নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-০৯

0
34

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ০৯
#জান্নাতুল_বিথী

তুহারা যখন বের হয় তখন বিকেলের শেষ ভাগ। জিহাদ গাল ফুলিয়ে বসে আছে। প্রিয় বন্ধুর প্রস্থান কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তাও আবার বিয়ে বাড়ি থেকে। জিহাদ অনেক অনুরোধ করার পরও শৈবাল রাজি হয় না। তার একটাই কথা,

“আমার হসপিটালে ইমার্জেন্সি কাজ পড়ে গিয়েছে। না গিয়ে উপায় নেই!”

“কিন্তু তুই তো ছুটি নিয়েছিস। এভাবে ছুটি শেষ না হলে তোকে হসপিটাল থেকে ডাকার মতো কেউ নেই। অন্য কোনো কারণ আছে সেটা বলে যা।”

জিহাদের কথা মানতে নারাজ সে। তাকে কিছুতেই মানানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত মুখ গোমড়া করে বসে আছে সে। তুহা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে। শৈবাল আসে আরো দশ মিনিট পরে। তুহার পাশে বসে গাড়ির দোর বন্ধ করতে করতে বলে,

“সব কিছু নিয়েছো? আবার কিছু রেখে আসোনি তো?”

“আপনাকে রেখে আসলে শান্তি পেতাম। ভুল করে হয়তো চলে এসেছেন!”

তুহার কথা শুনে এক গাল হাসে শৈবাল। রাগে পিত্তি জ্বলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় তুহার। বিরক্তি স্বরে বিরবির করে বলে,

“পৃথিবীর সবচাইতে জঘন্য হাসি।”

শৈবাল আরো একবার হেসে শুধালো,

“মানুষ যে জিনিসটা সবচাইতে বেশি অপছন্দ করে আমি তা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।”

তুহা আর উত্তর দেয় না। কথা বাড়ালেই বাড়বে। তাই নিজেকে শান্ত করে সে। গ্রামের পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায় তাদের গাড়ি৷ প্রকৃতির বাতাবরণে চারদিক স্বচ্ছ। সবুজে ঘেরা পল্লি ঘুরে দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিলো তুহার। ছোট ছোট পুকুর, উচু নিচু গাছ, মানুষের পল্লিজীবন সবটাই ছবিতে আঁকা। তুহা মুগ্ধ নয়নে বাহিরে তাকায়। এই দুইদিনে শৈবালের জন্য বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি সে। ছেলেটা তাকে এক মিনিটের জন্য ও বাহিরে যেতে দেয়নি।

পাশে বসা মেরুন রঙা শার্ট পড়া সুপুরুষ টাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রাণপন চেষ্টা চালায়। কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে তার দিকে। মানুষটার দিকে আড়চোখে তাকায় তুহা। মনে মনে ভাবে,

“পৃথিবীর সবচাইতে খারাপ সুদর্শন পুরুষটি তার স্বামী। এও বুঝি কোনো একদিন হওয়ার ছিলো?”

এইত আর মাত্র কিছুদিন। তারপর এই খারাপ সুদর্শন পুরুষ, তাঁর বিরক্তিকর সঙ্গ সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে সে। তখন বারবার বিরক্ত হবে না তার কথা শুনে। দিন গুলো মন্দ হবে নাকি ভালো হবে? তুহার জন্য সুখকর হবে তো?
.
ভার্সিটির এক কোণে বসে আছে ইফা, ইকরা, রাতুল আর হিমেল। তাদের মাঝে সবচাইতে প্রিয় দুইজন বন্ধু অনুপস্থিত আছে। তুহা নিজের বৈবাহিক জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আর শান্ত তুহাকে হারিয়ে একাকিত্ব জীবন কাঁটাতে ব্যস্ত। ইকরা নিচের দিকে তাকিয়ে ঘাস উঠাতে উঠাতে আওড়ায়,

“শান্ত ভার্সিটিতে আসবে না?”

