নিভৃত দহনে পর্ব-৩২+৩৩

0
43
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩২)
নুসরাত জাহান লিজা

রাফিদ যখন বাসায় ফিরল, জয়নাল তখনো ফেরেননি। বহুদিন পরে ছেলের আগমনে শিরীন ভীষণ খুশি হলেন।

“মা, তুমি ভালো আছো তো?”

তিনি হেসে রাফিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তোরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি। এখন হাত-মুখ ধুয়ে আয়, খেয়ে একেবারে রেস্ট নে।”

যাবার আগে রাফিদ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, তপা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে। যত দ্রুত সম্ভব বিয়েটা করে ফেলতে চাই। তুমি রাজি তো? তোমার আর বাবার পারমিশনের জন্য এসেছি।”

শিরীন একদিকে ভীষণ খুশি হলেন, তার ছেলেটা থিতু হচ্ছে এইবার, অন্যদিকে কিছুটা বিচলিতবোধ করলেন। জয়নালকে বেশ কিছুদিন হয় তিনি ঠিকঠাক চিনতে পারেন না। তিনি তার মনের আশঙ্কাটুকুকে জায়গা দিলেন না। রাফিদের মাথায় হাত রেখে তিনি প্রগাঢ় স্বরে বললেন,

“আমি তো তোর এই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম। আপত্তি করব কেন? তাছাড়া তপাও ভীষণ চমৎকার একটা মেয়ে। তবে একটা কথা আজ বলতে চাই।”

“বলো মা।”

“একটা কথা মনে রাখবি, যখন স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে চাইবি, উত্তাল ঢেউ বারবার তোকে উল্টো দিকে নিয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। সেই উন্মত্ত ঢেউ সরিয়ে এগিয়ে যেতে হলে অসম্ভব মনের জোর আর একাগ্রতা প্রয়োজন হয়। তোদের বিয়েটা আর দশটা বিয়ের মতো নয়, একটা সন্তান আছে৷ নানা লোকে নানা কথা বলতে পারে। সেসব কথায় কখনো কান দিবি না, আমি জানি তোরা যথেষ্ট পরিণত। তবুও মানুষ তো, ভুল করে কান দিয়ে ফেললেই সব শেষ। এমনিতেই বিয়ে একটা বিশাল দায়িত্ব, তোদের ক্ষেত্রে সেটা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। দায়িত্ব থেকে কখনো পালিয়ে যাস না যেন?”

খানিকটা থেমে তিনি আবার বললেন, “আরেকটা কথা, বিয়ের পরে দর্পণ কিন্তু তোর সন্তান। এটা কখনো ভুলবি না।”

রাফিদ মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল, “মা, আমি তোমাকে এত ভালোবাসি কেন জানো?”

“কেন?”

“কারণ তুমি আমার মা বলে। তুমি আমার মাথার উপরে ছায়া হয়ে না থাকলে আমি তোমার মতো স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি কী করে পেতাম বলো তো?”

রাফিদের কথার ভঙ্গিতে এখনো ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাস খেলা করে। শিরীন হেসে বললেন,

“হয়েছে হয়েছে, এত কথায় কাজ নেই, তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর পছন্দের চিংড়ী আছে, সর্ষে ইলিশ করেছি তুই আসবি বলে।”

খেতে বসে রাফিদ কয়েকবার করে বলল, “তোমার রান্নার কোনো তুলনা হয় না মা।”

“এখন তো বিয়ে করে বউয়ের রান্না খাবি।”

“তুমি তো মাঝেমধ্যে রান্না করোই, তখনও তাই করবে আমার জন্য স্পেশাল করে।”

শিরীন হাসিমুখে ছেলের খাওয়া দেখলেন, দেখতে দেখতে ছেলেটা কেমন বড় হয়ে গেছে। বিয়ে করতে যাচ্ছে। দায়িত্ব নিতে শিখেছে।

খাওয়া শেষ করে রাফিদ আরও কিছুক্ষণ কথা বলে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল, ভেবেছিল আজ আর বাবার সাথে এসব নিয়ে কথা বলবে না। একেবারে আগামীকাল সকালে বলবে। শুক্রবার আছে, তিনি বাসাতেই থাকবেন।

কিন্তু রাত সাড়ে দশটার দিকে রাফিদের ডাক পড়ল লাইব্রেরি ঘরে। ভ্রমণ ক্লান্তিতে ওর চোখ বুঁজে আসছিল, তবুও উঠে এলো।

তিনি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলেন। পায়ের আওয়াজে চোখ খুলে ছেলের দিকে তাকালেন।

“বসো। কখন এসেছ?”

