পদ্ম ফুলের অভিমান পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0
557

#পদ্ম_ফুলের_অভিমান (পর্ব:17) শেষ পর্ব
#লেখনীতে_নাফিসা_আনজুম

পদ্মকে ওটি থেকে বের করে আলাদা এক রুমে রাখা হয়েছে,পাশে একজন নার্স দাড়িয়ে আছে,মুখে অক্সিজেন মাস্ক,মাথার চারপাশে ব্যান্ডেজ,চোখঁগুলো বন্ধ, ঠোঁটগুলো যেনো শুকিয়ে গেছে,কেমন যেনো বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে, পদ্মকে এভাবে দেখতে হবে তা কখনো ভাবি নি,আর সহ্য হচ্ছে না এরকম, চোখেঁর পানি ছেড়ে দিয়ে ভাবে নিলয়।এতোক্ষন ও ওই রুমের সামনে গিয়ে জালানা দিয়ে পদ্মকে দেখতে থাকে আর কথাগুলো ভাবে,কারন নার্স ছাড়া অন্যকারো প্রবেশ নিষেধ তাই বাহিরে থেকেই দেখছে নিলয়,,
ফিরে আয় পদ্ম, দেখ আমি চলে এসেছি আর যাবো না তোকে ছেড়ে। তুই আমাকে ছেড়ে যাস না পদ্ম।

-পেছন থেকে নিলয়ের আব্বু এসে নিলয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে,
এখন তুমি শান্ত হও নিলয়, ভরসা রাখো আল্লাহর ওপর। সব ঠিক হয়ে যাবে।

-কখন ঠিক হবে আব্বু ডাক্তার কেনো বললো, মাথায় আঘাত পেয়েছে অনেক রক্ত ঝরেছে,এক ঘন্টার আগে ঙ্গান না ফিরলে আমার পদ্মকে ওরা বাঁচাতে পারবে না। কেনো এভাবে বললো আব্বু,আমার পদ্মর কিচ্ছু হতে পারে না,,

-বাবা দেখো, আল্লাহর ওপর কারো হাত নেই, ডাক্তাররা তো চেষ্টা করে বাঁচানোর কিন্তু বাকিটা তো ওপর আল্লাহর হাতে,চলো তুমি এশার নামাজ পরে আল্লাহর কাছে তোমার পদ্মকে চাইবে চলো।

-হ্যাঁ আব্বু ঠিক বলছো, আমি এক দৌড়ে হাসপাতালের পাশেই একটা মসজিদে চলে আসলাম।পেছন পেছন আব্বুও আসলো। ওজু করে নামাজ পরে নিলাম।

একঘন্টা পার হয়ে গেছে কিন্তু ডাক্তাররা এখনো কোনো খবর দিতে পারে নি,নামাজ পরে এসে দেখি পদ্মকে আবারো ওটিতে ঢোকানো হয়েছে,কি হয়েছিলো বা এখন কেমন আছে এখনো জানা হয় নি,আম্মু জিজ্ঞেস করলেও কি হয়েছিলো তা শুনতে পায় নি,আমি আব্বু আম্মু তিনজনে ওটির সামনে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছি।
আরো একঘন্টা পর একজন নার্স বের হয়ে কিছু ঔষধ আনতে বললো আর আল্লাহকে ডাকতে বললো। কেনো জানি মনের মধ্যে একটু আশার আলো দেখতে পেলাম মনে হয়, মনটা বলে উঠলো আমার পদ্ম ঠিক হয়ে যাবে। তারাতারি করে ঔষধ নিয়ে এসে দিলাম। বিশ মিনিট পর ডাক্তার বের হয়ে এসে বললো, মনে হয় না আর সমস্যা হবে,রোগির অবশ কেটে গেলে ঠিক হবে ইনশাআল্লাহ, তবে ঠিক হলেও ওনাকে কখনো কোনো কিছু নিয়ে প্রেশার দেওয়া যাবে না, লক্ষ্য রাখতে হবে রোগি যেনো কখনো কোনো কিছু নিয়ে উত্তেজিত না হয়, নাহলে কিন্তু আবারো….

