নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-১৩

0
31

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ১৩
#জান্নাতুল_বিথী

জাপান, পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। যা প্রশান্ত মহাসাগরের এক প্রান্তে ৬৮৫২ টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ইংরেজিতে এদেশকে ল্যান্ড অফ রাইজিং সান বলা হয়, যার অর্থ সূর্যোদ্বয়ের দেশ। এতো সুন্দর একটি দেশে এসেও রমণীর মাঝে কোনো সুখ নেই। জানালার এক কোণে হেলান দিয়ে বসে আছে রমণী। হাতে একটা ইংরেজি উপন্যাসের বই। কিন্তু বইয়ের দিকে তার নজর নেই। দৃষ্টিতে তার উদাসীনতা। মনে মনে কি ভাবছে সেই সম্পর্কে কেবল ওই রমণীই অবগত।

“এ্যাই তুহা তোকে মাম্মাম ডাকছে, খাবি না?”

দিশারার কথায় পিলে চমকে উঠে তুহা। ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে। দিশারার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকায়। মেয়েটা তুহার তাকানো দেখে মুখ কাচুমাচু করে বলে,

“আমার কি দোষ, তোকে ডাকছে তা বলবো না আমি?”

“ডাকবি না, আমি খাবো না এখন। কিছু খেতে পারিনা!”

“এই অবস্থায় খাওয়া দাওয়ার ঠিক মতো না করলে সেটা তোদের দুজনের জন্যই সমস্যার। অন্তত বেবির কথাটা মাথায় রাখ। খাবি আয়।”

কথা শেষ করে চলে যায় দিশারা। তুহা ছলছল চোখে পেটে হাত বুলায়। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। সেদিন ওই বাড়ি থেকে এসে ইকরার বাসায় উঠে তুহা। কোনো একটা ভয়ে নিজের বাড়িতে যায় না। সেখানে দুইদিন থেকে বাবার সাথে দেখা করে ওখান থেকেই পাড়ি জমায় স্বপ্নের দেশে। স্বপ্নের দেশ বললে ভুল হবে। নিজেকে লুকাতে এদেশে পাড়ি জমায় তুহা। জাপানের ওসাকা শহরে তার ফুপি থাকে। ভাইয়ের আদরের মেয়েকে তিনিই আঁকড়ে নেয়। শেফালি বেগমের একমাত্র মেয়ে দিশারি। তুহার বয়সি, জাপানে জন্ম এখানেই বেড়ে ওঠা৷ তুহাকে সঙ্গ দিতে সারাক্ষণ লেপ্টে থাকে তাঁর সাথে। বিরক্ত হয় না তুহাও। দুজনে একসাথে ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।

এখানে এসে আরো একটা সত্যের মুখোমুখি হয় সে। শৈবালের অংশ নিজের মাঝে বেড়ে উঠতে শুনে সেদিন মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদে। ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে এসে তার অংশকে নিজের মাঝে ধারণ করে। তাঁর অংশ নিয়েই তুহার বাকি পথ চলা। এখানে আসার পর শেফালি বেগম যত্নের ত্রুটি রাখে না একমাত্র ভাইয়ের মেয়ের। কোনো অভাব বুঝতে দেয় না। শৈবালের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা কিছু জানে না। তুহা এখানে পড়ালেখা করতে এসেছে এইটুকুই জানে। এখানে আসার পর তুহা যে জিনিসটা বুঝতে পেরেছে তা হলো শৈবাল নামক সুপুরুষ ছাড়া তাঁর প্রতিটা প্রহর কাঁটে নিরবে নিভৃতে। লুকিয়ে কাঁদে মনের পুরুষের জন্য। মনে মনে আকাশ সমান অভিমান এঁটে রাখে মন সায়রে।
.
কেবিনে নিজ আসরে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে আছে শৈবাল। ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে বুঝার উপায় নাই। ক্লান্ত শ্রান্ত মুখবিবর দেখলে পাষাণের মনটাও গলতে শুরু করবে। দিন রাত এক করে কাজে ব্যস্ত রাখে নিজেকে। কেনো ব্যস্ত রাখে, কেনো নিজেকে কষ্ট দেয় উত্তর নাই তার নিকট। শুধু জানে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে পারলে একটুখানি শান্তি পেতো। হঠাৎ দরজায় নক করে কেউ একজন। কিন্তু সেদিকে ধ্যান নাই শৈবালের। অনেকক্ষণ নক করার পর শেষে বিরক্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ে শৈবালের এসিস্ট্যান্ট রাব্বি।

“স্যার বাহিরে রোগী অপেক্ষা করছে। আমি কি আসতে বলবো তাঁদের?”

রাব্বির কথায় ধ্যান ভাঙে শৈবালের। আপন ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় রেগে যায় সে।

“আমি তোমাকে অনুমতি দিয়েছি ভেতরে আসার? দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো তুমি!”

মুখটা ছোট হয়ে যায় রাব্বির। এতক্ষণ দিন দুনিয়া ভুলে নক করছে কই সেটা তো ভাবলো না। তাঁর স্যার কেমন জানি হয়ে গিয়েছে। আগে রাগী ছিলো বটে কিন্তু এখন বেশ কয়েকমাস ধরে লক্ষ করছে ছেলেটা অকারণে রেগে যায়। যাকে তাঁকে কথা শোনায়। অথচ আগে সে এমন ছিলো না। শৈবালকে রেগে যেতে দেখে রাব্বি কাঁদো কাঁদো হয়ে শুধালো,

“আগামী কালকে তো আপনি চট্টগ্রাম যাবেন। আজকে সিরিয়াল শেষ করলে ভালো হোতো তাই বললাম আর কি!”

