নিভৃত দহনে পর্ব-৪০+৪১

0
39
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪০)
নুসরাত জাহান লিজা

হাঁটতে ভালো লাগছে তপার। নিরিবিলি রাস্তা, রাস্তায় দুই পাশে গাছের সারি। গাছে নাম না জানা লতানো আগাছায় চমৎকার ফুল ফুটে আছে। ছোট্ট জলাশয়ে মাছরাঙা। দর্পণ গাঢ় নীল রঙের পাখি দেখে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। রাফিদ হাঁটতে হাঁটতেই ছবি তুলছে, মাছরাঙার ছবি তুলতে বেশ কসরত করতে হলো। যখন পারফেক্ট শট নিতে পারল, শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। এমন একটা পরিবার তপার চাওয়া ছিল। যেখানে সবাই একসাথে হাঁটতে পারবে, আনন্দ বিষাদ ভাগাভাগি করতে পারবে। একজন আরেকজনের পাশে থাকবে। দর্পণ আর রাফিদের উৎফুল্ল হাসিতে নিজেকে হারাতে ভালো লাগছে ওর। সহসা মনে হলো জীবন সুন্দর। ভীষণ ভীষণ সুন্দর।

টঙ দোকানে ছোট্ট জটলা, তপাকে এখন এই এলাকার সবাই চেনে, সম্মান করে। ওদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ কয়েকটা ছেলে।

“মামা, দুইটা দুধ চা দিয়েন তো।”

“নীলা আছে কেমন ম্যাডাম?”

একজন বৃদ্ধ প্রশ্ন করলেন, “ভালো আছে, চাচা। এখন তো স্কুলে যাচ্ছে।”

“যাক, মাশাল্লাহ। বড্ড দুখী মাইয়া। আল্লাহ আপনের ভালা করব।”

চা দেবার পরে দর্পণ রাফিদের কাপ ধরে সে-ও খেতে চাইল। রাফিদ আরেকটা কাপ নিয়ে তাতে অল্প করে ঢেলে ঠান্ডা করে দর্পণের হাতে দিল। সে মা বাবার দেখাদেখি চা খেতে চেষ্টা করল। দোকান থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে সূর্য ধীরে ধীরে লালচে হয়ে আসল। আজকের মতো মেঘের আড়ালে ডুব দেবার আয়োজন করছে পৃথিবীতে স্নিগ্ধ গোধূলি ক্ষণ উপহার দিয়ে। কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই সূর্য কেমন তেজোদ্দীপ্ত ছিল।

সূর্যের আলোর এই নানা রঙের সাথে জীবনের রঙ কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কখনো উত্থান, কখনো পতন, কখনো আনন্দ, কখনো বিষাদী অন্ধকার। ঠিক সূর্যের নানা রূপের মতো, ভোরের, দুপুরের, গোধূলির কিংবা রাতের অন্ধকারের সাথে বিচিত্র এক সাদৃশ্য।

***
নীলাকে স্কুলে যাবার আগে ভীষণ যত্ন করে টিফিন বক্সে খাবার তুলে দেয়। চুলে ঝুঁটি বেঁধে দেয়, মাঝেমধ্যে মুখে তুলে খাইয়েও দেয়। ওর মাতৃত্বের অপূর্ণতা সে নীলাকে দিয়ে পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করে হয়তো। এই বিশাল পৃথিবীতে সে-ও তার মতোই একা। দুই নিঃসঙ্গ মানুষ নিজেদের আঁকড়ে ধরে অপূর্ণতাগুলোকে পূর্ণ করতে পারলে দোষ নেই নিশ্চয়ই।

নীলাকে স্কুলে দিয়ে ফিরছিল মলিনা, আজও মনে হলো কেউ যেন পিছু নিয়েছে। ওকে কে ফলো করবে! নিজের কোনো শত্রু আছে কিনা ভাবতে চেষ্টা করল। কিছু মনে পড়ল না।

সহসা মনে হলো নীলার কথা, সে ভয় পেল ওর জন্য। আজকেই তপাকে জানাতে হবে বিষয়টা।

***
সোমা আজ তপার সাথে দেখা করতে এসেছে। আজ শুক্রবার, তপা ওর অফিসে যাবার কিছু জামাকাপড় ধুয়েছে, দর্পণেরও কিছু ময়লা কাপড় জমেছে। সেগুলো রোদে দিয়ে এসে বসল।

স্বাভাবিক সৌজন্যতা শেষ করে সোমা বলল,

“তপা আপু, তোমার সাথে কিছু আছে। ভীষণ জরুরি।”

“হ্যাঁ, বলো। সব ঠিক আছে তো?”

