পান পাতার বৌ পর্ব-০৬

0
146

#পান_পাতার_বৌ
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি

শর্বরীর চুল টেনে ধরে তাকে ঘরের মেঝেতে ফেললেন আরজু বেগম। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সে। শেষরাতের দিকে ঘুমিয়েছিল। দু’ঘণ্টাও ঠিকমতো ঘুম হয়নি। আচমকা ঘুম ভেঙে এমন দৃশ্যে শর্বরী ধাতস্থ হতে পারে না।

-“আমার শান্তি সহ্য হয় না তোর? মরিস না কেন তুই? জন্মাইছিলি কেন? ডাইনী পয়দা করছি আমি একটা! সংসারটা খেয়ে ফেল আমার!”

শর্বরী কী বলবে বুঝতে পারছে না। শফিক আহমেদ বাড়িতে নেই। থাকলে নিশ্চিত আরজু বেগমকে আটকাতেন। এমতাবস্থায় শর্বরীর কিছু করারও নেই। তার মন বলছে তার বিয়েটা ভেঙে গেছে এবং ভাঙার পেছনের কলকাঠিটা যে শর্বরী নেড়েছিল তাও বোধহয় আরজু বেগম আন্দাজ করেছেন। শর্বরীকে ঘরে তালাবদ্ধ করে আরজু বেগম বেরিয়ে গেলেন। শর্বরীর মাথা যন্ত্রণা করছে। মা এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? রক্তের সম্পর্কের টানও কি নেই? দীর্ঘশ্বাস ফেলল শর্বরী। ভয়েস মেইলটা তবে সীমান্ত শুনেছে আর শুনেই বিয়েটা ভেঙেছে। ভালোবাসা কর্পূরের মতো উবে গেছে! জানা কথা এটা। সব মধুর কথা এখন হাওয়া হয়ে গেছে। মানুষের এত রঙ কেন? কই শর্বরীর তো এত রঙ নেই! সে এত বেরঙ কেন? আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ পড়ে শর্বরীর। মায়ের আঘাতে ঠোঁটের খানিকটা নিচে কেটে রক্ত বের হচ্ছে। শর্বরী রক্ত মুছলো। আপাতত কয়েকটা দিন যে এমন শতশত আঘাত আসবে তা তো নিশ্চিত! সহ্য করতে পারবে শর্বরী? কিন্তু কেন সহ্য করবে সে? চাইলেই তো দূরে কোথাও চলে যেতে পারে তবুও কেন তাকে সহ্য করতে হবে?

______________

-“মা তুমি ফাজলামি শুরু করছো সকালবেলা? বিয়েটা ভেঙে দিছো মানে কী? কেন ভেঙেছো?”

-“কেন ভেঙেছি জানিসনা? এই নে ফোন। এইটা শোন।”

সীমান্ত ফোন নিতেই একটা ভয়েস বেজে উঠলো,”দুঃখিত সীমান্ত। আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমি চাইনি একটা মিথ্যে দিয়ে এ সম্পর্ক শুরু করতে। আপনাকে আগেও বলতে গিয়েছিলাম। পরিস্থিতি সহায় ছিল না। আমার ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যেস আছে। একবার হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পাশে পড়েছিলাম সারারাত। পরবর্তীতে ওষুধ নিতে শুরু করি। আপনার কাছে এটা কত বড় ব্যাপার হবে জানিনা তবে সত্যটা জানিয়ে রাখলাম। এরপর বিয়েটা হবে কিনা তাও জানিনা তবুও মিথ্যে দিয়ে সূচনাটা না হোক!”

সীমান্তর মুখের ভাবভঙ্গিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না দেখে সালমা খানম বিরক্ত হলেন। তার ইচ্ছে করছে ছেলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। বলদ ছেলেটা! অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে করতেও যেন তার আপত্তি নাই!

-“হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বুঝেছিস কেন বিয়ে ভেঙেছি?”

-“নাহ। তুমি এই কারণে বিয়ে ভেঙেছো যে মেয়েটা ঘুমের মধ্যে হাঁটে? মা! সিরিয়াসলি?”

-“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস সীমান্ত? তুই একটা মেয়েকে বিয়ে করবি যে ঘুমের মধ্যে ভূতের মতো হেঁটে বেড়াবে? ঘাস খাইতে গেছে তোর ব্রেন?”

সীমান্ত কথা বাড়ালো না। শর্বরীর সাথে কথা বলতে হবে তাকে এ মুহূর্তে। সীমান্ত নিজের ঘরে এসে শর্বরীর নম্বরে কল করলো।

-“হ্যালো।”

-“আমার মেয়েকে আর বিরক্ত করো না সীমান্ত। ও এমনিতেই ভেঙে পড়েছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এভাবে পিছু হটলে তোমরা! একটা সামান্য রোগ যা ওষুধেই সেরে যেতো। আমার মেয়েকে এভাবে কষ্ট না দিলেও পারতে!”

-“আন্টি, আমার শর্বরীর সাথে কথা বলা দরকার। ওকে ফোনটা দিন।”

-“তোমার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। আর চেষ্টা করো না যোগাযোগ করার, সেটাই ভালো।”

সীমান্তর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। কেউ তার কথা শুনছে না কেন!

-“আমি শর্বরীকে বিয়ে করবো এখনি। আপনি রাজি না থাকলে নাই। আমি আসতেছি। কথাবার্তা আর আমি বলার মুডে নাই!”

