নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-২০+২১

0
59

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-২০]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

[প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত]
“রাত দুটো বাজে, ঘুমাতে না গিয়ে তুমি আমার সাথে ঝগড়া করতে বসেছো?”(কঠোর কণ্ঠস্বরে)

কৌশিক চৌধুরী রাগের সহিত বলে উঠলেন। ইলা তারচেয়েও দ্বিগুন রেগে বলে উঠলো,,

“তুমি এটাকে ঝগড়া ভাবলে ঝগড়াই। তুমি কেনো আদিতকে বলেছিলে আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? তোমার জন্য আদিত আজকে আমাকে ভালোবেসেও স্বীকার করছেননা যে উনি আমাকে ভালোবাসেন।”(দ্বিগুন রাগী স্বরে)

কৌশিক চৌধুরী মেয়ের রাগান্নিত কণ্ঠস্বরের বাক্য বচন শুনে আরো রাগন্নিত হলেন। রাগান্নিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন,,

“একটা বেকার, জেল যাওয়া ছেলেকে তখন তুমি ভালোবাসতে। শুনো আবেগ দিয়ে পৃথিবী চলেনা, আবেগ থেকে বেরিয়ে আসো। এবার শুধু অনার্স ফাইনাল ইয়ারটা তোমার শেষ হোক, তোমাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বো।”(রাগান্নিত স্বরে)

“তুমি তোমার কথা বলেছো আমি শুনেছি, এখন তুমি আমার কথা শুনো। আদিত ওনাকে ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করবোনা আমার সোজা উক্তি। একে তো আমার সাথে, আদিত ওনার সাথে অন্যায় করেছো তার উপর অন্য মানুষের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার কথা বলছো। তুমি যদি তোমার কথায় অটল থাকো তাহলে তুমিও জানো আমি তোমার মেয়ে, তোমার যতটুকু রাগ আছে আমারও ততটুকুই আছে। আমিও আমার কথায় অটল থাকবো।”(রাগান্নিত কণ্ঠস্বরে)

ইলা আর দাঁড়ালোনা কৌশিক চৌধুরীর কক্ষ থেকে হনহন করতে করতে বেরিয়ে গেলো। কৌশিক চৌধুরীর পাশে ওনার স্ত্রী অর্থাৎ ইলার মা প্রমীলা চৌধুরী নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। এখন উনি কিছু বলা মানেই কৌশিক চৌধুরী “মেয়েকে দেখে রাখতে পারোনি? তুমি থাকতে ও এতো তেজী কিভাবে হলো” বলে উঠা। প্রমীলা চৌধুরী কিছু না বলা শর্তেও কৌশিক চৌধুরী রাগান্নিত চোখে ওনার দিকে চেয়ে সোফা থেকে উঠে বিছানার দিকে আগত হলেন ঘুমানোর জন্য। প্রমীলা চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

ইলা নিজের কক্ষে এসে রাগে পায়চারি শুরু করলো। ফোনটা হাতে নিয়ে আদিতকে ফোন দিলো।
এক দু বার রিং হতেই আদিত কল রিসিভ করলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,,

“হু, কে বলছেন?”(ঘুম জড়ানো কণ্ঠে)

ইলা যেন আরো ক্ষুদ্ধ হলো। এদিকে আদিতকে বিয়ে করার জন্য রাত দুইটা বাজে বাবার সাথে এক ধাপ তর্ক করে আসলো আর আদিত কিনা ঘুমাচ্ছে! ইলা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,,

“ফিউচারে আপনাকে খু’ন্তি দিয়ে আদর করা নারী বলছি। কিসের এতো ঘুম হ্যা? উঠুন।”(দাঁত দাঁত চেপে)

শেষোক্তি একপ্রকার ধমকে বলে উঠলো ইলা। এদিকে ইলার এহেনে কথাবার্তা আর এহেন ধমকে ঘুম ছুটে গেলো আদিতের। ফোন কর্ণ থেকে নামিয়ে দেখলো “আলু” অর্থাৎ ইলার নাম্বার। ইলাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সময় ইলা জোর করে নিজের নাম্বার আদিতের ফোনে সেভ করেছিল “বউজান” দিয়ে। সাথে আদিতের নাম্বারও নিজের ফোনে সেভ করে নিয়েছিল। কারণ কিছুদিন আগেই আদিত নাম্বার পাল্টে ফেলেছে।
আদিত পরে অবশ্য “বউজান” নিকনেম “আলু” দিয়ে সেভ করেছিল।
ইলার এমন রাগান্নিত কণ্ঠস্বর শুনে আদিত গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“এই মেয়ে এই, রাত বিরাতে আমায় কেনো ফোন করেছো? ঘুম নিদ্রা নাই তোমার?”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

