#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৪)
নুসরাত জাহান লিজা
গত দুই মাসের কর্মব্যস্ততায় রাফিদের জীবন নিস্তরঙ্গ নদীর মতো হয়ে গেছে। তারুণ্য সেখানে ঢেউ খেলা না আর। সদা হাস্যোজ্বল, প্রাণোচ্ছ্বাসে টগবগে ছেলেটার মুখাবয়বে এখন বিষাদের ঘনঘটা। তবুও সে দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে নিচ্ছে। নয়তো ওর ভালোবাসা হেরে যাবে।
আজ অফিস শেষে বেরুচ্ছিল, তখন ডাক পড়ল বাবার৷ সে কেবিনে যেতেই তিনি বললেন, “এখন কোথায় যাবে?”
“তুমি ঢাকার বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলে, এখন কি বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিতে গেলেও তোমার কাছে এপ্লিকেশন দিয়ে এপ্রুভাল নিয়ে তারপর যেতে হবে?”
“রাফিদ, আমি তোমার বাবা। তোমার ঔদ্ধত্য কমাও। কার সাথে কথা বলছ ভুলে যেও না।”
রাফিদ তার হৃদয়ের সমস্ত অভিযোগ, অনুযোগের ঝাঁপি খুলতে চাইল, কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল, কী লাভ কংক্রিটের দেয়ালে মাথা ঠুকে! তাতে নিজের মাথাই কেবল আআঘাতপ্রাপ্ত হয়, কংক্রিটের দেয়ালের কিছু হয় কী! শুধু শুধু বলা মানে অনুভূতির অপচয়, তিনি কিছুই বুঝতে চাইবেন না৷ তাই বোবা হয়ে থাকাই সমীচীন মনে করল সে।
“যাচ্ছ, যাও। কোনো সমস্যা নেই। সময়মতো বাসায় ফিরে এসো।”
“তোমার বানিয়ে দেয়া রুটিন ধরেই তো চলছি, তোমার প্রোগ্রাম সেট করে দেয়া রোবট হয়ে। আরও কোনো সংযোজন করতে চাইলে করে নাও।”
জয়নুল রাফিদকে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করলেন, এরপর বললেন, “যা করছি, তোমার ভালোর জন্য করছি। এখন যাও। এই শুক্রবার কোনো প্রোগ্রাম রেখো না। বাসায় তোমার প্রয়োজন আছে।”
“ঠিক আছে।”
রাফিদ বেরিয়ে এলো। তরী এরমধ্যে তিন-চারবার ওকে কল দিয়েছে। মেয়েটাকে ওর সমস্যা খুলে বলতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
বন্ধুরা বলে, “তোর কী হয়েছে? কেমন বদলে যাচ্ছিস। ইদানিং তোকে কেমন অচেনা লাগে।”
বন্ধুদের সাথেও রাফিদের কোনো কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করে না। আড্ডায় আসর জমাতে ওস্তাদ রাফিদ ধীরে ধীরে কেবলই শ্রোতার ভূমিকা নিয়ে নিচ্ছে।
কোনো কিছুই ওর আর ভালো লাগে না। এক পৃথিবী বিতৃষ্ণা ওকে ঘিরে ধরছে চারপাশ থেকে।
***
তুহিনরা ভাড়া বাসায় উঠেছে গত মাসে। বাড়ির কাজ শুরু হয়ে গেছে। জহুরা বাড়ি ছাড়ার আগে খুব কান্নাকাটি করেছেন।
তুহিনের মনে হয়, এসব আবেগ নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। যুগের হাওয়া গায়ে মেখে চলতে হয়। বর্তমানে সবাই সাফল্যের পেছনে রীতিমতো ছুটে চলছে, সেখানে পুরোনোকে আঁকড়ে রেখে লাভ কী। স্মৃতি মানুষের মনের বিষয়, মনেই থেকে যাবে। তারজন্য জীবনে সেটাকে ধরে রাখতে চাওয়া নেহায়েত বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়।
উন্নত জীবনমান তো সকলেরই আরাধ্য। ওরা উঠেছে পাঁচ তলায়। ভাড়াটা একটু চড়া হলেও সদ্য জন্মানো মেয়ের জন্য নিতে হয়েছে। ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রয়োজন এখন। ওদের বাসার চারপাশে তো বড় বড় বিল্ডিংয়ের জন্য ঘরে আলো বাতাসই ঢুকত না। মশার আড্ডা বসত দিনেও। সেই তুলনায় এখানে বেশ ভালো।
