নীরবে নিভৃতে পর্ব-২৩+২৪

0
101

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_২৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

সকালের নাস্তা শেষে পড়তে বসেছে মিষ্টি। গতকাল সন্ধ্যায় আহনাফ স্যার পড়াতে আসেননি। বিষয়টা নিয়ে মনটা কেমন খচখচ করছে ওর। ওরকম আচরণ করার ফলেই কি স্যার রাগ করলেন? কই রাগ করলে তো ছাতা দিয়ে যেতেন না! তাহলে কী হলো? মিষ্টির মন আজ পড়ায় যতটা তারচে আহনাফ স্যারের উপর বেশি। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, শুক্রবার সকাল সকাল পড়তে বসতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু মায়ের ধমকে পড়তে হয়। তাই হয়তো ভাবনা হিসেবে আহনাফ স্যারকে নিয়েই মনটা ভাবছে!

” মিষ্টি! বাসায় আছো?”

আচমকা রোশনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকাল মিষ্টি। নিজের মনের ভুল কি-না যাচাই করতে এক দৌড়ে সদরদরজার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো। রোশন মেহেককে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে লিমন, ফয়সাল। নিজের বোনকে এরকম অবস্থায় দেখে দিশেহারা লাগছে ওর। দৌড়ে উঠোনে গিয়ে মা’কে ডাক দিলো কয়েকবার। সিদ্দিক আহমেদ বাড়িতে নেই।
” আপুর কী হয়েছে দুলাভাই? ও এমন কোলে কেনো!”
ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে মিষ্টি। এরমধ্যে আনজুম বেগম হাতে সাবান মাখা অবস্থায় মেয়ের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে পুকুর ঘাট থেকে দৌড়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
” আগে ওকে ঘরে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। ভীষণ জ্বর।”
” জামাই! মেহেকের কী হয়েছে? ”
” ঘরে গিয়ে শুনবে। আগে আপুকে ওর ঘরে নিয়ে চলো।”
আনজুম বেগমের প্রশ্নের উত্তর মিষ্টি দিলো। তিনিও চুপচাপ রোশনের পিছু নিলেন। মিষ্টি আগে আগে হেঁটে মেহেকের ঘর কোন দিকে সেটা দেখিয়ে দিলো। মেহেককে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশে বসলো রোশন। লিমন আর ফয়সাল সামনের বারান্দায় চেয়ারে বসেছে। আনজুম বেগম একফাঁকে শরবত দিয়ে এসেছে ওদের।

” প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে জ্বর, ঔষধ এনে খাইয়েছি। কিন্তু ডাক্তার ছাড়া কাজ হবে না মনে হচ্ছে।”

” কী বলো!”

” আপনি প্লিজ ডাক্তারের ব্যবস্থা করুন। এই অবস্থায় ও ডাক্তারের কাছে যেতে পারবে না। আপনারা ডাক্তার বাসায় আনার ব্যবস্থা করুন। টাকাপয়সা যা লাগে আমি দিচ্ছি। কিন্তু ওর চিকিৎসায় যেনো কোনো ত্রুটি না থাকে। ”

আনজুম বেগম মেহেকের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুটা অভিমান বুকে চেপে রেখে বললেন,
” মেয়েটা গেলো সুস্থ আর ফিরলো!”
” আহ মা! মানুষ কি অসুস্থ হতে পারে না বলো? এখানে থাকতে কি কখনো অসুস্থ হয়নি! দুলাভাই তো ডাক্তার দেখানোর জন্যই নিয়ে এসেছে। ”

রোশনের কিছুটা গিল্টি ফিল হচ্ছে। নম্র কণ্ঠে শ্বাশুড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলে,
” মা আমার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ছিলো করেছি। আপনারা তো জানেনই, জঙ্গলে কোনো ডাক্তারকে নেওয়া সম্ভব নয়। ”
” আমি ওর বাবাকে কল দিয়ে বলছি। ডাক্তারকে নিয়ে আসতে পারে কি-না। ”
” পারে কি-না? পারতেই হবে! বেশি টাকার অফার করতে বলবেন বাবাকে। তারপরও না আসলে তুলে আনবো গিয়ে। ”