“সন্ধ্যার পরপর-ই।”

“তা সিলেটে কেমন কাটল তোমার দিনকাল?’’

রাফিদ এই প্রশ্নের উত্তর দিল না, শুধু বলল, “ভালো।’”

‘’ফেরার কথা মনে পড়ল তাহলে? তুমি জানো তুমি সেদিন ওইভাবে চলে গিয়ে আমার স্টাফদের মধ্যে হাসির খোরাক জুগিয়ে গিয়েছিলে?”

“একজন মানুষ তখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল, তাকে দেখার জন্য ছুটে যাচ্ছিলাম, এর মধ্যে যদি কারোর হাসি পায়, তাহলে তাদের মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।”

“তা যার জন্য ছুটে গেলে, তার এখন কী অবস্থা?”

“ভালো।”

“হুম, ভালো হলেই ভালো, জেনে ভালো লাগল।”

তিনি রাফিদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মুহূর্তকাল, এরপর বললেন,

“তুমি তোমার চুক্তি ভঙ্গ করে চলে গিয়েছিল। মেয়েটা অসুস্থ বলে সেসব নিয়ে আমিও আর মাথা ঘামাইনি। এখন তো সে সুস্থ। এখন নিজের কাজে মন দাও, এই সপ্তাহ রেস্ট নাও, সামনের সপ্তাহ থেকে শুরু করো।”

রাফিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আমার কিছু কথা আছে, খুব ইম্পর্ট্যান্ট।”

“বলো।”

“আমি তপাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। আশা করি তুমি আপত্তি…”

ওকে থামিয়ে রণহুংকার দিয়ে উঠলেন জয়নাল, তিনি ভুলে গেলেন এটা বাসা, তার প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রী আছেন এখানে।

“তোমার সাহস হলো কী করে এই কথাটা বলার? অন্যদের মতো বেয়াদবি করলে পিঠে কয়টা দিয়ে দিতাম ছোটবেলা থেকে, তবে ঠিক হতে। এমন একটা বেয়াড়া ছেলে তৈরি হতে না।”

অসহনীয় রাগে রাফিদের মুখেও কিছু শক্ত কথা চলে এসেছিল, তখন তপার মুখটা মনে পড়ল, শান্ত হয়ে বোঝানোর কথা ওর। নিজের ক্রোধকে সংবরণ করে নিল সে। এরপর খুব শান্ত গলায় বলল,

“তোমার আপত্তির কারণ কী বাবা?”

“হাজারটা কারণ আছে। তুমি ছোট বাচ্চা ছেলে নও যে সেসব আমার মুখে বিশ্লেষণ করতে হবে।”

রাফিদ জয়নুলের কাছে এগিয়ে গেল, তার চেয়ায়ের সামনে হাঁটু ভেঙে বসল, এরপর বাবার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিল, কতদিন পরে বাবার এত কাছাকাছি এলো মনে নেই রাফিদের৷

“বাবা, আমি জানি যতই আমাকে শাসন করার চেষ্টা করো, রেগে থাকো, তবুও তুমি আমাকে ভালোবাসো, তাই না? আমার ভালোর জন্যই তো রেগে যাও। তুমি তো চাও আমি চাকরি করি বা তোমায় ব্যবসায় সঙ্গ দিই, তাই না? তুমি যা চাও, আমাকে যেভাবে কাজে লাগাতে চাও, আমি তাই করতে রাজি আছি। শুধু এই বিয়েতে অমত করো না প্লিজ। আমি কীসে ভালো থাকব এটা তো তুমি বোঝো, বোঝো না বাবা? প্লিজ?’’

