হাসছে। বাবার কথা শুনেই কি সে হাসছে? মীরা কি কিছু বুঝতে পারছে? সত্যিই কি এমন হয় যে, হারিয়ে যাওয়া মানুষ নতুন করে কারো মধ্যে ফিরে আসতে পারে? যদি এমন হতো তাহলে পৃথিবীতে ভালোবাসার কোনো মূল্যই থাকতো না। সবাই বুঝতে পারতো তার প্রিয় মানুষটা আবার ফিরে আসবে। তাই তার চলে যাওয়ার পর আর কোনো টান থাকতো না। মানুষ একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। তা জীবিত হোক বা মৃত। মানুষ ফিরে আসে না বলেই তো এতো মূল্যবান সম্পর্ক। তার চলে যাওয়ায় আঘাত পায় প্রতিনিয়ত। যেমনটা এখন বাবা পাচ্ছেন। তার আর তাহিরা মায়ের সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক ছিলোনা। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এই কষ্ট নিয়ে ছিলেন। তাহিরা মায়ের জীবনের শেষ মুহূর্তে আমি তার পাশে ছিলাম। তার পাশে থেকে এটা উপলব্ধি করলাম যে, তিনি নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। না পেয়েছেন নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে, না ভালোবাসতে পেরেছেন নিজের স্বামীকে। আমার নিজের মা আর তাহিরা মায়ের সাথে কিছু মিল আছে। এই যেমন বাবা আমার নিজের মায়ের মৃত্যুর সময় তার পাশে থাকতে পারেননি ঠিক তেমনি তিনি তাহিরা মায়ের পাশেও থাকতে পারেননি। দু’ জনের দিকে থেকে দেখতে গেলে আমার নিজের মা সবচেয়ে সুখী ছিলেন। তিনি তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে জীবনে কিছুটা সময় কাটাতে পেরেছেন। বাবা এখন একা হয়েছেন পুরোপুরি।
ও বাড়িতে এখন আর ফুফুরা থাকেনা। নিজের সন্তানদের সাথে থাকেন। কাকা দেশের বাহিরে চলে গেছেন। ভাইয়ারা সবাই নিজের জীবনের টানে একেকজনে একেক জায়গায় থাকেন। বাবা আমাকে প্রায়ই এসে বলেন,
‘ রাত্রি তুই এ বাড়িতে এসে থাক। এখানে একা থাকতে আমার ভালো লাগেনা।’
আমি যদি বাবাকে বলি এ বাড়িতে এসে থাকতে তবে তিনি বলেন,
‘ মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকাটা সমাজ ভালো চোখে দেখেনা।’
এই সমাজ এটা এখনো মেনে নিতে পারেনা। মেয়ের বাবা কেন এসে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থাকবে? এটা এক প্রকার অপরাধ যেনো। কেনো মেয়ের বাবারা কি বাবা নয়? শেষ জীবনে তার কি ইচ্ছে হতে পারেনা বাকী জীবনটা সে তার মেয়ের হাত ধরে কাটাবেন? ‘ পেশেন্ট নং ৭ ‘ ডাক্তার দেখাতে হবে ডাক্তার এসে গেছেন। মীরার কয়েকদিন ধরে ঠান্ডা লেগেছে। হালকা জ্বরও আছে। এ কদিন তেমন কিছু খাচ্ছেওনা। ডাক্তারের কেবিনে ডুকতেই ডাক্তারের দিকে চোখ পরলো। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করেত পারছিনা। এ কাকে দেখছি আমি? আমার মনে পরলো কলেজের সেই প্রথম দিন। যেদিন আমার সাথে তার প্রথম দেখা হলো। সেই বন্ধুত্ব, সেই খুনসুটি মাখা মুহুর্ত। তারপর তার হারিয়ে যাওয়া। কোনো খোঁজ না পাওয়া। এতো বছর পর আবার তাকে দেখে আমার হৃদপিণ্ড তার ক্রিয়া নিজের গতির চেয়ে বাড়িয়ে দিলো। আমার সামনে সাদা এপ্রোন পরা ইশতিয়াক বসে আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো সেও আমার মতো বিস্ময় হয়েছে। আজো তার সেই একই চাহনি, একই অনুভূতি। সাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনিও অবাক। মীরার কান্নায় আমার চিন্তার রেখা ছুটলো। আমি এগিয়ে গিয়ে সামনে রাখা চেয়ারটায় বসলাম। আমার মুখ ফসকে একটা কথাই বেরোলো,
‘ ইশতিয়াক… ‘
‘ অন্য কাউকে আশা করেছিলি?’ ওর সেই হেয়ালিপনা এখনো রয়ে গেছে।
‘ তোকে আশা করিনি। কেমন আছিস?’