ইলার রাগ যেন আরও বৃদ্ধি পেলো। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,,

“আপনার সাথে পঁচা কথা বলবো বলে রাত বিরাতে কল দিয়েছি। কোনো সমস্যা আপনার? আসুন বাচ্চার পরিকল্পনা করি।”(দাঁত কিড়মিড় করে)

আদিত আরও গম্ভীর হলো, রাত দুটো বাজে, এই সময়ে এই মেয়ে ফোন দিয়ে বাজে ব’কছে! আদিতের ইচ্ছে করছে এক ধমক মা’রতে ইলাকে। নেহাত অনেক রাত হয়েছে, এখন চেঁচালে পাশের ঘরে থাকা মা উঠে এসে রিমান্ড দেওয়া শুরু করবে আদিতকে। আদিত গম্ভীর কণ্ঠেই বলে উঠলো,,

“অসভ্য মেয়ে, মুখে আটকায় না? দিনদিন লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে তোমার মুখ। কন্ট্রোল করো নাহয় আমি..”(গম্ভীর কণ্ঠে)

আদিতকে বলতে না দিয়ে ইলা বলে উঠলো,,

“নাহয় আপনি, আপনি কন্ট্রোললেস হয়ে পড়বেন। পরে করতে গিয়ে বিয়ে সেরে বাসরও সেরে ফেলবেন। এরপর আমাদের ডজনখানেক বাচ্চা হবে। এইতো? ঠিকাছে আমি রাজি। স্ক্রু ঢিলা পুরুষমানুষ কোথাকার, রাতের দুটো বাজে আমি বাবার সাথে তর্ক করে এসেছি আপনাকে বিয়ে করবো বলে আর আপনি ভুসভুস শব্দ করতে করতে ঘুমাচ্ছেন! শুধু বিয়েটা হোক না, একসাথে তিনটা বাচ্চার মা হবো। সবার পটি আপনায় দিয়ে পরিষ্কার করাবো স্ক্রু ঢিলা পুরুষমানুষ কোথাকার।”(রাগী স্বরে)

আদিত এবার চেয়েও রাগ সামলাতে পারলোনা। ধমকে বলে উঠলো,,

“শাট আপ, বাজে কথা একদম বলবেনা। নয়তো ঘুম বাদ দিয়ে এই মুহূর্তে তোমার বাড়িতে এসে তোমায় কানের নিচে এমন মারবোনা কেঁদে সমুদ্র বানিয়ে ফেলবে। এক বাচ্চার মা হতেই দম বেরিয়ে যাবে সেখানে তিনটা বাচ্চার মা হওয়ার স্বপ্ন দেখে! চ’ড়িয়ে একদম গাল লা’ল করে দিবো অ’সভ্য মেয়ে। ফোন রাখো।”(ধমকের স্বরে)

আদিতের ধমক খেয়ে ইলা কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলো। “আপনি ভালোনা, কথা বলবোনা আপনার সাথে” বলেই ফোন কেটে দিলো। আদিত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো, এই মেয়ে কি জীবনেও তাকে শান্তি দিবেনা? দিনে তো অশান্তি দেয়ই রাতেও অশান্তি দেয়। দুহাতে মাথার চুল টেনে ধুপ করে শুয়ে পড়লো আদিত।


“অসভ্য চোরের মতো আমায় কোলে তুলে কেন নিয়ে আসলেন?”(রাগত স্বরে)

সারুর বাক্য বচনে শেরহাম ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,,

“বউ, বাচ্চা ছাড়া ঘুম আসেনা তাই আমার বউ, বাচ্চা আমি তুলে নিয়ে এসেছি। এতে তোমার কি? তুমি বলার কে?”(ভ্রু কুঁচকে)

