#নীড়ের_খোঁজে [০২]
পর্বঃ১৭
#জান্নাতুল_বিথী
বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে বসে আছে শৈবাল৷ জিহ্বার কোণে যুতসই জবাব পায় না ছেলেটা৷ পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুর মেয়েটা হয়তো তাঁর সামনে বসে আছে। সে নাহয় ভুল করেছে, তুহাকে অবহেলা করেছে। কিন্তু তুহা? তাঁর কি কোনো দোষ ছিলো না? প্রথম থেকেই সে তুহার সাথে যা করেছে তাঁর দ্বিগুণ তাঁকে ফেরত দিয়েছে মেয়েটা৷ আজ এসে তাঁর উপর সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে? তুহা কি একটিবারও তাঁকে বুঝতে চেয়েছে? একটিবারের জন্য ও তো তাঁকে প্রশ্ন করেনি শৈবাল কি চায়। সব সময় নিজের জেদ, নিজের মর্জিতে চলে এসেছে। না জেনে না বুঝে কেবল দূরত্ব বাড়াতে চাইছে। শৈবালের ভেতরটা তেঁতো হয়ে উঠে। বিষাদ ভরা নয়নে তুহাকে বলল,
“আমি নাহয় ভুল করেছিলাম মিসেস। কিন্তু একটিবারের জন্যও কি তুমি আমার ভুল শুধরে দিতে এগিয়ে এসেছে? আমার পাশে বসে ভালোবেসে জানতে চেয়েছো কখনো কি হয়েছে আমার? সব দোষ দিন শেষে আমাদের ছেলেদের ঘাড়ে কেনো আসে মিসেস?
তুহা কিছুটা রাগ মিশ্রিত স্বরে জবাব দেয়,
“আপনারা ছেলেরা অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকবেন। এক সময় বিয়ে করবেন। তখন এসে বউয়ের উপর অতীতের শোধ তুলবেন। কানের কাছে সব মেয়েরা এক রকম বলে বলে জপ করবেন। কেনো? আমাদের মেয়েদের কি কোনো সম্মান নেই?”
শৈবাল হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো বলল,
“উভয়ই যদি ইগোওয়ালা হয় তাহলে সংসার কিভাবে টিকবে? এখানে সম্মানের কথা কেনো আসছে তুহা? ভুলটা আমার ছিলো আমি নিজের ভুল স্বীকার করেছি। ছোট বেলা থেকে বেশিরভাগ মেয়েলি কেস গুলোতেই দেখি মেয়েরা নিজের স্বামীর থেকেও একটু ভালো অপশন যদি পায় তাহলে স্বামী, সন্তান ফেলে চলে যায়। ব্যাপারটা আমার সামনে বেশ কয়েকবার ঘটার কারণে আমার চারদিকে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়। আমি ওইসব ট্রমা থেকে নিজেকে বের করতে পারিনি। যখন নিজেকে সুযোগ দিবো ভেবেছিলাম ঠিক তখনি আরেকটা অঘটন ঘটে। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা পাগল প্রায় ছিলো। তার মাঝে আবার তোমার সাথে হঠাৎ বিয়ে। আমি তোমাকে কখনো কোনো কিছুতে জোর করবো না। হয়তো এখনকার মতো সব সময় তোমার কাছে আসা হবে না। তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো। আমি তোমাকে বাঁধা দিবো না। শুধু এটুকু বলবো আমার সন্তানের থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখো না। আমি চলে যাবো! শুধু কষ্ট একটাই যাকে আমি ভালোবেসেছি সে আমাকে বুঝেনি। না বুঝে দূরে ঠেলে দিয়েছে!”
শেষের কথা গুলো জড়িয়ে আসে, ভেজা কণ্ঠস্বর। তুহা থম মেরে বসে আছে। মাথায় ঘুরপাক খায় শৈবালের সব কথা। সে কি একটু বেশি বেশিই করে ফেলেছে? শৈবাল কথা শেষ করে চোখের পানি লুকাতে ব্যস্ত হয়৷ উঠে যাওয়ার আগে তুহার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলল,
“ভালো থেকো, আমার উপরের রাগ আমার সন্তানের উপর না দেখানোর অনুরোধ রইলো। শৈবাল শাহরিয়ার তাঁর মিসেসকে অনেক ভালোবাসে।”
কথা শেষ করে উঠে যেতে নেয় শৈবাল। ধড়ফড়িয়ে উঠে তুহা। ছেলেটার কোমরের পাশের একাংশ টেনে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তুহাকে কাঁদতে দেখে হকচকিয়ে যায় শৈবাল। তাড়াতাড়ি আবার বসে পড়ে মেয়েটার পাশে। তাঁর মাথায় হাত রাখতেই গলা জড়িয়ে ধরে তুহা। বুকে মুখ লুকিয়ে ইচ্ছে মতো কাঁদে। শৈবাল নিজের বাহুডোরে আগলে নেয় অর্ধাঙ্গিনীকে। তুহা ব্যাকুল হয়ে কাঁদে। ফুপিয়ে কিছু একটা বলে। যদিও কথাটা শৈবাল অবধি পৌঁছায় না। পুনরায় জিজ্ঞেস না করে সময় দেয় তুহাকে। মেয়েটা নিজেকে সামলাতে বেশ বেগ পোহাতে হয়।
মিনিট বিশেক পরে শান্ত হয় তুহা। কিন্তু শৈবালকে ছেড়ে উঠেনা। দুই হাতে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে রাখে। তুহাকে শান্ত হতে দেখে শৈবাল ফিসফিস করে শুধালো,
“এভাবে কাঁদে না মিসেস। আমাকে যা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিবো। তারপরো তোমার চোখের জল নষ্ট কোরোনা।”
শৈবালের কথা তুহা শোনে কি না জানা নেই। মেয়েটা শৈবালের বুক থেকে মাথা তুলে তাঁর দিকে তাকায়। তারপর আবারো মুখ লুকায়। এক হাতে শৈবালের বুকের তিনটা বোতাম খুলে ফেলে। তাঁর সুপুরুষ হাজবেন্ডের বুকে এলোপাতাড়ি চুমু খায়। শৈবাল চোখ বন্ধ করে উন্মাদ তুহার প্রতিটা স্পর্শ অনুভব করে। রমণীর অবস্থা দেখে একদিকে ভালো লাগার আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। অন্যদিকে আবার হাসিও পায়। এই এক অন্য তুহাকে দেখছে সে।
তুহা কিছুটা শান্ত হয়ে লজ্জায় আবারো মুখ লুকায়। এ যাত্রায় হেসে ফেলে শৈবাল। তুহার চুলের ভাজে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
“কিছু লাগবে মিসেস?”
