#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৩৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” তুমি আমার প্রাক্তন স্ত্রী’র সন্তান। ”
” প্রাক্তন স্ত্রী! আমার মা আছে? আমার মা! কোথায় আমার মা? বাবা প্লিজ একটু পরিষ্কার করে বলো সব। আমার… আমার কেমন পাগল পাগল লাগছে।”
সবুর রোশনের কাঁধে হাত রেখে নিজেও মাটিতে বসলেন। সময় এসেছে এখন, সবকিছু প্রথম থেকে খুলে বলার…..
রোজী সবুরকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর একেবারে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল সবুর। দীর্ঘ সময়ের পরে অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়েছিল সবুর। এভাবেই সময় অতিবাহিত হতে থাকে। সবুর নিজের রাজত্ব সামলাতে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু একুশ বছর পর সবুর একদিন জানতে পারে রোজীর একটা ছেলে সন্তান আছে। কিন্তু রোজীর হাসবেন্ড নেই। বিষয়টা জানার পর সবুরের মনে হতে থাকে রোশন হয়তো তারই ঔরসজাত সন্তান। এসব ভেবে মনে মনে খুব খুশি হয়। কিন্তু রোজীর বিষয় আরো ভালো করে খোঁজ খবর নিতে হতো। হাসবেন্ড বর্তমানে নেই বলে যে আগেও ছিলো না তেমনটা না-ও হতে পারে। সবুর তাই রোজীর পিছনে লোক লাগিয়ে দিলো। কয়েকদিন পর জানতে পারলো রোশন সবুরের ছেলে না। ওর বাবা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। উনি মারা গেছেন প্রায় আট বছর হলো। নতুন করে সৃষ্টি হওয়া আশা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল সবুর। রোজীর সব সুখ কেড়ে নিবে বলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে উনার। রোশনকে রোজীর থেকে দূরে সরিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করবে বলেই ঠিক করে। কিন্তু শহরে গিয়ে রোশানকে কিছুতেই কিডন্যাপ করা সম্ভব ছিলো না। তর্কে তর্কে ছিলো সবুর। একদিন বন্ধুদের সাথে শহরের বাইরে ঘুরতে গেলো রোশন। আর সেখানেই রোশনকে কিডন্যাপ করে সবুর। মাথায় আঘাত করার ফলে তখুনি মেমোরি লস হয় ওর। এতে অবশ্য সবুরের সুবিধাই হয়। রোশনের মস্তিষ্কের সাদা পৃষ্ঠায় নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু লিখে দিয়েছিলেন সবুর। এমনিতেই রোশন ছিলো উচ্ছৃঙ্খল। নেশা করা, মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করাই ছিলো ওর স্বভাব। তাই জঙ্গলে সবার সাথে বছরখানেক যেতেই বেশ মিশে যায়। ঠিক ছয় বছর আগে রোশনকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন সবুর। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রোশনকে নিজের ছেলের মতোই ট্রিট করেছেন তিনি। সময় যত গড়িয়েছে রোশনের প্রতি উনার ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছে। রোজীকে ঘৃণা করুক আর যাই করুক রোশনের মধ্যে রোজীর ছায়া খুৃঁজে পেতেন সবুর। পরে অবশ্য বছর দুয়েক পর জানতে পারেন রোজী মারা গেছে। ছেলের শোক আর নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্যই পরলোকগমন করেন ভদ্রমহিলা। সবুরের সেদিনও ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। ভালোবাসার মানুষ সাথে না থাকলেও একই পৃথিবীতে আছে জেনেও একটু স্বস্তি মিলতো। কিন্তু মানুষটা আর নেই এটা সহ্য করা কষ্টকর।
” কী হয়েছে মিষ্টি? ঘুম আসছে না? ”
বিছানায় শুয়ে বারবার এপাশ-ওপাশ করার জন্য উপরোক্ত প্রশ্নটি করে আহনাফ। মিষ্টির অস্থির লাগছে। আহনাফের বুকের উপর মাথা রাখল।
” না। খুব অশান্তি অশান্তি লাগছে। ”
” মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুমাও। সকালে কলেজে যেতে হবে তো। ”
” হুম।”
মিষ্টি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ফেলে। আহনাফ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সংসারের পাশাপাশি লেখাপড়াও চলছে ওর। বাসায় কাজ করার জন্য আলাদা একজন লোকও রেখেছে আহনাফ। রান্নাবান্না, পড়ালেখা সবকিছু একসাথে সামলানোর মতো ক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি মিষ্টির। সত্যি বলতে আহনাফ নিজেও আজ চিন্তিত। দেশের খবরাখবর জানে ও। কিন্তু প্রার্থনা করা ছাড়া আর কী বা করতে পারবে ও!
মাটিতে মুখোমুখি বসে আছে বাবা ছেলে। মেহেক ঠিক আগের জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘর জুড়ে পিনপতন নীরবতা। সবুর হোসেন অপরাধীর মতো দৃষ্টি নত করে আছে। রোশনের চোখে চোখ রাখার মতো শক্তি আজ উনার নেই। রোশনের দু-চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সত্যি বলতে সামনে থাকা মানুষটার উপর রাগ করার কথা থাকলেও করতে পারছে না রোশন। আবার নিজের মা পৃথিবীতে নেই, স্মৃতিপটে তার কোনো ছবি নেই এসব ভেবে রাগে-দুঃখে অসহায় লাগছে। মেহেক বুঝতে পারছে না ওর কিছু বলা উচিত কি-না। এরমধ্যে দরজায় লিমনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকাল সবাই।
” ভাই! প্রশাসনের লোকজন আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। বস কোথায়! উনার ঘরে তো নেই ! ”
লিমনের কথা শেষ হতেই বসা থেকে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালেন সবুর,সাথে রোশনও। কীভাবে কী হলো বুঝতে পারছে না। জঙ্গল ঘেরাও করলো অথচ কেউ কিচ্ছু টের পেলো না!
