ধূসর অবেলায় সন্ধি পর্ব-০৫

0
164

#ধূসর_অবেলায়_সন্ধি
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_পাঁচ
পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তমিত হয়েছে। কর্মস্থলের মানুষেরা বাড়ি ফিরছে। কেউ কেউ রাস্তায় বাজার সদাই করছে। ফুলের দোকানগুলোতে এই সময়ে প্রচন্ড ভীড় থাকে। ক্লান্ত শরীরে পুরুষদেরকে দেখা যায়, গাজরাফুলের মালা অথবা কয়েকটা গোলাপ ফুল নিয়ে প্রিয়জনকে খুশি করার জন্য কিনে নিচ্ছে। অবশ্য ফুলের দিকে তাকিয়ে তাদের তৃপ্তি হাসি দেখার সৌভাগ্য মিলে।
মিশুর জীবন থেকে আরো দুইটি বছর কেটে গেলো। নিহালের সাথে সেইদিনের পর আর কথা হয়নি। গতমাসে নিহালের ব্যবস্থা করে দেয়া চাকরিও চলে গেলো। চলে গেছে বললে ভুল হবে, মিশুই ছেড়ে চলে আসলো। এবারের চাকরি চলে যাওয়াতে মিশুর কষ্ট হলো না। বরঞ্চ খুশি হলো। কেননা তার চাকরি চলে যাওয়াতে একজন দরিদ্র পরিবারের রিজিক তৈরী হয়ে গেলো। মূল ঘটনা বিস্তারিত বললে বলা হবে সেই সময়ের ঘটনাটি। নিহাল ঢাকার একটি বড়ো কাপড়ের ব্রান্ডে মিশুর চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানে মিশু প্রথমে গোছগাছের কাজ করলেও পরবর্তীতে ব্রান্ডের মালিক মিশুর সততা দেখে ম্যানেজার পদে চাকরি দেন। ভালোই চলছিল মিশুর দিনকাল। সারাদিন কাজে রাত হলে বাড়িতে আসা যাওয়ার সীমাবদ্ধতায় ছিল মিশু। কিছুদিন পর ব্রান্ডের মালিক কর্মচারীর নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়, প্রায় বিশজনের সিভি রিসিভ করলো মিশু। তারমধ্যে তিনজনকে সিলেক্ট করা হলো। তিনজনের মধ্যে রাসেল নামক একজন ছেলে ছিল, যে মিশুর থেকে বয়সে তিন বছরের বড়ো। ছেলেটার রেজাল্টও ছিল দুর্দান্ত। মিশুকে সম্মান করতো। রাসেল জয়েন হওয়ার এক সপ্তাহ পর দোকানে একজন বৃদ্ধা লোক আসলো। সাধারণত কর্মচারীরাই সকল ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলে। সেদিন মিশুর কী যেন হলো! বৃদ্ধা লোকটাকে দেখে তার বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। মিশু নিজেই বৃদ্ধার কাছে এগিয়ে গেলো। বৃদ্ধাটি ছিল রাসেলের বাবা। মিশু রাসেলের বাবার হাত ধরে চেয়ারে এনে বসালো। রাসেল তখন ছিল না, কিছু কাপড় আনতে গোডাউনে গিয়েছিল। মিশু সেদিন শুনতে পেলো রাসেলদের পারিবারিক কথা। রাসেলের বাবা পেশায় একজন কৃষক। ছেলেকে পড়াশোনা করানোর জন্য জায়গা সম্পদ বিক্রি করে ঢাকা শহরে চলে আসে। মিশু আরো জানতে পারলো, রাসেলের পড়াশোনা ঠিকই শেষ কিন্তু ভালো চাকরি পাচ্ছিল না। আমাদের দেশে এই আর নতুন কী! বিগত ছয়মাস ধরে চাকরির পিছনে ছোটাছুটি করছিল রাসেল। এমনও বেলা গিয়েছে,তারা তিনবেলা থেকে দুইবেলা অনাহারে থেকেছে। বৃদ্ধা বয়সে রাসেলের বাবা রিকশা চালাতেও হয়েছিল। এসব শুনে সেদিন মিশুর চোখের পানি চলে আসলো। মিশু সেদিনই ঠিক করলো সে রাসেলকে ভালো পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে। এজন্য মিশু ব্রান্ডের মালিকের সাথেও কথা বলল। মালিক প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে মিশু রাজি করিয়ে ফেলল। মিশু চলে আসায় রাসেলের মিশুর পরিবর্তে চাকরি হয়ে যায়।

