নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-১০

0
30

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ১০
#জান্নাতুল_বিথী

তুহা বাবার বাড়িতে আছে আজ চারদিন। শৈবালের সাথে সেদিন রাগারাগি করে এবাড়িতে চলে এসেছে। মূল কারণ রাগারাগি দেখালেও সে এসেছে নিজের কাজে। জাপানে যাওয়ার বিষয়টা ভালো ভাবে গুছিয়ে নিয়েছে এই চার দিনে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিজের মতো থেকেছে, ওই বাড়িতে যোগাযোগ রেখেছে। মামনিকে বলেছে বাবার কথা মনে পড়ে, তাকে দেখতে চায়। শৈবালের ব্যাপারটা জানায়নি। এই চারদিনে তার সাথে এক সেকেন্ডের জন্যও কথা হয়নি।

তুহা একটা কালো জামদানী শাড়ি পরে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। এখানকার কাজ শেষ। ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। নিজেকে সাজানোর কারণ হলো শৈবালকে দেখানো উচিত সে দিব্যি ভালো আছে। সুখে আছে৷

তুহাকে নেওয়ার জন্য প্রিয় এসেছে। দু’জনে গল্প গুজব করে ঘন্টা খানেক পরে বাড়ি আসে। আসার সময় মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করতে ভুলে না। তুহা যখন এখানে আসে তখন প্রায় সন্ধ্যা। নামাজ পড়ে চা বসায় নিজেই। আজকে বাড়িতে শৈবালের পিতা আতিফ খন্দকার (আগে নাম দিয়েছি কি না সঠিক মনে নেই। দিয়ে থাকলে আগের নামটা কমেন্ট করবেন) আছে। বিয়ের পর আজকেই প্রথম মামাকে দেখেছে তুহা। এতোদিন তিনি বিদেশের মাটিতে ছিলেন ব্যবসায়ের কাজে।

তুহা চা এনে আতিফ খন্দকারের হাতে দিলে মুচকি হাসে ভদ্রলোক। প্রিয়র সাথে গল্পে মত্ত থাকায় তুহার দিকে খেয়াল করা হয়নি। এখন দেখে কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে,

“বসো তুহা। তোমার সাথে মামার তো কথাই হয়নি। পর করে দিয়েছো নাকি মামাকে?”

প্রতিত্তরে মুচকি হাসে তুহা। আতিফ খন্দকারের পাশের আসনে বসতে বসতে শুধালো,

“পর হতে দিলেন কই? ভালো মন্দ বিচার না করেই তো আরো আপন করে নিয়েছেন!”

তুহার কথার ধরনে মুগ্ধ হয় ভদ্রলোক। তাদের ছোট্ট তুহা কতো বড় হয়ে গিয়েছে। এখন গুছিয়ে কথা বলতে জানে। যদিও কথাটা সামান্য খোঁ*চা দিয়ে বলেছে তাও তিনি গায়ে মাখেননি। কারণ ইতোমধ্যেই ভদ্রলোক নিজের ছেলের কর্মকান্ড সম্পর্কে সামান্য হলেও অবগত। তুহার কথার জবাবটা দেয় খানিক বাদেই,

“ভালো মন্দের বিচার করতে গেলে পৃথিবীর ৯০% কাজ বাকি থাকবে মা। জগতে যেমন খারাপ আছে তেমন ভালোও আছে। ভালোর সংস্পর্শে এসে কিন্তু খারাপের ভিত নড়বড়ে হয়!”

জবাব দেয় না তুহা। বরং দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাদের সবার কথার সারমর্ম ইতোমধ্যে তার জানা। কিন্তু তাদের ই*তর ছেলে যে ভালো হবার নই এটা কিভাবে বুঝাবে তাদের?