সারু নাক ফুলিয়ে নিশ্চুপ হয়ে শেরহামের বুকে গুটিয়ে রইলো। শেরহাম আলতো হেসে দুহাতে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো সারুকে। সময় এখন রাত তিনটা। শেরহাম হাজার চেয়েও ঘুমাতে পারেনি। এতদিন সারুকে জড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস তৈরী হওয়াতে আজকে সারু নেই বলে শেরহামের ঘুম আসছিলোনা। শেষে এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘড়ির কাঁ’টা তিনটায় এসে থামতেই উঠে চলে গেলো সারুকে নিয়ে আসতে। ভাগ্য ভালো দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিলোনা নাহয় সারুকে নিয়ে যেতে পারতোনা শেরহাম।
সারুর মাথায় চু’মু দিয়ে শেরহাম প্রশান্তিতে চোখ বুজলো।


নতুন ভোরের আগমন, সেই সাথে নতুন একটা বারের। সারু ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে গেলো সবার জন্য নাস্তা তৈরী করতে। সারু ভেবেছিলো এতসকালে একমাত্র সেই প্রথম উঠেছে কিন্তু না সারুর শাশুড়ি মিতালিও রান্না ঘরে উপস্থিত রয়েছেন। সারু ওনাকে দেখে একটু ইতস্তত বোধ করলো। প্রেগন্যান্সির আগ থেকেই মিতালি আর প্রেগন্যান্সি নিয়ে কথা শুনায়নি সারুকে। কথা তেমন বলতেন না, যতটুকু বলতেন সবটাই সারুর নিজের প্রতি খেয়াল রাখতে বলতেন।
সারু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো মিতালিকে সাহায্য করার জন্য।

“মা, রুটি আমি বেলে দেই?”

সারু নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করলো মিতালিকে। মিতালি সারুর দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন,,

“তোমার রুটি বেলা লাগবেনা। এতো সকালে কেনো উঠেছো? এই সময়ে পর্যাপ্ত পরিমানের ঘুম দরকার আর এখন কোনো কাজ করা লাগবেনা। যাও বিশ্রাম নাও।”(মিষ্টি হেসে)

সারুর কেনো জানি মিতালির এমন ব্যবহার একবার ভালো লাগে আরেকবার ভালো লাগেনা। কারণ মাঝে মধ্যে মনে হয় শাশুড়ি তার ভালো হয়ে গিয়েছে, এখন থেকে আর ঝগড়া করবেনা। আবার মনে হয় ঝগড়ার সময়টাই সুন্দর ছিল, মাঝে মধ্যে ঝগড়া ভালো না লাগলেও ঝগড়ার সময়টা সারুর ভালো লাগতো সারুর কাছে।
সারু নিচু কণ্ঠে আবারো বলে উঠলো,,

“আমি পারবো মা।”

“আমি জানি পারবে, তবে আমি করতে দিবোনা। যাও এখন ঘরে যাও, বিশ্রাম নাও। নাস্তা তৈরী হয়ে গেলে সবাইকে ডেকে দিবো।”

সারু আর একটাও শব্দ করলোনা। নিশ্চুপ পায়ে ঘরে গেলো। বিছানায় বসতেই শেরহাম শুয়ে থাকা অবস্থায় সারুর কাছে গিয়ে পেছন থেকে দুহাতে সারুর কোমর জড়িয়ে কোমরে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আচমকা শেরহামের এহেন কাণ্ডে ভড়কে গেলো সারু। শেরহামের হাত সরাতে চেয়েও সরাতে পারলোনা সারু। শেরহাম সারুকে নিজের কাছে টেনে সারুর কানে কানে বলে উঠলো,,

“আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে উঠে গিয়েছো, এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে জান।”(ফিসফিস করে)

সারু নিজেকে ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়া শুরু করলো। শেরহাম নিজের অধর সারুর অধরের সাথে মিশিয়ে দিলো। কিয়ৎক্ষণ উষ্ণ আবেশ বজায় থাকলেও শেরহাম জোরে একটা কা’ম’ড় বসালো সারুর অধরে। সারু ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে শেরহামের দিকে চাইলো। শেরহাম মৃদু হেসে কা’ম’ড় দেওয়া স্থানে আলতো চু’মু খেলো,,

“রোজ সকালে এভাবে আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে উঠে যেও, তাহলে রোজ রোজ সকালে তোমায় এমন শাস্তি দিতে পারবো। তোমায় এমন শাস্তি দিতে আমি প্রতিদিনই কেনো প্রতি মিনিটই ইচ্ছুক।”(মৃদু হেসে)

চলবে..?