“হুম।”

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সোমা বলল, “আসলে রবিনের ট্রান্সফার অর্ডার ইস্যু হয়েছে হুট করে, রাজশাহীতে। আমি তো কিছুদিন আগেই ওখানে গেলাম৷ এখন আমার পক্ষে আর বদলি হওয়া সম্ভব নয়। আবার রবীন একা থাকবে, আমি আসলে ডিসিশন নিতে পারছি না। জবটা ছেড়ে না দিলে আমি ওইখানে, আর ও থাকবে রাজশাহীতে। কী যে একটা ঝামেলার মধ্যে পড়েছি। রবীন, ওই বাড়ির সবাই বলছে জব ছাড়তে।”

তপা উত্তর দেবার আগে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। এরপর বলল, “সোমা, তুমি কি চাও সেটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি জব ছাড়বে কিনা সেটাও তুমি চাইছ কিনা সেটাই আসল৷ ধরো সবার কথা শুনে তুমি জব ছাড়লে। একটা সময় গিয়ে তোমার মনে হতেই পারে যে তুমি ওদের জন্য জব ছেড়ে ভুল করেছ৷ তখন না চাইতেও তাদের প্রতি তোমার একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হতে পারে, রবীনের সাথে দাম্পত্যে না চাইতেও প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু তুমি যদি কারো কথা কানে না নিয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নাও যে তুমি এটাই চাও। তাহলে পরে আক্ষেপ হবে না। অন্যের জন্য না, তুমি নিজের জন্য কোনটা চাইছ সেটা ভাবো। সময় নাও। এরপর ঠান্ডা মাথায় একটা ডিসিশনে আসো।”

খানিকটা থেমে তপা আবারও বলল, “আমার কথায় আত্মকেন্দ্রীকতার ছাপ হয়তো আছে, কিন্তু কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের নিজেদের জন্যই নেয়া উচিত। নিজে কী চাইছি সেটার চাইতে বড় কিছু হয় না। তাতে সিদ্ধান্ত যদি কখনো ভুলও হয়, তাতেও কাউকে দোষ দেবার থাকে না। ভালো হোক সেটাই তো কাম্য।”

“অনেক ধন্যবাদ তপা আপু। আমি বরং আরেকটু সময় নিয়ে ভাবি। এরপর ডিসিশন নিই।”

***
তপা এই মাসের স্যালারি তুলেছে আজ। এরপর ভাবল শপিং করা যেতে পারে। দর্পণের জন্য কিছু কেনাকাটা করল।

এরপর একটা টি-শার্ট বেশ পছন্দ হলো রাফিদের জন্য। সে কিনে ফেলল, একবার মনে হলো, রাফিদের পছন্দ হবে তো!

কবীরের সাথে বিয়ের পরে পরে একবার সে কবীরের জন্য একটা শার্ট কিনেছিল। কবীর নামী ব্র‍্যান্ড ছাড়া পরে না। শার্টটা নিয়ে সে কিছু বলেনি বটে। কিন্তু কখনো পড়েনি, ভালো মতো খুলেও দেখেনি। অথচ সে কয়েকটা শো-রুম ঘুরে ভালোবেসে কিনেছিল। ভালোবাসা ব্র‍্যান্ডভ্যালুর নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। এরপর সে কবীরের জন্য নিজে পছন্দ করে কিছু কেনেনি।

রাফিদ টি-শার্টটা ভীষণ উৎসাহ নিয়ে খুলল, সাথে সাথে পরল, আয়নায় দেখল, ওকেও দেখাল।

“তোমার পছন্দ হয়েছে? খুব বড় ব্র‍্যান্ডের নয় কিন্তু!”

রাফিদ একগাল হেসে দর্পণের জন্য আনা কাপড় ওকে পরাতে পরাতে বলল, “আমাকে যা মানায়, যেটা পরে কমফোর্ট ফিল করি, আমি সেটাই পরি। এসব নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তাছাড়া তুমি আমার কথা ভেবে আমার জন্য পছন্দ করে এনেছ, সেটা আমার ভালো লাগবে না?”