তুহা কিছুটা নড়েচড়ে মিনিট দুয়েক পরে জবাব দেয়,
“আপনাকে লাগবে, আপনি যাবেন না!”
“কেনো যাবো না?”
ফিসফিস করে আওড়ালো শৈবাল। তুহাকে জবাব দেয়ার সুযোগ না দিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলে,
“এখানে থেকে যেতে বলছো? তোমার ফুপি আমাকে ঘরজামাই রাখবে নাকি?”
“আপনার মতো পুরুষ থাকবে ঘরজামাই? এও বিশ্বাস যোগ্য?”
অবিশ্বাস্য নেত্র মেলে জবাব দেয় তুহা। শৈবাল হেসে তুহাকে তাঁর বুক থেকে সরিয়ে সোজা করে বসায়। তুহার গাল দু হাতের আঁজলে এঁটে বলল,
“তুমি কি আমার সাথে যাবে?”
তুহা ভেবে পায় না কি বলবে, মনের সাথে বিবেকের যুদ্ধ লাগে। একদিকে পড়ালেখা অন্যদিকে শৈবাল। নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়া লেখা করেছে সে। এখন ড্রপ দিবে? ভাবলেই তো কান্না পায়। তুহার মনের ভাবনা হয়তো বুঝতে পারে শৈবাল। মুখে ফু দিয়ে বলল,
“তোমার সব ধরণের সিদ্ধান্তে আমাকে পাশে পাবা। যদি এখানেই পড়ালেখা কন্টিনিউ করতে চাও তাও করতে পারো। আর যদি দেশে যেতে চাও তাহলেও আমি সবটা মেনেজ করে নিবো!”
“আমি এখন দেশে গেলে এক বছর ড্রপ দিতে হবে না? তাছাড়া এতো দ্রুত আপনিও বা যাবেন কিভাবে”
“আচ্ছা থাক, এদিকটা আমার উপর ছেড়ে দাও আমি সামলে নিবো।”
শৈবাল একটু থেমে আবারো বলল,
“শোনো মিসেস জীবন হলো অলিখিত বোঝাপড়া ?
মেনে নিলে ভালো নয়তো জীবন ছন্ন ছাড়া।”
“আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
“আমি তোমার মন রাখতে মিথ্যাটা বলবো না। সত্যি যেটা সেটা হলো তুমি সব কিছু না জেনে না বুঝে এখানে চলে এসে ভুল করছো। তোমার ঠাণ্ডা মাথায় আরেকটু ভাবা উচিত ছিলো।”
“বিয়ে প্রতিটা মেয়ের জীবনেই অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে। আমি সব সময় এই জিনিসটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি। এই বন্ধনের মাধ্যমে বাকি জীবন কাঁটে তাঁদের। সঠিক পুরুষ পেলে জীবন স্বার্থক। কিন্তু যার সাথে আমি বাকী জীবনটা কাটাবো সে যদি আমার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকায় বা আমাকে অবহেলা করে তখন আমার কাছে কিরকম লাগবে? আমি অবহেলাটা নিতে পারিনি!”
আহত হয় শৈবাল। সে কখনোই তুহাকে অবহেলা করেনি। যতোবার কাছে টেনে নিয়েছে ভালোবেসেই টেনেছে। নিজের ভালোবাসাটা অপ্রকাশিত রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু সবার তো আর ম্যাজিক্যাল পাওয়ার নাই যে সবটা জাদু দিয়ে বুঝে নিবে। ভালোবাসা সব সময় অপ্রকাশিত রাখতে নেই। এটা ভেবেই একটা চরম শিক্ষা পেয়েছে সে। শৈবাল তুহার কথার পিঠে জবাব দেয়,
“তুমি আমার রয়ে যাও, আমি রেখে দিবো। আগে পরে কি হয়েছে সব ভুলে যাও। যেদিন আমার আর ইচ্ছে করবে না তোমাকে ভালোবাসার সেদিন বুঝে নিও আমি হয়তো এই পৃথিবীতে আর নেই!”
চলবে,,,,,,,,