শৈবালের কথা মনে আসতেই আনমনে আসে পাশে তাকায় তুহা। মনের অজান্তেই চোখ বিচরণ করে চারদিকে। কিন্তু কোথাও বহু কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে দেখতে পায় না। তুহার চনমনে দৃষ্টি নজরে আসে প্রিয়র। চঞ্চল চিত্তে জবাব দেয়,

“তোমার বহু আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালে রোগী দেখতে গিয়েছে। নিজেকে রোগী বানিয়ে আরেক রোগীর সেবা করা যাকে বলে।”

প্রিয়র কথায় চমকে উঠে তুহা। মিনিটের মাঝে নিজেকে সামলে নেয়। যেন প্রিয়র কথা তাঁর মাঝে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। প্রিয়র দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ কিছুটা ধমকের স্বরে বলে,

“কার কথা বলেছো? যদি তোমার ভাইয়ের কথা বলে থাকো তাহলে বলবো, সে কোথায় আছে কেমন আছে এসব ব্যাপারে জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। তুমি আমাকে এসব বলছো কেনো আজব।”

থমকে যায় প্রিয়। তুহার কাছ থেকে এতো কড়া কথা হজম করতে বেগ পোহাতে হয় তাকে। মেয়েটা তাকে যথেষ্ট স্নেহ করে। যেখানে আদুরে স্বরে কথা বলে সেখানে হঠাৎ এতো কড়া কথা নিতে পারে না সে। তুহার পেছনে অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় শৈবালকে। চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে৷ তুহার কথা হয়তো শুনে নিয়েছে। কয়েক কদম এগিয়ে এসে আওড়ায়,

“দিন দিন বে*য়াদব হয়ে যাচ্ছো তুমি। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় শিক্ষা দেয়নি তোমার পরিবার?”

আকস্মিক শৈবালের কথা শুনে পিলে চমকে উঠে তুহা। পরিবার নিয়ে কথা বলায় রেগে যায় বেশ। কিন্তু যুতসই উত্তর না পেয়ে তিরতির করে কাঁপতে থাকে তার শরীর। অবস্থা বেগতিক দেখে সেখান থেকে সরে যায় প্রিয়। শৈবাল সেখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে নিজের কামরায় চলে যায়। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হয়।

তুহার নিজেকে সামলাতে মিনিট খানেক লাগে। তবে কাঁদে না সে। এতোদিন পরে এসে শৈবালের আক্রমনাত্মক কথার বানে এতো দ্রুত পড়তে হবে বুঝেনি সে।
.
রাতে খাওয়ার সময় সবাইকে টেবিলে দেখা যায়। এর মাঝে তুহা আর রুমে যায়নি। যার ফলে শৈবালের সাথেও আর দেখা হয়নি। শৈবাল নিচে এসে চেয়ার টেনে বসে। তার এক পাশে আতিফ খন্দকার, অন্য পাশের চেয়ারটা অবহেলায় পড়ে আছে। অপজিট পাশে প্রিয় বসা। তুহা আর আফসানা বেগম সব কিছু এগিয়ে দেয়। এক সময় বিরক্ত হয়ে শৈবাল বলে,

“মম আমাদের কিছু লাগলে নিয়ে খেতে পারবো। তুমি খেতে বসো!”

আড়চোখে এক নজর তুহাকে পরখ করে কথাটা শুধালো শৈবাল। তুহার এসবে ধ্যান নেই। মেয়েটা প্রিয়র প্লেটে খাসির মাংস তুলে দিতে ব্যস্ত। আফসানা বেগম তার হাত টেনে ধরে শৈবালের পাশে বসিয়ে দিতে গেলে তুহা বলে,

“আমি এখানে বসবো না, তুমি বোসো আমি পরে খাবো।”

আতিফ খন্দকার হয়তো তুহার মনোভাব বুঝতে পারে। তাই তো তুহাকে বলল,

“তুমি বাবার পাশে এসে বোসো। কতোদিন হলো মেয়ের পাশে বসে খাই না।”

আতিফ খন্দকারের কথায় খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে তুহা। যেখানে তাদের ছেলেকেই মেনে নিতে পারেনি সেখানে উনাদের বাবা বা মা ডাকতে পারেনা। এখনো অবধি আগের সম্মোধনেই আছে। তারপরো আর বাক্য ব্যয় না করে তুহা তার পাশে বসে।