ভেতরে আটকে রাখা শ্বাসটা সন্তর্পণে ছাড়ল তপা। রাফিদ প্রতি মুহূর্তে ওকে ভালোবাসা নতুন করে উপলব্ধি করায়৷ পৃথিবীতে কবীরের মতো লোকের পাশাপাশি রাফিদরা আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো এত সুন্দর। এখনো জগতে ভালোবাসা প্রবল গৌরবে অধিষ্ঠিত।

“তোমার জন্য কী কিনলে?”

“আমার তো আছে। আজ কেনা হয়নি।”

রাফিদের মুখ কিছুটা মলিন হলো, সে ভাবল তপাকে সে নিজে পছন্দ করে কিছু কিনে দেবে।

জব সাইটে ঢুকে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করল, টুকে রাখল, কোথায় কোথায় এপ্লাই করবে।
………….
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪১)
নুসরাত জাহান লিজা

দর্পণের অভিভাবকত্ব চেয়ে কবীরের করা মামলাটা তপার জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে এলো। তপাকে কল করে অবগত করা হয়েছে। মামলার বিষয়বস্তুও জানানো হয়েছে। নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে, সেটাও চলে আসবে।

তপা অফিসে কাজ করছিল, হন্তদন্ত হয়ে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এলো। বাসায় ফিরে দেখল রাফিদ দর্পণকে খাওয়াচ্ছে। মলিনা নীলাকে স্কুলে দিতে গেছে।

তপার বিপর্যস্ত মুখ দেখে রাফিদ জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? গুরুতর কিছু?”

তপা প্রায় ছুটে গিয়ে দর্পণকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল, মনে হলো এভাবে নিজের পাঁজর দিয়ে ওকে আগলে রাখবে পৃথিবীর সমস্ত কলুষতা থেকে, পৃথিবীর হিংসাত্মক চেহারা থেকে। সে কিছুতেই তার সন্তানকে কোনো জঘন্য লোকের কাছে যেতে দেবে না।

নিজেকে ধাতস্থ করে তপা বলল, “হ্যাঁ। কবীর দর্পণের অভিভাবকত্ব চেয়ে মামলা করেছে। আমাদের ঢাকায় যেতে হবে। সামনের সপ্তাহে উপস্থিত থাকতে হবে।”

রাফিদ হতভম্ব হয়ে বলল, “মামলা? কিন্তু তুমি তো তোমার কাছে রাখার অনুমতি পেয়েছ আদালত থেকে।”

তপা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। আমাকে কোনোভাবে ভাঙতে না পেরে এখন আমাদের বিয়েকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে শ য় তা ন টা।”

কৌতূহলী রাফিদের দিকে তাকিয়ে তপা বলল, “বিয়ে করে নাকি আমি দর্পণের দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয়েছি, আর তুমি…”

এটুকু বলে মুহূর্তের জন্য থামল তপা, দর্পণের প্রতি রাফিদের অতল স্নেহ সে চাক্ষুষ অবলোকন করেছে সে। এমন একটা ঘোরতর অপবাদের কথা কী করে বলবে ভেবেই থমকে গেল।

“আমি কী?”

রাফিদের প্রশ্নে তপা আবারও মুখ খুলল, “তুমি দর্পণের দায়িত্ব নিতে চাও না, আর আমার অবর্তমানে তুমি ওর উপরে নির্যাতন করো। এমন উদ্ভট অভিযোগ করতে ওর বাঁধেনি।”

রাফিদ এগিয়ে এসে তপার মাথায় হাত রেখে বলল, “তপা, মিথ্যে মিথ্যেই হয়। একটা সত্য হাজারটা মিথ্যার চাইতে শক্তিশালী হয়। আমরা আমাদের ছেলেকে আমাদের কাছেই রাখব। আমাদের কাছ থেকে কেউ ওকে নিয়ে যেতে পারবে না।”