গত সপ্তাহে মিশুর অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো। ভালো পয়েন্টের সাথে দুর্দান্ত ফলাফল করেছে মিশু। মিশু ভেবে নিয়েছে এবার মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যাবে সে। বিগত দুই বছরে ভালো টাকা জমিয়েছে সে। এই টাকায় আগামী একবছর চাকরি ছাড়াও চলতে পারবে। কিন্তু বলে না! ‘রাজার ধন বসে খেলে এমনিতেই ফুরিয়ে যায়!’ কর্মজীবী মানুষেরা ঘরে শুয়ে-বসে কাটাতে পারে না। মিশুর ক্ষেত্রেও তাই। পড়াশোনা করলেই হয় না চর্চা করতে হয়। মিশু তাই বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটি কোচিং সেন্টার খুলে ফেলল। নাম দিল, ‘এসো পড়ি পাঠশালায়।’
নামটা সাধারণ হলেও ভালো লাগলো মিশুর কাছে। প্রথম প্রথম অনলাইনে, পোস্টারে প্রচার শুরু করলো মিশু। আস্তেধীরে ছাত্র ছাত্রী আসতে শুরু করলো। কমার্সের স্টুডেন্ট হিসাবে মিশু এসএসসি ও এইচএসসির দুইটি ব্যাচ শুরু করলো। প্রায় ছয়মাসে মিশুর নামডাক চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো। এতদূর মিশু সহজেই আসতে পেরেছে বললে ভুল হবে। ভালে খারাপ মিলিয়েই তো পৃথিবী!

একদিন একদল মানুষ ভীড় করলো মিশুর কোচিং সেন্টারের সামনে। বলা যায় তারা ছিল, এলাকার নেতাদের ডান হাত বাম হাত। তাদের পাঠিয়েছিল তলায় পড়ে থাকা প্রতিবেশী কোচিংয়ের মালিকেরা। একা একজন মেয়ের এতো উন্নতি দেখে হিংসা করলো প্রচুর। প্রথমে মিশুর কাছে চাঁদা চাইলো। বলল, ” এখানে থাকতে হলে কমিশন দিতে হবে।”

মিশু তখন ভয় পেলো। কমিশনও সাথে সাথে দিয়ে দিলো। মোটামুটি পাঁচ দশহাজার খেয়ে যখন এরা আবার আসলো মিশু তখন তাদের মূল কর্মকাণ্ড ধরে ফেলল। পরবর্তীতে আসলে মিশু তাদের সামনেই পুলিশ ডাকলো। প্রতিবাদী হয়ে বলল,” নারী বলে আমাকে দুর্বল ভাববেন না। আপনাদের যারা পাঠিয়েছে তাদের সুব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। এখন আপনাদেরও করব। জানেনই তো! আজকাল নারীদের ক্ষমতা বেশি। একা আছি বলে যা ইচ্ছে করতে পারছেন! ভুলে যাবেন না, দশের লাঠি একের বোঝা। আমি একাই আপনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব।”

পুলিশ আসলো। তদারকি করে মিমাংসা করে দিলো। মিশুর দিন এখন ভালোই চলছে। কোচিংয়েই সময় কাটে।এরমধ্যে একদিন নিহালের ফোন এলো। মিশু তখন রাতের খাবার রান্না করছিল। বিদেশি নাম্বার থেকে ফোন আসাতে অবাক হয়েছিল। কানে ধরতেই নিহালের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো মিশু। নিহাল বলল,” তোমার চায়ের স্বাদ এখানে খুঁজে বেড়াই,পাই নাহ!”

মিশু বারান্দায় দাঁড়ালো। পূর্ণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” দেশের স্বাদ কী আর বিদেশে পাবেন, ভাইয়া?”

নিহাল প্রশ্ন করলে,” দেশে আসলে কী চা বানিয়ে খাওয়াবে?”

