পরিযায়ী জীবন পর্ব-০৩

0
17

#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ৩)

মেহরাব মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। এখানে তার বন্ধু ইমতিয়াজকে দেখিয়ে আর্জেন্ট বেশ কিছু টেস্ট করতে দেয়। ইমতিয়াজ এতদিন পর বন্ধুকে পেয়েছে সেই সাথে তার মাও আছেন তাই তাদের নিয়ে খাবারের জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করে কিন্তু মেহরাব অন্যদিনের কথা বলে বের হয়ে আসে। সে মাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। আজ মা ছেলে মিলে ভোজন বিলাস করবে। সাজেদা মানা করলেও মেহরাব সেসব কানে তোলে না।

মেহরাব মাকে নিয়ে ৫তারকা টাইপ একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। মেন্যু বুকটা নিয়ে মাকে বুঝিয়ে বলে এখানে কী কী খাবার পাওয়া যাবে। তারপর মা কী খেতে চায় জানতে চায়। সাজেদা বলে-

-আমি এইসবের কী বুঝি? তুমি একটা কিছু দিয়া দাও। কিন্তু খাবারের যা দাম… মাগো মা!

মেহরাব হেসে বলে- আম্মা, তোমার ছেলে কত কামায় জানো? তুমি খাবে না তো এসব খাবে কে?

সাজেদার চোখে পানি এসে যায়। তার এই রাজপুত্রের ভাগ সে কী করে কাউকে দিবে?

মেহরাব মায়ের ভালো লাগবে এমন কিছু খাবার অর্ডার করল। তারপর খেতে খেতে অনেক গল্প করল। সাজেদা এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে ফেলল-

-বিজরীর কথা কিছু জানতে চাস না?

মেহরাব অস্বস্তি বোধ করল। বিজরীর কথা জানতে চায় না এমনটা কী হতে পারে? যাকে ভুলবার জন্য প্রতি মুহূর্ত মনে রাখে আর সে কেমন আছে এটা জানতে চাইবে না? কিন্তু সেসব কিছু প্রকাশ না করে বলল- যা চলে গেছে তাকে আর টেনে এনো না।

-আনব না, কিন্তু কিছু কথা তোর জানা দরকার। বিজরীর বাবা বছরখানেক আগে আমার কাছে আসছিল। তোর কথা জানতে চাইল। একপর্যায়ে সে কাটা কলাগাছের মত ভাইঙা পইড়া বলল-

“ভাবি, আপনারা তো জানেন আমি খুব উচ্চ বংশের ছেলে। আমার চলনে বলনে সব সময় সেই অহংকারের ছাপ রেখেই চলেছি। অথচ আমি নিজেকে তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। নিজ যোগ্যতায় এই ৫তলা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি। ছেলেটা তবু মেধা ভালো ছিল বলে নিজের চেষ্টায় আজ PHD নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ী হয়েছে। মেয়েটাও পড়াশোনায় ভালো ছিল। আমার বংশে সবাই দেশ বিদেশে নামকরা সব পজিশনে আছে। গর্ব করতাম সব সময় সেসব নিয়ে। কিন্তু নিজে তেমন কিছু করতে পারিনি বলে বংশের বা পরিবারের সবার কাছে বরাবরই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয় ছিলাম। তাই ছেলে মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করে ভালো বংশে বিয়ে দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি ফেলনা নই। ছেলেটা আমেরিকা গিয়ে নিজের পছন্দে বিয়ে করে ফেলল, আমাদের জানাবার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করল না! খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তাই বিজরী এমন কিছু করে ফেলবে ভেবে তার আগেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইলাম। সে যে সজীবকে পছন্দ করে, তাকেই চায় সেটা আমার অজানা ছিল এমন না। সজীব ছেলে হিসেবে চমৎকার, এত বড় ডাক্তার, সব দিক থেকে ভালো। কিন্তু তার বংশ? আমার কাছে যেখানে ভালো বংশই সব কিছু সেখানে সজীবের তো কোন জন্ম পরিচয়ই নেই! যদিও শেষ পর্যন্ত আপনি জানিয়েছিলেন সজীব পরিচয়হীন নয় তারপরও তার প্রতি আমার মনোভাবের কোন পরিবর্তন হল না। তারপর যা হবার তাই হল… ধরে বেঁধে মেয়েটাকে উচ্চ বংশ দেখে বিয়ে দিয়ে দিলাম। মেয়েটা আমার উপর পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। আমি বুঝতেই পারলাম না তার সাথে কত বড় অন্যায় করে ফেলেছি! তারচেয়েও বেশি অন্যায় করেছি সজীবের সাথে। আমার অন্যায়ের মাশুল আমার মেয়েকে এভাবে দিতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।”