তপার মুখে তিক্ত হাসি, “কবীর ভীষণ ক্ষমতাবান রাফিদ, ক্ষমতাবান লোক যদি ধূর্ত হয়, তবে এই পৃথিবীতে সত্য মিথ্যা হতে আর মিথ্যা সত্য হয়ে যেতে সময় লাগে না। তুমি কবীরকে চেনো না, জেতার জন্য নোংরামির শেষ সীমাও ক্রস করে ফেলতে পারে সে। এরকম একটা মিথ্যা সাজিয়েছে, নিশ্চয়ই সেটা প্রমাণ করার কিছু ব্যবস্থাও নিয়ে রেখেছে। নইলে এটা করতই না।”

রাফিদেরও ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, তবে সে তা তপাকে দেখাতে চায় না। তাহলে আরও ভেঙে পড়বে মেয়েটা। তপাকে সে সবসময় যেকোনো পরিস্থিতি আশ্চর্য দৃঢ়তার সাথে সামলে উঠতে দেখেছে। আজও ভেতরের ঝড়টা চেপে রাখতে চাইছে। তবে আজকের মতো করে এমন নৈরাশ্যবাদী কথা তপা কখনো বলেনি। এখন রাফিদকে শক্ত থাকতেই হবে। সে দর্পণকে কোলে নিয়ে তপার পাশে বসে একটা হাত তপার কাঁধের উপরে রেখে বলল,

“এই ঝড়টা আমরা দুজনে মিলে ঠিক সামলে উঠবো, দেখো। তুমি একদম টেনশন করো না।”

তপা রাফিদের কাঁধে হেলান দিয়ে দর্পণের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নির্ভার হবার চেষ্টা করল।

***
তুহিন আজ বাসায়ই আছে। ব্যবসার কিছু জিনিসপত্র কিনতে চট্টগ্রাম যাবে আজ রাতের ট্রেনে। তাই আজ দিনটুকু মেয়ের সাথে কাটাবে, বিশ্রামও হবে ভেবে যায়নি।।

ওর মেয়ের নাম তরু’ই রেখেছে। প্রথমে ইলা আপত্তি করলেও পরে কী মনে করে সম্মতি দিয়েছে। এখন ছোট্ট তরুকে কোলে নিয়ে বারান্দায় মিঠে রোদে বসে আছে।

কবীর কল করল এই সময়, “তোমার সিদ্ধান্ত জানালে না তো তুহিন?”

“কীসের সিদ্ধান্ত?” বুঝতে পারলেও না বোঝার ভাণ করল।

“একটাই কথা তোমার আমাকে জানানোর কথা ছিল। তাই ভান ধরে লাভ নেই। তুমি নিশ্চয়ই রাজি হয়েছ?” আত্মবিশ্বাসী গলা কবীরের।

“কবীর, এবার তোমার বুঝতে একটু ভুল হয়ে গেছে। আমি প্রচণ্ড স্বার্থপর এটা সত্যি। স্বার্থের জন্য কাউকে ঠকাতেও পারি। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। মনুষ্যত্ব নামক বস্তুটা আমার মধ্যে খুব একটা না থাকলেও একেবারে শুকিয়ে যায়নি। আমার পক্ষে এবার তোমার সঙ্গ দেয়া সম্ভব নয় কবীর।”

কবীর দাঁতে দাঁত চেপে অত্যন্ত অশ্রাব্য একটা গালি দিল, এরপর হিসহিসিয়ে হুমকির সুরে বলল, “এরজন্য ভীষণ পস্তাবে তুহিন। প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পাবে না।”

তুহিনেরও রোখ চেপে গেল, জীবনে প্রথমবার দৃঢ় গলায় বলল, “তুমি যা করার করে নাও কবীর। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। বহুদিন পরে নিজেকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে। রাখছি।”

বলেই মুখের উপরে কল কেটে দিল তুহিন। তরুর নিষ্কলুষ মুখের দিকে তাকাল, অবোধ্য শিশুটা পরম ভরসায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আজ এমন কিছুতে সম্মত হলে এরপর কোনোদিনও কি এই চোখে চোখ রাখতে পারবে!