” সুন্দরী তুমি এখানেই থাকো। আমি না আসা পর্যন্ত ঘর থেকে বেরোবে না। ”
রোশন কথা শেষ করেই বাবার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। লিমনকে সাথে নিয়ে তিনজন ছুটলো সামনের দিকে। এরমধ্যেই মেহেকের কর্ণকুহরে গুলির আওয়াজ ভেসে এলো। আঁতকে উঠল মেয়েটা। বাইরে রোশন একা! আসন্ন বিপদের আঁচ করতে পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মেহেকও।
বাইরে বেরিয়ে বিস্ময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছল রোশন। সবুর হোসেন লিমনকে নিয়ে অস্ত্র বের করতে। সবাই যে যার ঘরে ছিলো অথচ বাইরের পাহারারত লোকগুলোর লাশ পরে আছে। তাহলে কি সাইলেন্সার লাগানো ছিলো ওদের বন্দুকে? হ্যাঁ সেজন্য গুলির আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। তখন তাহলে এসবের আওয়াজই শুনেছিল রোশন। কিন্তু সবুর হোসেনকে দেখে বিষয়টা বুঝতে পারেনি। দু’টো হেলিকপ্টার আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। আশপাশ থেকে মাইকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। প্রশাসন সবাইকে আত্মসমর্পণ করতে বলছে বারবার।
ডেপুটি আইজিপি রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে আজকের অপারেশন করতে এসেছে পুলিশের বিগ্রেড ফোর্স। হেলিকপ্টারে বসে সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছেন উনি। আইজিপি স্যারের নির্দেশ কোনো ডাকাত অস্ত্র নিয়ে ঝামেলা করতে গেলেই যেনো সরাসরি গুলি করা হয়৷ এদেরকে শুধু আত্মসমর্পণের সুযোগ দিচ্ছে এটাই বেশি। আধুনিক দেশে এরকম ডাকাতদের থাকার কোনো মানেই নেই।
” স্যার আমরা তাহলে এগিয়ে যাচ্ছি ভেতরের দিকে। ”
জঙ্গলের ভেতর থেকে অফিসার রাকিব ডেপুটি আইজিপির থেকে অর্ডার চাইলো।
” ওকে। ”
রিজভী অর্ডার করতেই সবাই এগোতে লাগলো সামনে। এদিকে সবুরসহ বাকিরা নিজেদের অস্ত্র নিয়ে এরমধ্যেই নেমেছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হলো বন্দুকযুদ্ধ। মেহেক দিকবিদিকশুন্য হয়ে রোশনের নাম দিয়ে ডাকতে ডাকতে দৌড়াচ্ছে। রোশনসহ সবাই এখন পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে ব্যস্ত। জঙ্গলে বসবাসকারী সকল পাখপাখালি গুলির আওয়াজে নিজ বাসা ত্যাগ করছে।
” রোশন! রোশন! কোথায় আপনি? ”
মেহেকের যেদিকে দৌড়ে যাচ্ছে সেদিকেই মাটির লুটিয়ে পড়ে আছে লাশ। এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখে ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছে মেয়েটা। এমন সময় হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে বসে পড়ে মেহেক।
” মীরা আপু! মীরা আপু আমার রোশনকে খুঁজে পাচ্ছি না গো। তুমি কি দেখেছো?”
মেহেক পাগলের মতো মীরাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শুধালো। মীরা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,
” না মেহেক। তুমি বাইরে এভাবে থেকো না। যেকোনো সময় গুলি লেগে যেতে পারে। চলো ঘরে চলো। ”
মেহেকের উত্তরের অপেক্ষা না করে মীরা ওর হাত ধরে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু মেহেক কিছুতেই ঘর গিয়ে বসে থাকতে পারবে না।
” মীরা আপু প্লিজ আমাকে ছাড়ো! আমি রোশনকে খুঁজবো। ”
” জেদ করো না মেহেক। তোমার শরীর খারাপ। ”
মীরা আর মেহেক দু’জন দু’জনার সিন্ধান্তে অটল। কথায় যখন কাজ হলোনা তখন মেহেক বাধ্য হয়ে নিজের হাত হেঁচকা টানে ছাড়িয়ে নিলো। মীরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো জঙ্গলের অন্য দিকে। মীরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। এই অসহায়ত্ব কীসের তা মেহেক বুঝতে পারবে না।
শান্তর নিথর শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই রোশন চিৎকার করে উঠলো। সবুরও তাকাল সেদিকে। লিমনসহ বাকিরা এগিয়ে গেলো শান্তর কাছে। কিন্তু নাহ! শোক দেখানোর মতো সময়ও নেই ওদের। একের পর এক গুলি ছুড়ছে পুলিশ।
” বস আমরা আত্মসমর্পণ করলেও ওরা আমাদের বাঁচতে দিবে না। তারচে আজ মরবো না হয় ওদের মারবো। ”
” আমরা ওদের সাথে পারবো না লিমন। ”
লিমনের কথার পরিপ্রেক্ষিত বললো সাদাত। রোশন গুলি ছুড়ছে সাথে সবুরও। সবাই গুলি করতে করতে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে।
” বাবা আমার মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে কেউ আছে যে প্রশাসনকে সাহায্য করেছে। নইলে এভাবে আক্রমণ করা ওদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ”
রোশনের মুখে বাবা ডাক শুনে ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে সবুর। ছেলেটা তাহলে ভুল বোঝেনি উনাকে।
চলবে,