কথাগুলা বইলা সে চোখের পানি ফেলল। পুরুষ মানুষ তো সহজে চোখের পানি ফেলে না। ভাইসাব মনে মনে খুব যন্ত্রণায় আছে।

সাজেদা এই পর্যায়ে এসে থামলেন। মেহরাব দেশ ছাড়ার পর বিজরীর কোন খোঁজই নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। খোঁজ নেবেই বা কোন যুক্তিতে? কিন্তু বিয়ে হবার পর কী এমন ঘটেছে বিজরীর সাথে যে, তার বাবা এভাবে ভেঙে পড়েছে? বিজরীর জন্য তার বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল। সে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল- “কী হয়েছে বিজরীর?”

-বিয়ের এই প্রস্তাবটা দেখে বিজরীর বাবা এক বাক্যে রাজি হয়ে যায়। ছেলের উচ্চ বংশ, নামকরা ব্যবসায়ী পরিবার, অঢেল টাকা পায়সা। বাবার ব্যবসার সাথে সাথে ছেলে তার নিজের আলাদা ব্যবসা দেখে। ছেলের বাবা নাকি বিজরীকে এত পছন্দ করছে যে তারা বিয়ের জন্য সময় নিতে চায় না। বিয়ের জন্য খোঁজ খবর নেওয়ার কোন সুযোগই ভাইসাব পাইল না। তড়িঘড়ি বিয়েটা হয়ে গেল। কে জানত যে এই তড়িঘড়ির পিছনে অন্য কিছু ছিল? বিয়ের রাতেই জামাই বাসরঘরে মাতাল হয়ে ঢুকল। সে বিজরীর সাথে কোন কথাই বলতে পারে নাই। একে তো বিজরীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়া তার উপর এইসব দেখে ও ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে গেল। পরেরদিন সকালবেলা জামাই ঘুম থেকে জাইগা বিজরীর সাথে যা তা ব্যবহার। বিজরী কিছুই বুঝল না তার সাথে কেন এমন করে? জানতে চাইলে জামাই সাথে সাথে তারে অপমান করা শুরু করে। সে নাকি টাকার লোভে বড়লোক ছেলের গলায় ঝুইলা পড়ছে! বিজরী প্রতিবাদ করতে গেলেই তার গালে চড় দিয়া বসে! বিজরীর ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। সে রাগে, দুঃখে, অপমানে আর কোন কিছুই বলে নাই। সেদিনই তো বউ-ভাত ছিল, ছেলে বিজরীর সাথে আসে কিন্তু থাকেনাই। জামাইর এইভাবে চলে যাওয়ায় ভাইসাব অনেক চিন্তিত হয়ে গেল। বাড়ি ভর্তি মানুষ… সে সবাইকে জানায়- জামাইর অনেক বেশি জরুরি কাজ এসে পড়ায় যাইতে হইছে। নিজের এত বড় ব্যবসা… সে না গেলে তো চলবে না। কিন্তু এইসব কথা কারো মনে ধরল না। সবাই কানাঘুষা শুরু করল। বিজরীর দোষই দিতে লাগল সবাই। জামাই ধরে রাখার মুরদ নাকি নাই তার। নিশ্চই অন্য কোন ঘটনা আছে। জামাই এমন কিছু দেখছে, জানছে তাই সে থাকে নাই নয়ত নতুন বউ রাইখা কেউ কাজে যায়? ওদিকে বিজরী কোন কথাই বলল না। দুইদিন পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে নিতে আসল কিন্তু সেদিন জামাই আসে নাই। ভাইসাব জামাইর কথা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে বলল- “ছেলের অনেক ব্যস্ততা… এত বড় ব্যবসা তার উপর