রোশনের মৃদু হুমকিতে দমে গেলেন আনজুম। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে স্বামীকে কল দিতে নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। মিষ্টি বোনের পাশে বসে কপালে হাত ছুঁইয়ে জ্বরের তীব্রতা বোঝার চেষ্টা করছে। জ্বরের ঘোরে সবকিছু বুঝতে পারলেও কথা বলছে না মেহেক। শরীর খুব দূর্বল। মাথা ব্যথা সাথে আছেই! রোশন মেহেকের অন্য পাশে বসে মিষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করে।

” মিষ্টি একটু জলপট্টির ব্যবস্থা করো তো। ”

” ঠিক আছে দুলাভাই। আমি এখুনি ব্যবস্থা করছি। ”

মিষ্টি তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মেহেকের দু-চোখ বেয়ে জল পড়ছে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে খুব। রোশনের বুকের ভেতর কেমন উথাল-পাতাল করছে সেই জল দেখে। দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। হাত দিয়ে মেহেকের চোখের কোণ মুছে দিলো ও। মেহেককে বালিশ রেখে নিজের কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় রোশন। ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের উপর। আরো আগেই কেনো নিয়ে এলোনা এখানে? ভেবেছিল স্বাভাবিক জ্বর, প্যারাসিটামল খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু নাহ ঘটনা আলাদা। জঙ্গলের পরিবেশে তো মেহেক অভ্যস্ত না। সেজন্য হয়তো কিছু হয়েছে। লোকটার অস্থির মন নানান জল্পনা-কল্পনা করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
” দুলাভাই এই যে, বাটিতে পানি আর রুমাল নিয়ে এসেছি।”
মিষ্টি পাশে বস বললো। রোশন কালক্ষেপণ না করে দ্রুত কপালে ভেজা রুমাল দিলো মেহেকের।

দুপুরের কড়া রোদে উঠোনের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে রোশন। ফয়সাল ও লিমনও দাঁড়িয়ে। ঘরে মেহেককে ডাক্তার দেখেছ। সিদ্দিক আহমেদ মোটা অংকের টাকাপয়সা দেওয়ার কথা বলে অবশেষে গ্রামের সবচেয়ে বড়ো ডাক্তার সিরাজুল ইসলামকে নিয়ে এসেছেন। ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম বেশ কিছুক্ষণ মেহেককে দেখে পরিশেষে জানালেন, ব্লাড টেস্ট করতে হবে। খুব সম্ভবত টাইফয়েড হয়েছে মেয়েটির। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে টেস্ট করানো দরকার। এখুনি চিকিৎসা না করালে জীবন-মরণ সমস্যা হতে পারে। আনজুম মিষ্টির হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন ডাক্তারের কথায়। মিষ্টি ইশারায় চুপ করতে বলে মা’কে।
” তাহলে বিকেলে হাসপাতালে নিতে হবে মেহেককে?”
” হ্যাঁ সিদ্দিক ভাই। কারণ বাড়িতে ওসব টেস্ট করার মতো ব্যবস্থা আমাদের এখানে তো নেই! ”
” ঠিক আছে। বিকেলে নিয়ে যাবো। আমার মেয়েটা ঠিক হয়ে যাবে তো ডাক্তার সাহেব? ”
বাবার আকুতিভরা টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম বললেন,
” একদম ঠিক হয়ে যাবে। শুধু একটু সময় লাগবে। চিন্তা করবেন না। ”
” ঠিক আছে। ”

