নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-২২ এবং বোনাস পর্ব

0
53

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-২২]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

মিনিট দশেকের মতো অন্ধকারে বসে আছে স্নিগ্ধা। মোম নিভু নিভু হয়ে আসার পর উৎস উঠে বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গিয়েছে। ভেতরে যাওয়ার মিনিট দুয়েকের মাঝেই মোম নিভে গেছে আর স্নিগ্ধাও অন্ধকারে একা বসে আছে।
পরিবারের চিন্তায় স্নিগ্ধা এতটাই মত্ত হয়েছে চারদিকে অন্ধকারে তার একটুও ভয় অনুভব হচ্ছেনা। অবশ্য এতো বেশিও অন্ধকার নয়, চাঁদের আবছা আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে চারদিক।

“একা একা ভয় করছে অন্ধকারে?”

ভাবনায় মত্ত থাকায় হুট্ করে উৎসের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হতচকিত হলো স্নিগ্ধা। আবছা আলোয় দেখলো উৎস তার পাশের চেয়ারে বসেছে। স্নিগ্ধা আড়চোখে তাকালো। হুট্ করেই উৎস আলোকিতময় কিছু একটা স্নিগ্ধার সামনে তুলে ধরলো। স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে দেখতে পেলো একটা কাছের জারের মধ্যে অনেকগুলো জোনাকিপোকা। জোনাকিপোকার আলোয় স্নিগ্ধা উৎসের দিকে তাকালো। উৎস একদৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা একনজর সেই দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। উৎস সেই জারের মুখ খুলে দিয়েছে। জোনাকিপোকা একে একে বেরিয়ে আসছে, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা স্নিগ্ধার ভালো লাগলো, লাগলোনা শুধু উৎসের উপস্থিতি। উৎস আসার সময় সাথে করে মোম নিয়ে এসেছে, তিনটা মোম জ্বালালো সে। স্নিগ্ধার মুখশ্রী পানে তাকিয়ে বিরস কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“ভাবলাম কই একটু হাসবে, তা নয় মুখ গম্ভীর করে বসে আছো। একদম নিজের ভাইয়ের মতো হয়েছো, তোমার ভাই যেমন আমার বোনের সামনে মুখ গম্ভীর করে রাখে তেমনি তুমিও আমার সামনে মুখ গম্ভীর করে রাখো।”(বিরস কণ্ঠে)

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে উৎসের মুখশ্রী পানে তাকালো। উৎসের বাক্য বচন কিয়ৎক্ষণ মস্তিষ্কে আওড়ালো। “বোন”, উৎস বোন বলে কাকে বুঝাচ্ছে? স্নিগ্ধা গমগমে স্বরে বলে উঠলো,,

“বোন? কে আপনার বোন?”(গমগমে স্বরে)

উৎস চুপ করে রইলো দৃষ্টি নত করে। কিয়ৎক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর উৎস ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। স্নিগ্ধার মুখশ্রী পানে তাকালো। ধীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“তুমি যেহেতু আমার ভালোবাসা সেহেতু তোমার সবটা জানার অধিকার আছে। (লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে) ইলা হচ্ছে আমার বোন।”(ধীর কণ্ঠে)

স্নিগ্ধা কিঞ্চিৎ চোখ বড় বড় করে তাকালো উৎসের দিকে। অবাক স্বরে বলে উঠলো,,

“ইলাদি আপনার বোন মানে! কিভাবে সম্ভব!”(অবাক স্বরে)

উৎস আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মৃদু স্বরে বললো,,

“আমার মা আর বাবার লাভ ম্যারেজ হয়েছিল। মায়ের পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ ছিলোনা। মা বাবাকে অনেক ভালোবেসেছিলো এবং এখনো বাসে আই থিঙ্ক। আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন বাবা অন্য এক মহিলার জন্য আমাকে আর মাকে ছেড়ে চলে যায়। বাবা আর সেই মহিলার মেয়ে হচ্ছে ইলা। সম্পর্কে তো বোনই হয়, সৎ বোন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর ওনার সাথে তিনমাস আগে আমার দেখা হয়েছে। ওনার হার্ট প্রব্লেম ছিল, সার্জারিটা আমি করেছিলাম।”(মৃদু স্বরে)