রাতুল মোবাইল বের করতে করতে বলে,
“আমাকে বলেছিলো তো আসবে। কিন্তু এখনো আসেনি কেনো কে জানে।”

ইফা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আওড়ালো,

“তুহার বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হলেও বিয়ের পর তার সাথে অনেক অন্যায় হয়েছে। সে চুপচাপ এসব মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে না। কিন্তু তুহা ভার্সিটিতে কেনো আসে না?”

“সে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর সাথে হানিমুনে গিয়েছে!”

কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এসে হিমেলের পাশে বসে শান্ত। তাঁর উপস্থিতি তে সবার বুকের ওপর থেকে ভারি পাথর নেমে যায় যেনো। কিন্তু শান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় ইফার। ছেলেটা এই কয়েকদিনে নিজের কি অবস্থা করেছে। আগের থেকে শুকিয়ে গিয়েছে। ঠোঁট কালচে রঙ ধারণ করেছে। দেখেই বুঝা যায় এই কয়টা দিন তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিলো সিগারেট।

ইকরা প্রতিত্তর করে শান্তর কথার,

“তুই কিভাবে জেনেছিস? তোর সাথে যোগাযোগ হয়েছে তুহার?”

“না, ওর খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পরে শুনেছি।”

কথা বলতে বলতে সিগারেট ধরায় শান্ত। ইকরা ইফা হাজারবার নিষেধ করলেও শুনেনা। সবার মাঝে নিরবতা বিরাজ করে কিছুক্ষণ। একটু পর শান্ত নিজে নিরবতা ভেঙে বুকের বা পাশে হাত রেখে শুধালো,

“বুকের এই খানটায় ব্যথা করে। সহ্য করতে পারিনা ইচ্ছা করে ম*রে যাই!”

কথা শেষ হতেই বুকের বা পাশে জ্বালিয়ে রাখা সিগারেট চেপে ধরে। ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় চারজনে। ইফা তড়িঘড়ি করে হাত সরিয়ে দেয় শান্তর। সিগারেট চেপে ধরা জায়গাটার শার্ট পুড়ে বুক লাল হয়ে যায়। ইফা শার্ট খুলে ফেলে। সহ্য করতে না পেরে এক সময় ফুপিয়ে কেঁদে উঠে ইফা ইকরা দুইজনে। হিমেল উঠে বরফ এনে দেয়। নিরব থাকে কেবল এতো কিছু ঘটানো পুরুষটা। রাতুল ইচ্ছা মতো বকাবকি করে শান্তকে। চার বন্ধুরই অভিমান হয় তুহার ওপর।
.
তুহার যখন ঘুম ভাঙে তখন নিজেকে শৈবালের কামরায় আবিষ্কার করে। গাড়িতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে একদম টের পায়নি। এখন নিজেকে রুমে দেখে সামান্য অবাক হয়। কে এনেছে তাকে? শৈবাল শাহরিয়ার? এই দেমাকি পুরুষ তাকে কামরায় নিয়ে এসেছে?

আড়মোড়া ভেঙে সামনে তাকাতে চোখে পড়ে শৈবালকে। ছেলেটা সোফার এক কোণে বসে ল্যাপটপে কোনো একটা কাজে ব্যস্ত। তার দিকে খেয়াল নেই। তুহা মাথার নিচে এক হাত রেখে পূর্ণ দৃষ্টিতে শৈবালের দিকে তাকায়। ডাক্তার প্রফেশনটা তার বরাবরই পছন্দের ছিলো। নিজে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েও টিকেনি। যখন শুনেছে তার স্বামী ডাক্তার তখন খুশি হয়েছিলো। অথচ তার ডাক্তার স্বামীর রূপ দেখে সে প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়েছে। শৈবালের প্রথমদিনের আচরণ আজো ভুলেনি সে। তার সাথে হওয়া ছোট বড় সকল অন্যায়ের শা*স্তি সে শৈবাল কে দিবে৷

কানের ওপর গরম নিশ্বাস পড়তেই চমকে উঠে তুহা। পেছনে ফিরে তাকানোরও সুযোগ পায়না। তার আগেই শৈবাল তাঁকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দুই হাত আঁটকে দেয়। আপন ভাবনায় মত্ত থাকায় শৈবাল কখন উঠে এসেছে খেয়াল করেনি। তুহা কঠোর ভাবে শুধালো,

“ছাড়ুন আমাকে৷ বারবার একই কাজ করতে লজ্জা করেনা আপনার?”