সীমান্ত কল কেটে দিল। আরজু বেগমের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আগুন সঠিক জায়গাতেই ঢেলেছেন তিনি! এখন শফিক আহমেদকে নিয়ে একটু ঝামেলা। তাকে ব্যস্ত রেখে শর্বরীকে সীমান্তর সাথে পাঠাতে পারলেই হলো! দ্রুত পায়ে শর্বরীর ঘরের তালা খুললেন তিনি। শফিক সাহেব বেরিয়েছেন কোথায় যেন। এটাই সুযোগ। শর্বরীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি থেকে বার করতে হবে।

-“শর্বরী, সীমান্ত আসতেছে।”

-“মানে? কেন?”

-“জানিনা। বলতেছে তোকে বিয়ে করতে চায়। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুই বরং গিয়ে কথা বল। বাড়িতে তোর বাবা যদি জানতে পারে…”

-“তুমি চিন্তা করো না মা। আমার ফোনটা দাও। আমি কথা বলি।”

-“ফোনে কথা বলে হবে না। তুই গিয়ে আটকা ওকে আগে।”

-“মা উনি বাসে উঠে পড়লে?”

-“দেখ কী করবি!”

শর্বরী ভালোই মুসিবতে পড়লো। কাঁধের ব্যাগ আর ফোনটা নিয়ে ছুটলো বাসস্ট্যান্ডের দিকে। দু’ঘণ্টার পথ। সীমান্ত বাসে আসবে? কী যে! সীমান্তকে কল করলো শর্বরী।

-“কোথায় আপনি? মা’কে কী বলেছেন? আপনি আসছেন মানে কী? কেন আসবেন আপনি?”

-“চুপ! বাসস্ট্যান্ডে যাও, চুপচাপ বাসে উঠে পড়ো আর বাস কোন রুটে আসতেছে আমায় বলো।”

-“কেন বলবো?”

-“না বললে পুলিশ হয়েও গুণ্ডার মতো তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবো, দেখতে ভাল্লাগবে?”

শর্বরী হকচকিয়ে গেল। টিকিট কেটে বাসে উঠে পড়লো। সীমান্তর কথামতো কিছুক্ষণ পর পর বাসের রুট বলতে লাগলো তাকে। ঘণ্টা দেড়েক হওয়ার আগেই বাস হঠাৎ করে থেমে উঠলো। হেলপার নেমে কী যেন কথা বলে ভেতরে এসে শর্বরী নামের মেয়ের খোঁজ করতে লাগলো। শর্বরী ভাবলো বোধহয় তার বাবা সব জেনে লোক নিয়ে এসেছে। ভয়ে তার হাত পা কাঁপতে লাগলো। পরক্ষণেই খেয়াল করলো বাসের সামনে সীমান্তর বাইক। ইউনিফর্ম পড়ে হিরোর মতো বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। শর্বরী রাগে কটমট করতে করতে বাস থেকে নামলো। বাস যথারীতি ছেড়ে দিল। শর্বরী রাগান্বিত ভাব নিয়েই সীমান্তর মুখোমুখি দাঁড়ালো।

-“সমস্যা কী আপনার?”

-“কোনো সমস্যা নেই। বাইকে উঠো।”

-“উঠবো না আপনি। আমার জীবন নিয়ে ফাজলামি শুরু করছেন আপনি? বিয়ে ভেঙে এখন আবার কী? দয়া দেখাতে আসছেন?
আপনার দয়ার জন্য আমার জান যাচ্ছে?”

-“নাহ! তোমার জন্য আমার জান যাচ্ছে। এখন সব কথা বাদ, আমার সাথে চলো।”

-“কোথায়?”

-“বিয়ে করতে!”

শর্বরীর রাগ হচ্ছে প্রচণ্ড। সীমান্ত মজা করছে তার সাথে? কী ধরনের মজা এটা?

-“আপনি কী চান টা কী?”

-“তোমাকে।”

-“পরে আফসোস করবেন এমন সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভালো।”

-“তুমি যেন আমার আফসোস না সও, সে ব্যবস্থাই করছি। তুমি কি চুপচাপ বাইকে বসবে নাকি তোমার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগাবো? তখন কিন্তু পুরো রাস্তা আমার হাতে হাত আবদ্ধ রেখে যেতে হবে।”

শর্বরী কথা বাড়ালো না। সীমান্ত বাইকে ওঠার আগে হঠাৎ থামলো। মলিন কণ্ঠে বললো,” শর্বরী তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরি?”

সীমান্তর আকুতিটা অন্যরকম লাগলো শর্বরীর। ইচ্ছে করলো তৎক্ষণাৎ সীমান্তকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে কিন্তু শর্বরী অনুমতি দিল না। সীমান্তর ম্লান মুখ আরো খানিকটা ম্লান হয়ে এলো। সীমান্ত বাইকে বসার আগেই শর্বরী পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। শর্বরীর হাতের স্পর্শে সীমান্তর হৃদস্পন্দন কমে এলো। দুনিয়ার সবকিছু যেন সে বেমালুম ভুলে গেল সে।

-“আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না তো?”

-“তুমি না ছাড়লে আমি কেন ছাড়বো? তুমি শুধু হাতটা ধরো, আজীবন ধরে রাখার দায়িত্বটা আমি নিলাম।”

-“চলেন বিয়ে করবো।”

-“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

শর্বরী মুচকি হাসলো। এ মুহূর্তে তার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। মায়ের ক্যাচ ক্যাচ, ফুফুর হাউকাউ কিংবা আসন্ন ঝুটঝামেলার কথা। আচ্ছা তার শাশুড়ি কি মেনে নেবে তাকে? নাহ! সে সবও এখন ভাবতে ইচ্ছে করছে না শর্বরীর। আপাতত এ মুহূর্তটা ধরে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে করছে তার।

চলবে…