স্নিগ্ধা অবাক চোখে উৎসের দিকে তাকিয়ে আছে। উৎসের দৃষ্টি এখন জ্বলন্ত মোমের দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,,

“ইলাদির বাবা আপনারও বাবা!”(অস্পষ্ট স্বরে)

উৎস তাচ্ছিল্যর হাসলো, বললো,,

“যেই বাবা নিজের ছয় বছরের ছেলে ও স্ত্রীকে ফেলে অন্য মহিলার হাত ধরে ছেড়ে চলে যায়। সে বাবা হওয়ার যোগ্য নয়, আমি ওনাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করি, বাবা হিসেবে মানিনা।”(তাচ্ছিল্যর হেসে)

উৎস আর বসে থাকলোনা। উঠে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধার হাত ধরে স্নিগ্ধাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো। স্নিগ্ধা অবাক চোখে উৎসের দিকে চেয়ে রইলো।
বাড়ির ভেতরে কাঙ্খিত কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো উৎস। পেছন ফিরে স্নিগ্ধাকে উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,

“তোমার রুম, এখানেই থাকবে আজকে থেকে।”

উৎস পাশের রুমে চলে গেলো, স্নিগ্ধা তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বেয়াদব, অসভ্য, চরিত্রহীনের পাশাপাশি লোকটা অদ্ভুত! ভাবতে ভাবতে স্নিগ্ধা ঘরে প্রবেশ করলো।


রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি,,

আদিত নির্ঘুম, স্নিগ্ধা কোথায় আছে, কোন অবস্থায় আছে ভেবে ভেবে অস্থির হচ্ছে আদিত। রুমে জ্ব’লন্ত লাইটের আলো বি’ষের মতো ঠেকছে আদিতের কাছে। রুমের দরজায় ঠক ঠক আওয়াজে, দরজার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো আদিত। দরজা খুলে দেখলো কল্যাণী দাঁড়িয়ে আছে।

“এখনো ঘুমাসনি কেনো?”

“স্নিগ্ধা কোথাও নেই, কোথাও খুঁজেও পাইনি! এই অবস্থায় আমি ভাই হয়ে কিভাবে ঘুমাবো মা?”

“অহেতুক অস্থির হচ্ছিস। উৎস চৌধুরীর উপর আমার ভরসা আছে। স্নিগ্ধার কোনো ক্ষতি হবেনা। ভাবছি কি জানিস?”(মৃদু স্বরে)

“কিভাবে ভরসা করছো ওই অসভ্য লোকটাকে! ওর সাহস হয় কি করে আমার বোনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার! একবার শুধু পেয়ে নেই, ওর খবর করে ছাড়বো।”(রাগান্নিত কণ্ঠ স্বরে)

“অযথা রাগ করিস না, আমি যখন বলছি উৎস চৌধুরী স্নিগ্ধার ক্ষতি করবেনা মানে করবেনা। এটা নিয়ে ভাবিস না, মনে করে নে স্নিগ্ধা প্রাণবন্ত হওয়ার জন্য একটা ট্যুরে গিয়েছে। এখন আমার ভাবনার কথা শুন। কালকে ইলার পরিবারকে ডিনারে ইনভাইট করবো তোর আর ইলার বিয়ের কথা বলতে।”(এক নিঃশ্বাসে)

কল্যাণী এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে হাঁপাচ্ছেন। আদিত নির্ভীক হয়ে চেয়ে আছে কল্যাণীর দিকে। বিছানার পাশে থাকা টেবিল থেকে গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে কল্যাণীর সামনে ধরলো আদিত। কল্যাণী পানিটুকু জল খেয়ে তাকালো আদিতের দিকে। আদিত নির্লিপ্ত ভাবে গ্লাস হাতে নিয়ে পুনরায় টেবিলে রেখে দিয়ে মায়ের মুখশ্রী পানে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,,

