নীরবে নিভৃতে পর্ব-০৬

0
125

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

ভর দুপুরবেলা। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেহেক। মেঘলা আকাশ, একটু-আধটু শীতল হাওয়া বইছে । মাঝে মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছোঁয়া এসে লাগছে মেহেকের হাতে । এমন আবহাওয়ায় বাড়িতে থাকতে জানালার পাশে বসে বই পড়তো । গতকাল পল্লব এসেছিল আবারো । মেহেকের সাথে কথাও হয়েছে টুকটাক । তবে কেউ দেখে ফেলার ভয়ে বেশিক্ষণ কথা বলা হয়নি। তবে একটা বিষয় অবাক লেগেছে মেহেকের কাছে। গতকাল দুপুরের পর থেকে রোশন আর ওর ঘরে আসেনি। যদিও বলেছিল রাতে আসবে আর মেহেক সেই মতো নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছিল। মীরা গতকাল রাতে একটা ফল কাটা ছুড়ি দিয়েছিল মেহেককে। সেটা নিয়ে রাতে অপেক্ষা করছিলো মেহেক। প্রাণে মারতে না পারলেও একটা শিক্ষা দিতে চাচ্ছিল ডাকাতের বাচ্চা রসুনকে।

” সুন্দরী! আমার কথাই ভাবছো নাকি?”
জানালার বাইরে থেকে আচমকা রোশনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকাল মেহেক। বৃষ্টির মধ্যে লোকটা জানালার বাইরে কী করছে ভেবে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। রোশন এক হাত কোমরে দিয়ে অন্য হাতে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। উন্মুক্ত শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে ওর। পরনে শুধু একটা ট্রাউজার। মেহেক দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। কেমন যেনো ইতস্তত লাগছে এরকম দেখে। রোশন মেহেকের অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে হেসে জানালা দিয়েই ঘরের মধ্যে ঢুকলো। ভেজা শরীরের পানিতে মেঝে ভিজে যাচ্ছে। মেহেক তাই কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে ওর অদ্ভুত কাজকর্ম দেখছে।
” এভাবে ঘরে এলেন কেনো?”
রোশন এগিয়ে গেলো মেহেকের দিকে। মেহেক পেছাতে লাগলো। কিন্তু রোশনের ক্ষিপ্রতার সাথে ঠিক পেরে উঠলো না মেয়েটা। উন্মুক্ত ভেজা বক্ষের সাথে মেহেককে চেপে ধরলো। কোমরে ব্যথা লাগায় “আহ” করে উঠলো মেহেক।
” সুন্দরী এরকম আওয়াজ করতে হয় না। এসব শুনলে আমি আরো হট হয়ে যাই। ”
” ছাড়ুন বলছি। ”
ছুড়িটা বিছানার নিচে থাকায় সেটার ব্যবহার করতে পারছেনা। এভাবে যে হুট করে জানালা দিয়ে লাফিয়ে বাঁদরের মতো ঘরে ঢুকবে লোকটা তা তো মেহেক জানতোনা।
” বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি! ঘরে সুন্দরী ললনা সাথে হট এন্ড সেক্সি পুরুষ। তা-ও দু’জনে এতো কাছাকাছি! এই তুমি এতো আনরোমান্টিক কেনো হ্যাঁ? ”