মেহেক চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। সিদ্দিক আহমেদ ডাক্তারকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন মাত্র। মিষ্টি আর আনজুম ঘরে দাঁড়িয়ে।
” মিষ্টি! ”
বোনের ক্ষীণ আওয়াজে চমকে ওঠে মিষ্টি। সাথে আনজুমও! তড়িঘড়ি করে পাশে বসে দু’জন।
” কী হয়েছে আপু? কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার? ”
” মেহেক? এই মেহেক? মা আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে? ”
দু’জনার সম্মিলিত প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় লাগলো মেহেকের। থেমে থেমে বললো,
” এমনিতে শরীর ব্যথা খুব, মাথা কেমন ভার হয়ে আছে। তাছাড়া ঠিক আছি এখন। বিকেলের পর সন্ধ্যায় আর হুঁশ থাকে না। তোমরা কেমন আছো? ”

” আমরা ঠিক আছি রে। তোকে এতো কথা বলতে হবে না। মিষ্টি তুই মেহেকের কাছে বস। আমি জামাই আর ওর বন্ধুদের হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করে, খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করি। দুমুঠো খেয়ে তারপর আবার হাসপাতালে যেতেও হবে। ”

মেহেক চাইলেও কিছু বলতে পারলোনা। এই মুহুর্তে রোশনকে নিয়ে ক্ষেপে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ওর নেই। মিষ্টিও মায়ের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বসে রইলো।

লিমন আর ফয়সাল গোসল করলোনা। ওরা বিকেলেই ফিরে যাবে, নৌকা পাবে না তখন। তাই নদী সাঁতরে যেতেই হবে। অযথা এখন গোসল না করে তাই হাতমুখ ধুয়ে নিলো দু’জন। রোশন গোসল সেড়ে মেহেকের ঘরের দিকে এগোলো। আনজুম এরমধ্যে মিষ্টিকে ডেকে পাঠিয়েছেন। একা হাতে সব খাবার খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাওয়া মুশকিল! সিদ্দিক আহমেদ মেয়ের সাথে কথাবার্তা বলে গোসল করতে পুকুর ঘাটের দিকে গেছেন একটু আগে।

ভেজা চুলগুলো কপালে ঝুলছে রোশনের। টপটপ করে পানি ঝরছে চুল থেকে। তোয়ালে কাঁধে নিয়েই মেহেকের পাশে বসেছে সে। অর্ধনগ্ন শরীরে, লুঙ্গি আর কাঁধে তোয়ালে থাকায় মেহেকের কাছে লোকটাকে বেশরম ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।

” এখন কি একটু ভালো লাগছে সুন্দরী? এমন ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছো যে!”

রোশনের দুষ্ট হাসির ঝিলিকে মেহেকের কপাল কুঁচকে গেলো। সাথে ভ্রু উঁচিয়ে সে বললো,

” দেখার মতো কিছু থাকলে তো দেখবো? সবাই দেখেছে যা তা আমি কেন দেখবো? নেহাৎ এটা আমার বাবার বাড়ি, তাই চিল্লাতে পারছি না। ”

রোশান মেহেকের মুখের উপর ঝুঁকে দু-হাত বালিশের দুইপাশে রেখে মুচকি হাসলো। এরমধ্যে রোশনের চুল থেকে কয়েক ফোঁটা পানি চুইয়ে পড়লো মেহেকের ললাটে। বিরক্ত লাগছে ওর।

” সবাই যা দেখেনি সেসব দেখতে চাও তুমি? তাহলে দেখাই?”

পাশ ফিরে শুয়ে রোশানকে সরাতে চাইলো মেহেক। কিন্তু শরীর দূর্বল হওয়ায় পারলোনা। রোশন নিজে থেকেই উঠে দাঁড়ালো।

” আমার কিছু দেখার ইচ্ছে নেই। আপনি যান এখন, খেয়ে আসুন।”

তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রোশান ফিক করে হেসে উঠলো।
” কেয়ার করলে! খেয়ে আসতে বললে সুন্দরী? ”
” মোটেও না! এখান থেকে সরানোর জন্য বলছি। ”
” তাহলে ঠিক আছে। আমিও ভাবছিলাম, ভুতের মুখে রামনাম! ”

চলবে,

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_২৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রোশান মেহেকের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো।
” কেয়ার করলে! খেয়ে আসতে বললে সুন্দরী? ”
চোখেমুখে দুষ্ট হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো রোশন। মেহেক চেহারায় বিরসভাব ফুটিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করে।
” মোটেও না! এখান থেকে সরানোর জন্য বলছি। ”
” তাহলে ঠিক আছে। আমিও ভাবছিলাম, ভুতের মুখে রামনাম! ”
মেহেক চুপ করে রইলো। এরসাথে অহেতুক কথা বলার মতো এনার্জি নেই এখন। কথায় কথা বাড়বে। তারচেয়ে একা একা বকে খেতে চলে যাক বরং হুহ!