“বিয়ের কথা না তুললেই কি নয়? আমি ইলাকে আমার সাথে জড়াতে চাইনা।”(মৃদু স্বরে)

কল্যাণী তির্যক ভাবে তাকালেন আদিতের দিকে। মুখশ্রী খানিকটা কঠোর করে বলে উঠলেন,,

“সবটা মজা পেয়েছো? মেয়েটাকে ভালোবাসার, একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছো। মেয়েটা তোমায় অসম্ভব ভালোবাসে, এতো যে অপমান করো তবুও তুমি তুমিই করে। এখন তুমি ওকে ভালোবাসোনা, বিয়ে করতে চাওনা বলে মেয়েটার মন বিষিয়ে তুলনা। আমি স্পষ্ট কথা ইলার সাথেই তোমার বিয়ে হবে, কালকে আমরা এটা নিয়ে দুই পরিবার ডিসকাস করবো। তোমার মতামত আর গ্রহণযোগ্য নয়, আমি যা বলবো তাই হবে।”(কঠোর কণ্ঠস্বরে)

কল্যাণী আর দাঁড়ালেন না, হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। আদিত মনে মনে হাসলো, যেখানে জীবনের নিশ্চয়তা নেই সেখানে নিষ্পাপ একজনকে নিজের সাথে জড়িয়ে তাকেও অনিশ্চিততায় ভোগান্তি করাতে আদিত অনিচ্ছুক, ভীষণ ভাবে অনিচ্ছুক। এতো অনিচ্ছুকতার মাঝে আদিত চায়, ইলাকে ভীষণ চায়। কিন্তু ঐযে অনিশ্চিত জীবন। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদিত, মাথা প্রচুর যন্ত্রনা করছে।
প্রথমত স্নিগ্ধাকে কি’ড’ন্যা’প করে নিয়ে গেছে উৎস চৌধুরী। দ্বিতীয়ত, যেই প্রফেশনটা আদিত নিজ ইচ্ছায় বিষন্নতায় আপন করে নিয়েছিল, এরপর হুট্ করেই নিজ ইচ্ছাটা ছেড়ে দিয়েছিলো সেই প্রফেশন আবার ফিরে আসতে চাইছে। পরিচয় গোপন রেখে প্রফেশনটা পালন করলেও তার পরিচয় লিক হয়ে গেছে এমন একটা দলের কাছে যাদের লিডারকে টাকার বিনিময়ে মা’র্ডার করেছিল আদিত। এসজে(দলের নাম) আদিতকে খুঁজতে খুঁজতে তারা বিপুল রায় অব্দি পৌঁছে গেছে, বিপুল রায়কে গার্ড দেওয়া সকল বডিগার্ডকে খু’ন করে বিপুল রায়কে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে এসজে গ্রুপের সদস্যরা।
রাত দুটোর দিকে তার ফোনে একটা মেইল আসে, সে সাথে একটা ভিডিও। ভিডিও ওপেন করে আদিত থ হয়েছিল। বিপুল রায়কে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। ওনার বুঁকের উপর পা দিয়ে এসজে গ্রুপের বর্তমান লিডার বিশ্রী কয়েকটা গালি দিয়ে আদিতকে হুমকি দিয়েছে, যদি সে তাদের কাছে আত্মসমর্পন না করে তাহলে বিপুল রায়ের এমন অবস্থা করবে আদিত ভাবতেও পারবেনা।

আর ভাবতে পারলোনা আদিত, চুল খামচে বিছানায় বসে রইলো। মাথায় তীব্র যন্ত্রনা করছে আদিতের। সে তো সবটা ছেড়ে দিয়েছে তবে এখন এই ঝামেলা কেনো হচ্ছে! হাস্যকর লাগলেও আদিতের মনে একটা কথাই ঘুরছে, “পাপ তার বাপকেও ছাড়েনা।”


“জান..”