মায়ের এখানে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি সারাজীবন নিজের বাড়িতে থেকেছেন৷ সেই মায়া এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাছাড়া তিনি পুরোনো ধ্যানধারণার মানুষ।
তুহিন বোঝে মায়ের আসল চিন্তা তপাকে নিয়ে। যে মেয়ে ওদের নিয়ে চিন্তা করে না, তাকে নিয়ে এত ভাবার কী আছে। বাড়ি ভাঙার আগে তাকে ঘ্যানঘ্যান করে এনেছিলেন।
দুই ভাইবোনের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে, শেষের দিন। তপা দুইদিন ছিল, যাবার আগেরদিন রাতে কবীরের সাথে ওর যোগাযোগ রাখা নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল।
তুহিন বিয়ের কথা তুলেছিল, আগে কিছুদিন চাকরি করেছিল, তখনকার ইমিডিয়েট বসের সাথে তো একবার বলেছিল, এখন ওর বন্ধুর বড় ভাইয়ের জন্য বলেছে। অভিজাত পরিবার ছিল, অর্থ সম্পদের কোনো অভাব ছিল না। তার স্ত্রী মারা গেছে। তবে কানাঘুষা শোনা যায়, স্ত্রী মরার পেছনে তার হাত ছিল। কিন্তু ওর বন্ধু বলেছে সব বানানো কথা। ওদের শত্রুরা ছড়ায়।
তপার আসলে সমস্যা কোথায় এটাই সে বুঝতে পারে না। কারো ভালো চিন্তা করতে নেই, এজন্যই বলে বোধহয়। থাক সে ওর মতো, সে আর কিছু বলবে না, কখনো আগেপিছে যাবে না। যা খুশি করুক।
কোন রাজপুত্র ওকে বিয়ে করে সে দেখবে, এই বয়সী একটা মেয়ের জন্য একা থাকা যে কত ঝুঁকিপূর্ণ, এটা কী সে বোঝে না! একটা নিরাপত্তার জন্য হলেও তো এই বিয়েতে রাজি হওয়া উচিত ছিল।
ইলার মেজাজ ইদানিং চড়েছে, কথায় কথায় ফোঁস ফোঁস করে উঠে। মেয়েটারও জন্মের পর থেকেই অসুখ-বিসুখ পিছু ছাড়ছে না। ব্যবসায় কখনো একটু লাভের মুখ দেখলে পরেই আবার যে কী সেই। সে স্বপ্নবিলাসী মানুষ, ছা-পোষা চাকরি ওর পোষায় না ঠিক। চাকরির পাশাপাশি এখানে সময় দেয়া যায় যায় না বলে ছেড়ে দিয়েছে।
ভালো লাগে না কিছু, কোথাও একফোঁটা শান্তি নেই।
***
সোমার বদলি হতে সময় লেগে যাচ্ছে৷ রবীনদের জেলায় একটা পোস্ট খালি ছিল, কিন্তু লবিং করে অন্য একজন সেখানে চলে এসেছে। এতে ওর বদলি আটকে গেছে। অন্য একজন প্রমোশন পেয়েছে, সে দায়িত্ব নিলে তবেই সে যেতে পারবে। এই মাসটা এখানেই থাকতে হবে। সামনের মাসে হয়ে যাবে বদলী।
এটা নিয়ে শাশুড়ি কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন, হলেই কী করা যাবে! এটা তো ওর হাতে নেই৷ সবকিছুরই একটা প্রসিডিওর আছে। চাইলেই তো আর সব হয় না।
রবীন অবশ্য তাকে বুঝিয়ে বলেছে অবস্থা। তিনি সরাসরি সোমাকে কিছু বলেননি, তবে সে বুঝতে পারে।
***
দর্পণ এখন হাত ছেড়ে দিলেও খানিকটা হাঁটতে পারে। অবোধ্য শব্দের সাথে কিছু অস্পষ্ট অথচ বোধ্য শব্দও বলতে শিখেছে। বেশ দুষ্টুমিও শিখে ফেলেছে। সেদিন গ্লাস ফেলে ভেঙে সে কী কান্না। সামনে কাগজ পেলে ছিঁড়ে কুটিকুটি করছে, খেলনা সব এলোমেলো করে ফেলছে। একটু একটু করে সন্তানের এই বড় হওয়ার মুহূর্তটা সে মনেপ্রাণে উপভোগ করছে।
আজ তপা ফিল্ড ভিজিটে এসেছিল৷ নির্ধারিত সেশন শেষ করে ফিরছিল, হঠাৎ একটা মিহি কান্নার শব্দে সে থেমে গেল, কান্নার উৎসের খুঁজে আশেপাশে তাকিয়ে দেখা পেয়ে গেল। একটা বাচ্চা মেয়ে গাছের নিচে বসে কাঁদছে।
তপা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার কাঁধে হাত রাখলে সে তাকালো, তপা জিজ্ঞেস করল,
“কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?”