***
শিরীনের শরীর কিছুটা খারাপ হয়েছে শুনেই বাসায় এসেছেন জয়নুল। ব্লাডপ্রেশার বেড়েছে।
ছেলেকে নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করে বলে এমন হচ্ছে। আগে নিজের হাতে রান্না করতে পছন্দ করতেন, কিন্তু রাফিদ চলে যাবার পর থেকে একদিনও রান্না করেননি।

জয়নুল গতকাল রাতে খাবার সময় একবার হেসেই বলেছিলেন,

“তোমার রান্না মিস করি।”

“এখন ইচ্ছে করে না, শরীরটাও ভালো লাগে না।”

“সমস্যা নেই। জমিলার রান্না খাওয়া যায়।”

শিরীন যেন তার কথা শোনেননি এমনভাবে স্বগোতক্তির মতো প্রায় অস্ফুটস্বরে এবার বললেন,

“রাফিদটা আমার রান্না ভীষণ পছন্দ করে। কতদিন ছেলেটা আমার হাতের রান্না খায় না। ওর পছন্দের খাবার ওকে ছাড়া আমার গলা দিয়ে নামবে না।”

বলেই উঠে পড়লেন, জয়নুলেরও আর খাওয়া হলো না। জীবনের সপ্তসুরের কোথাও যেন একটা তাল কেটে গেছে। তিনি কি ছেলেকে মিস করেন না! তার ভেতরে কি তোলপাড় হয় না! কিন্তু তিনি কাউকে বোঝাতে পারেন না। ঝড়টা নিজের মধ্যেই থাকুক।

শিরীন এখন চোখ বুঁজে শুয়ে আছেন, ঘুমিয়ে পড়েছেন কিনা বোঝা গেল না। জয়নুল মাথার কাছে এসে বসলেন। এরপর হাত রাখলেন স্ত্রীর মাথায়। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। শিরীনের আগে মাথা ব্যথা হলে তিনি মাথায় বিলি কেটে দিতেন।

বিয়ের কিছুদিন পরে একবার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হয়েছিল, তিনি হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, শিরীন ঘুমিয়ে পড়েছিল সেভাবেই। ঘুম থেকে উঠে উচ্ছল তরুণী স্ত্রী উদ্ভাসিত হাসিমুখে তাকে বলেছিলেন,

“মাথা ব্যথার জন্য আমার ওষুধ খাবার দরকার নেই। আমি অন্য ওষুধ পেয়ে গেছি।”

“মানে?”

“এরপর থেকে আমার মাথা ব্যথা করলে এভাবেই সারিয়ে দিও।”

তরুণ বয়সের কথা চিন্তা করে ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটল তার।

হঠাৎ নস্টালজিয়া কেটে গেল বেরসিক মুঠোফোনের কর্কশ শব্দে। তিনি দেখলেন রাফিদের কল। শিরীন উঠে বসলেন। কল রিসিভ করলেন।

জয়নুল বুঝল শিরীন ঘুমাননি এতক্ষণ। তার হাসির রেখা গাঢ় হতে হতে শিরীনের মুখে চিন্তার ছাপ দেখে তা মিলিয়ে গেল।

কোনো দুঃসংবাদ! রাফিদের কিছু হয়েছে! চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছেন, কথা শেষ হবার।

***
মলিনা আজ নীলাকে রাখতে যাবার সময় অনুসরণকারীকে দেখেছে। ডে শিফট শুরু হয় সাড়ে বারোটা থেকে। সে রেখে ফিরছিল, ঠিক করেছে আজ একটু আগে আসবে নিতে। ঝুঁকি নেয়া যাবে না।

স্কুল থেকে বাসার দূরত্ব হাঁটলে পনেরো মিনিটের মতো। সে হেঁটেই যায়। শুধু আসার সময় রিকশায় আসে। বিকেলে ফেরার সময় দুজন হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফেরে।

স্কুলের রাস্তা থেকে কিছুটা হেঁটে গেলে একটা গলি পড়ে, গলিটা এই সময় নিরিবিলি থাকে। গলিতে ঢুকে কিছুটা হাঁটার পরেই একটা কর্কশ স্বরে ওর পা থমকে গেল মুহূর্তের জন্য। এরপর হাঁটার গতি বাড়াতেই যাচ্ছিল, একটা ভীষণ শক্ত হাত ওর হাত চেপে ধরল,

“চিল্লাবি না, চাক্কু মাইরা দিমু পেটের মইদ্যে। চুপচাপ হাঁটতে থাক। আস্তে আস্তে।”

মলিনা তাই করল, সাহস করে প্রশ্ন করল, “আপনে কে? আমার কাছে কী চান?”