শৈবালের চোয়াল ক্রমশ শক্ত হয়ে আসে। তুহা যে খুব সূক্ষ্ম ভাবে তার পাশে বসাকে এড়িয়ে গিয়েছে তা ঢের বুঝতে পেরেছে সে। থম মেরে বসে থাকে, মুখে খাবার নিয়ে৷ তার সারা জীবনে এই মেয়েটার নিকট সে যতোটা অপমানিত হয়ে আর কেউ তা করতে সাহস পায়নি।

পেটে খাবার পড়ে না শৈবালের। একে তো জ্বরের শরীর, মুখ তেতো হয়ে আছে। কোনো খাবারই ভালো লাগছে না। তার উপর তুহার নিরবে করা অপমান। দুইটাই সহ্য সীমার বাহিরে। শৈবাল নিরবে প্রস্থান করে সেথা হতে।

বাহিরে বজ্রপাত হচ্ছে। বর্ষণের আগাম সংকেত। বৃষ্টি আসার পূর্বে প্রকৃতির কি নিদারুণ অপূর্ব দৃশ্য। কখনো এতোটা মনোযোগ সহকারে প্রকৃতি দেখা হয়নি শৈবালের। আজ দেখতে গিয়ে অনুভব করে, মন্দ লাগছে না। কথায় আছে ব্যক্তি নিজেকে ভালোবাসলে আসেপাশের সব কিছুকে ভালোবাসতে জানে সে। তবে কি শৈবাল নিজকে ভালোবাসতে শুরু করেছে?

ঝুম বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শৈবাল। হাতের সিগারেট টা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির লীলাখেলা অনুভব করে সে। শরীরের জ্বর, ব্যথা কিছু মাথায় নেই।

মেয়েলি কণ্ঠস্বরে হঠাৎ চমকে উঠে সে। পেছনে তাকিয়ে দেখে তুহা দাঁড়িয়ে। কালো জামদানীতে অপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে। এতক্ষণে ভালো করে লক্ষ্য করেছে তাকে। এলোমেলো চুল গুলো ক্লিপ দ্বারা আঁটকে রাখা। ছোট বড় কিছু চুল বাতাসে উড়ে বেড়ায়। মুখে হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়া। ঘোর লেগে যায় শৈবালের। এগিয়ে যায় তুহার দিকে। এগিয়ে যেতে নিলে তার মনে পড়ে তুহার বলা সেই হৃদয়বিদারক কথা গুলো। দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে। চাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। সে এগিয়ে যেতেই বললো,

“আপনাকে মামনি ডাকছে।”

জ্বরের তাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে তার শরীরে। এদিকে আবার তুহার আগুন ঝরানো রূপ। কোনোটাই সামলাতে না পেরে মুখ ফসকে বলে ফেলে,

“মম ডাকছে তুমি ডাকোনি?”

“আমি ডাকার কথা? কেনো ডাকবো?”

“ভালোবেসে!”

শৈবালের কথায় মুচকি হাসে তুহা। আরো একবার মুগ্ধ হয় শৈবাল। তুহার মুখ থেকে বের হয় আরো একটা হৃদয় নিংড়ে দেওয়ার মতো কথা,

“আমি মোমবাতি নই মিস্টার শৈবাল শাহরিয়ার, মোমবাতিরা নিজেকে পুড়িয়ে অন্যকে আলোকিত করে। আর আমি অন্যকে জ্বালিয়ে নিজেকে আলোকিত করি। সবাই ধরে নিয়েছে আপনার জীবনের মোমবাতি আমি। কিন্তু আপনার ধরে নেওয়া উচিত আমার জীবনে মোমবাতি আপনি। আপনাকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে আমি আলো নিবো। আপনি আমাকে স্বা*র্থপর হতে বাধ্য করেছেন।”

চলবে,,,,,,,,,