মেয়েটার কান্নার বেগ বেড়ে গেল, কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। ভীত দৃষ্টি চোখে-মুখে।
তপা ওর পাশে বসে স্নেহের স্বরে বলল, “কী হয়েছে তোমার? তোমার নাম কী?”
“নীলা।”
“নীলা, তোমার কী হয়েছে?”
একই বয়সী আরেকটা মেয়ে এসে উপস্থিত হলো সেখানে, সে বলল, “ওর বিয়া।”
তপা বিস্মিত চোখে নীলাকে আরেকবার দেখল, এইটুকু মেয়ের বিয়ে?
“তুমি স্কুলে যাও?”
“ও সেভেনে পড়ে।”
সদ্যই কৈশোরে পা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
“ওর মা মইর্যা গেছে জন্মের সময়। বাপে মা তা ল। একটা খাটাশ ব্যাটার সাথে বিয়া ঠিক হইসে। ওইটাও পাড় মা তা ল, আগেও দুইটা বিয়ে করছে। খারাপ জায়গায় যাতায়াত আছে। এখন এর উপরে চোখ পড়ছে।”
তপার মন বিদ্রোহ করে উঠল, সে নীলার মাথায় হাত রেখে বলল,
“নীলা, তুমি বিয়ে করতে চাও?”
নীলার চোখে ভীতি তীব্র হলো, তবে ইতস্তত না করে মাথা দু’দিকে নেড়ে নিজের অসম্মতি জানাল৷
“পড়াশোনা করতে চাও?”
এবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
“বিয়ে কবে?”
“দশ তারিখ।” এবার সাথের মেয়েটি উত্তর দিল।
তপা ঘড়ি দেখল, আজ আর সময় নেই। এই বাসটা মিস করা যাবে না। সাত তারিখ ওকে আবার এখানে আসতে হবে, তখন একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
এইটুকু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দেখেও কিছু করতে না পারলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
নীলার মাথায় হাত রেখে বলল, “আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলব। সামনের সপ্তাহে আসব আবার। তুমি চিন্তা করো না নীলা।’’
তপা বাস ধরল, কিন্তু নীলার পরিস্থিতি ওর মস্তিষ্কে খচখচ করছিল।
………….
(ক্রমশ)
#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৫)
নুসরাত জাহান লিজা
রাফিদের ঘুম ভাঙল ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। ঘড়িতে দেখল সময় সাড়ে চারটা। ভীষণ বুক ধড়ফড় করছে। পানি খেলো ঢকঢক করে। এরপর বিছানায় চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণ পরে ফজরের আজান ভেসে এলো। সে উঠে নামাজ পড়ল। সময় নিয়ে দোয়া করল।
দুঃস্বপ্ন দেখেছে তপাকে নিয়ে। নামাজ শেষে ওর খুব ইচ্ছে করছিল তপাকে একটা কল দেবার। এত সকালে কল দেবে! নিজেকে সংবরণ করল। বারান্দায় পায়চারি করে সাতটা পর্যন্ত কাটিয়ে দিল। এরপর একবার কল দিল। ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। সে আরেকবার দিল, এবার রিসিভ হলো।
রাফিদ ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করল, “কেমন আছো তপা?”
“ভালো, তুমি?”
“এখন ভালো আছি। দর্পণ কেমন আছে?”