বিকেলে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো মেহেককে। রোশন অবশ্য সাথে গেলেও একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছে। চেহারা ঢাকার জন্য মুখে অবশ্যই মাস্ক পরে নিয়েছে লোকটা। মেহেক বাড়িতে এসেছে দেখে এমনিতেই আশেপাশের লোকজন রোশনের কথা বলাবলি করছিল দুপুরে। প্রতিবেশীরা তো মিষ্টির কাছে বারকয়েক জিজ্ঞেসও করেছিলো,
” তোর ডাকাত দুলাভাই এসেছে? ”

মিষ্টি অবশ্য কৌশলে কথা এড়িয়ে গেছে। তবুও সাবধানে থাকতে হয়। জীবনে এই প্রথম নিজের এই কাজকর্মের জন্য বিরক্ত লাগছে রোশনের। নিজের স্ত্রী অসুস্থ অথচ সাথে হসপিটালের ভেতর যেতে পারছে না। এরচেয়ে অশান্তির কি আরকিছু আছে? নাহ! রোশনের কাছে এরচেয়ে অশান্তির কিচ্ছু নেই আপাতত । মিষ্টি আর সিদ্দিক আহমেদ সাথে আছে মেহেকের। তবুও অস্থিরতা কমছে না রোশনের। অপেক্ষা করা কতটা তিক্ত তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছো। প্রায় একঘন্টা পরে মেহেককে দেখতে পেলো রোশন। বাবা ও বোন মিলে মেহেককে ধরে ধরে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসছে। রোশন আর নিজের জায়গায় স্থির থাকতে পারলোনা। পকেট থেকে কালো রঙের সানগ্লাসটি চোখে পরে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে মেহেকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রোশন। জ্বর বেড়েছে বলে ভালো খেয়াল নেই ওর। একটু পর জ্বর আরো বাড়বে বৈ কমবে না।
” আমি দেখছি। ”

শ্বশুর আর শ্যালিকাকে ইশারায় মেহেককে ছাড়তে বলে, কোলে তুলে নিলো বউকে। সিদ্দিক আহমেদ দ্রুত পা চালিয়ে অটোরিকশা ঠিক করতে এগোলেন। মিষ্টি রোশনের সাথে সাথে হাঁটছে।
” কী বললেন ডাক্তার? আর ঔষধ নিতে হবে না? ”
ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে রোশন। মিষ্টি ধীরস্থিরভাবে বলে,
” টাইফয়েড হয়েছে। ঔষধে কাজ হবে না এখন, ইনজেকশন দিয়েছে। তবে সাথে আনুষঙ্গিক কিছু ঔষধ আছে। বাবা গাড়ি ঠিক করে আমাদের আগে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর হয়তো ঔষধ কিনবে। বুঝতেই পারছেন, আপনাকে কেউ চিনে ফেললে মহা ঝামেলা হবে। ”
মিষ্টির কথায় কোন ভুল নেই। সবকিছুই বুঝতে পারছে রোশন। তাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। এরমধ্যে সিদ্দিক আহমেদ ইশারায় একটা অটোরিকশার দিকে এগোতে বললেন মিষ্টিকে। মিষ্টি রোশনকে ইশারা করতে মেহেককে নিয়ে সেদিকে এগোলো।