শুভসকাল, শুভ দিয়ে সকাল শুরু হয়েছে মানে দিনটা প্রচুর ভালো কাটবে তোমার। শুধু আজকের সকাল আর দিনটা কেনো প্রতিটা দিন, প্রতিটা সকাল তোমার শুভ হোক সেই কামনাই করি। কথাগুলো তোমায় সামনাসামনি বলতে পারতাম তবে বলিনি কেনো জানো? আজকে সেপ্টেম্বর মাসের সূচনা, আজকে নাকি বিশ্ব চিঠি দিবস। ভাবলাম তোমায় চিঠি দেওয়া যাক। চিঠিতে প্রেম জমে বেশি। অন্যরকম অনুভূতি অনুভূত হয়। সে যাই হোক, পাশে ব্রেকফাস্ট রাখা আছে খেয়ে নাও এবং ঘুরতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে আসো। চিঠিদিবস একটু অন্যরকম ভাবে উপভোগ করবো এবং তোমায় আজ খুশি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তৈরী হয়ে নিচে আসো, ভালোবাসিইই।”

ইতি..
স্নিগ্ধার উৎস।

নির্লিপ্ত ভাবে চিঠির কথাগুলো মনে মনে আওড়ালো স্নিগ্ধা। শেষে স্নিগ্ধার চোখ আটকে গেলো “ভালোবাসিইই” শব্দটাতে।

চলবে..?

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[বোনাস পর্ব]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

নির্লিপ্ত ভাবে চিঠির কথাগুলো মনে মনে আওড়ালো স্নিগ্ধা। শেষে স্নিগ্ধার চোখ আটকে গেলো “ভালোবাসিইই” শব্দটাতে।
তাচ্ছিল্যর হেসে স্নিগ্ধা বিছানা থেকে উঠলো।


“হা করে তাকিয়ে আছো কেনো মুখ খোলো।”(মৃদু স্বরে)

স্নিগ্ধা উৎসের মুখশ্রী পানে তাকিয়ে আছে। অনেকটা উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে তার মুখশ্রীপানে। এক হাতে পায়েসের বাটি, আরেক হাতে এক চামুচ পায়েস স্নিগ্ধার মুখের সামনে ধরে রেখেছে উৎস। স্নিগ্ধা মুখ হা করলোনা, গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,,

“অস’ভ্যর মতো কিডন্যাপ তো করে এনেছেন, কোথায় এনেছেন তা বললে খুশি হতাম।”(গম্ভীর স্বরে)

উৎস ভাবুক চেহারা করলো, স্নিগ্ধার কথার ফাঁকে পায়েস ভর্তি চামুচটা স্নিগ্ধার মুখে প্রবেশ করিয়ে দিলো। স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে উৎসের দিকে তাকালো। উৎস স্নিগ্ধার এহেন মুখশ্রী দেখে মৃদু হেসে বলে উঠলো,,

“আমরা চট্টগ্রাম আছি। জেদ বাদ দিয়ে খেতে থাকো।”

চট্টগ্রামের কথা শুনে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো স্নিগ্ধার। চট্টগ্রাম! কোথায় ঢাকা আর কোথায় চট্টগ্রাম! স্নিগ্ধা রাগান্নিত স্বরে বলে উঠলো,,

“আপনি চরম লেভেলের একটা অসভ্য লোক। আমায় কেনো এখানে এনেছেন? নাটক করেন হ্যা? যত্তসব অসভ্য লোক! আমি বাড়ি যাবো, আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিন।”(রাগান্নিত স্বরে)

উৎস ভাবুক স্বরে বলে উঠলো,,

“অসভ্য? কিছু করেছি আমি? আচ্ছা অসভ্য যখন বলেছো এদিকে এসো। কড়া একটা চু’মু খেয়ে যেই ট্যাগ দিয়েছো ওই ট্যাগ অর্জন করি। হানিমুন করতে এলাম একদিনও হলোনা আর বাড়ি ফিরতে চাইছো? আমাকে কে কি তোমার ভাই ব্রাদার্স পেয়েছো যে ঘুরতে এসে দুদিন হতে না হতেই বাড়িতে চলে যাবো? শুনো মেয়ে ভালোবেসে খাইয়ে দিচ্ছি, চুপচাপ আমার ভালোবাসা উপভোগ করো। রাগ উঠালে তোমায় চু’মু খাওয়া শুরু করব, নিশ্চয়ই এটা চাওনা। তাই চুপ করে যা করছি তা সহ্য করো।”(ভাবুক স্বরে)