ইশতিয়াক হাসলো। আবারো সেই স্নিগ্ধ হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ একেবারে প্রথম দিনের মতোই আবার অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হলো। যাক বাদ দে, বেবি তোর?’
‘ হুম।’
‘ কি হয়েছে ওর?’ কথাটা বলে আমার উত্তরের আশা করলো না ও। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে এসে মীরাকে নিজের কোলে নিলো। ওকে চুমু খেলো। সাদ এসব দেখছেন আর হাসছেন। একটু হাঁটাহাটি করে মীরাকে আমার কোলে দিয়ে ওর জন্য প্রসক্রিপশন লিখে দিলো আমার কথা শুনে। যাওয়ার সময় বললো,
‘ আতিথেয়তা করতে পারলাম না আজ। বাড়িতে আসিস।’
অবশেষে বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে। তখন সাদ আমাকে বললেন,
‘ তুমি সবার জন্য মঙ্গলময়। সেদিন তুমি ইশতিয়াককে কি সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে আর তার ফল দেখলে।’
হ্যাঁ, সেদিন ইশতিয়াক আমার কথাগুলো বুঝেছিলো হয়তো। নিজের জীবনে পরিবর্তন এনেছে। ও এখন ভালো আছে। বাড়ির উদ্দেশ্য গাড়িতে উঠলাম তবে সাদের বাড়ি নয় আমার নিজের বাড়ি। আন্টি এবং নেহাকে সেখানে থাকতে বলেছি। তিনি সম্মত হয়েছেন। বাবার সাথে বাকী জীবনটা কাটাতে চাই। যখন আনন্দ করা উচিত ছিলো তখন তো সেটা হয়নি।
__________________
সন্ধ্যায় প্রকৃতি হয়তো তার নব যৌবন ফিরে পায়। পশ্চিম আকাশে লাল আভা। পাখিরা কিচিরমিচির করে তাদের বাসায় ফিরছে। শীত লাগছে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। আমার ছোটবেলার সেই বাড়িটায় এখন বাবা, তাসকিন,আন্টি, নেহা, সাদ, আমাদের মেয়ে এবং আমি থাকছি। পুরো বাড়িটা এখন খালি। একটা সময় এই বাড়িটায় এতো মানুষ ছিলেন আর আজ তেমন কেউ নেই। ছোটবেলার সেই সময়, সেই ভালোবাসাময় মুহুর্তগুলো আজ মনের কোনে একটু একটু করে জেগে উঠছে। ভাই বোনেরা মিলে কতশত আড্ডা দিয়েছি বাড়ির ছাদে। সন্ধ্যায় সবাই ছাদে উঠে পাটি বিছিয়ে গল্প করতাম। একেকজনের প্রতি একেকজনের কি ভালোবাসা ছিলো তখন। যেনো একে অন্যের পরিপূরক। সময়ের সাথে সাথে সবার প্রতি সবার একটা তিক্তভাব চলে এলে সবাই দূরে সরতে থাকে। তামিম, নিরব,নিলয় ভাইয়ারা প্রথমেই বাড়ি থেকে বাহিরে চলে গেলেন। একে একে সবাই। এরপর আমি নিজেও চলে গেলাম। সবার এখন সংসার আছে। আচ্ছা তাদের কি, ‘ গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ছোটবেলার সেই মধুর মুহুর্তগুলোর কথা মনে পরেনা? নাকি এসব শুধু আমারই পরে? আমিই কি সব স্মৃতির রোমন্থন করছি? জানিনা।
‘ রাত্রি বাহিরে ঠান্ডা পরেছে। তুমি রুমের ভেতরে এসো।’
সাদের ডাকে বারান্দা ছেড়ে রুমে এসেছি। তিনি আজ এতো তাড়াতাড়ি কেনো এলেন বুঝতে পারলাম না। রাতে তার ফিরতে একটু দেরী হয়। আমি কারন জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন,
‘ আমার বাড়িতে থেকে থেকে এসব তোমার অভ্যস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু এ বাড়িতে এসে এখনো খাপ খাওয়াতে পারোনি।’
তিনি তার কথা বলেছেন। কিন্তু আমি জানি, আমার বাড়িতে বহুবছর আগেই আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছি। শত আঘাতের পরেও সেটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সাদ বললেন,
” নিজের বাড়িতে এসে আমাকে ভুলে যেওনা।’
‘ আপনাকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।’
সাদ গোলাপ ফুলের মালা এনেছেন। তা তিনি আমার খোঁপায় পরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ ভালোবাসি। ‘
‘ আমিও ভালোবাসি আপনাকে।’
সমাপ্ত।