বলতে বলতে কেন যেন রাফিদের গলা ভেঙে আসছিল, চোখে জল জমছিল, এতটা আকুল হয়ে সে কখনো কিছু চায়নি,

“ছোটবেলায় কতরকম ছেলে ভুলানো গল্প করে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে, যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিলাম, তখনও আমি প্রতীক্ষায় থাকতাম, তুমি অফিস থেকে ফিরে আমায় ঘুম পাড়াবে বলে। অপেক্ষা করতে করতে সেভাবেই কখন ঘুমিয়ে পড়তাম! একসময় বুঝতে শিখলাম, তুমি ব্যস্ত মানুষ, অপেক্ষা করতে ভুলে গেলাম একসময়। একবার জন্মদিনে আমার সব বন্ধুবান্ধবরা এলো, তোমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তোমাকে ছাড়াই কেক কাটা হলো। এরপর থেকে জন্মদিনেও তোমার জন্য অপেক্ষা করার অনভ্যাস তৈরি হলো। এসএসসির রেজাল্টের পরে খুব ভালো রেজাল্ট করলাম। কত কল আসছিল, সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছিল। তুমি তখন দেশেই ছিলে না। তুমি অভিনন্দন জানালে সবার শেষে। তুমি কী বলেছিলে তোমার মনে আছে বাবা?
‘তোমাকে আমার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠতে হবে। এই রেজাল্ট ধরে রাখতে হবে।’
অথচ আমি ভেবেছিলাম, তুমি আমার কৃতিত্বে খুশি হয়ে আমি কী করতে চাই সেটা জিজ্ঞেস করবে। আমার মিউজিক, ফটোগ্রাফি কোনোটাই তোমার পছন্দ হয়নি। একসময় আমি বুঝে গেলাম, তুমি আসলে আমার প্রতি ভরসা রাখতে পারো না। আমার মনে এমন আরও কতশত অপেক্ষার গল্প জমা আছে তোমাকে নিয়ে, সেসবের কয়টা বলব তোমাকে?”

খানিকটা থেমে রাফিদ চোখ মুছে আবারও বলতে শুরু করল,
“তুমি জানো না, এসব অপেক্ষার গল্পের নিচে তোমার জন্য আমার ভালোবাসা চাপা পড়ে আছে। তোমার কথায় রেগে হয়তো প্রতিক্রিয়া দেখাই, কিন্তু ভালোবাসি না এটা ভুল।”

অবচেতনেই জয়নাল একবার তার হাত দিয়ে রাফিদের মাথায় আর গালে স্পর্শ করলেন, রাফিদ আশান্বিত গলায় বলল,

“এইবার, অন্তত একবার আমার উপরে ভরসা করে দেখো না বাবা! আমি ভুল নই। আমাকে প্রমাণ করার সুযোগ দিলে, তোমাকে নিয়ে আমার মনে যে অপূর্ণতা আছে, আজকের পরে সেই সারাজীবনের সমস্ত অপূর্ণতা আমি ভুলে যাব।”

জয়নাল হাত সরিয়ে নিলেন, এরপর গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি নিজের জীবন নিজের মতো কাটাতে চাও, তাই কাটাও। আমি বাঁধা দেব না। শুধু এই বিয়েটা আমি মানব না। মাথা থেকে এই সিদ্ধান্ত ঝেড়ে ফেলে দাও।”

রাফিদ ভীষণ মরিয়া গলায় বলল,
“বাবা, আমি বললাম তো, তুমি যেভাবে আমাকে দেখতে চাও, আমি সেভাবে নিজেকে তৈরি করব। শুধু তপার সাথে আমার বিয়েটা মেনে নাও।”

“যদি বলি ওকে বিয়ে করলে এই বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না, কী করবে?”

“আমার পক্ষে এখন আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়।”

“তাহলে বেরিয়ে যাও। যে সন্তান তার পরিবারের কথা ভাবে না, তাকে আমার প্রয়োজন নেই।”

রাফিদ উঠে দাঁড়িয়ে আরও একবার চোখটা মুছে নিয়ে বলল,
“এটাই তোমার শেষ কথা বাবা?”

জয়নুলও উঠে দাঁড়িয়ে বিপরীত দিকে ঘুরলেন, এরপর বললেন,
“হ্যাঁ।”

“মেনে না নিলেও, অন্তত আমাদের জন্য দোয়া কোরো। আমি আর তপা নতুন জীবন সুন্দর করে শুরু করতে চাই, সবার দোয়া নিয়ে।”

রাফিদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে জয়নুল বললেন, “তাহলে ফ্যামিলি আর ওই মেয়ের মধ্যে তুমি ওকেই বেছে নিলে?”