মিশু আনমনে বলল,” আজকাল চা বানাতে ভুলে গেছি।”

নিহাল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,” আবার শিখে নিও, মিশকা। আমি আগামীকাল বাংলাদেশে আসছি, দেখা হবে।”

নিহালের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলল মিশু। আজ মিশুর কেমন যেন আনন্দ হচ্ছে। এই পৃথিবীতে মিশুর আপন বলতে কেউ নেই, নিহালের কাছে সে চিরকৃতজ্ঞ। তাই মিশু ভেবে নিলো, নিহালের আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখবে না।

পরেরদিন কোচিং শেষ করে মিশু বাজার করলো। এই প্রথম মিশু এতো এতো বাজার করলো। তার কাছে মনে হচ্ছে তার বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হবে। বিশাল বড়ো আয়োজন না হলেও ঘরোয়া আয়োজন হবে। অবশ্য মিশুর ভাবনা তো মিথ্যা নয়। মিশুর কোনো আত্মীয় থাকলে অবশ্যই মিশু বড়ো আয়োজন করতো।

পোলাও, গরু, মুরগি, চিংড়ি, ডিম, মাছ সব রান্না করলো মিশু। নিহালের ফ্লাইট সন্ধ্যা ছয়টায় ছিল। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হতে হতে নয়টা বেজে গেলো। যেহেতু বাংলাদেশে নিহালের কিছুই নেই। নিহাল বিনা লজ্জায় মিশুর দুয়ারেই কষাঘাত করলো। নিহাল মিশুর বাড়িতে ঢুকতে অবাক হলো। তার দেয়া জিনিসপত্র ছাড়া নতুন কিছু কিনেনি মিশু। নিহালের মনে তখন প্রশ্ন জাগলো, ” মিশু কী তবে ভালো নেই?”

সোফায় বসে মিশুর জন্য অপেক্ষা করছিল নিহাল। মিশু গরম ধোঁয়া উঠা চা নিহালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” আপনার চলে যাওয়ার পর চা বানিয়ে খাইনি। কেমন হয়েছে বলেন তো, ভাইয়া?”

নিহাল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি হেসে বলল, ” পারফেক্ট। আমার এতো ঘণ্টার জার্নির ক্লান্তিই দূর হয়ে গেলো।”

মিশু কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে আঙুল ফোটাতে লাগলো। নিহাল চা শেষ করে বলতে শুরু করলো, ” তুমি কী ভালো নেই,মিশকা?”

মিশু অবাক হলো। সে তো ভালোই আছে। কোচিং, নিজের পড়াশোনা নিয়ে খুব ভালো আছে। পাল্টা প্রশ্ন করলো মিশু, ” বয়স বেড়েছে বলেই কী বলছেন?”

নিহাল হাসলো। উত্তরে বলল,” তেমার থেকে আমার বয়স বেশি, মিশকা। লজ্জা দিও না।”

নিহাল পুনরায় বলল,” মেয়েরা সৌন্দর্যের ব্যপারে খুব যত্নশীল থাকে, তুমি তো ঘরই সাজাওনি।”

মিশু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,” এই আসবাবপত্রে আমার অভিভাবকদের ছোঁয়া আছে। প্রতিনিয়ত এরা আমাকে শক্ত হতে বলে। এদের ছুঁয়ে আমি চাচার স্নেহ অনুভব করি। নতুনত্ব এনে এদের পর করতে চাইনি।”

মিশুর কথায় নিহাল সন্তুষ্ট হলো। তার বাবার কথাই সত্যি হলো। ফারুখ সাহেব সবসময় বলতেন, ” এই মেয়ে হচ্ছে লক্ষী। যেই ঘরে যাবে আলোয় ভরে দিবে।”

নিহালের আগমনে মিশু প্রতিবেশীদেরও দাওয়াত করলো।রাতের ভোজ গ্রহনে অনেক আলাপআলোচনাও করলো সকলে। নিহালে মিশুর বাড়িতেই থাকলো। সকলে চলে যাওয়ার পর মিশু নিহালের ঘরে আসলো। নিহাল তখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল। মিশুকে দেখে একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,” তোমার জন্য একটা শাড়ি বাবা কিনেছিল, মিশকা। বাবা বলেছিল, সুস্থ হয়ে দেশে আসলে শাড়িটা নিজের হাতে তোমাকে দিবেন।”

মিশু শাড়িটা খুলে দেখলো, গোলাপি রংয়ের খুব সুন্দর একটি শাড়ি। শাড়ির উপর হাত বুলিয়ে মিশু বলল,” শেষ সময়ে চাচার পাশে কে ছিল?”

নিহাল বলল,” আমি ছিলাম। বাবা আমার কোলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।”

মিশু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বিড়বিড় করে বলল, ” আল্লাহ চাচার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিন!”

চলবে……………..