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকেই রইলো, তবে কিছু বললোনা। উৎস স্নিগ্ধার নীরবতা দেখে মুচকি হাসলো। স্ব-যত্নে পায়েস খাওয়ানো শেষ হলে উৎস বলে উঠলো,,

“এই শুভ্র থ্রী পিসে তোমায় সুন্দর লাগছে। শুভ্রস্নিগ্ধা। উৎস চৌধুরীর পছন্দ আছে বলতে হবে।”

স্নিগ্ধা উত্তর করলোনা, চুপচাপ নাস্তা শেষ করলো উৎসের হাতেই। পরিবার থেকে আলাদা করে সুদূর এই চট্টগ্রামে এনে আদর মাখিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে, স্নিগ্ধার কাছে বিষয়টা জুতা মে”রে গরু দানের মতোই ঠেকলো।

“তুমি কি তৈরী সুন্দর একটা দিন উপভোগ করার জন্য? আশা করি এবারের চিঠি দিবস অন্যতম কাটবে তোমার।”(মুচকি হেসে)

স্নিগ্ধা কিছু বললোনা, বরাবরের মতো নীরব থাকলো। টিস্যু দিয়ে উৎস স্নিগ্ধার মুখ মুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো। স্নিগ্ধার হাত ধরে স্নিগ্ধাকে দাঁড় করালো। “চল যাওয়া যাক” বলে হাঁটা ধরলো বাড়ির বাহিরে যাওয়ার জন্য।

“সুদূর চট্টগ্রাম আনার কারণ?”

স্নিগ্ধার প্রশ্নের উত্তর উৎস স্নিগ্ধার দিকে না ফিরেই দিলো।

“ওখানে থাকলে কি আর তোমার ভাই ব্রাদার্সরা তোমার আমার প্রেম জমতে দিতো? দিতোনা তাই এখানে আসা।”

“এটা আপনার বাড়ি? কোথায় যাবেন আমাকে নিয়ে? এই বাড়িতে কেউ থাকেনা?”

“বাড়িটা বাবা নামক অযোগ্য ব্যাক্তিটা থাকাকালীন বানানো হয়েছে। আমরা এই বাড়িতেই থাকতাম, মা বাড়িটাকে ভালোবাসেন, এখানে আমার দুঃসম্পর্কের মামা মামি থাকেন। বাবা হঠাৎ করে চলে যাওয়ার পর মামির সাথে দেখা হয় মায়ের। মা অনেক ভেঙে পরেছিল, মামি মাকে সামলিয়েছে। সেই থেকেই ওনাকে মামি আর ওনার স্বামীকে মামা ডাকি। ওনাদের দুই মেয়ে এক ছেলে। মায়ের কেউ ছিলোনা, আমরাও ঢাকা চলে যাবো ঠিক করেছি। মামিদের অবস্থাও ভালো ছিলনা তাই ওনাদের এখানে থাকাতে বলেছেন। মা বছরে একবার এখানে আসেন। আপাতত কোথায় যাবো গেলে দেখতে পাবে।”

স্নিগ্ধা আর কিছু জিজ্ঞাসা করলোনা। উৎস গাড়িতে উঠে বসলো স্নিগ্ধাকেও তার পাশে বসালো।
প্রায় আধা ঘন্টার জার্নি শেষ করে গাড়ি একটা পার্কের সামনে এসে দাঁড়ালো। উৎস গাড়ি পার্ক করে নেমে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে। নেমে স্নিগ্ধার কাছে এসে গাড়ির দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো এই আশায় স্নিগ্ধা তার হাত ধরে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু না, স্নিগ্ধা নিজ থেকেই বেরিয়ে আসলো। উৎস নিজের বাড়ানো হাতের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো।

“আমরা বর্তমানে ডিসি পার্কে এসেছি। ফেব্রুয়ারীতে এখানে ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল হয়। চারদিকে নানান ফুল, পার্কের মনোরম পরিবেশ। ফুল আর ফুল, এখন অতো ফুল না থাকলেও চলবে কারণ আমার পাশে তুমি নামক ফুল আছো।”(মৃদু হেসে)