“দুটোই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাবা। তবে তুমি তো তোমার সোসাইটি আর সন্তানের মধ্যে সোসাইটিকেই বেছে নিলে। আমি বরং একজন মানুষকে বেছে নিয়েছি, যার সাথে একসাথে চলার প্রতিজ্ঞা করেছি।”

ঘরে বইয়ের তাকগুলো একবার দেখলো রাফিদ, এখানকার অনেক বই ওর নিজের সংগ্রহের। এছাড়াও প্রায় সব বইতে ওর হাতের ছোঁয়া রয়েছে। এই বাড়ির আনাচেকানাচে কত সহস্র স্পর্শ লেগে আছে রাফিদের, অস্ফুটস্বরে সে বলল,
“আসি।”

“যাও। বাস্তব দুনিয়ায় কিছুদিন ঠোকর খাও। দেখো পৃথিবী কত কঠিন।”

“কঠিন পৃথিবীর বুকে কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়, সুন্দর কিছু অনুভূতির চাষ হয়। কাঠিন্যের সাথে যখন ওই সুন্দর অনুভূতিগুলো জুড়ে যায়, তখন কঠিন আর কঠিন থাকে না। থাকলে মা হয়তো তোমাকে বিয়ে করে পস্তাতো। কিন্তু মা ভীষণ সুখে আছে।”

রাফিদ বেরিয়ে আসছিল, তখন শিরীন ঘরে ঢুকলেন, তার চোখে পানি, দৃষ্টিতে অবিশ্বাস,

রাফিদের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তিনি দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত জীবন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমার ছেলেকে তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছো?”

“শিরীন, প্লিজ, উত্তেজিত না হয়ে বসো, আমরা ঠান্ডা মাথায় কথা বলি।”

“কী বলবে আর? তোমার বলার কিছু আছে? অন্য কেউ বললে বলুক, কিন্তু তুমি? তুমি নিজেই একদিন শূন্য হাতে আমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলে। সেইসময় আমরা ছিলাম রাফিদের এইপাশে। সেজন্য তোমার যুক্তি ছিল অন্যরকম। আজ তুমি বাবার জায়গায়, তোমার যুক্তিও উল্টে গেল। সেদিন তাহলে ওইসব কেন বলেছিলে? আসলে তুমি সেলফিশ, হিপোক্রেট একজন মানুষ জয়নুল। সময় অনুযায়ী তোমার যুক্তি, চিন্তা উল্টে যায়।”

“মা, তোমার শরীর খারাপ করবে। আমি চলে যাচ্ছি, আমাকে হাসিমুখে বিদায় দেবে না?”

শিরীন ছেলেকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বহুদিন তিনি কাঁদেন না। রাফিদের চোখেও তখন জল।

তিনি ছেলেকে হাত ধরে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন, এরপর বললেন,

“একটু বোস, আমি আসছি।”

কিছুক্ষণ পরে তিনি একটা গয়নার বাক্স নিয়ে এলেন। সেটা খুলে রাফিদকে দেখাতেই সে বলল,

“মা, আমি এই বাড়ির কিছুই নেব না, প্লিজ জোর কোরো না।”

“এটা তোর বাবার দেয়া নয়। আমার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। মা আমার বিয়েতে লুকিয়ে দিয়েছিলো। তোদের বিয়েটা তো দাঁড়িয়ে থেকে দিতে পারব না, তবে এই উপহারটা তপাকে দিস। আমি না থাকি, তোদের বিয়েতে আমার একটা উপহার তো থাকল।”

বলতে বলতে আবারও কেঁদে ফেললেন তিনি, “আমার হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে করলে কী করবি খোকা?”

“আমি তো আসতে পারব না মা। তুমি চলে এসো।”

“ভালো থাকিস, খুব বেশি রাত জাগবি না একেবারে, যখন তখন মন চাইলেই এখানে ওখানে ছুটিস না এখন। একটু গোছালো হোস।”

“তুমি ঠিকমতো ওষুধ খেও মা, নিয়মিত চেকআপ করে নিও। টেনশন করে সব মিস করো না।”

“রাগ করে আমার নম্বর ব্লক করবি না তো?”

“কক্ষণো না। তুমি একটু হাসবে না মা?”

“হাসতে পারছি না রে! তোরা খুব ভালো থাকিস।”

“আমাদের বিয়েতে আসবে না মা?”