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-২১]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“পুরুষমানুষ কাছে আসলে নারীর ধর্ম হচ্ছে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা সেখানে দেখছি তুমি নিজেকে নিস্তেজ করে নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে আছো আমার দিকে। কি আমার প্রেমে ট্রেমে পড়লে নাকি?”(ধীর কণ্ঠে)

উৎসের ধীর কণ্ঠস্বরের বাক্য বচন শুনেও স্নিগ্ধা নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে রইলো উৎসের মুখশ্রীপানে। কিয়ৎক্ষণ প্রহর অতিবাহিত হওয়ার পরে শান্ত স্বরে স্নিগ্ধা বলে উঠলো,,

“আগেরবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও নিজেকে বাঁচাতে পারিনি এবারও নিশ্চয়ই বাঁচাতে পারবোনা। শুধু শুধু চেষ্টা করে লাভ নেই। সম্মানহানি করতেই তো তুলে এনেছেন, করুন। আপনাদের মতো চরিত্রহীন পুরুষমানুষদের কাছ থেকে আর কিই-বা আশা করা যায়।”(শান্ত স্বরে)

উৎসের প্রচুর রাগ উঠলো স্নিগ্ধার কথায়, তবুও রাগটাকে চাপা দিয়ে বাঁকা হাসলো। সদ্য কিনে আনা নতুন সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সিগারেট ধরালো উৎস। মুখে দিলোনা, দু আঙুলের ভাঁজে চেপে ধরে মৃদু হেসে বললো,,

“আমি ছাড়া আমার মায়ের পৃথিবীতে কেউ নেই। আমাকে নিয়ে আমার মা অনেক স্বপ্ন দেখতো এবং এখনো দেখে। মা যাতে কোনোদিনও কষ্ট না পায় তার জন্য কিছুক্ষন আগ অব্দি পর্যন্ত সিগারেট ছুঁইনি। কোনোদিন মেয়েদের সংস্পর্শে আসিনি। এই প্রথম তোমার এবং এই সিগারেটের সংস্পর্শে আসলাম। তবুও যদি চরিত্রহীন উপাধি দাও এইক্ষেত্রে আর কিই-বা বলতে পারি। দাও, এমনিও পুরুষমানুষকে নিজের ব্যাক্তিগত নারীর কাছে চরিত্রহীন হতেই হয়। নো প্রব্লেম।”(মৃদু হেসে)

স্নিগ্ধার কোনো ভাবোদয় হলোনা। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে উৎসর দু আঙুলের ভাঁজে চেপে ধরা সিগারেটের দিকে। উৎস ঠোঁট স্পর্শ করাচ্ছেনা সিগারেট, হাতের আঙুলেই চেপে ধরে রেখেছে। স্নিগ্ধা কিছু বলছেনা দেখে উৎস আবারো বলে উঠলো,,

“আমার বউ হতে রাজি হয়ে যাও, এটা কিন্তু অনেক বড় একটা অফার। অফার স্টক আউট হলে কিন্তু পরে কাঁদলেও এই অফার পাবেনা জান।”(ঠোঁট চেপে হেসে)

স্নিগ্ধার ভ্রু খানিকটা কুঁচকালো। কণ্ঠে বিরক্ত মিশিয়ে বলে উঠলো,,

“বিরক্তিকর। আপনার এসব বাজে কথা শুনতে আমি মোটেও ইচ্ছুক নই।”

“কেনো? তুমি কি অন্যকিছু করতে ইচ্ছুক? আই মিন কিছুমিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছ নাকি?”(চোখ টিপে)

“চরিত্রহীন!”(রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে)

উৎস হাসলো। স্নিগ্ধা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিল আর উৎস বিছানায়। বিছানা থেকে উঠে এসে উৎস স্নিগ্ধাকে কোলে তুলে নিলো। স্নিগ্ধা টু শব্দও করলোনা। চুপচাপ উৎসর কোলে স্থির হয়ে রইলো। উৎস মুখ ভার করে বলে উঠলো,,

“ভাবলাম শিং মাছের মতো লাফালাফি করবে তা না, তুমি দেখছি আমার বাহুডোরে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছ।”(মুখ ভার করে)