“দর্পণ ভালো আছে।”
“তুমি বিরক্ত হলে স্যরি। কল ধরার জন্য থ্যাংকস। সাবধানে থেকো।”
বলে নিজেই কল কেটে দিল। কত কথা বলার ছিল, কিন্তু বলল না কিছুই। এতদিন পরে তপার গলার স্বর শুনল, এটাই বা কম কী। সবচাইতে বড় কথা তপা আর দর্পণ সুস্থ আছে ভালো আছে। নিজেকে বোঝাল যে স্বপ্ন হচ্ছে অবচেতন মনের প্রভাব।
ইদানিং ভীষণ আশঙ্কা হয় বলেই হয়তো এমন স্বপ্ন দেখেছে৷ একটু পরে মা ডাকলে সে উঠে নাস্তা করে অফিসে চলে গেল আরেকটা বিরক্তিকর দিন কাটাবার জন্য।
***
তপা আজ আবার এসেছে ফিল্ড ভিজিটে। এই কয়দিন অস্থিরতায় কেটেছে। ওই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়েছে। নিজের কাজ গুছিয়ে নিয়ে সে লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে চলে গেল নীলাদের বাড়িতে। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে জানতে পারল আজই বিয়ে। মেয়েটা বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ধরা পড়ে যায় বলে আজই বিয়ে হবে। দ্রুত পা চালায় সে।
বাড়িটা কেমন নির্জীব মনে হচ্ছে। তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু বারান্দায় একটা চেয়ারে নীলা বসে ছিল একটা শাড়ি পরে। একজন মহিলা আঁচল ওর মাথায় তুলে দিচ্ছিল।
তপার ডাকে নীলা সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, এরপর দৌড়ে চলে এলো, “আমি মনে করছিলাম আপনে আইবেন না।”
“আমাকে তো আসতেই হতো নীলা।” ওর মাথায় হাত রেখে বলল তপা।
নীলা কেঁদে ফেলল, চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে। ঘুমহীনতার ক্লান্তি। শাড়ি পরে দৌড়ানোর ফলে কুঁচকে এলোমেলো হয়ে গেছে। কাজল ছড়িয়ে গেছে গালে, সাথে হাতের আঙুলের দাগ। ভীষণ মায়া হলো তপার।
পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের ভালোভাবে বাঁচার অধিকার আছে, এইটুকু বয়সে মেয়েটা জীবনের কী এমন দেখেছে, এত জটিলতা সে ডিজার্ভ করে? হেসেখেলে হৈ হৈ করে এখন স্কুলে যাবার বয়স, খেলার বয়স।
তপা জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা কোথায়?”
একটা লোক বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, চোখে মুখে কুটিলতার ছাপ। নীলা তপার হাত চেপে ধরল।
“আপনি নীলার বাবা?”
“হ, আপনে কে?”
“ওর বিয়ে দিচ্ছেন কেন?”
“বড় হইতাসে। বিয়া দিব না?”
“ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে একটা অসভ্য লোকের সাথে আপনি মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন না। ও পড়ালেখা করতে চায়।”
“ম্যাডাম, পড়ার খরচ আছে। তাছাড়া মাইয়্যা মানুষ, এত পইরে হইবডা কী!”
তপার মেজাজের পারদ চড়ছে, কবীরের ছায়া সমাজের অনেক পুরুষের মধ্যেই বিদ্যমান।
“বিয়েটা বন্ধ করুন। দেশে আইন আছে।”
পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো, “ম্যাডাম, আপনে আপনের কামে আইছেন। নিজের কাম করেন। আইনের ধামকি দিয়েন না।”
তপা লোকটাকে একবার দেখল, পাঞ্জাবি পরা, মাথায় মুকুট। সাথে আরও দুজন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বিয়ে করতে চলে এসেছে। নীলার হাত আরও শক্ত হলো, তপা ওর দিকে তাকিয়ে বুঝে নিল এই সেই লোক। চোখের দৃষ্টি ভীষণ অশোভন।
“আপনি একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছেন কেন?”
উত্তরে বিশ্রী হেসে ভীষণ অশ্রাব্য একটা কথা বলল লোকটা। তপার ইচ্ছে করল স্যান্ডেল খুলে সপাটে মেরে দিতে। কিন্তু নিজেকে সংযত করল দাঁতে দাঁত চেপে। এমন একটা জঘন্য প্রজাতির মানুষের কাছে কেউ মেয়ের বিয়ে দেয়!
“আপনি কেমন বাবা?”
নীলার বাবা বলল, “আমারটা আমি বুঝব।”
পাশ থেকে কেউ একজন বলল, “আপন না হইলে এই হয়।”
একজন বলল, “এইডা হের নিজের মাইয়্যা না। বাচ্চাসহ বিয়া করছিল। জামাই মইরা গেছিল হের।”
“শুনেন ম্যাডাম, মাইনসে বিয়ে কইরা কত কী পায়, আমি উল্টা টাকা পয়সা দিছি। আমি ভালো মানুষ, তাই বিয়া করবার চাইছি, নাইলে তো…”
এইটুকু বলে থামল ফজলু। নীলার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে।
“আপনে খামাখা ঝামেলা কইরেন না। শিক্ষিত মানুষ, শহর থেকে আসছেন, গ্রামের গরীব মহিলাগরে নিয়ে কাজবাজ করতাসেন, সেইটা নিয়ে থাকেন। আপনার কাজে যান।”
ততক্ষণে বেশকিছু মহিলা এসে জমায়েত হয়েছে সেখানে। তপা নীলার বাবা আর ফজলুর চোখে চোখ রেখে বলল, “এই বিয়ে কী করে হয় আমি দেখব। আমার সাথে চলো নীলা।”
তপা এখন থানায় চলে গেলে এরমধ্যে বিয়েটা হয়ে যেতে পারে, কাউকে পাঠালে ফিরতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে! সিদ্ধান্ত নিল নীলাকে নিয়েই বের হবে। পরে যা হবে দেখা যাবে।
“আমার সাথে যাবে নীলা?”