স্নিগ্ধা কিছু বললোনা, উৎস স্নিগ্ধার হাত ধরে পার্কের টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলো।

“আসো প্রথমে আর্ট প্রদর্শনী ঘুরে আসি। এরপর আশেপাশে ঘুরবো।”

উৎসের কথা মতো আর্ট প্রদর্শনী তে গেলো স্নিগ্ধা আর উৎস। নানা ধরণের আর্ট দেখে স্নিগ্ধা চেয়ে চেয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সবটা। একদিকে স্নিগ্ধা আর্ট পর্যবেক্ষণ করছে, অন্যদিকে উৎস স্নিগ্ধার মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে। স্নিগ্ধার এমন কৌতূহলী মুখশ্রী দেখে মুচকি হেসে উঠলো উৎস। স্নিগ্ধা নজর ঘুরিয়ে উৎসের দিকে তাকালো। উৎস বুকে হাত দিয়ে বলে উঠলো,,

“আহ মেয়ে, এভাবে হুটহাট তাকাতে নেই। হার্ট বিট মিস হয়ে যায়, বুঝোনা? আমি ম”রে তোমায় বিধবা আর আমার বাচ্চাদের বাবা হারা করতে চাইনা।”(বুকে হাত দিয়ে)

“যত্তসব ফা”ল”তু কথা আপনার মুখেই আসে।”(বিরক্ত মাখা কণ্ঠস্বরে)

“আমার মৃ”ত্যুর কথা শুনে বুঝি তোমার বুকে হাহাকার করছে? এতো ভালোবাসো! ভালো না বাসলে তো বলতে না যত্তসব ফালতু কথা আমার মুখেই মানায়। উফফফ জান, এত্ত ভালোবাসো আগে জানতাম না।”(ধীর কণ্ঠস্বরে)

“আপনার মতো অস’ভ্যলোক আগে কখনো দেখিনি। একটাও কথা বলবেন না আর।”(রাগান্নিত স্বরে)

উৎস মিটমিট হাসলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে উঠলো,,

“অস’ভ্য হলেও তোমারই তো। তোমাকে রাগাতে আমার এত্ত ভালো লাগে বলে বুঝাতে পারবোনা।”(মিটমিট হেসে)

“আপনাকে আমার প্রচুর অসহ্য লাগে, আপনার থেকে মুক্তি পেলে আমি আমার জীবনে সব থেকে বেশি খুশি হবো।”(রাগান্নিত স্বরে)

উৎস প্রতিক্রিয়াবিহীন হলো। শান্ত চোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধা উৎসের মুখশ্রীপানে তাকালো। উৎসের চোখে চোখ পড়তে থমকে গেলো স্নিগ্ধা। অদ্ভুত চাহনি উৎসের।


সকাল থেকে ব’মি করতে করতে বেশ দুর্বল হয়ে পরেছে সারু। কিছু খেতে পারছেনা, খেলেই ব’মি করে ফেলে দিচ্ছে। শেরহাম বিছানায় শুয়ে থাকা সারুর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মেয়েটা অনেক ঝিমিয়ে গেছে। কতটা দুর্বল হলে চোখ মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সারুর।
শেরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিচু স্বরে বলে উঠলো,,

“সারু! কেমন লাগছে? বেশিই খারাপ লাগছে? ডাক্তারের কাছে যাই?”(নিচু স্বরে)

সারু চোখ মেলে শেরহামের দিকে তাকালো। দুর্বল, অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,,

“ঠিক আছি, ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবেনা। ঘুমাবো।”

শেরহাম সারুর কথার উপরে আর কোনো কথা বললোনা। শুকনো ঢোক গিলে, উঠে গিয়ে সারুর পাশে বসলো। সারুর হাত শক্ত করে ধরে, সারুর কপালে আলতো করে চু’মু খেলো। মৃদু স্বরে বলে উঠলো,,

“ভালোবাসি তোমায়।”(মৃদু স্বরে)