“আপনি যদি বুঝতেন আপনার স্পর্শে আমার ঠিক কতটুকু ঘৃণা হচ্ছে তাহলে এসব বলার ভাষা পেতেন না।”

“ঘৃণা থেকে ভালোবাসা জন্মায়। যাক আমার হাতে তাহলে সুযোগ আছে তোমার মনে আমার জন্য ভালোবাসা জন্মানোর। তোমার মনে যেহেতু আমার জন্য ঘৃণা আছে সেহেতু ভালোবাসাও জন্মাবে। ভালোই, শুনে খুশি হলাম।”

স্নিগ্ধা কিছুই বললোনা। বলার মতো তার হাতে আর কিছুই নেই। বহুদিন ধরে পড়ালেখা থেকে দূরে ছিল স্নিগ্ধা। গত রাতে সারুর সাথে মন খুলে অনেকদিন পর কথা বলেছে। এই চার দেয়ালের মাঝখানে স্নিগ্ধা একপ্রকার দুমড়ে মুচড়ে মা’রা যাচ্ছিলো। কিন্তু সে ম’রতে চায়না, বহুদিন বাঁচতে চায়। প্রানভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়। সবটা নতুন করে শুরু করতে চায়, নিজেকে শক্ত করে তৈরী করতে চায়। অনেকদিন পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আজকে থেকে সে কলেজ যাবে, পড়াশোনা করবে সবার সাথে হাসিখুশি থাকবে।
তার কথা শুনে সবাই কত খুশি হয়েছিল। আদিত গাড়ি করে স্নিগ্ধাকে কলেজ নামিয়ে দিয়ে এসেছিলো। কলেজে এতদিন পর সবাই তাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল। তার বন্ধুমহল তাকে দেখে অনেক খুশি হয়েছিল। পাছে কয়েকজন বাঁকা দৃষ্টি আর কটু কথা বলেছে। যার স্বভাব যেমন, স্নিগ্ধা সেসব পাত্তা দেয়নি। বহুদিন পর চিরচেনা ক্লাসরুম, বন্ধুমহলের সাথে এক বেঞ্চে বসে মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল। এর মাঝেই প্রিন্সিপাল স্যার স্নিগ্ধাকে অফিসকক্ষে ডেকেছে। স্নিগ্ধা ফুরফুরে মনে অফিসকক্ষে ঢোকার পর বেশ অবাক হলো প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষে উৎস চৌধুরীকে দেখে। স্নিগ্ধাকে দেখা মাত্রই উৎস বলে উঠলো,,

“ভালো থাকবেন স্যার, আমি স্নিগ্ধাকে নিয়ে যাচ্ছি।”

প্রিন্সিপাল স্যার সৌজন্যের হাসি হাসলেন। স্নিগ্ধা অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল স্যার আর উৎসের দিকে। উৎস হাসি প্রশস্ত করে স্নিগ্ধার হাত চেপে প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষ থেকে বের হলো। স্নিগ্ধা হাত ছাড়িয়ে কিছু বলতে নিবে এর মাঝেই উৎস কিছু একটা স্প্রে করলো স্নিগ্ধার মুখে। এরপর আর কিছু মনে নেই স্নিগ্ধার। যখন চোখ খুলেছিলো তখন নিজেকে একটা কক্ষের বিছানায় আবিষ্কার করেছিল। পাশে নজর যেতেই দেখেছিলো উৎস হাতের উপর মাথার ভর দিয়ে তার দিকে মুচকি হেসে চেয়ে আছে। হতচকিত হয়ে স্নিগ্ধা বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেলো। তবুও নিজেকে টেনে হিচড়ে দেয়ালের সাথে লেপ্টে বসলো।