রোশন মেহেকের কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বললো কথাগুলো। মেহেকের রাগে মেজাজ খারাপ লাগছে। কবে যে পল্লব এখান থেকে ওকে নিয়ে যাবে!
” আপনার মতো লুচ্চামি আমার দ্বারা হয় না বলেই আনরোমান্টিক মনে হচ্ছে? আমি সুযোগ পেলে আপনাকে প্রাণে মেরে ফেলবো। ”
” মেরে দাও না। কে বারণ করেছে বলো? আমি তো তোমার হাতেই মরতে চাচ্ছি। এসো শেষ করো আমাকে!”
রোশনের থুতনি বেয়ে বৃষ্টির জল মেহেকের ঠোঁটে পড়তেই হেসে উঠলো রোশন। মেহেক হাত দিয়ে দ্রুত ঠোঁট মুছে ফেললো।
” আমার শীত লাগছে। ছাড়ুন প্লিজ।”
মেহেকের কষ্ট হচ্ছে শুনে এক মুহুর্ত বিলম্ব করলোনা রোশন। দ্রুত ওকে বাহুডোর থেকে আলগা করে একটু দূরে সরে দাঁড়াল।
” আমি মীরাকে দিয়ে অন্য জামাকাপড় পাঠিয়ে দিচ্ছি। পোশাক পালটে নাও। ”
মেহেক চুপ করে থাকে। রোশনের নজর পড়েছে এখন মেহেকের গলায়। দ্রুত মেহেকের কাছে এসে গলায় হাত ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করে,
” এখানে কী হয়েছে? এভাবে ছিঁলে গেছে কীভাবে? ”
” অ্যালার্জির সমস্যা আছে। সেজন্য চুলকে চুলকে এই অবস্থা। ”
” আর কোথাও হয়েছে না-কি? ”
” পিঠে হয়েছে। ”
রোশন তড়িৎ গতিতে মেহেককে পিছনে ঘুরিয়ে দিলো। থমকাল মেয়েটা। দুশ্চরিত্র লোকটা কি এখন পিঠ দেখবে? রোশন মেহেকের কামিজের ব্যাক চেইন খুলতে লাগলো।
” খবরদার বলছি! জামা খুলবেন না। আপনাকে দেখতে হবে না। ছাড়ুন বলছি। লুচ্চা, শয়তান, ছাড়ুন…. ”
মেহেক রেগেমেগে আরো কিছু বলতে লাগলো। রোশন তাতে কর্ণপাত না করে একহাতে পেটে হাত রেখে স্থীর করে দাঁড় করিয়ে, অন্য হাতে পুরোপুরি চেইন খুলে দিলো। যতটুকু উন্মুক্ত হয়েছে তাতেই দুই-তিন জায়গায় একইরকম লালচে দাগ দেখতে পেলো রোশন। আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সেইসব জায়গায়। মেহেক যতই রোশনকে ঘৃণা করুক পুরুষালী গভীর স্পর্শে এক মুহুর্তের জন্য হলেও কেঁপে উঠল।
” আমি ঔষধ পাঠাবো রাতে। আজকে আর আসবো না। কাজ আছে আমার। মীরাকে বলবে মলম দিলে লাগিয়ে দিতে। কারণ পিঠে একা একা মলম লাগানো যায় না। ট্যাবলেট দিলে আলাদা কথা। ”
কামিজের চেইন আঁটকে মেহেককে ছেড়ে দিয়ে বললো রোশন। মেহেকের সেদিকে মন নেই এখন। একটু আগে কেনো কেঁপে উঠল সে তারজন্য নিজের উপর তীব্র রাগ হচ্ছে। কতটা ঘৃণ্য এই লোকটা তবুও তার জোর করে করা স্পর্শে কেনো এমন হবে! মেহেকের নীরবতায় রোশন আরকিছু বললো না। বরাবরের মতো ঘাড় কাত করে ইশারায় টাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

প্রায় সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেলেও মেহেকের লোকেশন জানতে পারেনি প্রশাসন। জীবিত নাকি মৃত সে বিষয়ও কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই কারো। মেয়ের এমন পরিণতিতে দিনকে দিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন সিদ্দিক আহমেদ। আনজুম বেগমের অবশ্য সেই নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। রাতের রান্না করছেন আনজুম। এ বাড়িতে তিনবেলা রান্নাবান্না হয়। মিষ্টিকে সেই কখন একটা পেঁয়াজ কেটে দিতে বলেছিলেন তিনি৷ অথচ মেয়ে ফোন নিয়ে বসার ঘরে বসে আছে। রান্না শেষে তাই মেয়েকে কিছু বকাবকি করবে বলে ঠিক করেন তিনি।