ডাক্তারকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বলে উঠলাম,না না আমরা ওকে কখনো কোনো কিছু নিয়ে প্রেশার দেবো না,

ডাক্তার মুচকি হেসেঁ বললো, সেটাই ভালো, আর হ্যাঁ আপনার মতো ছেলে কমে আছে যে তার বউকে এতো ভালোবাসে,আপনাকে দেখে যা বুঝলাম মেয়েটা বড়ই ভাগ্যবতি।

,,,

একঘন্টা ধরে বসে আছি পদ্মর পাশে,অপারেশন শেষে ওকে আবারো আগের রুমটাতে রাখা হয়েছে, একজন নার্স ও আমাদের সাথে আছে আমি ওর মাথার কাছে আর আম্মু পায়ের দিকে বসে আছে। আব্বু মনে হয় বাহিরে গেছে খাবার আনতে, এর মধ্যে পদ্মর বাবা আর ওদের পাশের বাসার একটা ছেলে আসে। পদ্মর বাবার দু চোখঁ ফুলে আছে মনে হয় সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে,এসে পদ্মকে দেখে থমকে যায়,
মেয়ে মানুষ হলে হয়তো সবার সামনেই কাঁদতো কিন্তু ছেলে মানুষ তো, আড়ালে কাঁদলেও সবার সামনে এসে পাথর হয়ে যায়। আমার কাছে আসলে আমি উঠে দাড়িয়ে মামাকে বসার সুযোগ করে দিলাম উনি পদ্মর মুখের দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে চোখেঁ আসা পানিটুকু মুছে নিলেন।

এর মধ্যে আব্বুও এসে গেছে খাবার নিয়ে, ওনার সাথে আসা ছেলেটাকে আমি চিনি,পদ্ম ওনাকে ভাইয়া বলে ডাকতো আগেও দেখেছি মামা বাড়িতে গেলে,ও আমাকে একপার্শে ডেকে নিয়ে বললো,
চাচা সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে ভাই, আর আমাকে শুধু বলেছে জোড়ে চালাতে,বৃষ্টির কারনে আমাদের ঐদিকে রাস্তাও খারা*প ছিলো যতোটা সম্ভব জোড়ে চালিয়েছে।
আমি বললাম কে বলেছিলো আপনাদের,

কে বলেছিলো যে তা জানি না, সন্ধ্যার আগে চাচা আমাকে গিয়ে বললো পদ্ম এ*ক্সি*ডে*ন্ট করেছে তারাতারি বাইক বের কর এক্ষুনি যেতে হবে, যেমন ছিলাম তেমনি শুধু বাইক বের করে তখুনি বের হয়ে এসেছি।

হুমম, অনেক তারাতারি এসেছো

কথা বলতে বলতে মনে হলো পদ্ম হাত নাড়াচ্ছে, আমি দৌড়ে গিয়ে পদ্মর সামনে বসলাম, আসতে আসতে চোখঁ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। ইতিমধ্যে নার্স গিয়ে ডাক্তারকে খবর দিয়েছে ডাক্তার এসে আবারো পদ্মকে দেখে বললেন, এখন একদম ঠিক আছে, আর রোগীর সাথে কম কথা বলবেন।

পদ্ম একে একে সবাইকে দেখলো, ওর বাবাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলো মায়ের কথা। মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই ওর বাবা বললো,
হ্যাঁ ভুলেই গেছিলাম,তোর মা মনে হয় অপেক্ষায় আছে কখন ফোন দেবো। আসতে চেয়েছিলো কিন্তু ওকে নিয়ে আসতে গেলে অনেক সময় লাগতো আর তুর্য খুব জ্বা*লা*তন করে তাই রেখে এসেছি, ওকে বলা হয় নি এতো গুরুতর কিছু, আমাকে তো তোর শশুর শুধু বলেছে ছোট্ট একটা এ*ক্সি*ডে*ন্ট। এখানে না আসলে জানতেই পারতাম না,,