সারু শুনলোনা, ঘুমে আচ্ছন্ন হলো। শেরহাম কিয়ৎক্ষণ ওভাবে থেকে উঠে চলে গেলো।


বিকালকে ছাপিয়ে প্রায় সন্ধ্যা নেমে আসবে নেমে আসবে এমন ভাব। উৎস স্নিগ্ধাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে এসে এখন পতেঙ্গা এসেছে। চারদিকে মানুষে ভরপুর। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সবাই সবার মতো খুশ মেজাজে প্রিয়জনের সাথে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরিবেশটা ভীষণ পছন্দ হবে যে কারোরই। কিন্তু স্নিগ্ধার হলোনা, খানিকটা বিরক্তবোধ করলো। উৎস স্নিগ্ধার হাত ধরে পানিতে পা ভিজিয়ে ধারে হাঁটা শুরু করলো।

“আজকের দিনটা কেমন লেগেছে তোমার?”

উৎসের প্রশ্নে স্নিগ্ধা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,,

“ভালো লেগেছে, তবে আপনি সাথে ছিলেন দেখে ভালোটার থেকে বিরক্ত লেগেছে বেশি। কেনো এমন করছেন আমার সাথে, আমার এমন জোরাজোরি ভালো লাগছেনা। আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিন, আমার দ্বারা কখনো সম্ভব না আপনাকে ভালোবাসা। আপনি কেনো বুঝতে চাচ্ছেন না? প্রথম দেখাতেই আপনি এতসব করতে কিভাবে পারেন? একটা মেয়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে কিভাবে পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে তুলে আনতে পারেন? জোর করে ভালোবাসা আদায় করা সম্ভব নয়। কখনোই নয়।”

উৎস স্নিগ্ধার অদ্ভুত কণ্ঠস্বরের বাক্য বচন শুনে নির্লিপ্ত ভাবে তাকালো স্নিগ্ধার মুখশ্রী পানে। স্নিগ্ধা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। উৎসের ভালো লাগলোনা বিষয়টা। হ্যা, আসলেই তো জোর করে ভালোবাসা হয়না। উৎস ভালোবাসে দেখে কি স্নিগ্ধাকেও বাসতে হবে নাকি? উৎস ভাবলো। ভাবতে ভাবতেই বলে উঠলো,,

“বুঝলাম, তোমার ভালো লাগছেনা। চল যাওয়া যাক।”

উৎস স্নিগ্ধার হাত ছাড়লোনা। মানুষের গায়ের সাথে স্পর্শ না লাগে ওভাবে স্নিগ্ধাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে যেতে লাগলো। গাড়ি যেখানে রেখে এসেছে সেখানে যেতে যেতে পথে দাঁড়ালো উৎস, চারদিকে অনেক কিছুর দোকান। দোকানের মধ্যে কিছু একটা নজরে আসতে উৎস স্নিগ্ধাকে নিয়ে দোকানে গেলো।
একটা ডিজাইন করা কাঠের আয়না, দু জোড়া কাঁচের লাল চুড়ি, কালো টিপ ও কাজল কিনলো।
নিজ হাতে স্নিগ্ধার হাতে কাঁচের চুড়ি পরিয়ে দিলো। টিপের পাতা থেকে একটা টিপ নিয়ে স্নিগ্ধার কপালে পরিয়ে দিলো। কাঠের আয়নাটা স্নিগ্ধার সামনে ধরে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“দেখো, তোমাকে টিপ দেওয়াতে কত সুন্দর দেখাচ্ছে। কাজল তো আমি পরিয়ে দিতে পারবোনা, পড়ে আয়না দেখো। অপরূপ সুন্দর লাগে তোমায়।”

স্নিগ্ধা আয়নায় তাকিয়ে রইলো। বেশকিছুক্ষন তাকিয়ে উৎসের চোখের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধার অদ্ভুত লাগলো, উৎসের চোখে অন্যরকম কিছু একটা আছে। যে অন্যরকম কিছু আজ অব্দি স্নিগ্ধা কারো চোখে দেখেনি তার জন্য।

চলবে..?