” বলো না কবে বিয়ে করবো আমরা?”
ওপাশ থেকে টেক্সট আসতেই মিষ্টির ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। মিষ্টি সোফায় হেলান দিয়ে ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলো,
” আমার এইচএসসি শেষ হোক বাবু তারপর। ”
” ততদিনে তো আমার যৌবন ফুরিয়ে যাবে সোনা। চলো না বিয়ের আগে একটু এনজয় করি? তোমার সব বান্ধবীরাই তো করে বলো?”
মিষ্টি একটু লজ্জা পেলো। কিন্তু খুব ইন্টারেস্ট ফিল করলো কথাটায়।
” ঠিক আছে। কিন্তু বাসায় কী বলে যাবো?”
” বলবে বন্ধুরা মিলে ট্যুরে যাবে। আমি আন্টিকে বলে ম্যানেজ করিয়ে দিবো লাগলে। জানোই তো আমাকে কতটা পছন্দ করেন তোমার মা।”

মিষ্টি শুধু হেসে যাচ্ছে। জীবনের সবথেকে সুখকর মুহুর্তগুলো বুঝি এখনই কাটাচ্ছে সে। অজানাকে জানার জন্য এখন অনুভূতিরা লুটোপুটি খাচ্ছে। প্রেমিকের সব কথায় শুধু হ্যাঁ বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মতের মিল হলেই বুঝি সে চলে যাবে।

” ঠিক আছে। তাহলে আজকেই এসে বলো। কালকেই আমরা বেরোবো।”
মিষ্টি ঠোঁট কামড়ে হেসে রিপ্লাই দিলো। অপরদিক থেকে সাথে সাথে রিপ্লাই এলো।
” ওকে বেবস। কালকে দেখা হচ্ছে তাহলে। উফ ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে। ”
” সেইম টু ইউ বেবি৷ এখন টাটা।”
” ওকে লাভ ইউ। ”
” লাভ ইউ। ”
ডাটা অফ করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো মিষ্টি। সামনেই মা’কে চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কালো। মা কি কিছু বুঝতে পারলো!
” তোকে কখন বলেছিলেন একটা পেঁয়াজ কেটে দিতে! আর তুই এখানে বসে বসে ফোন টিপছিলি? ”
মিষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তাহলে এই কারণে মায়ের রাগ হয়েছে। মিষ্টি তাড়াতাড়ি কান ধরে মায়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে,
” আর হবে না মা। এই দেখো কান ধরে দাঁড়িয়ে আছি! এবারের মতো সরি,সরি!”
” সরি না বলে গিয়ে পড়তে বস। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে ধরে বিয়ে দিয়ে দিবো। ”
আনজুম এতটুকু বলেই চলে গেলেন। মিষ্টি মাথা চুলকে হাসতে হাসতে নিজের ঘরে চলে যায়।