পাশে থেকে আব্বু বলে উঠলো, কিভাবে বলতাম এতোটা। এরকম বললে কোনো বাবা-মা কিভাবে সহ্য করতো, আসতে পারতে কি এতোটা পথ, তখন নিজেই তো অসু*স্থ হয়ে যেতে।

পদ্ম সবার সাথে কথা বললো শুধু আমার সাথে ছাড়া, আমাকে দেখে একটু হেসেছেই যা আর কিছু বলে নি, সবার সাথে কথা শেষ হলে একে একে সবাই বের হয়ে গেলো আমি একপাশে দাড়িয়ে ছিলাম, সবাই চলে গেলে ওর পাশে বসে পদ্মর এক হাত আমার হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম,
আমার পদ্ম ফুল কি এখনো আমার ওপর অভিমান করে আছে।

পদ্ম আসতে আসতে উত্তর দিলো,
তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চেয়েছিলে কেনো,আর অভিমান করে থাকলে কি তোমাকে আনতে যেতাম।

আমি একটু হেসেঁ, ওর কপালে একটা ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে বললাম,আর ছেরে যাবো না গো।

-আর যেতে দিলে তো

একদিন পর পদ্মকে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। কাল রাতে আব্বু আম্মু আর মামাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আমি একাই থেকেছি, আজকে মামা বাড়িতে গিয়ে মামিকে নিয়ে আসছে।

এতোক্ষন নিলয়ের মুখ থেকে কাহিনি শুনলাম,এখন পদ্মর থেকে শুনবো।

বাড়িতে এসে সবার সাথে দেখা করে নিলয় ভাইয়াকে বললাম হাত ধরো ওপরে যাই, কিন্তু উনি সেটা না করে আমাকে সবার সামনে কোলে তুলে নিলো

-এই এটা কি করছো,

-কি করছি

-সবার সামনে কোলে নিলে কেনো,

-আমার বউকে আমি কোলে নিয়েছি কার কি

-ধ্যাত বলে ওনার গলা জরিয়ে ধরলাম

সেদিন থেকে যে শুরু হলো আমার যত্ন আর কোনো ছাড় নেই, প্রথম কয়েকদিন শুধু তরল জাতীয় খাবার খেয়েছি কিন্তু তারপর থেকে সকালে দুধ,ডিম,কলা,কমলা,দশটার মধ্যে ভাত,বারোটার মধ্যে গোছল তারপর আবার ভাত, দেড় মাসে তেতাল্লিশ কেজি থেকে হয়ে গেলাম বায়ান্ন কেজি,,
নিলয় ভাইয়া পড়াশুনা একদম নিষেধ করে দিলো।

,,

সময় চলমান, দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেছে, আমি আর সেই আগের আমি নেই এখন অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে,বাবা অবসর নিয়েছে, নিলয় ব্যাবসার হাল ধরেছে,,আর আমি, আমি আজ একজন সফল ডাক্তারের একজন। সেদিন নিলয় ভাইয়া নিষেধ করলেও আমি সে কথা শুনি নি, একটু সুস্থ হতে না হতেই আমি আবারো পরাশুনা চালিয়ে গেছি কেনোনা আমার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হওয়া। নিলয়ের মতো স্বামি আর এমন শশুরবাড়ি পেলে পড়াশুনার সময় মাথায় প্রেশার পরবে না। যখন কোনো সমস্যা হতো নিলয় ঠিক কিছু না কিছু করে আমার মন ভালো করে দিতো।

আজকে নানু বাড়িতে যাবো। নিলয়কে রেডি হতে বলে নিজেও রেডি হয়ে নিলাম, পরশ পাথরকে আগেই রেডি করে দিয়েছি, পরশ আর পাথর এসে বলছে আমরাও যাবো পাপা বলেছে।

-হ্যাঁ তোমরাও তো যাবে,একদম দু*ষ্টুমি করবে না কিন্তু,
না আম্মু একদম দু*ষ্টুমি করবো না,,
এই হলো আমার জমজ ছেলে আর মেয়ে। বয়স দুই ছুঁই ছুঁই। আধো আধো কথা বলে,, দুজনেই একদম বাবার মতো সবকিছু ধৈর্য নিয়ে করে,শুধু মাঝে মাঝে একটু দুষ্টু*মি করে আর আমি ব*কা দিলে বাবার কাছে বিচার দেবো।