“এটা আমারও একটা লড়াই বাবু। অন্যরকম লড়াই। তোরা সুখী হ। পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোদের জীবনে আসুক।”

শেষবার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মা-পুত্রের বিদায়ী পর্ব সারা হলো, চোখ ভিজল বারংবার। মায়ের মন জুড়ে সন্তানের জন্য এক পৃথিবী শুভ কামনা আর দোয়া।

রাফিদ একবার পুরো বাড়িটা আর নিজের ঘরটা দেখে শুধু ক্যামেরা আর গিটারটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। এছাড়া আর কিছুই নিল না, কেবল মায়ের দেয়া হারটা ছাড়া। বলা যায় প্রায় শূন্য হাতে সে অবলীলায় পেছনে ফেলে এলো অনেককিছু, আধখানা জীবনের সহস্র স্মৃতি, অর্জন, পরিজন।
…………
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩৩)
নুসরাত জাহান লিজা

শিরীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাফিদের চলে যাওয়া দেখলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সে দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল তিনি ততক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, এরপর আরও কতক্ষণ ধরে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর ভেতরে এলেন, ডাইনিং টেবিলে এখনো খাবার সাজানো আছে। আজই তিনি কতটা যত্ন করে ছেলের জন্য রেঁধেছিলেন। একটু আগে কত স্বপ্নের বুনন আঁকিবুঁকি করছিল, ভালোবাসা প্রাপ্তির আনন্দে টইটম্বুর ছিল রাফিদ। উচ্ছ্বাস ঠিকরে পড়ছিল, নিজের স্বপ্নের পৃথিবী সাজাচ্ছিল মনের ক্যানভাসে, অদৃশ্য রং-তুলির ছোঁয়ায়।

সন্তানের সেই স্বপ্নের আঁকিবুঁকি দেখতে দেখতে তার হৃদয়েও খুশির লহরী বইছিল। সন্তানের সুখের চাইতে আরাধ্য কিছু কি মা’য়ের জীবনে আছে!

অথচ মুহূর্তের ব্যবধানে শিরীনের সেই উচ্ছ্বাস, ছেলের স্বপ্ন আঁকা ক্যানভাস, সব যেন এক ফুঁৎকারে কোথায় মিলিয়ে গেল। তার এতদিনের বিশ্বাস, সব কেমন হঠাৎ অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে।

তিনি রাফিদের ঘরে যাচ্ছিলেন, পেছন থেকে জয়নুল বললেন, “রুমে এসো শিরীন, কথা আছে।”

শিরীন দ্রুততার সাথে চোখের পানি মুছে ফেললেন। জীবনের সমস্ত উত্থান পতনে যার কাঁধে পরম ভরসায় মাথা রেখে এসেছেন, আজ তাকে এই কান্না দেখাতে তার ভীষণ বাঁধো বাঁধো ঠেকল।

“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, জয়নুল। আমি রাফিদের ঘরে শোবো আজ।”

“কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা…”

“আজ আমি বড্ড ক্লান্ত। জীবনের কিছু হিসেব মেলাতে চেষ্টা করব একান্তে, নিভৃতে। কোথায় গড়বড় হলো বুঝতে পারছি না।”

বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে রাফিদের ঘরে ঢুকলেন, জয়নুল পিছু পিছু যাচ্ছিলেন, কিন্তু শিরীন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

বন্ধ দরজার ওইপাশে জয়নুল কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর স্টাডিতে ফিরে গেলেন। তার স্ত্রী কীসের হিসাব মেলানোর কথা বললেন, সেটাই ভেবে চলেছেন।

রাফিদ শেষ পর্যন্ত চলে গেল। কোনো পিছুটান ছেলেকে আটকাতে পারল না। স্ত্রী অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। দু’জনেই কাঠগড়ায় তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আজ রাতের মতো এমন বিষাদময় রাত কি তার জীবনে বহু বছরে একবারও এসেছিল? মনে করতে পারেন না জয়নুল। তাদের জীবন অসংখ্যবার ঝড়-ঝঞ্ঝায় নুয়ে গেছে, শিরীন খুঁটি হয়ে তাকে আগলে গেছেন। আজ তার মুখের উপরে শিরীনের দরজার ছিটকিনি তুলে দেবার পর থেকে তার মনে হচ্ছে তার জীবনীশক্তি হিসেবে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা সেই খুঁটিটা যেন আলগা হয়ে গেল। বুকের কোথাও যেন চিনচিনে ব্যথা করছে, মৃদু অথচ অসহনীয় ব্যথা।