শৈবাল তুহার কানের কাছে আস্তে কামড় দেয়, শিউরে উঠে মেয়েটা। ছেলেটা আস্তো একটা ফাজিল। তাকে পুনরায় প্রশ্ন করে,

“কোন কাজের কথা বলছো তুমি?”

“নিজেকে প্রশ্ন করেন, এখন পর্যন্ত যতোবার আমাকে স্পর্শ করেছেন একবারো কি আমার অনুমতি নিয়েছেন?”

“অনুমতি নেওয়ার জন্য যেদিন তুমি থাকবেনা সেদিন নিতে আসবো।”

তুহা তাচ্ছিল্য হেসে উত্তর দেয়,

“অনুমতি নিতে হলে খুঁজে পেতে হবে। আপনি আমাকে কখনো খুঁজে পাবেন?”

“খুঁজে পাবো কি না সেটা জিজ্ঞেস না করে এটা জিজ্ঞেস করো আমি তোমাকে খুঁজবো কি না!”

উত্তর দেয় না তুহা। তাকে উত্তর দিতে না দেখে রেগে যায় শৈবাল। কামড় বসায় তুহার গালে, বুকে। মেজাজ খারাপ হয় তুহার। জোর করে শৈবালের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আওড়ায়,

“আপনি সব কিছুর উর্ধ্বে চলে গিয়েছেন শৈবাল শাহরিয়ার। আপনার মাঝে যদি মিনিমাম লজ্জাটুকু থাকে তাহলে আমাকে আর কখনো স্পর্শ করবেন না। আপনার একেকটা স্পর্শে আমার বমি আসে। নিজেকে আবর্জনা মনে হয়। আপনি ভালো মানুষ আপনার সাথে আমার যায় না। তাই দয়া করে আমাকে একটু মু*ক্তি দেন প্লিজ। আপনি অ*সহ্যকর একজন পুরুষ। যার নিজের প্রতি মায়া, ভালোবাসা নেই। যাকে বিয়ে করেছে তার প্রতিও কোনো মায়া কাজ করেনা। সাধারণ ভাষায় আপনার মতো পুরুষদের যা বলে তা মুখে আনতে চাইছি না!”

কথা গুলো বলে রুম থেকে বের হয়ে যায় তুহা। শৈবাল থম মেরে বসে আছে। তুহার কথা গুলো তার মাঝে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। মূলত তুহাকে জ্বালানোর জন্য অনেক সময় তাকে কাছে টেনে নেয় সে। তুহার রাগত স্বরে প্রতিবাদ করা, মুখের সামনে আঙুল নাচিয়ে কথা বলা দারুণ লাগে তার কাছে।

কিন্তু তুহা এমন ব্যবহার করবে কস্মিনকালেও ভাবেনি সে। নিজেকে নিজের কাছেই মা*রাত্মক খারাপ মনে হচ্ছে। সে খারাপ, নিজের প্রতি মায়া নেই এই কথাগুলো সে জানে। আজ তুহা বলায় আরো ভালো ভাবে অনুধাবন করে। মনে মনে আওড়ায়,

“আমার খারাপ হওয়ার পেছনের কারণটা খতিয়ে দেখে আমাকে খারাপ বলো মিসেস। আমার আফসোস থাকবেনা। সমুদ্র কে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে আমাকে খারাপ বলো আমি তোমাকে কিছু বলবো না। কিন্তু এভাবে তো তুমি আমাকে খারাপ বলতে পারো না জান। আমার প্রতিটা খারাপ কাজের প্রত্যক্ষদর্শী তোমাকে বানানোর জন্য হলেও তোমাকে আমার জীবনে থাকতে হবে সারাজীবন। এক চুল পরিমানও ছাড় দিতে রাজি নই আমি!”

চলবে,,,,,,,,,