আমি রেডি হয়ে ওদের নিয়ে নিচে নামলাম,মা বাবাকে বলে বাহিরে এসে ওদের গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। মা বাবাকেও যেতে বলছিলাম কিন্তু ওনারা বললো এখন তোরা গিয়ে ঘুরে আয়,পরে আমরা যাবো।

নানুবাড়িতে আসতে আসতে বিকেল হয়ে এসেছে, রাস্তায় জ্যাম ছিলো না জন্য তারাতারি আসতে পারলাম। সেই যে এসেছিলাম নানু বাড়িতে তারপর আর আসা হয় নি, আমি যেতেই সবাই দৌড়ে আসলো গাড়ির কাছে, তুর্য আসতেই পরশ পাথর দৌড়ে মামার কাছে গেলো ও বসে দুজনকেই জরিয়ে ধরলো, মামাকে দেখে দুজন খুব খুশি। নিলয় নেমে সবার সাথে কথা বলছে আমি এক পা দুই পা করে এগিয়ে গেলাম এক সাইডে দাড়িয়ে থাকা চার/পাঁচ বয়সি একটা মেয়ের দিকে। খুব চেনা চেনা লাগছে মুখটা। তারপর মনে পরলো প্রায় তিন বছর আগে ফোন এ ছবিতে দেখছিলাম এই মেয়েটাকে। এখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। হাতে
আমার দেওয়া ব্রেসলেট। এই হলো অবনি,আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে,আমি এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলাম। পেছন থেকে শুপ্তি এসে বললো, অবাক করা কান্ড যে মেয়ে আমি ওর বাবা আর দাদি ছাড়া আর কারো কোলে ওঠে না সে আজ তোমার কোলে উঠলো যাকে সে কখনো দেখেই নি।
আশেপাশে অনেকেই এসে বললো, আসলেই তো অবনি পদ্মর কোলে উঠছে যাকে ও দেখেই নি। আমরা নিতে চাইলে তো চিল্লিয়ে দৌড় দেয়।
অভ্রের কথা উঠতেই বললাম, অভ্র ভাই এখন কি করে,

-ছয় মাস জে*ল খাটার পর, এখন এসে ঔষধের দোকান দিয়েছে আর পাশাপাশি গরুর খামার সাথে জমিজামা দেখাশুনা করে।

-তা দিনকাল কেমন যাচ্ছে,

-আগের থেকে ভালো গো, আগে তো ওর চরিত্র নিয়ে ভয়ে ছিলাম কিন্তু এখন সেই ভয়টা নেই। মেয়েকেও অনেক ভালোবাসে।

আমি হেসেঁ উঠলাম। অবনি আমার গলা জরিয়ে ঘারে মাথা দিলো। আমি ওকে কোলে নিয়ে সেদিনের ঐ ধানক্ষেতের দিকে এগোলাম। সেদিন এসেছিলাম সকালে আজ আসলাম সন্ধ্যায়। তবে একটাই মিল এখনো সবুজ ধানক্ষেত। চারিদিকে তাকাতে তাকাতে এতোগুলো বছরের সৃতিচরন করলাম। আনমনেই একটু হেসেঁ উঠলাম। আমার সঙ্গ দিলেন নিলয়। কই থেকে যেনো এসে আমাকে জরিয়ে ধরে বললো অভ্রের মেয়েটা কিন্তু বেশ মিষ্টি দেখতে।

হুমমম

চলো না আমরা আবারো একটা পুঁচকে নেই,

এই দুইটারে সামলাতেই বারোটা বাজে আবারো,,

হুমম আবারো,

প্রেশার দিচ্ছো,

এই এই না একদম না, আমাদের আর পুঁচকে চাই না,,

নিলয়ের ভয় পাওয়া দেখে আমি হেসেঁ উঠলাম, একটু পর নিলয় ও হেসেঁ উঠলো।

সমাপ্ত