নতুন আরেকটা ব্যবসা শুরু করেছে তাই খুব চাপ যাচ্ছে। চাইলেই সব জায়গায় যেতে পারে না।” “চাইলেই সব জায়গায় যেতে পারে না” কথার সূক্ষ্ম অপমানটা ভাইসাব ধরতে পারল না তা না। কিন্তু কথাটা হজম করে নেয়। ধরে নিছে আসলেই তো ব্যস্ততা অনেক। আবার বিজরী মানায় নিতে পারতেছে কিনা সেই ভয়ও তার ভিতরে জাইকা বসছে। ভাবল, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই মেয়েকে তাদের সাথে পাঠায় দিল। বিজরী কিছু না বইলা ব্যাগ গুছায় চইলা গেল। যাবার ৪দিন পর বিজরীকে তার বাবা আনতে যায়। তিনি যেয়ে বুঝলেন তার এবাড়ি আসাটা অনেকেই ভালো চোখে দেখতেছে না। কেউ ভালো করে কথা বলল না। তারে নিচে ড্রইংরুমেই বসায় রাখছে অনেকক্ষণ। এর মধ্যে কেউ আগায় আসে নাই। বিজরীর শ্বাশুড়ি এসে একবার দাঁড়ায় থেকেই দুই একটা কথা বলে ভেতরে চলে গেল। তার খটকা লাগল… নতুন বিয়ে, সে তো মেয়েকে নিতে আসবেই। এখন তো ঘনঘন যাওয়া আসা চলবে। তাছাড়া সে না জানায়াও আসে নাই। তখন বিজরী নিচে নাইমা আসে। মেয়ের দিকে তাকায় ভাইসাব চমকায় যায়, এই ৪দিনেই বিজরীর চেহারা কেমন শুকায় শ্যাষ! চোখের নিচে কালি পড়ছে, কপালে একটা কাটা দাগ। বউ-ভাতের দিনও বিজরীর ঠোঁট কাটা দেখছিল। জিজ্ঞেস করলে বলছিল- “অন্ধকারে সুইচ খুঁজতে যেয়ে দরজায় ধাক্কা লেগে কেটে গেছে। আজকে কপালে কাটা দাগ। এইসব তো ভালো কিছুর লক্ষ্মণ না! কী হইতে পারে? মুখে মেকাপ করা, বিজরী তো সহজে মেকাপ করে না। মেকাপ কী তাইলে কিছু আড়াল করার জন্য? ভাইসাব তখন তারে জিজ্ঞেস করল “কোথাও যাবি নাকি এখন?” সে “না” বলল। তখন ভাইসাব নিশ্চিত হয়ে গেল কী হইছে। দুঃখে তার কলিজা ফেটে যাবার অবস্থা। সে মেয়েকে একটা কথাই বলল- “ব্যাগ গুছা, বাড়ি যাবি।” বিজরীর শ্বাশুড়ি এসে বলল- “বিজরী কয়েকদিন পর যাবে। আপনি এসেছেন ভালো কথা, খেয়ে দেয়ে তারপর বাড়ি চলে যান।” এই কথা শুনে ভাইসাব অবাক হইল না, কারণ যা বুঝার সে ততক্ষণে বুঝেই গেছে। সে চোয়াল শক্ত করে বলছে- “আমি বিজরীকে নিতে এসেছি নিয়েই যাব। বিজরী যা ব্যাগ নিয়ে আয়। না আনলেও সমস্যা নেই, আমি আছি তুই এক্ষুনি চল, আমি আর দেরি করব না। আমার হাতে সময় নাই।” বিজরীর শ্বাশুড়ি কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু ভাইসাব তারে কিছুই বলতে দেয় নাই। সে বিজরীকে নিয়ে সোজা বের হয়ে আসে। সে মনের মধ্যে এত চোট পাইছে যে, বিজরীর সাথে ওইবাড়িতে কী হইছিল সেটাও জিজ্ঞেস করার সাহস করল না। বাড়ি এসে বিজরীর শ্বশুরকে ফোন করে কড়াভাবে জিজ্ঞেস করে ঘটনা জানতে চায়। তিনিও বুঝতে পারেন আর লুকায় রাখা যাবে না তখন অকপটে সব স্বীকার করে যে, ছেলে নাকি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে নাই। তার নিজের পছন্দ ছিল। এই কথায় ভাইসাব উত্তেজিত হয়ে যায়। কারণ প্রস্তাব ছেলের বাবা নিজে দিছে। তিনি ছেলেকে জেনে শুনে এই কাজটা কেন করল??? এই কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ছেলের ব্যাপারটা তিনি জানতেন। ছেলে নাকি তাদেরই এক উড়নচণ্ডী আত্মীয়ের মেয়েকে পছন্দ করে যাকে তার একদমই পছন্দ না। ওই মেয়ে মোটেও সংসারী না। তিনি নিজে বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে বিয়ে করে সারা জীবন অশান্তিতে কাটিয়েছেন তাই ছেলের বউ হিসেবেও এমন মেয়ে চায় নাই। তার অফিসের কারো মাধ্যমে সে বিজরীর খোঁজ পায় আর মেয়ে দেখে পছন্দও হয়ে যায়। তাই বাসায় না বলেই সে প্রস্তাব নিয়ে আসে। ভাইসাবের কাছেও প্রস্তাব খুব পছন্দ হয় তাই দুজনে তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়। ছেলে বাপের চাপে পড়ে বিয়ে করে ঠিকই কিন্তু বিজরীকে এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে দেয় না। পয়সার লোভে বিয়ে করছে বইলা বিয়ের রাত থেকেই কথায় কথায় গালাগালি করে। বিজরী প্রতিবাদ করতে গেলেই গায়ে হাত তুলে। এরপর শুধু হাতে মারছে তা-ই না। তার সাথে জোরজবরদস্তি, হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারা সবই করছে। ছেলে যেই মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছিল সে তার মায়ের চাচাত বোনের মেয়ে ছিল। তাই বিজরীর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করার পরেও শ্বাশুড়ি কিছুই বলত না। নতুন বউয়ের সাথে যারা এমন করে সেখানে মেয়েকে কেমনে রাখে? বিজরী ভাইসাবের অতি আদরের… তাই সে এইসব সহ্য করতে পারে নাই। ছেলের বাপ পরে মাফ চাইছে। বলছে- “আমি ভেবেছিলাম বিজরীর রূপ আর গুণ দেখে আমার ছেলেটা সব ভুলে যাবে কিন্তু… ও আর ওর মা মিলে মেয়েটার উপর এমন অত্যাচার করবে তা আমি কল্পনাও করিনি। মেয়েটার জীবন আমি নষ্ট করে দিলাম… আমি ভুল করেছি তাই এটা আমিই শোধরাবার চেষ্টা করব।” তিনি তার স্ত্রী সন্তানকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো লাভই হয় নাই। বিজরীর বাবাও ভাবছিল আরও কিছুদিন দেখি? কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তনই হইল না বরং খারাপের দিকেই গেল। পুলিশের ভয় দেখায়ও কোন কাজ হইল না। শেষে হাল ছেড়ে দেন। বিয়ের প্রায় ৬মাসের মাথায় ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়। বিজরীর শ্বশুর এখনো যোগাযোগ রেখেছেন। বিজরীকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করেন। ওর জন্য অনেক ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে কিন্তু বিজরী আর বিয়ে করতে রাজি হয় নাই।