“যামু।”
নীলার হাত ধরে নিয়ে বেরিয়ে আসছিল, ফজলুর চোখের হুমকি উপেক্ষা করে।
পুলিশ স্টেশনে গিয়ে একটা অভিযোগ দায়ের করতে হবে, বাল্যবিবাহ আর টাকা লেনদেনের। তপা আরও জেনেছে ফজলু এলাকায় নানা ধরনের মা দ ক সাপ্লাই দেয়৷ এরকম একটা অপরাধী যে সমাজের ক্ষতি করছে, তাকে ধরিয়ে দিতে হবে।
তপা আর নীলার সাথে একজন ছেলেও আসছিল, সাইকেল নিয়ে। ওকে বলল,
“তুমি দ্রুত গিয়ে একটা রিকশা পাঠাও। আর থানায় চলে যাও।”
তপা মোবাইল বের করে অফিসে মনিরুল আলমের কাছে কল করল, খুবই সংক্ষেপে ঘটনার বিবরণ দিল, তিনি বললেন,
“আপনি এসবের মধ্যে জড়াতে গেলেন কেন? লোকাল লোকের সাথে লাগতে গেলে আমাদের রেপুটেশন নষ্ট হবে। তাছাড়া এগুলো অন্যের পার্সোনাল ইস্যু। এসবের মধ্যে গিয়ে ঠিক করেননি।”
তপা বিস্মিত গলায় বলল, “অন্যায় করা আর সহ্য করা দুটোই সমান অপরাধ স্যার। রেপুটেশনের জন্য এতবড় অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করতে হবে? আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
সে ওর কলিগ শোভনকে কল করলে ওদিক থেকে আশ্বাস পাওয়া গেল, “আমি আসছি।”
‘সম্ভব হলে জার্নালিস্ট সাথে নিয়ে এসো।”
হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা এগিয়ে এসেছে, এই জায়গাটা নির্জন। আশেপাশে ঘরবাড়ি নেই, রাস্তার একপাশে ক্ষেত অন্যপাশে ঝোঁপ। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে।
“আমার ভয় করতাসে।”
নীলার কথায় তপা বলল, “ভয় নেই নীলা।”
বলল বটে, কিন্তু ভয় আসলে সে-ও পাচ্ছে। তবে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসার মানুষ সে নয়। হঠাৎ রাফিদের কথা মনে পড়ল ওর। কেমন বুক চিতিয়ে উত্তেজিত জনতার কাছ থেকে একজনকে উদ্ধার করেছিল! আজ সকালেই কল করেছিল।
হঠাৎ পেছন থেকে ইঞ্জিনের শব্দ পেল, পেছনে তাকিয়ে দেখল তিনটা মোটরসাইকেল এগিয়ে আসছে। নীলাকে সে বলল,
“তুমি জোরে দৌড় দাও, যত দ্রুত পারো। আমি তোমার পেছনেই আসছি।”
এখানে লুকানোর মতো কোনো জায়গা নেই। ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল তপার মেরুদন্ড বেয়ে।
ভয়ে আর শাড়ির জন্য নীল ঠিকমতো দৌড়াতে পারছে না৷ খুব কাছে চলে এসেছে ধাওয়াকারীরা। হঠাৎ তপার মাথায় একটা শক্ত কিছুর আঘাত লাগল প্রচণ্ড জোরে, সে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। হাঁটুতে লাগল এবার।
চেতনা হারাবার আগে দর্পণের মুখটা মনে পড়ল, নিজের সমস্ত চাওয়া কেন্দ্রীভূত হলো একটা জায়গায়,
“আমি ছাড়া আমার ছেলেটার আর কেউ নেই। আমার ছেলেকে একা করে দিও না আল্লাহ।”
এরপর চেতনা পুরোপুরি লুপ্ত হলো তপার।
……..
(ক্রমশ)