লোকটা ওর পাশাপাশি হাঁটছে, “তোরে একটা কাম কইরা দিতে হইব। বহুত ট্যাকাওলা পার্টি। এনাম পাবি কাম হইলে।”

মলিমা ঢোক গিলে বলল, “কী কাম?”

সে কিছুই বুঝতে পারছে না, অত্যন্ত সামান্য একজন মানুষ সে। কী এমন কাজ তার, যারা জন্য টাকাও পাওয়া যাবে৷

“তোর ম্যাডাম আছে না? ওই যে বাচ্চাওয়ালি, আরেকবার বিয়া করছে। হের পোলা বাপ, পোলারে ফেরত নিবার চায়। সেইজন্য কোর্টে মামলা হইসে। তোর কামডা ছোট্ট, খালি একটা স্বাক্ষী দিবি। কবি যে তুই নিজের চোখে দ্যাখছস, হ্যাগোর মইদ্যে ওই পোলারে নিয়া গ্যাঞ্জাম হয়, নতুন জামাই তোর সামনেই পোলারে মারে। এট্টুকই কাম৷ সাহেব এক লাখ দিবো।”

মলিনা কখনো একসাথে এত টাকা দেখেনি। শোনার পরে প্রবৃত্তি বশত ভেতরে একটু লোভ হয়েছিল বৈকি। এত টাকা পেলে নিজের একটা ছোট্ট দোকান হতে পারে, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে তাহলে। অন্যের বাসায় কাজ করতে হবে না।

কিন্তু পরক্ষণেই দর্পণের হাসিমুখটা ভেসে উঠল ওর মানসপটে। প্রায় বছরখানেক হয় ছেলেটাকে কোলেপিঠে করে আদর করেছে। মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে, তাছাড়া তপা কত ভরসা করে ওকে। যখন হাঁটতেও শেখেনি, তখন থেকে ওর কাছে রেখে যায়৷ রাফিদও এত ভালো, সবসময় হাসিমুখে কথা বলে। সে কোনোভাবেই এদের সাথে বেঈমানী করতে পারবে না৷

মলিনা নিঃসন্তান হলেও সন্তানের মর্ম বোঝে। একটা সন্তানের জন্য ওর হৃদয়ে অপার হাহাকার জমে আছে। অন্য একজন মায়ের বুকে এই হাহাকার সে তৈরি করতে পারবে না।

“রাজি না থাকলে, যারে ইশকুলে দিয়া আসলি, তার ক্ষতি হইব।”

নীলা মলিনার দুর্বল জায়গা। সে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল, এখন অস্বীকার করলে হাতের ছুরিটা সত্যি সত্যি ওর পেটে চালিয়ে দিতে পারে লোকটা।

ভেবেচিন্তে সে বলল, “ট্যাকা যে দিবো, তার গ্যারেন্টি কী?”

“আগে অর্ধেক পাবি, কামের পরে অর্ধেক। কাইলই সাথে নিয়া আসমু ট্যাকা।”

“আপনেরে বিশ্বাস করমু ক্যামনে?”

“কইলাম তো। কাইলই পাবি৷ হের পরে বিশ্বাস করিস। এহন ক।”

মলিনা এটুকু বুঝল সে নিজের কথা কিছুটা বিশ্বাস করাতে পেরেছে, সে উত্তর দিলো,
“আমি আইজকা ভাবি, কালকে যদি ট্যাকা নিয়া আসেন, তাইলে আমি রাজি হমু।”

“যা তাইলে। ত্যারিবেরি করার চেষ্টা করবি না। তাইলে কপালে খারাবি আছে।”

মলিনা বাসা পর্যন্ত কী করে এলো সে জানে না। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছে। এত ভয় সে কোনোদিন পায়নি।

ভেবেছিল আবার নীলার স্কুলে ফিরে যাবে কি-না। কিন্তু স্কুলে সিকিউরিটি সিস্টেম বেশ ভালো। ভেতরে সে নিরাপদ। ছুটির আগে বেরুতে হলে বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন। তাই আগে বাসায় আসাই স্থির করেছে।

আগে সব জানাতে হবে। আজকের মতো নিরাপদ হলেও, বিপদ মাথার উপরেই আছে। আগামীকাল কী হতে যাচ্ছে সে জানে না!

তপা আর রাফিদকে সব জানালে, বাকিটা তাদের উপরেই ছেড়ে দেবে সে।
…….
ক্রমশ