উৎস স্নিগ্ধাকে কোথাও বসাচ্ছে অনুভব হতেই স্নিগ্ধা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। আবছা লাইটের আলোয় চারদিকে নজর বুলাতে দেখলো তারা এখন বাগানে এসেছে। উৎস স্নিগ্ধাকে দোলনায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসে পা দিয়ে দোলনা মৃদু ভাবে দোলাচ্ছে। স্নিগ্ধা উপলব্ধি করলো এখন বেশ রাত হয়েছে। মাথার উপর পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। চারদিকে নানা রকমের ফুলগাছ লাগানো আছে। মৃদু বাতাসের সাথে সাথে ফুল গাছ গুলো আপন মনে দুলছে আর ঘ্রাণ সুভাষিত করছে চারদিক। শান্ত স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ, যে কারোরই ভালো লাগবে এমন পরিবেশ। তবু এতসবের মাঝে স্নিগ্ধা এখন বাড়ির কথা ভাবছে, সেই সকালে মায়ের, আদিতের, সবার মুখশ্রী দেখে বেরিয়েছিল আর এখন রাত। পরিবারের কেউ কোথাও নেই আশেপাশে। আছে শুধু অচেনা, অসভ্য একটা মানুষ। যাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে স্নিগ্ধা।
স্নিগ্ধা ভাবছে তাকে খুঁজে না পেয়ে তার মা, ভাই পরিবারের সকলের কি অবস্থা হচ্ছে। মা নিশ্চয়ই তাকে খুঁজে না পেয়ে প্রচুর কান্নাকাটি করছে, শেরহাম আদিত হয়তো এখনো হাল ছাড়েনি। এদিকে ওদিকে তাকে অনেক খুঁজছে। পরিবারের অবস্থান সম্পর্কে ভাবতেই স্নিগ্ধার বুক ভার হয়ে উঠলো, বুক ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইলো।

“কাঁদছো কেনো? খিদে পেয়েছে? খিদের জন্য কাঁদছো?”

উৎসের প্রশ্নে কোনো উত্তর দিলোনা স্নিগ্ধা, নীরবে অশ্রুজল বিসর্জন দিতে লাগলো। উৎস উঠে দাঁড়ালো স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,,

“পরিবারের কথা মনে পড়লেও কিছু করার নেই আমার। যতদিন না অব্দি তোমার মনে আমার জন্য ভালোবাসা জন্ম না নিচ্ছে এখান থেকে কোথাও যেতে পারবেনা। এখন চল।”

উৎস স্নিগ্ধার হাত টেনে ধরে এগিয়ে যেতে থাকলো সামনের দিকে। দু ধারে বিভিন্ন ফুলের গাছ, কিছুদূর যেতে স্নিগ্ধা দেখলো একটা টেবিলে কয়েকটা মোম জ্বলছে আর সেখানে খাবার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা আছে। পাশাপাশি দুটো চেয়ার রাখা আছে। উৎস স্নিগ্ধাকে সেখানে বসিয়ে নিজেও স্নিগ্ধার পাশে বসলো।

“প্রেমময় একটা প্রহর, আজকে যদি আমায় ভালোবাসতে তাহলে প্রহরটা অনেক সুন্দর উপভোগ করতে পারতে তুমি সাথে আমিও। কিন্তু তুমি তো আমায় ভালোবাসোনা, আর কি করার। নাও হা করো।”(মৃদু স্বরে)

স্নিগ্ধা মোমের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে উৎসর দিকে তাকালো। স্নিগ্ধার মুখের সামনে উৎস খাবার ধরে তার দিকে চেয়ে আছে। চারদিকে মোম আর চাঁদের আলো ছাড়া অন্য কোনো আলো নেই। জ্বলন্ত মোমের আলোয় উৎসর মুখশ্রী বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। না চাইতেও স্নিগ্ধা কিছুক্ষন চেয়ে রইলো সেই মুখশ্রী পানে।

“এভাবে চেয়ে থাকার সুযোগ তুমি অনেক পাবে। আমি পুরোটাই তোমার, চেয়ে থাকারও অনেক সময় আছে। আপাতত খেয়ে নাও, অনেকক্ষন যাবৎ কিছুই খাওয়া হয়নি তোমার।”(শান্ত স্বরে)

স্নিগ্ধা নজর সরিয়ে ফেললো। মুখশ্রী ঘুরিয়ে অন্যদিকে চাইলো যার মানে হচ্ছে সে খাবেনা উৎসের হাতে। উৎস বারকয়েক ডাকলো স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা কিছুতেই মুখ এদিকে ঘুরাচ্ছেনা দেখে কিছু রাগ নিয়েই উৎস স্নিগ্ধার মুখে এদিকে ঘুরিয়ে মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো।
স্নিগ্ধার প্রচুর কান্না পেলো। মুখে খাবার রেখেই ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। উৎস মুহূর্তেই নরম হয়ে গেলো, দুহাত দিয়ে স্নিগ্ধার গাল স্পর্শ করে অস্থির কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“প্লিজ কান্না থামাও, কাঁদছো কেনো! তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে বলেই তো আমি খাইয়ে দিচ্ছিলাম তোমায়। কাঁদছো কেনো এভাবে?”(অস্থির কণ্ঠস্বরে)