ঠিক দু’দিন পর পল্লব এসেছে আজ। তবে আজ এসেছে লুকিয়ে। নদীতে পাহারা দেওয়ার জন্য বরাদ্দকৃত দু’জন লোককে যথেষ্ট টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে। মেহেককে আগেই বলেছিল আজকে রেডি হয়ে থাকতে। যদিও মেহেকের রেডি হওয়ার মতো এখানে কিছু নেই। যেভাবে আছে সেভাবেই চলে যাবে।
” পল্লব ভাই আমার খুব ভয় করছে। যদি ধরা পড়ে যাই!”
জানালা দিয়ে বাইরে নেমে এসেছে মেহেক। পল্লব দাঁড়িয়ে আছে পাশেই। আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিয়ে পল্লব বলে,
” তুমি শুধু আমার উপর বিশ্বাস রাখো। আর হ্যাঁ আমি যেদিকে যাচ্ছি হাতে হাত রেখে সেদিকে হাঁটতে হবে শুধু। আমরা জঙ্গলের অন্য রাস্তা দিয়ে যাবো। ওদিকে কেউ যায় না। ”
” আচ্ছা। ”
পল্লবের হাতে হাত রেখে মেহেক এগোতে লাগলো। বড়ো বড়ো গাছপালা ডিঙিয়ে চলছে দু’জন। সময়টা এখন বিকেলবেলা। পাখিরা নিজেদের বাসায় ফিরতে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে কিছু পাখি শব্দ করে ডেকে উঠছে। আর তাতেই ভয়ে কেঁপে উঠছে মেহেক। পল্লব অবশ্য বারবার আস্বস্ত করেছে ওকে। তবুও ভয় তো থাকেই! প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর নদীর তীরে এসে পৌঁছল ওরা দু’জন। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে, নদীতে একটা ছোটো স্প্রিং বোট।
” পল্লব তোর জন্য আমরা এতবড় রিস্ক নিলাম। সময়মত আমাদেরও কাজে আসিস তুই। ”
দু’জনের মধ্যে থেকে একজন বললো কথাটা। পল্লব হেসে বললো,
” অবশ্যই ভাই। আসছি আমরা। দেরি হলে সর্বনাশ। ”
” হ্যাঁ যা তোরা। বিষয়টা জানাজানি হওয়ার আগে নদী পেরিয়ে শহরের রাস্তা ধর। আর হ্যাঁ ভুলেও তোদের গ্রামে যাবি না। বস অবশ্যই গ্রামে যাবে খুঁজতে। ”
লোকটার কথায় স্বায় দিয়ে ওরা দু’জন বোটে উঠলো। বোট ছুটতে লাগলো তার আপন গতিতে। মেহেক ভাবছে অন্য কথা রোশন ওকে না পেলে গ্রামে পর্যন্ত হানা দিবে? কিন্তু কেনো? মেহেক ছোটো থেকেই গ্রামে মানুষ হয়েছে। তাই শহর সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই ওর। শুধুমাত্র পল্লবই ওর ভরসা এখন।
” মেহেক! এতো কী ভাবছো? আমি আছি তো। ”
মেহেকের চিন্তাভাবনা বুঝতে পেরে পল্লব কাঁধে হাত রেখে বললো। মেহেক হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
” আমি ভাবছি না।”
পল্লব কিছু বললো না আর।

একমাত্র মেয়ে তিন ধরে বাড়িতে না ফেরায় শোকে পাগলপ্রায় আনজুম বেগম। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেই বেড়িয়েছিল বাড়ি থেকে। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে কোনো বন্ধু কিংবা বান্ধবীর সাথে ঘুরতে যায়নি মিষ্টি। আর অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে গ্রামের কেউ ওকে অচেনা কারো সাথে কোথাও যেতেও দেখেনি। সিদ্দিক আহমেদ রাগের মাথায় যা-ই বলুক কিন্তু এখন উনারও চিন্তা হচ্ছে। দুই মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা উনার। গ্রামের কিছু লোকজন অবশ্য কানাঘুঁষা করে বলছে,
“ একেই বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! নিজের মেয়েকে হারিয়ে দেখ কেমন লাগে। ”
আনজুম কোনো কথায় কান দেয় না এখন। সেই অবস্থাও নেই এখন তার। থানায় মিসিং ডায়েরিও করেছে। কিন্তু পুলিশের উপর বিশেষ ভরসা করতে পারছেন না সিদ্দিক।

রাতের খাবার দিতে মীরা মেহেকের ঘরে এসে দেখে ঘর খালি। চমকায় মীরা। সমস্ত ঘরেও মেহেককে না পেয়ে দ্রুত পা চালিয়ে রোশনের কাছে এসেছে মীরা। রোশন বাবার সাথে বসে তাস খেলছে আর সিগারেট ফুঁকছে।
” ভাই মেহেককে খুঁজে পাচ্ছি না। ”
মীরা কথাটা বলতেই থমকে দাঁড়ালো রোশন। উত্তেজিত হয়ে শুধালো,
” কী বললে মীরা?”
” মেহেক কোথাও নেই। ”
” অসম্ভব এটা! কীভাবে পালাতে পারে ও!”
রোশন এক মুহুর্ত সময় ব্যয় না করে মেহেকের ঘরের দিকে দৌড় দিয়েছে। ছেলের এমন দিশেহারা অবস্থা দেখে রোশনের বাবাও উঠে দাঁড়িয়েছেন।

চলবে,