শৈবাল খানিকটা আনমনা হয়। সমুদ্রের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। একদিকে মনে শান্তি নাই অন্য দিকে বন্ধু সুস্থ না হয়ে দিন দিন অসুস্থ হয়। সব মিলিয়ে শৈবালের দিন গুলো অসহ্য ভাবে কাঁটছে। কোথাও যেনো শূন্যতা জেঁকে ধরেছে তাঁকে। যে মেয়েটা তাঁকে ছেড়ে যাবে ভেবে আগে থেকেই মনকে প্রস্তুত করেছে সেই নারী চলে যাওয়ার পর থেকেই অশান্তিতে ভুগছে সে। তবে কেনো এমন হচ্ছে? কেনো বারবার মনে হচ্ছে সে তাঁর জীবনের অনেক বড় কিছু হারিয়ে ফেলেছে।

হ্যাঁ হারিয়েই তো ফেলেছে। নিজের বউকে হারিয়ে ফেলেছে। প্রথমে ভেবেছিলো তুহা ছেড়ে গিয়েছে তো কি হয়েছে। তাকে ছাড়া সে দিব্যি থাকতে পারবে৷ কিন্তু দিন দিন মেয়েটা তাঁকে ভুল প্রমাণিত করছে। মেয়েটাকে যেমন ভেবেছিলো আধো সে তেমন নয়। দিনকে দিন অপরাধ ভোগে ভুগছে সে। দেশের এমন কোনো প্রান্ত বাদ নেই যেখানে সে খুঁজে নি। তুহার বাবার কাছে বারবার গিয়েও খালি হাতে ফিরেছে। তুহার বন্ধুরা কেউ কিছু জানে না। চারদিকের অবস্থা দেখে দিশেহারা শৈবাল!
.
ঘন্টা দুয়েক ধরে শাওয়ার নেয় শৈবাল। মনকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় ছেলেটা। পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুজন কপোত কপোতী গুমরে মরে যাচ্ছে। অথচ কেউ কারো কাছে হার মানতে রাজি না।
আফসানা বেগম ছেলের রুমে ঢুকে দেখে শৈবাল দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ দুইটা র*ক্ত জবার ন্যায় লাল হয়ে আছে। আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদে ভদ্রমহিলা। ছেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আওড়ায়,

“তোর আঙ্কেলের কাছে গিয়ে ভালো করে জিজ্ঞেস কর শৈবাল। আমি জানি ভাইজান জানে তুহা কোথায় আছে। নিজেকে এভাবে কষ্ট দিস না। জ্বরে সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে তোর। এভাবে তো সব সমাধান হয় না। নিজে যখন অপরাধ করেছিস তাহলে নিজেই খুঁজে নে। তুহার কাছে আরেকটা সুযোগ চেয়ে দেখ!”

শৈবাল উদাস স্বরে বলে,

“ক্ষমা চাওয়ার জন্য মানুষ টাকে খুঁজে পেতে হবে তো মম। তাঁকে খুঁজে এনে দাও। আমি তোমার কাছে আর কিছু চাইনা। তুমি তো জানো তোমার ছেলে কখনো কিছু চায়নি তোমাদের কাছে। এখন একথাটা রাখো প্লিজ। আমি তাঁকে ছাড়া ভালো নেই মম। তাঁর শাস্তি দেওয়া শেষ হবে কখন? আমি যে মরে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচতে সাহায্য করো। ও মম!”

আফসানা বেগম ছেলের আহাজারিতে নিরবে কাঁদে। ছেলেকে বুঝায় আরো একবার নুরুল পাটোয়ারীর কাছে যাওয়ার জন্য।
.
শৈবাল যখন তুহাদের বাড়ি পৌঁছায় তখন রাত দেড়টা বাজে। শরীরের তাপে ঠিক মতো দাঁড়াতেও পারেনা ছেলেটা। হেলে দুলে হেঁটে কোনো রকমে কলিংবেল চাপে। নুরুল পাটোয়ারী জেগেই ছিলো। মেয়ের সাথে বসে ফোনালাপে ব্যস্ত ছিলো। ফোন কেঁটে উঠে এসে দরজা খোলে। এতো রাতে শৈবালকে এখানে দেখে অবাক হয়না তিনি। প্রায়শই ছেলেটা এসে তুহার ব্যাপারে জানতে চায়। কিন্তু মেয়ের কড়া নিষেধাজ্ঞার কাছে হার মেনে কিছু বলতে পারে না তিনি। এখন ছেলেটাকে দেখে তাঁর মায়া হয়। তারপরো নিজেকে কঠোর রেখে শৈবালকে ভেতরে আসতে বলে। শৈবাল সেদিকে খেয়াল না করে নুরুল পাটোয়ারীর চোখের দিকে তাকিয়ে আওড়ায়,

“তুহা কোথায় আছে আঙ্কেল?”

“আমাকে কিছু বলে যায়নি।”

“আপনি আপনার মেয়ের সম্পর্কে জানেন না কথাটা শুনে যে কেউ হাসবে।”

“আমি যেহেতু কিছু জানিনা। তাই আমাকে বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করে লাভ নেই তোমার।”

শরীরের ভার ছেড়ে দেয় শৈবাল। নুরুল পাটোয়ারীর পায়ের কাছে বসে দুই হাতে তাঁর পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।

“তোমরা বাবা মেয়ে আমাকে এ কোন শাস্তি দিচ্ছো আঙ্কেল? আমি সহ্য করতে পারছি না আর। তোমার মেয়েকে এনে দাও নাহলে আমি মরে যাবো। বলো না তুহা কোথায় আছে? আমি দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমাকে বলো আমার তুহা কোথায় আছে। ও আঙ্কেল বলো না!”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,