শুরু থেকেই রাফিদকে নিয়ে তার উচ্চাশা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, তাকে জীবনে যা কিছু সইতে হয়েছে, তা যেন তার সন্তানকে না সইতে হয়। সমাজের বুকে যেন মাথা উঁচিয়ে বুক ফুলিয়ে বাঁচতে পারে। শিরীনকে বিয়ের পরে যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে, যে অভাব দেখতে হয়েছে, তা যেন আবার কখনো দাঁত বের করে কামড় বসাতে না পারে। তার এত এত পরিশ্রম, সব তো ওদের জন্যই।

ছেলের মধ্যে বিবাগী, বাউন্ডুলে স্বভাব তার নজরে পড়েছিল। তাই সবসময় ক্যারিয়ার নিয়ে রাফিদকে সচেতন করতে চাইতেন। জীবন এত সহজ নয়, তা যেন উপলব্ধি করতে পারে, সেজন্যেই তো বলতেন।

ছেলের বউ হিসেবে একজন এক সন্তানের মাকে মেনে নিতে তার ঘোরতর আপত্তি তৈরি হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন এক হাতে তালি বাজে না। ডিভোর্সের ক্ষেত্রে দুই দিকেই কিছু না কিছু গড়বড় থাকে বলেই দুজন মানুষ একসাথে চলতে পারে না। সাথে একজন সন্তান আছে। লোকে কী বলবে! সবাই তাকে, তার পরিবারকে নিয়ে হাসাহাসি করবে আড়ালে, টিপ্পনী কাটবে, তার সারাজীবনের অর্জিত সম্মান কালিমালিপ্ত হবে, এটা তিনি কখনো চাননি।

তিনি প্রথম নড়েচড়ে বসেন তপার একজন কিশোরী মেয়েকে উদ্ধারে নিজের প্রাণের মায়া না করে এগিয়ে যাবার ঘটনা ভাইরাল হলে। যে মেয়ে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষের জন্য এতটা অকুতোভয় আচরণ করতে পারে, সে আর যাই হোক, একজন ভালো মানুষ তো অবশ্যই। রাফিদের উপর রেগে গিয়ে তপার চাকরি নিয়ে যে হু ম কী তিনি দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। তাছাড়া একটা ছোট্ট শিশু মেয়েটার উপরে নির্ভরশীল।

রাফিদ যখন তপার অবস্থার খবর পেয়ে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সিলেটে চলে গিয়েছিল, তখন তিনি খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন। তপার এক্স হাজব্যান্ডের পরিচয় বের করার পরে তার কীর্তিকলাপ জানতে কষ্ট হয়নি তার। মিউচুয়াল অনেক ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছ থেকে যেসব শুনলেন তাতে সন্দেহ নেই লোকটা সুবিধার ছিল না।

তবুও তিনি একবার শেষ চেষ্টা করতে চাইলেন আজ ছেলেকে ফেরাবার। এখন তার তপাকে মেনে নিতে সত্যিই খুব একটা আপত্তি নেই। তবে ছেলের এই ভবঘুরেপনায় ভীষণ আপত্তি আছে।

আজ বিয়েটা মেনে নিলে ক’দিন পরে আবার বাইরের জগৎ রাফিদকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। সে বাস্তব জীবনকে চেনে না। কখনো বাস্তবতার রূঢ়তা ওকে স্পর্শ করেনি। কিছুদিন সে জীবনকে চিনুক। সত্যিকারের স্ট্রাগলের মুখোমুখি হয়ে তার মোকাবেলা করতে শিখুক। ঘর আর বাইরের দুই জগতের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে শিখুক। চাইলেই মানুষ পাখি হতে পারে না, মানুষকে মানুষ হবার জন্য দায়িত্বশীলতাও শিখতে হয়।

তিনি নাহয় একটু কঠিন হলেন, খারাপ বাবাই নাহয় হয়ে রইলেন ছেলের কাছে, তবুও ছেলে জীবনকে চিনুক।

যাবার আগে বলা রাফিদের একটা কথা তার কানে বাজল, “আমার উপরে তুমি ভরসা রাখতে পারনি, বাবা।”

শিরীনের আজকের চেহারায় কী যেন একটা ছিল, অদ্ভুত শীতলতার পাশাপাশি এক পৃথিবী অভিযোগের তির। সবগুলো তির একসাথে তার হৃদপিণ্ডকে যেন বিদ্ধা করল।

***
খুব ভোরে তপার ঘুম ভাঙল, তখনো রাত পোহায়নি ঠিকমতো। জানালা খুলে দিতেই একরাশ ঠান্ডা বাতাস হুহু করে ঘরে প্রবেশ করল। হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেল একটা অবয়বে। বাগানের পাশে বড় গাছটায় হেলান দিয়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। চেনা মনে হলো অবয়বটাকে।

তপা ধীর পায়ে হেঁটে বারান্দায় এসে স্পষ্ট চিনতে পারল, চমকে উঠল, “রাফিদ!”