আজকের ইনজেকশন করে দিয়েছে ডাক্তার। সাতদিন ইনজেকশন নিতে হবে, পাশাপাশি নিয়মমাফিক চলাফেরা করতে হবে। আনজুম বেগমের সহায়তায় মিষ্টি মেহেকের শরীর মুছিয়ে দিয়েছে। ঘেমে-নেয়ে থাকলে সমস্যা। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে রোশন। আজকে থেকে গেলেও কালকে অবশ্যই জঙ্গলে ফিরে যেতে হবে তাকে। কিন্তু কীভাবে কথা না বলে, দেখা না করে থাকবে? এমন একটা অবস্থা জঙ্গলে নেটওয়ার্কও খুব স্লো! বিরক্ত লাগছে সবকিছু।

” কই! কই? ”
মেহেকের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই অস্থির হয়ে উঠলো রোশন। মেয়েটা জ্বরের ঘোরে কিছু একটা বলছে। রোশন দ্রুত এগিয়ে মেহেকের পাশে বসলো। মেয়েটার চোখমুখ এই কয়দিনে কেমন হয়ে গেছে! ঠোঁটগুলো কেমন ফ্যাকাসে, চোখের নিচে কালচে দাগ, শুকিয়ে গেছে শরীরও।
” কী খুঁজছ সুন্দরী? কী লাগবে বলো!”
মেহেক পিটপিট করে রোশনের দিকে তাকিয়ে আছে। ম্লান হেসে একটা হাত রোশনের গালে রাখলো। চমকাল রোশন। পরক্ষণেই মনে হলো সবকিছুই তো ঘোর!
” এ তো খে..য়াল কেনো রাখো বজ্জাত লোক?”

থেমে থেমে শুধালো মেহেক। রোশন ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসলো। এবার সত্যি সত্যি তার ডাকাত রাণী তার সাথে কথা বলছে। তবে স্বাভাবিক থাকলে এসব কখনোই বলতো না সে বিষয় নিশ্চিত। প্রিয়তমার পাশে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে বললো রোশন,
” বজ্জাত লোক সেজন্য। ”
” বদের হাড্ডি একটা! ”
” আর কোনো কিছু আছে? অসভ্য, লুচ্চা? ”
” আছে…এ তো। দূরে সরররো।”
রোশনকে হাত দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেও ক্লান্ত শরীরে সেটা মেহেকের পক্ষে সম্ভব হলো না। রোশন মেহেকের মাথা তুলে নিজের বুকের উপর রাখল।
” সকালেই চলে যাবো। তারপর চাইলেও কিছুদিন কাছাকাছি থাকতে পারবোনা তোমার। তাই আজকের রাতটা আর হাতছাড়া করবোনা। সারারাত বুকে জড়িয়ে ধরে রাখবো। ”
রোশনের কথায় একটু নড়েচড়ে উঠলো মেহেক। কিন্তু কিছু বললো না। চুপ করে গেছে। কী বুঝলো মেয়েটা কে জানে! রোশন ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই নড়েচড়ে উঠলো সে। আবেশে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রোশনকে। লোকটা মৃদু হেসে আর কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

পরের দিন সকালে আচমকা লোকজনের চেঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো মেহেকের। সকালবেলা জ্বর কম আজ। তবে শরীর দূর্বল। বাইরে কী হচ্ছে দেখার জন্য শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। কিন্তু হাঁটার মতো শক্তি শরীরে নেই মনে হওয়াতে মিষ্টিকে ডাক দিলো কয়েকবার। মিনিট পাঁচেক পরে মিষ্টি এলো মেহেকের ডাকে।

” আপু তুমি ঠিক আছো? কিছু লাগবে? ”
” ঠিক আছি রে। বাইরে কী হচ্ছে? ”
” ভাইয়াকে খুঁজতে পুলিশ এসেছে, সাথে পাশের বাড়ির লোকজন আর গ্রামের লোকজন। ”
মিষ্টির কথায় আঁতকে উঠল মেহেক। আশেপাশে নজর বুলিয়ে কোথাও রোশনকে না দেখে আতংক বাড়লো বৈ কমলো না।
” উনি কোথায়? ”
” ভাইয়া ফজরের নামাজের পরেই চলে গেছে। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে বলে ডাকেনি।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেহেক। যাইহোক, পুলিশ এসে রোশনকে নিয়ে গেলে সিদ্দিক আহমেদের বদনাম হতো।