স্নিগ্ধা কান্না থামালোনা, কান্নার বেগ আরও বৃদ্ধি করলো। উৎস কি করবে বুঝে উঠতে পারলোনা। স্নিগ্ধার এমন ফুঁপিয়ে কান্না করায় অস্থির হয়ে উঠেছে উৎসর মন।


অন্ধকার অম্বর আজকে পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। জানালার ধারে একদৃষ্টিতে চাঁদের দিকে চেয়ে আছেন কল্যাণী। তার কক্ষে এখন পিনপন নীরবতা বিরাজমান। কক্ষের মধ্যে মিতালি, সারু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কল্যাণীর পিছনে।
নীরবতাকে চাপিয়ে ভারী কণ্ঠে কল্যাণী বলে উঠলেন,,

“আদিত, শেরহাম, নেহাল বাড়িতে আসেনি এখনও?”(ভারী কণ্ঠে)

মিতালি নিভিয়ে আসা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন,,

“ওরা এখনো আসেনি, স্নিগ্ধাকে খুঁজছে। উৎস চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছে। উৎস চৌধুরী বাড়িতে, তার মা রয়েছেন। কিন্তু তিনি জানেন না যে ওনার ছেলে আমাদের স্নিগ্ধাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন।”(নিভে আসা কণ্ঠস্বরে)

কল্যাণী কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলেন,,

“ওদের বাড়িতে ফিরতে বলো, আর খোঁজ করা লাগবেনা। আমার বিশ্বাস আছে উৎস চৌধুরী স্নিগ্ধার কোনো ক্ষতি করবেনা। উৎস চৌধুরী নিজেই স্নিগ্ধাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে।”

“দি তুমি কিভাবে বুঝলে উৎস চৌধুরী স্নিগ্ধার কোনো ক্ষতি করবেনা?”(অবাক স্বরে)

মিতালির প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কল্যাণী। চাপা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন,,

“ওকালতি করতে করতে মানুষের মনোভাব আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে সক্ষম হয়েছি। উৎস চৌধুরীর মনোভাব খারাপ নয় সেটা আমি সেদিনই পর্যবেক্ষণ করে ফেলেছিলাম। তোমার শুনতে অবাক লাগলেও সত্য এটা উৎস চৌধুরী বলেছিলো তার থেকে বেটার স্নিগ্ধার জন্য কেউ হবেনা কথাটা সত্যই।”(চাপা কণ্ঠস্বরে)

সারু, মিতালি অবাক হলো। সারু অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,,

“উনি যদি ভালো হোন তাহলে স্নিগ্ধাকে এভাবে অপহরণ কোন উদ্দেশ্যে করলেন?”(অস্পষ্ট স্বরে)

“উৎস চৌধুরী শুধু এটা দেখাতেই স্নিগ্ধাকে নিয়ে গেছেন যে আমরা চাইলেও স্নিগ্ধাকে ওনার থেকে সরাতে পারবোনা। এসব বাদ দাও, আদিত, শেরহাম, নেহালকে বলো বাড়ি ফিরতে।”(ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে)


ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তার ধারে বসে আছে শেরহাম, আদিত ও নেহাল রায়। সারাদিন খুঁজেও কোথাও পায়নি স্নিগ্ধাকে। উৎস চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েও লাভ হয়নি সেখানে সে নেই। আদিত উৎসের নামে থানায় স্নিগ্ধাকে অপহরণের মামলা দিয়ে এসেছে। তারাও উৎস আর স্নিগ্ধাকে খুঁজছে।
আদিত ক্লান্ত দেহে নিয়ে চুপ করে বসে আছে। বোনকে কোথাও না পেয়ে প্রায় পাগল হয়ে গেছে আদিত। নেহাল রায় আদিতের কাঁধে হাত দিলেন। আদিত নিভে যাওয়া কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“আমার বোনকে অপহরণের মূল্য বেশ চুকাতে হবে উৎস চৌধুরীকে। শুধু একবার পেয়ে নিই।”(নিভে যাওয়া কণ্ঠস্বরে)

চলবে..?