টানা এত কথা বলে সাজেদা থামলেন। মেহরাব তখন অতীতে ফিরে তাকায়… বিজরী বরাবরই খুব নরম মনের একটা মেয়ে। শেষ বিকেলের আলোর মতন। তার থেকে মাত্র ৪ বছরের ছোট বিজরী। কলেজ লাইফ থেকে সে বিজরীকে দেখে বড় হয়েছে… বিজরীর নাড়িনক্ষত্র সব তার জানা। পপড়াশোনার প্রয়োজনে বিজরী সব সময় তার কাছে ছুটে এসেছে। দুই পরিবারে একটা সুসম্পর্ক থাকায় দু’বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল তাদের। কত দুষ্টুমি আর মজা করেছে। কতশত স্মৃতি জমা আছে তার বুক পকেটে! বিজরী ভার্সিটিতে ভর্তি হবার ২ বছর যেতেই বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। আর তখন থেকেই মেহরাব বুঝতে শুরু করে সে বিজরীকে ভালোবাসে! সে তখন নানানভাবে বোঝার চেষ্টা করতে থাকে বিজরী কী ভাবছে? এক সময় বুঝে যায় বিজরীও তাকে চায়। তারা দুজনেই টের পায় খুব সন্তর্পণে তাদের সম্পর্কটা গুটিগুটি পায়ে ডালপালা মেলে হিয়ার মাঝে শীতলপাটি বিছিয়ে দিয়েছে। যেটা এতদিন কেউই টের পায়নি! তারপরের কয়েকটা বছর খুব ভালোই কাটল। এক সময় তাদের দুই পরিবারই তাদের সম্পর্কটা টের পেয়ে যায়। মেহরাব তখন ইন্টার্নি শেষ করে ভালো একটা প্রাইভেট জব পেয়ে গেছে। মেহরাবের বাড়িতে সবাই তার বউ হিসেবে বিজরীকেই ভেবে রেখেছে। কিন্তু বিজরীর বাবা বেঁকে বসলেন। তাকে কোনোভাবেই বোঝানো গেল না। এই বোঝাবুঝিতে কেটে গেল আরও একটা বছর। একটা মানুষের বর্তমান আর তার সকল অর্জনকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র তার বংশ পরিচয় দিয়েই তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে বিচার করা হবে এটা মেহরাবকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিল। নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মনে হতে লাগল। নিজের পরিচয় জানতে না পারার যে কষ্ট সে মনের ভেতর চেপে রেখে এতকাল কষ্ট পেয়েছে সেদিনের সেই অপমানের কাছে ওই কষ্ট নিতান্তই ক্ষুদ্র মনে হল। অস্তিত্ব সঙ্কটে ভোগা মেহরাব তখন একটাই সমাধান পেল, এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। তারপর সে কাউকে কিছু না জানিয়ে কানাডায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। খুব দ্রুতই সব কিছু গুছিয়ে পাড়ি জমায়। সাজেদা অনেক চেষ্টা করে আটকাতে কিন্তু পারে না। তারপর কেটে গেছে অগোছালো ৩ টা বছর… মেহরাব স্মৃতি থেকে ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যেটা সাজেদার নজর এড়ালো না। ছেলেটার জন্য তিনি কী কম কষ্ট পান? মেহরাব বলল- আম্মা চলো, উঠি?

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে মেহরাব চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল। সাজেদা বুঝতে পারছে তার ছেলে এই মুহূর্তে খুবই বিচলিত অবস্থায় আছে। সে ভুলেই গেছে মাকে নিয়ে অন্য কোথাও যেতে চেয়েছিল। তিনি এব্যাপারে আর কিছু বললেন না। সারাটা পথ মেহরাব চুপ করে রইল। বাড়ি ঢুকেই সে ওবাড়ির বারান্দাটায় তাকায়। বিকেলে মাধবীলতার আড়ালে দেখা বিষণ্ণ মুখটা যদি আরেকবার দেখতে পেত?

চলবে