ভরসন্ধ্যা! টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। আজ দু’দিন পর আহনাফ এসেছে মিষ্টিকে পড়াতে। ঘরে ঢুকে ছাতা পাশে রেখে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসেছে আহনাফ। মিষ্টিও নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসে আছে। পরীক্ষা প্রায় শেষের পথে। আহনাফের মুখাবয়ব দেখে ভাবনার অতলে হারিয়েছে মেয়েটা। চেহারা কেমন উষ্কখুষ্ক লাগছে, মলিনও!
” কী দেখছ! আসলে আমি দুঃখিত মিষ্টি। অসুস্থ থাকায় এই দুই দিন আসতে পারিনি। ”
আহনাফের কথায় নড়েচড়ে উঠলো মিষ্টি। কী অদ্ভুত! জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল আগে ওর, স্যার কেনো আসেনি কিংবা অসুস্থ ছিলেন কি-না! অথচ বেচারা নিজে থেকেই সবকিছু বলে যাচ্ছে।
” ব্যাপার না স্যার। আসলে আপু এসেছে তো সেজন্য আপনার খোঁজ নেওয়া হয়নি। নয়তো বাবা গিয়ে জেনে আসতেন, আপনার কী হয়েছে! ”
” হ্যাঁ শুনেছি। মেহেকের কী অবস্থা এখন?”
” আগের থেকে একটু ভালো। ”
” ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি বরং পড়া শুরু করো। ”
” জি।”

মিষ্টি বাধ্য ছাত্রীর মতো পড়ায় মনোযোগ দিলো। তিন দিন আগে জ্বর এসেছিল আহনাফের। এখন অবশ্য নেই। পেটে ঔষধ পড়ায় কমে গেছে। সেজন্য যে পড়ানো রেখে ঘরে বসেছিল বিষয়টা তেমনও নয়! মন খারাপের অসুখে ভুগছিল এ ক’দিন। একটা মানুষ কীভাবে আরেকটা মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে পারে নিজের সাথে তেমন ঘটনা না ঘটলে কেউই হয়তো বুঝতে পারে না। আয়েশা! এই মেয়েটা গ্রামে এসেছে, বাবার বাড়ি। সাথে স্বামী ও সন্তানও এসেছে বটে। সেটা স্বাভাবিক কিন্তু তার সুখের সংসারের গল্প আহনাফকে শোনানো অস্বাভাবিক। একটা সময় যে মানুষটার পাশে অন্য কারো নামও সহ্য করতে পারতোনা আহনাফ, আজ সেই মানুষটির সাথে অন্য কাউকে দেখতে হয়! এ যে কী ভীষণ যন্ত্রণা তা কাউকে বোঝাতে পারে না আহনাফ। ভালোই থাকে তারপর মাঝে মধ্যে আয়েশার হুটহাট কল এলোমেলো করে দেয় ওকে। এমনটা নয় যে আয়েশার নম্বর রেখে দিয়েছে আহনাফ, কিন্তু আয়েশা মাঝে মধ্যে নতুন নতুন সিম দিয়ে কল করে। কী শান্তি পায় আহনাফকে কষ্ট দিয়ে তা বুঝতে পারে না ভুক্তভোগী আহনাফ! যে মানুষটার সাথে দীর্ঘ সময় আমরা অতিবাহিত করি, ভবিষ্যতে ঘর বাঁধবো বলে স্বপ্ন বুনি হুট করে সেই মানুষের বদল ভীষণ বিশ্রী। আর এই বিশ্রী ব্যাপারটা কাটিয়েই আমাদের চলার পথে এগোতে হয়। আহনাফও আপ্রাণ চেষ্টা করছে এগিয়ে যাওয়ার। তবে এই এগোনোর পথটা বড্ড অমসৃণ ওর জন্য।

চলবে,