যে ছেলে গতকাল সকালে ঢাকায় গেল, সে এখন এখানে! যা বোঝার বুঝে নিল তপা।

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। রাফিদ তন্ময় হয়ে কী যেন ভাবছে। তপা যে এসে দাঁড়িয়েছে সে বুঝতেই পারেনি!

“রাফিদ, এখানে কী করছ?”

“ভোরের আলো ফোটা দেখছি।” অবচেতনে বলে সম্বিতে ফিরল রাফিদ।

“কেমন দেখছ?”

“আজকে যেভাবে ভোরের এই সময়টাকে উপলব্ধি করতে পারলাম, তা আগে কখনো করিনি৷ অন্ধকার আর আলোর এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটে এই সময়টায়। আমার জীবনের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে এর বিচিত্র মিল।”

“ব্যাখ্যা করবে?”

“আমার জীবন একদিকে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তুমি সেখানে একটু একটু করে আলো ছড়াচ্ছো, আমার জীবন এমন একটা ভোরের প্রতীক্ষায়।”

ততক্ষণে অন্ধকার ক্ষীণ হয়ে আসছিল, রাফিদকে আজকে কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছিল। খানিকটা ছন্নছাড়া, এলোমেলো। তপা কিছু বলার আগে রাফিদই মুখ খুলল আবার,

“আমি আজ পুরোপুরি পথের মানুষ। নিজের বলতে তোমাকে আর দর্পণকে অসম্ভব ভালোবাসার ক্ষমতাটুকু ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা নেই। তুমি এভাবে আমাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত?”

তপা খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, “আমাকে তোমার তাই মনে হলো বুঝি? তুমি আমাকে যোগ্যতার কোনো প্যারামিটারে মেপেছিলে?”

তপা কিছুটা থেমে বলল, “আমার ভালোবাসাটুকুরই বড্ড অভাব রাফিদ। সেটুকু হলেই আমাদের চলবে।”

রাফিদের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল, ভোরের সূর্যের মতো স্নিগ্ধ হাসি।

“বিয়েটা পেন্ডিং রেখে তাহলে কী করব? কবে শুভ কাজটা করতে চাও?”

তপার প্রথমে একবার মনে হচ্ছিল এভাবে রাফিদের বাবার অমতে বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে! পরক্ষণেই সেই ভাবনা নাকচ করে দিল। সে পিছিয়ে এলে যদি রাফিদ ভালো থাকত, সে ভেবে দেখত। কিন্তু সে যতটুকু চিনেছে ওকে, তাতে মনে হয়েছে সেটা হবার নয়। বরং রাফিদের মলিন চেহারা বলে দিচ্ছিল, ছেলেটা ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে সরে গেলে আরও ভেঙে পড়বে। তাই মন সায় দিল না পিছিয়ে আসতে।

“যত দ্রুত সম্ভব।”

“আজ তো শুক্রবার। চলো আজই বিয়েটা সেরে ফেলি।”

রাফিদের প্রস্তাবে তপা প্রায় চিৎকারই করে ফেলছিল, শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়ে বলল, “আজ?”

“তোমার আপত্তি আছে?”

ভেতর থেকে দর্পণের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে, তপা তড়িঘড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল, কিছুটা এগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,

“নেই।”

“সত্যি?” রাফিদের গলায় অবিশ্বাসের সুর।

“সত্যি।”

রাফিদের মনে হলো মন খারাপের কালো রাতের শেষে এক টুকরো সূর্য লালচে মৃদু আলো নিয়ে জ্বলে উঠল ওর মন জুড়ে।

হঠাৎ মনে হলো আজ তো শুক্রবার, বিয়ের কেনাকাটা হবে কী করে! খোঁজ নিতে হবে।

এই সুন্দর শুরু হওয়া দিনটা সে শুরু করল ফজরের নামাজ পড়ে। দোয়া চাইল নতুন জীবন নিয়ে। মা’কে কল করে জানিয়ে দিল বিয়ের কথা। ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন মা-ছেলে।
………
ক্রমশ